সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/শিকারী গাছ

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৪৮-১৫০)
শিকারী গাছ

 উপযুক্ত রকম জল মাটি বাতাস আর সূর্যের আলো পাইলেই গাছেরা বেশ খুশি থাকে, আর তাহাতেই তাহাদের রীতিমতো শরীর পুষ্টি হয় আমরা তো বরাবর এইরকমই দেখি এবং শুনি। তাহারা যে আবার পোকা-মাকড় খাইতে চায়, শিকার ধরিবার জন্য নানারকম অদ্ভুত যদি ঘটাইয়া রাখে এবং বাগে পাইলে পাখিটা ইদুরটা পর্যন্ত হজম করিয়া ফেলে, এ কথাটা চট করিয়া বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া দেখা গিয়াছে যে পৃথিবীর নানাজায়গায় নানা জাতীয় গাছ এই শিকারী-বিদ্যা শিখিয়াছে। তাহারা যে শখ করিয়া পোকা খাওয়া অভ্যাস করিয়াছে তাহা নয়, ঠেলায় পড়িয়াই ঐরূপ করিতে বাধ্য হইয়াছে! অনেক শিকারী গাছের বাস এমন স্যাৎসেতে জায়গায় এবং সেই-সকল জায়গা গাছের পক্ষে এত অস্বাস্থ্যকর যে সেখানে তাহারা তাহাদের শরীর রক্ষার উপযোগী মাল-মসলা ভালো করিয়া জোগাড় করিতে পারে না। এরূপ অবস্থায়, দু-একটা পোকা মাছি বা ফড়িং যদি তাহারা খাইতে না পারিত তবে তাহদের বাঁচিয়া থাকাই মুস্কিল হইত।

 আগেই বলিয়াছি, শিকারী গাছ নানারকমের আছে। ইহাদের শিকার ধরিবার জায়গাও নানারকম। কোনো কোনো গাছের পাতায় মাছি বা পোকা বসিলে পাতাগুলি আস্তে আস্তে গুটাইয়া যায়। মাছি বেচারা কিছুই জানে না, নিশ্চিন্ত মনে পাতার রস খাইতেছিল, হঠাৎ দেখে চারিদিকে ঘেরা, তাহার মধ্যে সে বন্দী| পাতার গায়ে লোমের মতো সরু সরু কাটা, তাহারই মুখে আঠার মতো রস লাগানো থাকে, সেই রসে আটকাইয়া শিকারের পলাইবার আরো অসুবিধা হয়। শুধু তাহাই নহে, পাতা গুটাইয়া গেলে পরে সেই-সকল কাঁটার মুখ হইতে একরকম তীব্র হজমি রস বাহির হইতে থাকে, তখন পোকাটা যতই ছট্‌ফট্‌ করে, ততই আরো বেশি করিয়া রস বাহির হয়। তাহাতেই শিকার মরিয়া শেষে হজম হইয়া যায়। তার পর আপনা হইতেই আবার পাতা খুলিয়া যায়। জলের মধ্যে একরকম গাছ থাকে, তাহার সাদা ফুল, জলের ধারে একটা খুব রঙচঙে গাছ হয়, তাহার পাতাগুলির চেহারা কতকটা কদম ফুল গোছের। আর একরকমের গাছ আছে তাহাতে ঠিক যেন মোচার খোলের মতো পাতা সাজানো। এই সবগুলিই একপ্রকারের শিকারী গাছ এবং ইহাদের শিকার ধরিবার কায়দাও প্রায় একরকম। মনে কর, একটা মস্ত পোকা ঐ কদম ফুলের মতো গাছটিতে উঠিয়াছে আর একটু পরেই গাছের পাতাগুলি ওটাইয়া মাঝখানে আসিয়া মিলিবে—একটি ফুটন্ত ফুল মুড়িয়া আবার কুঁড়ি হইয়া গেলে যেমন হয়, সেইরাপ। তখন পোকা বেচারার আর পলাইবার পথ থাকিবে না।

