বিষয়বস্তুতে চলুন

সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/ব্যাঙের রাজা

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৭৯-১৮২)
ব্যাঙের রাজা

 রাজবাড়িতে যাবার যে পথ, সেই পথের ধারে প্রকাণ্ড দেয়াল, সেই দেয়ালের পাশে ব্যাঙেদের পুকুর। সোনাব্যাঙ, কোলাব্যাঙ, গেছোব্যাঙ, মেঠোব্যাঙ—সকলেরই বাড়ি সেই পুকুরের ধারে। ব্যাঙেদের সর্দার যে বুড়ো ব্যাঙ, সে থাকে দেয়ালের ধারে, একটা মরা গাছের ফাটলের মধ্যে, আর ভোর হলে সবাইকে ডাক দিয়ে জাগায়—“আয় আয় আয়—গ্যাঁক্‌ গ্যাঁক্‌ গ্যাঁক্‌—দেখ দেখ দেখ—ব্যাঙ ব্যাঙ ব্যাঙ—ব্যাঙাচি।” এই বলে সে অহংকারে গাল ফুলিয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, আর ব্যাঙগুলো সব “যাই যাই যাই—থাক থাক থাক” ব’লে, ঘুম ভেঙে মুখ ধুয়ে দাঁত মেজে, পুকুরপারের সভায় বসে।

 একদিন হয়েছে কি, সর্দার ব্যাঙ ফুর্তির চোটে লাফ দিয়েছে উলটোমুখে ডিগবাজি খেয়ে—আর পড়বি তো পড়, এক্কেবারে দেয়াল টপকে রাজপথের মধ্যিখানে। রাজা তখন সভায় চলেছেন, সিপাইশান্ত্রী লোকলস্কর দলবল সব সঙ্গে চলছে। মোটা মোটা সব নাগরাই জুতো, খটমট ঘ্যাঁচম্যাঁচ করে ব্যাঙ বুড়োর মাথার ওপর দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে এমনি রোখ করে চলতে লেগেছে, যে ভয়ে ব্যাঙের প্রাণ তো যায় যায়! হঠাৎ কোত্থেকে কার একটা লাঠি না ছাতা না কিসের গুঁতো এসে এমনি ধাঁই করে ব্যাঙের গায়ে লেগেছে যে সে বেচারা ঠিকরে গিয়ে পথের ধারে ঘাসের ওপর চিৎপাত হয়ে পড়েছে।

 ব্যাঙ বুড়োর খুব লেগেছিল, কিন্তু হাতও ভাঙে নি, পাও ভাঙে নি, সে আস্তে আস্তে উঠে বসল—আর চারিদিকে তাকিয়ে, দেয়ালের গায়ে একটা ফাটল দেখে, তাড়াতাড়ি তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে খুব সাবধানে মুখ বার করে সে চেয়ে দেখল, মাথায়-মুকুট রঙিন-পোশাক রাজা, আলো ঝলমল চতুর্দোলায় চড়ে সভায় যাচ্ছেন। লোকেরা সব “রাজা, রাজা” বলে নমস্কার করছে, নাচছে, গাইছে আর ছুটোছুটি করছে। আর রাজামশাই চতুর্দোলায় বসে খুশি হয়ে, এর দিকে তাকাচ্ছেন, ওর দিকে তাকাচ্ছেন, আর কেবলি হাসছেন। তাই দেখে ব্যাঙের বড় ভালো লাগল, সেও দু হাত তুলে নমস্কার করতে লাগল আর বলতে লাগল, “রাজা রাজা রাজা—রাজা রাজা রাজা!” তার মনে হল রাজামশাই ঠিক যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন! ব্যাঙ তখন কাঁদ-কাঁদ হয়ে নিশবাস ফেলে ভাবল, ‘আহা! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!’

