সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/দেশ-বিদেশের গল্প/আশ্চর্য ছবি

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১০৬-১০৮)

আশ্চর্য ছবি

 জাপান দেশে সেকালের এক চাষা ছিল, তার নাম কিকিৎসুম। ভারি গরিব চাষা, আর যেমন গরিব তেমনি মূর্খ। দুনিয়ার সে কোনো খবরই জানত না; জানত কেবল চাষবাসের কথা, গ্রামের লোকদের কথা, আর গ্রামের যে বুড়ো ‘বজ্ঞে’ (পুরোহিত), তার ভালো ভালো উপদেশের কথা। চাষার যে স্ত্রী, তার নাম লিলিৎসি। লিলিৎসি চমৎকার ঘরকন্না করে, বাড়ির ভিতর সব তকতকে ঝরঝরে করে গুছিয়ে রাখে, আর রান্না করে এমন সুন্দর যে চাষার মুখে তার প্রশংসা আর ধরে না। কিকিৎসুম কেবলই বলে, “এত আমার বয়স হল, এত আমি দেখলাম শুনলাম, কিন্তু রূপে গুণে এরৎ মতো আর-একটিও কোথাও দেখতে পাইনি।” লিলিৎসি সে কথা যত শোনে ততই খুশি হয়।

 একদিন হয়েছে কি, কোথাকার এক শহুরে বড় মানুষ এসেছেন সেই গ্রাম দেখতে; তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর ছোট্ট মেয়েটি, আর মেয়েটির ছিল একটি ছোট্ট আয়না। রাস্তায় চলতে চলতে আয়নাটা সেই মেয়ের হাত থেকে কখন পড়ে গেছে, কেউ তা দেখতে পায়নি। কিকিৎসুম যখন চাষ করে বাড়ি ফিরছে তখন সে দেখতে পেল, রাস্তার ধারে ঘাসের মধ্যে কি একটা চকচক করছে। সে তুলে দেখল, একটা অদ্ভুত চ্যাপ্টা চৌকোনা জিনিস! সে কিনা কখনো আয়না দেখেনি, তাই সে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, এটা আবার কিরে? নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ সেই আরসির ভিতরে নিজের ছায়ার দিকে তার নজর পড়ল। সে দেখল কে একজন অচেনা লোক তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে সে এমন চমকে উঠল, যে আর-একটু হলেই আয়নাটা তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তারপর অনেক ভেবে চিন্তে সে ঠিক করল, এটা নিশ্চয়ই আমার বাবার ছবি—দেবতারা আমার উপর খুশি হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার বাবা মারা গিয়েছেন সে অনেক দিনকার কথা, কিন্তু তবু তার মনে হল, হ্যাঁ এইরকমই তো তাঁর চেহারা ছিল। তারপর—কি আশ্চর্য! সে চেয়ে দেখল তার নিজের গলায় যেমন একটা রূপার মাদুলি, ছবির গলায়ও ঠিক তেমনি! এ মাদুলি তো তার বাবারই ছিল, তিনি তো সর্বদাই এটা গলায় দিতেন—তবে তো এটা তার বাবারই ছবি।

 তখন কিকিৎসুম করল কি, আয়নাটাকে যত্ন করে কাগজ দিয়ে মুড়ে বাড়ি নিয়ে

এল। বাড়ি এসে তার ভাবনা হল, ছবিটাকে রাখে কোথায়? তার স্ত্রীর কাছে যদি রেখে দেয়, তবে সে হয়তো পাড়ার মেয়েদের কাছে গল্প করবে, আর গ্রামসুদ্ধ সবাই এসে ছবি দেখবার জন্য ঝুঁকে পড়বে। গ্রামের মূর্খগুলো তো সে ছবির মর্যাদা বুঝবে না, তারা আসবে কেবল ‘তামাশা’ দেখবার জন্য! তা হবে না—তার বাবার ছবি নিয়ে ছেলেবুড়ো সবাই এসে নোংরা হাতে নাড়বে-চাড়বে তা কিছুতেই হতে পারবে না। এ ছবি কাউকে দেখান হবে না, লিলিৎসিকেও তার কথা বলা হবে না।

 কিকিৎসুম বাড়িতে এসে একটা বহুকালের পুরানো ফুলদানির মধ্যে আরসিটাকে লুকিয়ে রাখল। কিন্তু তার মনটা আর কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। খানিকক্ষণ পরে পরেই সে একবার করে দেখে যায় ছবিটা আছে কিনা। তার পরের দিন সে মাঠে কাজ করছে এমন সময় হঠাৎ তার মনে হল, ‘ছবিটা আছে তো?’ অমনি সে কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে দেখতে এল। দেখে সে নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে যাবে, এমন সময় লিলিৎসি সেই ঘরের এসে পড়েছে। লিলিৎসি বলল, “এ কি! তুমি দুপুরবেলায় ফিরে এলে যে? অসুখ করে নি তো?” কিকিৎসুম থতমত খেয়ে বলল, “না না, হঠাৎ তোমায় দেখতে ইচ্ছে করল তাই বাড়ি এলাম।” শুনে লিলিৎসি ভারি খুশি হয়ে গেল। তারপর আর-একদিন এইরকম লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি দেখতে এসে কিকিৎসুম আবার তার স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ল। সেদিনও সে বলল, “তোমার ঐ সুন্দর মুখখানা বার বার মনে হচ্ছিল, তাই একবার ছুটে দেখতে এলাম।” সেদিন কিন্তু লিলিৎসির মনে একটু কেমন খটকা লাগল। সে ভাবল, ‘কই, এতদিন তো কাজ করতে করতে একবারও আমায় দেখতে আসেনি, আজকাল এরকম হচ্ছে কেন?’

