সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/দেশ-বিদেশের গল্প/বুদ্ধিমান শিষ্য (২)

উইকিসংকলন থেকে

বুদ্ধিমান শিষ্য

 টোলের যিনি গুরু তাঁর অনেক শিষ্য। সবাই লেখে, সবাই পড়ে কেবল একজনের আর কিছুতেই কিছু হয় না। বছরের পর বছর গেল, তার বিদ্যাও হল না, বুদ্ধিও খুলল না। সকলেই বলে—“ওটা মূর্খ, ওটা নির্বোধ, ওটার আর হবে কি? ওটা যেমন বোকা তেমনিই থাকবে।” শেষটায় গুরু পর্যন্ত তার আশা ছেড়ে দিলেন। বেচারার কিন্তু একটি গুণ সকলেই স্বীকার করে—সে প্রাণপণে গুরুর সেবা করতে ত্রুটি করে না।

 একদিন গুরু শুয়ে আছেন, মূর্খ শিষ্য বসে বসে তাঁর পা টিপে দিচ্ছে, গুরু বললেন, “তুমি ঘুমতে যাবার আগে খাটিয়াটা ঠিক করে দিও। পায়াগুলো অসমান আছে।” শিষ্য উঠবার সময় দেখল, একদিকের পায়াটা একেবারে ভাঙা। এখন উপায়? বেচারা খাটের সেই দিকটা নিজের হাঁটুর উপর রেখে সারারাত জেগে কাটাল। সকালে গুরু ঘুম থেকে উঠে ব্যাপার দেখে অবাক!

 গুরুর মনে ভারি দুঃখ হল। তিনি ভাবলেন, ‘আহা বেচারা এমন করে আমার সেবা করে, এর কি কোনরকম বিদ্যাবুদ্ধি হবার উপায় নাই? পুঁথি পড়ে বিদ্যালাভ সকলের হয় না, কিন্তু দেখে শুনে তো কত লোকে কত কি শেখে? দেখা যাক, সেই ভাবে একে কিছু শেখান যায় কি না।’ তিনি শিষ্যকে ডেকে বললেন, “বৎস, এখন থেকে তুমি যেখানেই যাও, ভালো করে সব দেখবে—আর কি দেখলে, কি শুনলে, কি করলে, সব আমাকে এসে বলবে।” শিষ্য বলল, “আজ্ঞে, তা বলব।”

 তারপর কিছুদিন যায়, শিষ্য একদিন জঙ্গলে কাঠ আনতে গিয়ে একটা সাপ দেখতে পেল। সে টোলে ফিরে এসে গুরুকে বলল, “আজ একটা সাপ দেখেছি।” গুরু উৎসাহ ক’রে বললেন, “বেশ বেশ। বল তো সাপটা কিরকম?” শিষ্য বললে, “আজ্ঞে, ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্‌।” শুনে গুরু বেজায় খুশি হয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছ। অনেকটা লাঙ্গলের ডাণ্ডার মতোই তো। সরু, লম্বা, বাঁকা আর কালো মতন। তুমি এমনি করে সব জিনিস মন দিয়ে দেখতে শেখ, আর ভালো করে বর্ণনা করতে শেখ, তাহলেই তোমার বুদ্ধি খুলবে।”

 শিষ্য তো আহ্লাদে আটখানা। সে ভাবলে, ‘তবে যে লোকে বলে আমার বুদ্ধি নেই।’ আর-একদিন সে বনের মধ্যে গিয়ে ফিরে এসে গুরুকে বলল, “আজ একটা হাতি দেখলাম।” গুরু বললেন, “হাতিটা কিরকম?” শিষ্য বললে, “ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্‌।” গুরু ভাবলেন, ‘হাতিটাকে লাগলদণ্ডের মতো বলছে কেন? ও বোধহয় শুঁড়টাকেই ভালো করে দেখেছে। তা তো হবেই—শুঁড়টাই হল হাতির আসল বিশেষত্ব কিনা। ও শুধু হাতি দেখেছে তা নয়, হাতির মধ্যে সবচাইতে যেটা দেখবার জিনিস, সেইটাই আরো বিশেষ করে দেখেছে।’ সতরাং তিনি শিষ্যকে খাব উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ঠিক, ঠিক, হাতির শুঁড়টা দেখতে অনেকটা লাঙ্গলের ঈষের মতোই তো।” শিষ্য ভাবলে, ‘গুরুর তাক লেগে গেছে—না জানি আমি কি পণ্ডিত হলাম রে!”

 তারপর শিষ্যরা একদিন গেছে নিমন্ত্রণ খেতে। মূর্খও সঙ্গে গিয়েছে। খেয়ে-দেয়ে ফিরে আসতেই গুরু বললেন, “কি করে এলে?” শিষ্য বললে, “দুধ দিয়ে, দৈ দিয়ে গুড় মেখে খেলাম।” গুরু বললেন, “বেশ করেছ। বলতো, দৈ দুধ কিরকম?” শিষ্য এক গাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্‌।”

 গুরুর তো চক্ষুস্থির! তিনি বললেন, “ও মূর্খ! এই বুঝি তোর বিদ্যে! আমি ভাবছি যে তুই বুঝি বুদ্ধি খাটিয়ে সব জবাব দিচ্ছিস। তুই লাঙ্গলও দেখেছিস, দুধ দৈও খেয়েছিস, তবে কোন আক্কেলে বললি যে লাঙ্গলের ঈষের মতো? দূর্‌ দূর্‌ দূর্‌! কোনদিন তোর কিচ্ছ হবে না।”

 শিষ্য বেচারা হঠাৎ এমন তাড়া খেয়ে একেবারেই দমে গেল। সে মনে মনে বলতে লাগল, ‘এদের কিছুই বোঝা গেল না। ঐ কথাটাই তো কদিন ধরে বলে আসছি, শুনে গুরু রোজই তো খুশি হয়। তাহলে আজকে কেন বলছে ‘দূর দূর’। দুত্তারি। এদের কথার কিছু ঠিক নেই।’

সন্দেশ—১৩২৬