 তারপর ঘরে ঘরে পথ খুঁজে খুঁজে ব্যাঙ যখন বাসায় ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সবাই বলল, “সর্দার বুড়ো, সর্দার বুড়ো সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমরা যে কত ডাকলাম, কত খুঁজলাম, তুমি তো কই সাড়াও দিলে না।” সর্দার বলল—“চোপ্‌ চোপ্‌ চোপ্‌ রাও! রাজা দেখতে গিয়েছিলাম।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সব এক সঙ্গে “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” বলে চেঁচিয়ে উঠল। বুড়ো তখন গাল ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে দুচোখ বুজে, দুহাত তুলে লাফিয়ে বলল, “রাজা হচ্ছে এই এত্তো বড়ো উঁচু, আর ধবধবে সাদা আর ঝক্‌ঝকে আলোর মতো—আর তাকে দেখলেই সবাই মিলে ডাকতে থাকে—“রাজা রাজা রাজা রাজা।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সবাই বলতে লাগল, “আহা! আহা! আমাদের যদি একটা রাজা, থাকত!” তাদের যে রাজা নেই এই কথা ভাবতে ভাবতে তাদের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে লাগল। বুড়ো ব্যাঙ বলল, “ভাই সকল, এসো আমরা রাজার জন্য দরখাস্ত করি।” তখন সবাই মিলে গোল হয়ে বসে, আকাশের দিকে চোখ তুলে, নানান সুরে ডাকতে লাগল—“রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা চাই রাজা চাই—রাজা চাই রাজা চাই।”

 ব্যাঙ পাকুরের ব্যাঙ-দেবতা—যিনি বাদলা দিনে বর্ষা মেঘের ঝাঁঝরি দিয়ে পুকুর ভরে জল ঢালেন—তিনি তখন আকাশতলায় চাদর মেলে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ ব্যাঙেদের চিৎকারে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি চারদিকে তাকিয়ে বললেন, “বৃষ্টিও নেই, বাদলাও নেই, মেঘের কোন চিহ্নও নেই, বাছারা সব চেঁচাও কেন” ব্যাঙেরা বলল, “আমাদের রাজা নেই, রাজা চাই।” দেবতা বললেন, “এই নে রাজা।” বলে মরা গাছের একখানা ডাল ভেঙে তাদের সামনে ফেলে দিলেন।

 ভাঙা ডাল পাকুরপাড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল—তার মাথার ওপর মস্ত মস্ত ব্যাঙের ছাতা জোছ্‌নায় চকচক করতে লাগল। তাই দেখে ব্যাঙেদের ফুর্তি আর ধরে না। তারা গোল হয়ে ঘিরে বসে মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গাইতে লাগল—“রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা রাজা রাজা রাজা—”

 এমনি করে দুদিন যায়, দশদিন যায়, শেষটায় একদিন সর্দার ব্যাঙের গিন্নি বললেন, “ছাই রাজা! কর্তা যে সেদিন রাজা দেখলেন, এর চেয়ে সে অনেক ভালো। এ রাজা নড়েও না চড়েও না, এদিকেও দেখে না ওদিকেও দেখে না—ছাই রাজা! তাই শুনে সবাই বলল, “ছাই রাজা! ছাই রাজা!—নড়েও না চড়েও না, দেখেও না শোনেও না—ছাই রাজা!” তখন আবার বুড়ো ব্যাঙ গাছের উপর চড়ে বলল, “ভাই সকল এসো আমরা দরখাস্ত করি—আমাদের ভালো রাজা চাই।” আবার সবাই গোল হয়ে বসে আকাশপানে চোখ তাকিয়ে নানান সুরে ডাকতে লাগল—“রাজা চাই! রাজা চাই! ভালো রাজা—নতুন রাজা।” তাই শুনে ব্যাঙ দেবতা জেগে বললেন, “ব্যাপারখানা কি? এই তো সেদিন তোদের রাজা দিলাম, এর মধ্যে আবার নতুন কি হল?” ব্যাঙেরা বলল, “ও রাজা ছাই রাজা! ও রাজা বিশ্রী রাজা—ও রাজা নড়েও না চড়েও না—ও রাজা চাই না চাই না চাই না চাই না চাই না চাই না—” ব্যাঙ দেবতা বললেন, “থাম্‌ তোরা থাম্‌—নতুন রাজা দিচ্ছি।” এই ব’লে, একটা বককে সেই পুকুরের ধারে নামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “এই নে তোদের নতুন রাজা।”

