সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/সূর্যের কথা

উইকিসংকলন থেকে
সূর্যের কথা

 সূর্যটা একটা গোল আগুনের পিণ্ড, এ কথা অমিরা সকলেই জানি। গোল, সেটা চোখেই দেখতে পারি—আর ‘আগুন’ কি না তা একটিবার দুপুর রোদে দাঁড়ালেই আর বুঝতে দেরি লাগে না। পণ্ডিতেরা বলেন, এই পৃথিবীটার মতো তেরো লক্ষ পিণ্ডের তাল পাকালে তবে ঐ সূর্যটার সমান বড়ো হয়। তাঁরা কেমন করে জানলেন? যাঁরা জরিপ করেন তাঁরা জানেন, খুব দূরের জিনিসকে নানারকমে পরখ করে এমন হিসাব পাওয়া যায় যা থেকে চট করে বলা যায় যে জিনিসটা কতখানি দূরে। এই কৌশলটি পণ্ডিতেরা সূর্যের উপর খাটিয়েছেন। পৃথিবীর দুই জায়গায় দুইজন লোক বসে সূর্যটাকে খুব সুক্ষভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন, কোন সময়ে সেটাকে আকাশের ঠিক কোন জায়গায় দেখা যায় এবং দুজনের হিসাব মিলিয়ে অঙ্ক কষে বলেছেন যে সুর্যটা এখান থেকে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে। সে যে কতদূর তা আমাদের কল্পনাতেই আসে না। একটা এঞ্জিন যদি ঘণ্টায় ষাট মাইল করে ক্রমাগত ছুটে আজ সূর্যের দিকে রওয়ানা হয়, সে একশো সাতাত্তর বছর পরে (২০৯৩ খ্রীষ্টাব্দে) সূর্যে গিয়ে পৌঁছাবে। পণ্ডিতেরা এই-সকল মাপ নিয়ে বলছেন যে ঐ সুর্যের পাশে পৃথিবীটাকে বসালে সেটা দেখাবে যেন একটি তরমুজের পাশে একটি মুসুরির ডাল।

 সুর্যটা কিসের তৈরি? সূর্যের আলোক পরীক্ষা করে পণ্ডিতেরা বলেন যে, পৃথিবীটা যা দিয়ে তৈরি সূর্যটাও ঠিক তাই দিয়েই তৈরি। তবে, সেই-সব মালমসলা জমে এখানে যেমন জল মাটি পাথর হয়েছে সেখানে তা হবার জো নেই—কারণ, সেখানকার সর্বনেশে গরমে সব জিনিস সত্য সত্যই আগুন হয়ে উঠে। লোহা শুধু গলে যায় তা নয়, ফুটন্ত জলের মতো টগবগ করে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। এই ফুটন্ত আগুন আর জ্বলন্ত বাষ্প সূর্যের চারিদিক ঘিরে লক্‌লক্ করতে থাকে। শুধু চোখে মনে হয় সূর্যটা বেশ একটি মোলায়েম গোল জিনিস, তার গায়ে কোথাও আঁচড়ের দাগটি পর্যন্ত নেই। কিন্তু আসলে তা নয়। ভালো দুরবীন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, তার সমস্ত গা ভরে আগুনের চিক্‌মিকি খেলছে—আগুনের সমুদ্রে আগুনের ঢেউ, তার মধ্যে বড়ো-বড়ো আগুনের ডেলা পাগলের মতো ডুবছে আর ভাসছে। তা ছাড়া সূর্যের গায়ে প্রায়ই ছোটো বড়ো ফোস্কা দেখা যায়-ফোস্কাগুলি তত উজ্জ্বল নয়, তাই দেখতে হঠাৎ কালো দেখায়। জলের মধ্যে যেমন বুদ্‌বুদ্ ওঠে সূর্যের গায়ে তেমনি আগুনের ফোস্কা ওঠে আর ফেটে পড়ে। একএকটি বুদ্‌বুদ্ মাঝে মাঝে এত বড়ো হয় যে, কালো কাঁচ দিয়ে দেখলে সেগুলোকে শুধু চোখেই দেখতে পার। ঐরকম এক-একটা বুদ্‌বুদের মধ্যে ইচ্ছা করলে, দু-দশটা পৃথিবীকে স্বচ্ছন্দে পুরে রাখা যায়। ঐ ফোস্কাগুলি এক-একটি আগুনের ঘূর্ণিচক্র, তার চারিদিকে দম্‌কা আগুন ঠেলে উঠছে।

