সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/মেঘবৃষ্টি

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২২৪-২২৬)
মেঘবৃষ্টি

 বর্ষাকালে রাস্তায় বাহির হইবার আগে আমরা আকাশের পানে তাকাইয়া দেখি। তাহার ভাবগতিক কিরূপ - মেঘ আছে কিনা, বৃষ্টির সম্ভাবনা অথবা ঝড় দেখা যায় কিনা। কিন্তু মেঘ কিরূপে জন্মায়, আকাশে কিভাবে থাকে, মেঘের আকার-প্রকার এবং চালচলন কিরূপ সে কথা ভাবিবার অবসর তখন আমাদের থাকে না।

 মেঘের জন্মের কথা বোধ হয় তোমরা সকলেই জান। পৃথিবীর খাল, বিল, পুকুর নদী, সমুদ্রের জল গরমে বাষ্প হইয়া আকাশে মিশিয়া যায়। সেই বাষ্প জমিয়া খুব ছোটো-ছোটো জলকণার সৃষ্টি হয়। এই-সকল জলকণার স্তুপকেই আমরা বলি মেঘ। মনে হইতে পারে যে জলকণা তো বাতাসের চেয়ে ভারী। তাহা হইলে মেঘ কেমন করিয়া শূন্যে থাকে? বাস্তবিক মেঘ সর্বদাই নীচে নামিতে চেষ্টা করে। কখনো বাতসের ঠেলায় উপরে উঠিতেও পারে, কিন্তু নীচে নামাই তাহার স্বভাব। যে মেঘের জলকণার আকার যত বড়ো সে মেঘ তত তাড়াতাড়ি নীচে নামে। জলকণাগুলি আকারে বেশি বড়ো হইয়া গেলে বৃষ্টি আকারে মাটিতে পড়ে। খুব উঁচুতে যে মেঘ থাকে, তাহাতে অনেক সময়ে জলকণাগুলি জমিয়া বরফের কণা হইয়া থাকে। এই মেঘ আবার নীচে গরম বাতাসের মধ্যে নামিলে সেই বরফ গলিয়া জলকণা হইয়া যায়। ঠাণ্ডা দেশে এই বরফকণাই তুষার বৃষ্টি হইয়া মাটিতে পড়ে।

 অনেক সময় উপরের মেঘ বৃষ্টি হইয়া মাটিতে পৌঁছাইবার আগেই বাষ্প হইয়া মিলিয়া যায়। কাজেই মেঘ আসিলেই যে বৃষ্টি পড়িবে, এ কথা বলা যায় না। শীতের দেশে মাঝে মাঝে একটা বড়ো মজার জিনিস দেখা যায়। মেঘের জলকণা খুব ঠাণ্ডা হইয়া নীচে নামিতে নামিতে হঠাৎ কোনো গাছপালা অথবা অন্য কোনো জিনিসের গায়ে বরফ হইয়া জমিয়া যায়।

 মেঘবৃষ্টি ও ঝড় বাতাসের খবর রাখিবার জন্য সকল সভ্য দেশেই বড়ো-বড়ো সরকারি অফিস আছে। ইংরাজিতে তাহাকে বলে মিটিয়রলজিক্যাল (Meteorological) অফিস। এই-সমস্ত অফিসের কাজ কেবল মেঘ বাতাস ইত্যাদির নানারকম মাপ জোখের হিসাব লওয়া। সে কিরকম হিসাব? কোনখানে কত গরম তাহার হিসাব, কোনখানের বাতাস কতখানি ভিজা বা শুকনা তাহার হিসাব। কোনখানে বাতাসের চাপ কিরূপ, বাতাস কতটা হাল্কা বা কতটা ভারী, তাহার হিসাব; বাতাস কতখানি জোরে কোনদিকে চলিতেছে, কোনখানে কতখানি বৃষ্টি পড়িল, কিরকম মেঘ দেখা দিল, তাহার হিসাব।

 বাতাস যখন চলে তখন তাহাকে বলে ‘হাওয়া', হাওয়া যখন ছোটে তখন তাহার নাম ‘ঝড়'। বাতাস আবার চলাফিরা করে কেন? গরম লাগিলে বা জলের বাম্প মিশিলে বাতাস ছড়াইয়া হালকা হইয়া উপর দিকে ভাসিয়া উঠে। তখন তাহার চাপ কমিয়া খানিকটা জায়গা যেন ফাঁকা হইয়া উঠিতে চায়। কিন্তু ফাঁকা হইবার জো নাই, চারিদিকের চাপে আশপাশ হইতে বাতাস ছুটিয়া সেই হালকা জায়গাটাকে দখল করিতে চায়, তাহাতেই বাতাসের চলাচল হয়। বাতাস যখন যেদিকে চলে, সে এখন মেঘগুলিকে সুদ্ধ সেদিকে টানিয়া লইতে থাকে। এইরকম টানাটানির মধ্যে পড়িয়া এক-একটা মেঘের এক একরকম চেহারা হইয়া ওঠে। যাঁহারা এ-বিষয়ে আলোচনা করিয়া থাকেন তাঁহারা মেঘের চেহারা দেখিয়া তাহার সম্বন্ধে অনেক কথা বলিতে পারেন। খুব উঁচুতে পাঁচ-ছয় মাইল উপরে যে মেঘ থাকে তাহার চেহারা অতি হালকা সূক্ষ চামরের মতো। সে মেঘে বৃষ্টি হয় না, সে মেঘ নীচে নামিতে গেলেই গরম বাতাসে শুকাইয়া মিলাইয়া যায়।

