বিষয়বস্তুতে চলুন

সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/উকিলের বুদ্ধি

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২০৯-২১০)
উকিলের বুদ্ধি

 গরিব চাষা, তার নামে মহাজন নালিশ করেছে। বেচারা কবে তার কাছে পঁচিশ টাকা নিয়েছিল, সুদে আসলে তাই এখন পাঁচশো টাকায় দাঁড়িয়েছে। চাষা অনেক কষ্টে একশো টাকা জোগাড় করেছে; কিন্তু মহাজন বলছে, “পাঁচশো টাকার এক পয়সাও কম নয়; দিতে না পার তো জেলে যাও।” সুতরাং চাষার আর রক্ষা নেই।

 এমন সময় শাম্‌লা-মাথায়, চশমা-চোখে তুখোড়-বুদ্ধি উকিল এসে বলল, “ঐ একশো টাকা আমায় দিলে, তোমার বাঁচবার উপায় করতে পারি।” চাষা তার হাতে ধরলো, পায়ে ধরলো, বলল, “আমায় বাঁচিয়ে দিন।” উকিল বলল, “তবে শোন,


আমার ফন্দি বলি। যখন আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াবে, তখন বাপু কথাটথা কয়ো না। যে যা খুশি বলুক, গাল দিক আর প্রশ্ন করুক, তুমি তার জবাবটি দেবে না—খালি পাঁঠার মতো ‘ব্যা—’ করবে। তা যদি করতে পার, তা হলে আমি তোমায় খালাস করিয়ে দেব।” চাষা বলল, “আপনি কর্তা যা বলেন, তাতেই আমি রাজি।”

 আদালতে মহাজনের মস্ত উকিল, চাষাকে এক ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি সাতবছর আগে পঁচিশটাকা কর্জ নিয়েছিলে?” চাষা তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, “ব্যা—”। উকিল বলল, “খবরদার!—বল, নিয়েছিলে কি না।” চাষা বলল, “ব্যা—” উকিল বলল, “হুজুর! আসামীর বেয়াদবি দেখুন।” হাকিম রেগে বললেন, “ফের যদি অম্‌নি করিস, তোকে আমি ফাটক দেব।” চাষা অত্যন্ত ভয় পেয়ে, কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, “ব্যা-ব্যা—” হাকিম বললেন, “লোকটা পাগল নাকি?”

 তখন চাষার উকিল উঠে বলল, “হুজুর, ওকি আজকের পাগল—ও বহুকালের পাগল, জন্মে অবধি পাগল। ওর কি কোন বুদ্ধি আছে, না কাণ্ডজ্ঞান আছে? ও আবার কর্জ নেবে কি! ও কি কখনো খত লিখতে পারে নাকি? আর পাগলের খত লিখলেই বা কি? দেখুন দেখি, এই হতভাগা মহাজনটার কাণ্ড দেখুনে তো! ইচ্ছে করে, জেনেশুনে, পাগলটাকে ঠকিয়ে নেবার মৎলব করেছে। আরে, ওর কি আর মাথার ঠিক আছে? এরা বলেছে, ‘এইখানে একটা আঙুলের টিপ দে’—পাগল কি জানে, সে অমনি টিপ দিয়েছে। এই তো ব্যাপার!”

 দুই উকিলে ঝগড়া বেধে গেল। হাকিম খানিক শুনেটুনে বললেন, “মোকদ্দমা ডিসমিস।” মহাজনের তো চক্ষুস্থির। সে আদালতের বাইরে এসে চাষাকে বলল, “আচ্ছা, নাহয় তোর চারশো টাকা ছেড়েই দিলাম—ঐ একশো টাকাই দে।” চাষা বলল, “ব্যা—।” মহাজন যতই বলে, যতই বোঝায়, চাষা তার পাঠার বুলি কিছুতেই ছাড়ে না। মহাজন রেগেমেগে বলে গেল, “দেখে নেব, আমার টাকা তুই কেমন করে হজম করিস!”

 চাষা তার পোঁটলা নিয়ে গ্রামে ফিরতে চলেছে, এমন সময়ে তার উকিল এসে ধরলো, “যাচ্ছ কোথায় বাপু? আমার পাওনাটা আগে চুকিয়ে দিয়ে যাও। একশো টাকায় যে রফা হয়েছিল, এখন মোকদ্দমা তো জিতিয়ে দিলাম।” চাষা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ব্যা—।” উকিল বলল, “বাপুহে, ও-সব চালাকি খাটবে না—টাকাটি এখন বের কর।” চাষা বোকার মতন মুখ করে আবার বলল, “ব্যা—।” উকিল তাকে নরমগরম অনেক কথাই শোনালো, কিন্তু চাষার মুখে কেবলই ঐ এক জবাব! তখন উকিল বলল, “হতভাগা, গোমুখ্যু, পাড়াগেঁয়ে ভূত—তোর পেটে এতো শয়তানি কে জানে! আগে যদি জানতাম তা হলে পোঁটলাসুদ্ধ টাকাগুলো আটকে রাখতাম।”

 বুদ্ধিমান উকিলের আর দক্ষিণা পাওয়া হল না।

সন্দেশ—১৩২৮