 আর-এক রকমের অদ্ভূত গাছ আছে, এক-একটা পাতার আগায় গোলাপি রঙের কী একটা জিনিস, তাহার চারদিকে কাঁটা। এই জিনিসগুলি Fly-trap (মাছি-মারা ফাঁদ)। এক-একটা ফাঁদ যেন মাঝখানে কব্জা দিয়া আটকানো, বইয়ের মতো খোলে আবার বন্ধ হয়। কোনো পোকা হয়তো পাতায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কোনো বিপদের চিহ্নও নাই; ঘুরিতে ঘুরিতে সে ঐ ফাঁদের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত। হয়তো দূরে থাকিয়া তাহার ঐ রঙটা খুব পছন্দ হইয়াছিল—তাই সে দেখিতে আসিল ব্যাপারখানা কি। কিন্তু সে তো জানে না যে ফাঁদের গায়ে সরু সূতার মতো কি লাগানো রহিয়াছে, তাহাতে ছুইলেই ফাঁদ বন্ধ হইয়া যায়। সে যেমন একটি সূতায় পা অথবা ডানা লাগাইয়াছে অমনি—খট্‌! ফাঁদ ছুটিয়া একেবারে বেমালুম বন্ধ হইয়া গেল। এখানে আর আঠার দরকার নাই, কারণ ফাঁদটি রীতিমতো মজবুত এবং খুব চট্‌পট্‌ কাজ সারে। আর-এক রকম শিকারী গাছ আছে, তাহাদের শিকার ধরিবার জন্য থলি বা চোঙা থাকে। এই থলি বা চোঙার মধ্যে পোকা বেশ সহজেই ঢুকিতে পারে কিন্তু বাহির হওয়া তত সহজ নয়। ইহাদের ভিতর সরু সরু কাঁটা থাকে—সেগুলির মুখ সব নীচের দিকে, আর তার গায়ে মোমের মতো একরকম কি মাখানো থাকে, তাহাতে পোকাগুলি বেশ সহজেই সুড় সুড়, করিয়া পিছলাইয়া নামিতে পারে। কিন্তু উপরে উঠিবার সময় তো আর পিছলাইয়া উঠা যায় না—তা ছাড়া কাঁটার খোচাও যথেস্ট খাইতে হয়। এই-সকল থলির তলায় প্রায়ই জল জমিয়া থাকে, পোকা যখন বারবার পলাইবার চেষ্টা করিয়া হয়রান হইয়া পড়ে, তখন সে ঐ জলের মধ্যে পড়িয়া মারা যায়। এই-সকল গাছে পোকাকে ফাঁকি দিবার এতরকম উপায় থাকে যে ভাবিলে অবাক হইতে হয়। কোনোটার মুখে ঢাকনি থাকে, সে ঢাকনির উপর হইতে চাপ দিলে খুলিয়া যায়। কিন্তু ভিতর হইতে ঠেলিলে খোলে না। প্রায় সবগুলিরই মুখের কাছে খুব সুন্দর রঙিন কাজ আর তার চারিদিকে মধু। সেই মধু খাইতে খাইতে পোকা ভিতরের দিকে ঢুকিতে থাকে—যত খায় তত মিষ্টি। শেষে এক জায়গায় গিয়া দেখে তাহার পরে আর মধু নাই-তখন সে ফিরিতে চায়,! কিন্তু ফিরিতে আর পারে না। কোনো কোনো থলির ভিতরে খানিকটা জায়গা স্বচ্ছ মতন—! ঠিক যেন শার্শী। পোকাগুলি মনে করে এই পলাইবার পথ—আর ক্রমাগত সেই শার্শীর গায়ে উড়িয়া উড়িয়া হয়রান হইয়া পড়ে। কখনো কখনো এমনও হয় কোনো ছোটো পাখি বা ইঁদুর হয়তো জল খাইতে আসিয়া ফাঁদের মধ্যে পড়িয়া যায় এবং আর বাহির হইতে না পারিয়া প্রাণ হারায়!

সন্দেশ —চৈত্র, ১৩২০