 তার পর দু মাইল চার মাইল উঁচুতে ছিটানো তুলার মতো বা চষাক্ষেতের মতো যে-সব সাদা সাদা মেঘ দেখা যায়, তাহাতেও হঠাৎ বৃষ্টি পড়িবার কোনো আশঙ্কা নাই। এইসমস্ত মেঘ যখন সূর্যাস্তের সময়ে লম্বা লম্বা স্তর বাঁধিয়া আকাশের গায়ে শুইয়া থাকে তখন তাহার উপর সূর্যের আলো পড়িয়া কি আশ্চর্য সুন্দর রঙের খেলা দেখা যায়, তাহা সকলেই দেখিয়াছ। বিদ্যুতের যে মেঘ তাহার চেহারাটা খুব গম্ভীর ও জমকাল হয়, সে যেন রাগে ফুলিয়া পাহাড়ের মতো উঁচু হইয়া উঠিতে থাকে কিন্তু বৃষ্টি নামিতে আরম্ভ করিলেই সে দেখিতে দেখিতে শান্ত হইয়া যায়। তখন সে বৃষ্টি মেঘ হইয়া ধোঁয়ার প্রলেপের মতো আকাশের গায়ে লেপিয়া যায়।

 বিদ্যুৎ যখন চমকায় তখনই মনে হয় 'এইবার বাজ পড়ার শব্দ শুনিব'-এবং অনেক সময়ই সে শব্দ শোনা যায়। বিদ্যুৎ চমকাইলে বাতাসটা কিরকম তোলপাড় হইয়া উঠে ঐ আওয়াজটা হইতেই তাহা বুঝিতে পার। বিদ্যুতের ঝলক ছুঠিবামাত্র চারিদিকে গরম বাতাস ঠিকরাইয়া পড়ে, আবার সেই চোট সামলাইতে গিয়া চারিদিকের বাতাস ছুটিয়া কড়কড় শব্দে টক্কর বাধাইয়া বসে। তাহার পরেও খানিকক্ষণ পর্যন্ত বার বার বহু দূরের মেঘ হইতে গুড়্ গুড়্ করিয়া সেই শব্দের প্রতিধ্বনি আসিতে থাকে।

 মিটিয়রলজিক্যাল অফিস থাকাতে বৃষ্টি-বাদল সম্বন্ধে নানারকম খবর আমরা আগে হইতে জানিতে পারি। 'ঝড় আসিতেছে' এই খবর সময়মতো জানিতে পারিলে মানুষে সাবধান হইয়া তাহার জন্য প্রস্তুত থাকিতে পারে। মনে কর, খবর আসিল-এখনি হইতে দুইশত মাইল দূরে একটা বড়ো ঝড় খুব বৃষ্টি লইয়া ঘটায় পঞ্চাশ মাইল বেগে এইদিকে আসিতেছে। সে যদি বরাবর ঐভাবে এই মুখেই আসে এবং আসিতে আসিতে তাহার বৃষ্টি যদি ফুরাইয়া না যায়, অথবা যদি মাঝে কোথাও গরম শুকনা বাতাসে তাহার মেঘ শুকাইয়া না ফেলে, তবে চার ঘণ্টা পরে এখানে বৃষ্টি হইবে।

 মিটিয়রলজিক্যাল অফিসে বড়ো-বড়ো মানচিত্রে সর্বদাই চারিদিকের খবর আঁকিয়া রাখা হয়। বাতাসের চাপ, বাতাসের গতি, বাতাসের বেগ, বাতাসের উত্তাপ, বাতাসের ভিজা ভাব ও মেঘবৃষ্টি, সব খবর সেই মানচিত্রের গায়ে স্পষ্ট রেখা টানিয়া দেখানো হয় এবং বাতাসের ভাবগতিক যেমন ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলাইতে যাকে, মানচিত্রের উপরেও সেই-সমস্ত পরিবর্তনের হিসাব ক্রমাগত বদলাইয়া দেখানো হয়।

সন্দেশ-আশ্বিন, ১৩২৫