সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/লোহা

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৪৯-২৫১)
লোহা

 যে-সমস্ত জিনিস মানুষে সর্বদা ব্যবহার করে, আজ যদি হঠাৎ তাহার কোনোটির অভাব পড়িয়া যায়, তাহা হইলে ঠিক বোঝা যায়, কোন জিনিসটার যথার্থ মূল্য কতখানি। সোনা রূপা মণি মুক্তা সব যদি হঠাৎ একদিন পৃথিবী হইতে লোপ পায়, তবে অনেক শৌখিন লোকে হা-হুতাশ করিবে-মানুষের টাকা-পয়সার কারবারের বিষম গোলোযোগ উপস্থিত হইবে, রূপার অভাবে ফটোগ্রাফের ব্যবসা প্রায় বন্ধ হইয়া আসিবে এবং ছোটোখাটো অনেকরকমের অসুবিধার সৃষ্টি হইবে। কিন্তু তবু মানুষের জীবনযাত্রার কোনো ব্যাঘাত হইবে না। বড়ো-বড়ো ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা যেমন চলিতেছি, অনেকটা সেইরকমই চলিতে থাকিবে। কিন্তু তেমনিভাবে যদি লোহার দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়, তবে অবস্থাটা আরো মারাত্মক হইবে। মানুষের কলকারখানা রেলপুল জাহাজ প্রভৃতি, সভ্যদেশে যাহা কিছু না হইলে চলে না, তাহার সমস্তই বন্ধ হইয়া আসিবে। মানুষের যে-কোনো অস্ত্র বা যে-কোনো যন্ত্র বল- বড়ো-বড়ো কামান, এঞ্জিন বা মোটর হইতে লাঙল কোদাল কাঁটা পেরেক পর্যন্ত- সবটাতেই লোহার দরকার হয়। যার মধ্যে লোহা নাই এমনও অসংখ্য জিনিস তৈয়ারি করিবার সময়ে লোহার যন্ত্র ব্যবহার করিতে হয়। যে জিনিসে তাহারও দরকার হয় না, যেমন অনেক ডাক্তারি ওষুধ, সেখানেও অনেক সময়েই কয়লার চুল্লি জ্বালিতে হয় এবং সেই কয়লা ডাঙিয়া উঠাইবার জন্য খনিতে লোহার কোদাল আর অনেক কলকব্জার দরকার হয়। মানুষের সকলরকম কাজে যেসমস্ত তৈজস বা বাসনপত্রের দরকার হয়, তাহার সমস্তই খনিজ জিনিসের তৈয়ারি। সেই-সমস্ত জিনিস সংগ্রহ করিয়া তাহাকে কাজের উপযোগী করিয়া গড়িতেও লোহার দরকার হয়। ঘরের দরজা জানলা, কড়ি বরগা, আসবাবপত্র, এ-সমস্ত কাঠের তৈয়ারি হইতে পারে, কিন্তু সেই কাঠকে কাটিয়া চিরিয়া চাঁচিয়া ঘষিয়া দরকারমতো গড়িয়া লইবার জন্য পদে পদেই লোহার কুড়াল করাত র‌্যাঁদা বাটালি প্রভৃতি যন্ত্রের দরকার হয়।

 পৃথিবীতে এমন দেশ নাই যেখানে লোহ পাওয়া যায় না। পথে ঘাটে, মাটিতে জলেতে, খুঁজিতে গেলে সর্বত্রই লোহা পাওয়া যায়। অথচ এক সময়ে লোকে লোহার ব্যবহার জানিত না, লোহা তৈয়ারি করিতে পারিত না। জল লাগিয়ে লোহায় মরিচা ধরিয়া যায়। লোহাধাতু আর লোহার মরিচা, দুটা এক জিনিস নয়। কিন্তু মরিচা বা 'লৌহমল’ নানারকমে ‘শোধন’ করিয়া তাহা হইতে আবার খাটি লোহা বাহির করা যায়। যে-মস্ত খনিজ জিনিস হইতে লোহা তৈয়ারি করা হয়, সেগুলিও এইরকম মরিচা-জাতীয় জিনিস, অনেক হাঙ্গামা করিয়া তাহাদের শোধন না করিলে তাহা হইতে লোহা বাহির হয় না। সোনা রূপা ও তামা অনেক সময়ে খাঁটি ধাতুর আকারেও পাওয়া যায় এবং খনিজ তাবস্থায় তাহাদের শোধনও লোহার চাইতে অনেক সহজ। সেইজন্য তামা প্রভৃতি ধাতুর ব্যবহার শিখিবার পরেও মানুষে অনেকদিন পর্যন্ত লোহা বানাইবার কৌশল বাহির করিতে পারে নাই।

