সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/মানুষের কথা

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২২২-২২৪)
মানুষের কথা

 জগতে কাহারও স্থির থাকিবার হুকুম নাই। জ্যোতির্বিদ বলেন, “চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবী সমস্তই চলিতেছে।” জড় বিজ্ঞানের পণ্ডিত বলেন, “প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে তাহার অতি সূক্ষ্ম অণুপরমাণু পর্যন্ত ছুটাছুটি করিতেছে।” ভূতত্ত্ববিদ বলেন, “এই পৃথিবীকে আজ যেমন দেখিতেছি, চিরদিন সে এমন ছিল না এবং পরেও এমন থাকিবে না—তাহার চেহারা পর্যন্ত যুগের পর যুগ বদলাইয়া চলিয়াছে।” সুতরাং মানুষ যে চিরকাল মানুষ ছিল না, সে যে ক্রমে এইরকম ভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, ইহা কিছুই আশ্চর্য কথা নয়। কোন আদিম কালের কোন জন্তু কেমন করিয়া ক্রমে মানুষের মতো হইয়া উঠিল, তাহার সমস্ত ইতিহাস জানিবার কোনো উপায় নাই। যতটুকু জানা যায় তাহাতে মানুষের সঙ্গে বানরের, বিশেষত বনমানুষের জ্ঞাতি সম্পর্কটাই স্পষ্ট হইয়া ওঠে।

 চোখে দেখিতে মানুষ ও বানরের চেহারার মধ্যে যেমন মিল দেখিতে পাই, তেমনি কতগুলা তফাতও বুঝতে পারি, যাহার দরুন বানরকে বানর বলিয়া বোঝা যায়। একটা মানুষের আর একটা গরিলার কংকাল পাশাপাশি লইয়া দেখিবে দুজনের শরীরের গড়ন মোটামুটি একইরকমের। একইরকম ভাবে হাড়ের পরে হাড় সাজাইয়া কাঠামো দুটিকে দাঁড় করানো হইয়াছে। বাঘ সিংহ বা গোরু ঘোড়ার কংকাল যদি ইহার পাশে বসাও তবে কখনই এতটা মিল দেখিতে পাইবে না। কিন্তু এতটা মিল থাকিলেও দুয়ের মধ্যে তফাতটাও বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়। গরিলার হাত প্রকাণ্ড লম্বা এবং মজবুত, কারণ তাহাকে গাছে গাছে ফিরিতে হয়, চলিতে-ফিরিতে তাহাকে হাতের ব্যবহার করিতে হয়। গরিলার পায়ের পাতা ঠিক হাতেরই মতো অর্থাৎ বলিতে গেলে তাহার চারিটাই হাত। তাহার শরীরে যে অসাধারণ শক্তি, তাহার পাঁজরের হাড়গুলী দেখিলেই সেটা বেশ বোঝা যায়। তার পর মাথার খুলিটা-গরিলার দাঁত এবং চোয়াল খুবই মজবুত কিন্তু আসল মাথাটুকু অর্থাৎ মগজের জায়গাটুকু মানুষের তুলনায় খুব ছোটো। মানুষকে বুদ্ধি খাটাইয়া বাঁচিতে হয়, তাই তাহার মগজ বাড়িয়া মাথাটাকে বড়ো করিয়া তুলিয়াছে। আরো কতগুলা সূক্ষ তফাত আছে পণ্ডিতেরা যাহাকে গুরুতর বলিয়া মনে করেন, যেমন হাঁটুর হাড়। মানুষ যে পায়ের পাতার উপর খাড়া হইয়া চলে এবং গরিলা যে সামনের হাত দুটিতে ভর রাখিয়া কুজা হইয়া চলে, হাঁটুর হাড় দেখিয়াই পণ্ডিতেরা তাহা বলিয়া দিতে পারেন।

 মানুষ কতদিন হইল এ পৃথিবীতে আসিয়াছে অর্থাৎ কতদিন হইল সে ‘মানুষ’ হইয়াছে, তাহা পণ্ডিতেরা এখনো ঠিক করিতে পারেন নাই। সকলের চাইতে পুরাতন মানুষের চিহ্ন যাহা পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের চোয়ালের হাড় আর মুখের ভিতরকার গড়ন দেখিয়া মনে হয় তাহারা কথা বলিতে জানিত না। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে ডাক্তার ডুবয় যবদ্বীপে প্রাচীন জন্তুর কংকাল খুঁজিতে গিয়া একটা মানুষের কয়েক টুকরা কংকাল খুঁড়িয়া তোলেন। সেটা মানুষের কংকাল কি বানরের কংকাল, সে বিষয়ে প্রথমে একটু সন্দেহ ছিল-কারণ তহির মগজকোষটি বানরের চাইতে অনেকটা বড়ো হইলেও আজকালকার সভ্য মানুষের তুলনায় খুবই ছোটো এবং কপালটাও বানরের মতো চ্যাপটা। তাহার দুইটা দাঁত পাওয়া গিয়াছিল, সে দুইটা দেখিলে গরিলার দাঁতের কথাই মনে হয়। কিন্তু তাহার উরুর হাড় দেখিয়া স্পষ্ট বোঝা গেল যে সে মানুষের মতো খাড়া হইয়া চলিত। এই প্রাচীন মানুষটির অর্থাৎ জন্তুটির নাম দেওয়া হইয়াছে বানর-মানুষ। ইহার চাইতে প্রাচীন কোনো মানুষের কংকাল আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই।