 তারপর আর-একদিন কিকিৎসুম এসেছে ছবি দেখতে। সেদিন লিলিৎসি টের পেয়েও দেখা দিল না—চুপি চুপি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল—কিকিৎসুম সেই ফুলদানির ভেতর থেকে কি একটা জিনিস বার করে দেখল, তারপর খুব খুশী হয়ে যত্ন করে আবার রেখে দিল। কিকিৎসুম চলে যেতেই লিলিৎসি দৌড়ে এসে ফুলদানির ভিতর থেকে কাগজে মোড়া আরসিটাকে টেনে বার করল। তারপর তার মধ্যে তাকিয়ে দেখে অতি সুন্দর এক মেয়ের ছবি!

 তখন যে তার রাগটা হল—সে রাগে গজ গজ করে বলতে লাগল, “এই জন্যে রোজ বাড়িতে আসা—আবার আমায় বলেন ‘তোমার মুখখানা দেখতে এলাম’, ‘তোমার মতো সুন্দর আর হয়ই না।’ মাগো! কি বিশ্রী মেয়েটা! হোঁৎকা মুখ, থ্যাবড়া নাক, ট্যারচা চোখ,—আবার আমার মতো করে চুল বাঁধা হয়েছে! দেখ না কিরকম হিংসুটে চেহারা! এই ছবি আবার আদর করে তুলে রেখেছেন—আর রোজ রোজ আহ্লাদ করে দেখতে আসেন।” লিলিৎসির চোখ ফেটে জল আসল, সে মাটিতে উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর চোখ মুছে আর-একবার আরসির দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়েটার কি ছিঁচকাঁদুনে চেহারা—এমন চেহারাও কেউ পছন্দ করে!” সে তখন আয়নাটাকে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখল।

 সন্ধ্যার সময় কিকিৎসুম বাড়ি এসে দেখল, লিলিৎসি মুখ ভার করে মেঝের উপর বসে রয়েছে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, “কি হয়েছে?” লিলিৎসি বলল, “থাক থাক, আদর দেখাতে হবে না—নাও তোমার সাধের ছবিখানা নাও। ওকে নিয়েই আদর কর, যত্ন কর, মাথায় করে তুলে রাখো।” তখন কিকিৎসুম গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি যে

আমার ছবিকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছ—জান ওটা আমার বাবার ছবি?” লিলিৎসি আরো রেগে বলল, “হ্যাঁ, তোমার বাবার ছবি! আমি কচি খুকি কিনা, একটা বলে দিলেই হল! তোমার বাবার কি অমনি আহ্লাদী মেয়ের মতো চেহারা ছিল? তিনি কি আমাদের মতো ক'রে খোঁপা বাঁধতেন?” কথাটা শেষ না হতেই কিকিৎসুম বলল, “তুমি না দেখেই রাগ করছ কেন? একবার ভাল করে দেখই না।” এই বলে কিকিৎসুম নিজে আবার দেখল, আরসির মধ্যে সেই মুখ।

 তখন দুজনের মধ্যে ভয়ানক ঝগড়া বেধে গেল। কিকিৎসুম বলে ওটা তার বাবার ছবি, লিলিৎসি বলে ওটা একটা হিংসুটি মেয়ের ছবি। এইরকম তর্ক চলছে, এমন সময়ে গ্রামের যে বুড়ো ‘বজ্ঞে’, সে তাদের গলার আওয়াজ শুনে দেখতে এল ব্যাপারখানা কি! পুরুতঠাকুরকে দেখে দুজনেই নমস্কার করে তার কাছে নালিশ লাগিয়ে দিল। কিকিৎসুম বলল, “দেখুন, আমার বাবার ছবি, সেদিন আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেলাম, আর ও কিনা বলে যে ওটা কোন্‌-এক মেয়ের ছবি।” লিলিৎসি বলল, “দেখলেন কি অন্যায়! এনেছেন একটা গোমড়ামুখি মেয়ের ছবি, আর আমায় বোঝাচ্ছেন, ঐ নাকি তাঁর বাবা!”

 তখন ‘বজ্ঞে’ ঠাকুর বললেন, “দাও তো দেখি ছবিখানা।” তিনি আরসি নিয়ে মিনিট পাঁচেক খুব গম্ভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আয়নাটাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, “তোমরা ভুল বুঝেছ। এ হচ্ছে অতি প্রাচীন এক মহাপুরুষের ছবি। আমি দেখতে পাচ্ছি, ইনি একজন যে-সে লোক নন। দেখছ না, মুখে কি গম্ভীর তেজ, কিরকম বুদ্ধি আর পাণ্ডিত্য, আর কি সুন্দর প্রশান্ত অমায়িক ভাব। এ ছবিটা তো এমন করে রাখলে চলবে না; বড় মন্দির গড়ে তার মধ্যে পাথরের বেদি বানিয়ে, তার মধ্যে ছবিখানাকে রাখতে হবে—আর ফুলচন্দন ধূপধুনো দিয়ে তার সম্মান করতে হবে।”

 এই বলে ‘বজ্ঞে’ ঠাকুর আরসি নিয়ে চলে গেলেন। আর কিকিৎসুম আর লিলিৎসি ঝগড়া-টগড়া ভুলে খুশি হয়ে খেতে বসল।

সন্দেশ—১৩২৫