 সূর্যের তেজ এত বেশি যে তার চারিদিকে যে আগুনের শিখা ঝড়ের মতো উঠছে আর পড়ছে, সেগুলি আমরা দেখতেই পাই না। সূর্যের যখন পূর্ণগ্রহণ হয়, চাঁদটা মাঝে পড়ে তার চক্‌চকে শরীরটিকে আড়াল করে ফেলে, তখন তাদের চেহারা দেখা যায় আগুনের লকলকে জিভের মতো। শিখাগুলি হাজার হাজার মাইল জুড়ে দপ্দপ্ করে জ্বলতে থাকে, কখনো আগুনের ঝাপটা দিয়ে মিনিটে ছয় হাজার মাইল ছুটে যায়, কখনো শান্ত মেঘের মতো সূর্যের গায়ে ভেসে বেড়ায়। এক-একটাকে দেখে মনে হয় যেন আগুনের ফোয়ারা উঠছে। তার মধ্যে যদি আমাদের এই পৃথিবীটিকে ছেড়ে দেও, এটি চক্ষের নিমেষে গলে বাষ্প হয়ে কোথায় যে মিলিয়ে যাবে সে আর খুঁজেই পাবে না। সূর্যের চারিদিকের এই অগ্নিমেঘের স্তরটিকে দিনের আলোতে দেখবার জন্য পণ্ডিতেরা আশ্চর্যরকম উপায় বার করেছেন, তার জন্য তাঁদের এখন আর গ্রহণের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না।

 কিন্তু সূর্যের চারিদিকে আর-একটি জিনিস আছে যেটিকে গ্রহণ ছাড়া দেখবার জো নেই—সেটিকে সূর্যের কিরীট (Corona) বলা যায়। পৃথিবীর চারিদিকে যেমন বাতাসের আবরণ, সূর্যের চারিদিকেও তেমনি বহুদূর পর্যন্ত এই কিরীটের ঢাকনি। যাঁরা সূর্যের পূর্ণগ্রহণ দেখেছেন তাঁরা বলেন, এমন আশ্চর্য অদ্ভুত দৃশ্য আর কিছু নেই। যখন গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে অসিতে থাকে, চাঁদের কালো ছায়া যখন চোখের সামনে পাহাড় সমুদ্র সব গ্রাস করে ফেলতে থাকে, আকাশের অদ্ভুত ফ্যাকাশে রঙ আর পৃথিবীর অন্ধকার দেখে, পশুপাখি পর্যন্ত ভয়ে স্তবদ্ধ হয়ে যায়, সেই সময়ে সূর্যের তেজ চাপা পড়ে তার আশ্চর্য কিরীটের শোভা দেখা যায়। শুধু এই কিরীটের সুন্দর স্নিধ আলো দেখবার জন্যই কত লোকে পয়সাকড়ি খরচ করে হাজার হাজার মাইল পার হয়ে গ্রহণ দেখতে যায়। এই কিরীটের চেহারা সব সময়ে একরকম থাকে না-কখনো সেটা চারিদিকে বেশ সমান ভাবে গোল হয়ে থাকে, কখনো তার মধ্যে ভয়ানক ঝড় ঝাপটার লক্ষণ দেখা যায়-কখনো তা থেকে লম্বালম্বা ছটা বেরিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে;। মোটের উপর বলা যায়, যে সময়ে সূর্যের গায়ে ফোস্কা বেশি দেখা যায় সেই সময়ে তার আগুনের শিখাগুলিরও অত্যাচার বাড়ে আর সেই অত্যাচারে তার কিরীটটিকেও ঘাঁটিয়ে তোলপাড় করে তোলে। আমরা জানি যে পৃথিবীটা চব্বিশ ঘটায় একবার পাক খায়, তাতেই আমাদের দিন-রাত হয়। সূর্যটাকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেও ভয়ংকর বেগে লাটুর মতো ক্রমাগত পাক খাচ্ছে—কিন্তু একটি পাক খেতে তার ছাব্বিশ দিন সময় লাগে।

 অনেকের বিশ্বাস এই যে, সূর্যটা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে—আর পৃথিবী গ্রহ চন্দ্র সবাই মিলে ঘুরতে ঘুরতে তার চারিদিক প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু আসলে তা নয়—বিশ্বজগতে কারো স্থির হয়ে বসে থাকবার হুকুম নাই। আমাদের এই পৃথিবী এবং আর-সমস্ত গ্রহকে নিয়ে সূর্য ভয়ানক বেগে শূন্যে ছুটে চলেছে। সে কোনদিকে কিরকম বেগে চলছে, তাও পণ্ডিতেরা হিসাব করে ঠিক করেছেন। এই হিসাবে সুর্য ঘণ্টায় প্রায় কুড়ি হাজার মাইল পথ ছুটে চলেছে।

 শুনলে হঠাৎ হয়তো মনে হতে পারে, এমন সাংঘাতিকভাবে চলতে গিয়ে হয়তো কোনদিন কোনো তারার সঙ্গে তার টু লেগে যাবে—কিন্তু সেরকম ভয়ের কোনো কারণ নেই। এই-সব তারাগুলি এক-একটি এত দূরে যে সূর্যটা দশ বৎসর এইভাবে ছুটলেও কোনো তারার কাছে পৌঁছবার সম্ভাবনা নেই। তোমরা হিসাব করে দেখ-এক ঘটায় যদি কুড়ি হাজার মাইল যাওয়া যায় তা হলে দশলক্ষ বৎসরে কত মাইল? ২০০০০x২৪x৩৬৫x১০০০০০০। তা হলে এক-একটি তারা কতখানি দূরে একবার ভাবতে চেষ্টা কর।

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৪