 ইউরোপে সেকালের মানুষের যে-সকল চিহ্ন পাওয়া যায়, এই বানর-মানুষের তুলনায় তাহাদের খুব প্রাচীন বলা চলে না। কিন্তু তাহারাও এক-একজন প্রায় পাঁচলক্ষ বৎসর আগেকার মানুষ। ধনুকের মতো বাঁকা ছোটো-ছোটো পা, বানরের মতো উঁচু-উঁচু ভ্রূ, একটু-আধটু কথা বলিতে পারে সেই-সব মানুষ এখন পৃথিবী হইতে লোপ পাইয়াছে। এই-সব মানুষের চেহারা কেমন ছিল তাহা এই-সকল কংকাল হইতেই কতকটা বোঝা যায়।

 মানুষ যখন সভ্য হয় নাই, যখন সে অস্ত্র গড়িতে বা আগুন জ্বালাইতে শিখে নাই, তাহারও অনেক আগে সে এমন একটি বিদ্যা শিখিয়াছিল যাহা মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পশুর জানা নাই। সেই বিদ্যাটি খাড়া হইয়া চলিবার বিদ্যা। কেবলমাত্র পায়ের সাহায্যেই যখন সে চলিতে শিখিল তখন হইতে তাহার হাত দুইটা ছাড়া পাইল। সেই সময় হইতে সে হাত দুটাকে যে কতরকম কাজে লাগাইয়াছে এবং কত কৌশল শিখিয়াছে, তাহার আর অন্ত নাই।

 সেই-সব মানুষেরা যে-সকল চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে পরিষ্কার দেখা যায় যে, হাতের ওস্তাদি কেমন করিয়া যুগের পর যুগ বাড়িয়া চলিয়াছে। প্রথম যে মানুষ অস্ত্রের ব্যবহার করিতে শিখে, তাহার অস্ত্র ছিল গাছপাথর জানোয়ারের শিং ও হাড়। এই অতি প্রাচীন মানুষটি যদি অস্ত্রশস্ত্রের আরো উন্নতি করিতে পারিত, তবে হয়তো সে আরো কিছুকাল টিকিয়া থাকিত। কিন্তু পাথরের অস্ত্রওয়ালা মানুষের সঙ্গে সে পাল্লা দিয়া পারে নাই। প্রাচীনকালের নানারকম পাথরের অস্ত্র পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই পাওয়া গিয়াছে। সবচাইতে পুরানো যেগুলি সেগুলিকে হঠাৎ দেখিয়া অন্ত্র বলিয়া বুঝা যায় না, কারণ সে সময়ে এক-এক টুকরা পাথরকে ঠুকিয়া ঠুকিয়া নিতান্তই মোটা রকমের উবড়োখবড়ো অস্ত্র গড়া হইত। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া এইরকম অস্ত্রের সাহায্যে তাহারা পৃথিবীতে শিকার করিয়া ফিরিয়াছিল। যে-সকল পর্বতে গুহায় তাহারা বাস করিত সেই গুহার মধ্যে পাথরে আঁচড় কাটিয়া তাহারা যে-সকল ছবি আঁকিত, তাহারও চিহ পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে। সেই ছবিগুলি দেখিলে তোমরা হয়তো হাসিবে-কারণ আজকালকার পাঁচ-সাত বৎসরের শিশুও অমন ছবি আঁকিতে পারে। কিন্তু পণ্ডিতেরা এই-সমস্ত ছবি দেখিয়া সেই গুহাবাসী মানুষদের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য খবর জানিতে পারিয়াছেন। এই মানুষদের গায়ে লম্বা লম্বা লোম হইত, তাহাদের চেহারা ছিল কতকটা এস্কিমোদের মতো, তাহারা চাষবাস জানিত না, বেদে জাতির মতো নানা স্থানে ঘুরিত আর দল বাঁধিয়া শিকার করিত। সম্ভবত ইহাদের অনেকেই কাঁচা মাংস খাইত এবং কেহ কেহ হয়তো মানুষ খাইতেও কোনো আপত্তি বোধ করিত না। ইহার পর আরো বুদ্ধিমান একরকম মানুষ দেখা দিল, যাহারা পাথর-কাটা বিদ্যায় রীতিমতো কারিকর হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাদের অস্ত্রগুলি খুব সমান ও ধারালো এবং রীতিমতো শান দিয়া পালিশ করা। তার উপর ইহারা মাটির বাসন গড়িতে, চাষবাস করিতে, কাপড় বুনিতে ও গোরু ছাগল প্রভৃতি জন্তু পুষিতেও শিখিয়াছিল। ইহারা যেখানে যাইত সেইখানেই সেই প্রাচীন যুগের আনাড়ি মানুষকে তাড়াইয়া মারিয়া শেষ করিত। বলিতে গেলে, পাথরের যুগের এই নূতন মানুষটি হইতেই সভ্যতার ইতিহাস আরম্ভ হইয়াছে।

সন্দেশ-আশ্বিন, ১৩২৫