 একবার যদি কোথাও কোনো লোহা বানাইবার কারখানায় যাও, তাহা হইলে বুঝিতে পারিবে যে লোহার মতো সামান্য জিনিসের জন্যও যানুষকে কতখানি চিন্তা পরিশ্রম ও হাঙ্গামা ফরিত হয়। আমাদের দেশে সাক্‌চিতে টাটা কোম্পানির লোহার কারখানা আছে-সেখানে প্রতি বৎসর হাজার হাজার মণ লোহা আর পাত তৈরি হয়। প্রকাণ্ড চিমনির মতো বড়ো-বড়ো পাথরের চুল্লি, তাহার মধ্যে সারাদিন সারারাত আগুনের আর বিশ্রাম নাই। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, রাবণের চিতার মতো সে আগুন জলিতে থাকে। একবার আগুন নিভিয়া গেলেই হাজার হাজার টাকার চুল্লি ফাটিয়া চৌচির হইয়া যাইবে। তাই দিনরাত সেখানে কাজ চলিতেছে, চিমনির মুখ দিয়া আগুনের লাল জিভ সারক্ষণ আকাশকে রাঙাইয়া তুলিতেছে। মাঝে মাঝে চুল্লির ঢাকনি খুলিয়া, গাড়ি-বোঝাই কয়লা-মিশানো লৌহখনিজের মসলা চুল্লির মধ্যে ঢালিয়া দেয়-একেবারে বিশত্রিশ বা একশো-দুশো মণ। চুল্লির মধ্যে সেই-সমস্ত মসলা গলিয়া পুড়িয়া তরল লোহা হইয়া জমিতে থাকে। মাঝে মাঝে চুল্লির নর্দমা দিয়া লোহার ময়লা ‘গাদ' বাহির করিয়া দিতে হয়। দরকার মতো শোধন হইলে পর পাশের একটা নল খুনিয়া তরল লোহা ঢালিয়া ফেলিতে হয়।

 পৃথিবীতে যত লোহার কারখানা আছে, তাহাতে প্রতি বৎসর তিনশো কোটি মণ লোহা তৈয়ার হয়। এবং বছর বছর ইহার পরিমাণ বাড়িয়াই চলিয়াছে। লোহা নানারকমের হয়। যে লোহা ঢালাই করিয়া সাধারণত কডি বরগা শিক প্রভৃতি তৈয়ারি হয় আর যে ইস্পাত লোহা ক্ষুর বা তলোয়ারের জন্য ব্যবহার হয়, এ দুয়ের মধ্যে অনেকখানি তফাত। সাধারণ চুল্লির মধ্যে যে লোহা তৈয়ারি হয়, তারা একেবারে খাঁটি লোহা নয়; আমরা যতরকম লোহা সর্বদা ব্যবহার করি, তাহার কোনোটাকেই ঠিক খাঁটি লোহা বলা যায় না। এই-সব লোহার সঙ্গে অল্প বা বেশি পরিমাণে অঙ্গার বা কয়লা, গন্ধক ফস্‌ফরাস প্রভৃতি নানারকম জিনিসের মিশাল থাকে এবং সেই মিশালের জন্য লোহার রূপ গুণ নানারকম হইয়া যায়। কোনোটা নরম, কোনোটা শক্ত, কোনোটা সহজে ঢালাই হয়, কোনোটা বেশ দলিয়া পিটিয়া নানারকম করা যায়, কোনোটা স্প্রিং-এর মতো বাঁকানো যায়, কোনোটা বাঁকাইতে গেলে ভাঙিয়া যায়, কোনোটাকে নানারকমে তাতাইয়া এবং নানা কৌশলে ঠাণ্ডা করিয়া ইচ্ছামতো মজবুত করা যায়, কোনোটাকে চমৎকার শান দেওয়া বা পারিশ করা যায়।

 এক-একরকম কাজের জন্য এক-একরকম লোহা। আজকাল ভালো ইস্পাত ও উঁচুদরের লোহা করিতে হইলে আগে খাঁটি কাঁচা লোহা তৈয়ারি করা হয়। তার পর তাহার সঙ্গে ঠিক দরকারমতো অন্য কোনো ধাতু বা কয়লা প্রভৃতি মিশাইয়া আবার সমস্তটা গলাইয়া একসঙ্গে জ্বাল দিয়া লইতে হয়। প্রথম কাজটির জন্য বিশেষরকম চুল্লির দরকার হয় -তাহার গঠন এবং ভিতরকার বন্দোবস্ত সাধারণ চুল্লির মতো নয়। একটা প্রকাণ্ড পিপার মতো জিনিস—তাহার মধ্যে পাঁচশো বা হাজার মণ মসলা ধরে; সেই পিপার তলার দিকে আগুন জ্বালাইয়া, তাহার ভিতর দিয়া ঝড়ের মতো দম্‌কা বাতাস চালাইয়া দেওয়া হয়। বাতাসের ঝাপটায় আগুনের শিখা প্রকাণ্ড জিভ মেলিয়া পিপার মুখ হইতে ছুটিয়া বাহির হয়। লোহার মসলা আগুনের তেজে গলিয়া পুড়িয়া যতই বিশুদ্ধ হইয়া আসিতে থাকে, আগুনের রঙও সেই সঙ্গে বদলাইয়া আসিতে থাকে। প্রথমে বেগুনি, তার পর ক্রমে লাল হলদে সাদা হইয়া, শেষে যখন ঘোর নীল রঙ দেখা দেয় তখন আগুনের তেজ নিভাইয়া, প্রকাণ্ড পিপাটিকে কলে ঘুরাইয়া কাত করিয়া তাহার তিতর হইতে তরল কাঁচা লোহা ঢালিয়া ফেলা হয়। তার পর ওজনমতো নানা জিনিসের মিশাল দিয়া সেই লোহাকে নানা কাজের উপযুক্ত করিতে হয়।

 এখানেও কি হাঙ্গামার শেষ আছে? সেই লোহাকে আরো কতবার অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়া, কত দুরমুশ কলে সাংঘাতিকভাবে দলিয়া পিষিয়া, কতরকমের উৎপাত সহাইয়া তবে তাহাকে ভারি ভারি কঠিন কঠিন কাজে লাগানো চলে।

সন্দেশ-শ্রাবণ, ১৩২৬