 তাই না দেখে, ব্যাঙেরা সব অবাক হয়ে বলতে লাগল, “বাপ রে বাপ! কি প্রকাণ্ড রাজা চক্‌চকে ঝক্‌ঝকে ধব্‌ধবে সাদা! ভালো রাজা! সুন্দর রাজা! রাজা রাজা রাজা রাজা।” বকের তখন খিদে ছিল না, মাছ খেয়ে পেট ভরা ছিল, তাই সে কিছু বলল না; খালি চোখ মিটমিট করে একবার এদিকে তাকাল, একবার ওদিকে তাকাল, তারপর এক পা তুলে চুপচাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তাই দেখে ব্যাঙেদের উৎসাহ আর ধরে না, তারা প্রাণ খুলে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল। সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল হল, সন্ধে হল—তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি এল—তখন ব্যাঙেদের গান গাওয়া বন্ধ হল।

 তার পরের দিন সকালবেলায় উঠে যেমনি তারা গান ধরেছে, অমনি বক রাজা এসে একটা গোব্‌দামতন মোটা ব্যাঙকে টপাস্‌ করে মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে! তাই দেখে ব্যাঙেরা সব হঠাৎ কেমন মুষড়ে গেল—তাদের ‘রাজা রাজা' গান একেবারে পাঁচ সুর নেমে গেল। বকরাজা ব্যাঙটিকে দিয়ে জলযোগ করে একটি ঠ্যাঙ মুড়ে ধ্যান করতে লাগলেন।

 এমনি করে এক-এক বেলায় এক-একটি ব্যাঙ বকরাজার পেটের মধ্যে যায়। ব্যাঙ মহলে হৈ চৈ লেগে গেল। সবাই মিলে সভায় ব’সে যুক্তি করে বলল, “এটা বড় অন্যায় হচ্ছে। রাজাকে বুঝিয়ে বলা দরকার, সে হল আমাদের রাজা, সে এমন করলে আমরা পালাই কোথা?” কিন্তু বুঝিয়ে বলবে কে? সর্দার গিন্নি বললেন, “তার জন্য ভাবছিস কেন? এতে আর মুশকিল কিসের? এই দেখ না, আমিই গিয়ে বলে আসছি।”

 সর্দার গিন্নি বকরাজার পায়ের সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে, হাতমুখ নেড়ে কড়কড়ে গলায় বলতে লাগলেন, “ও রাজা, তোর ভাগ্যি ভালো, তুই আমাদের রাজা হলি। তোর চোখ ভালো, মুখ ভালো, ঝক্‌ঝকে রঙ ভালো, তোর এক পা-ও ভালো, দুই পা-ও ভালো, কেবল ঐটি তোর ভালো নয়—তুই আমাদের খাস কেন? শামুক আছে শামুক খা না, পোকা-মাকড় প্রজাপতি তাও তো তুই খেতে পারিস। রাজা হয়ে আমাদের খেতে চাস? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা—রাম রাম রাম রাম—অমন আর কক্ষনো করিস নে।” বক দেখলে তার পায়ের কাছে দিব্যি একটা নাদুস্‌ননুদুস্‌ ব্যাঙ, তার নরম নরম গোলগাল চেহারা! টপ করে বকরাজার জিভ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল আর খপ্ করে সর্দার গিন্নি তার মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন!

 ব্যাঙেদের মুখে আর কথাটি নেই। সবাই তাড়াতাড়ি চট্‌পট্ সরে বসে বড়বড় হাঁ করে তাকিয়ে রইল। পরে সর্দার ব্যাঙ রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, “পাজি রাজা! লক্ষ্মীছাড়া দুষ্টু রাজা!” তাই শুনে সবাই এক সঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে চোঁচাতে লাগল, “পাজি রাজা! দুষ্টু রাজা!—চাই না চাই না চাই না চাই না—রাজা চাই না, রাজা চাই না।”

 ব্যাঙ দেবতা জেগে বললেন, “দূর ছাই! আবার কি হল?” ব্যাঙেরা বলল, “বাপ রে বাপ্! বাপ রে বাপ্! কি দুষ্টু রাজা! নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও!”

 তখন ব্যাঙ দেবতা হুশ্ করে তাড়া দিতেই বকরাজা পাখা মেলে উড়ে পালাল। আর ব্যাঙেরা সব বাসায় গিয়ে বলতে লাগল, “গ্যাঁক্ গ্যাঁক্ গ্যাঁক্—বাপ্ বাপ্ বাপ্—ছ্যা ছ্যা ছা—রাজাটাজা আর কক্ষনো চাইব না।”

সন্দেশ—১৩২৭