সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/আমি দেখেছিলাম

উইকিসংকলন থেকে

আমি দেখেছিলাম

আমি দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে—
তিসির ক্ষেতে পথ গিয়েছে বেঁকে,
কৃষ্ণচূড়া খোঁপায় প’রে
চলছে মেয়ে গরব-ভরে—
কলস কাঁখে
নদীর বাঁকে—
যেথা  টুপ্‌টুপিয়ে মহুয়া ফুল ঝরছে পেকে পেকে;
আমি  দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে।

সূর্য তখন অস্তাচলে চলে,
পলাশবনে রঙের মশাল জ্বলে,
মহিষ চ’ড়ে চলছে ছেলে—
দেখছে আমায় নয়ন মেলে,
হাতের বাঁশি
সুরের রাশি
যেন  হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেল আমায় দেখে দেখে;
আমি  দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে।

ঢালু পথের মেহেদী-বন ছাড়ি’
মরা-নদীর চড়ায় নামে গাড়ি,
বালুর চড়ায় চলছে ডুলি—
বেহারাদের শুনছি বুলি,
ডুলির মাঝে
সেদিন সাঁঝে
চলে  ছোট্ট মেয়ে শ্বশুরবাড়ি মাথায় সিঁদুর মেখে;
আমি  দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে।

সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে আসে ক্রমে,
পাহাড়-তলে আঁধার আসে জ’মে;
শালের বনের আড়াল থেকে
শেয়ালগুলো উঠল ডেকে,
এমন ক্ষণে
পূব-গগনে
জাগে  শুক্লা একাদশীর শশী সকল আঁধার ঢেকে;
আমি  দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে।

মাদার-তলার আঁধার ফাঁকে ফাঁকে
আলো-ছায়ার আল্‌পনা কে আঁকে?
পথের-পাশের পাথরকুচি—
ফুল ধরেছে গুছি গুছি,
তারই ধারে
মেথির ঝাড়ে
কত জোনাক্ মেয়ে আলোর প্রদীপ যাচ্ছে রেখে রেখে;
আমি  দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে।

শান্ত-নিবিড় কুটীরগুলির পাশে
এবার আমার গরুর গাড়ি আসে;
ছায়ার মত ছেলের দলে
মাদল বাজায় গাছের তলে,—
শীতল ছায়ে
তাদের গায়ে
সাদা  চাঁদের আলোর উল্‌কি কে রে দিচ্ছে এঁকে এঁকে?
আমি  দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে।

আধো-আঁধার পলাশ-ডাঙা গাঁয়ে
কে চলে আজ আল্‌তো পায়ে পায়ে?
কে গেছে আজ পাহাড়-তলে—
ঘর ফেরে নি সন্ধ্যা হ’লে,
জননী যে
খুঁজছে নিজে,
আহা  ছেলের তরে আকুল হয়ে ফিরছে ডেকে ডেকে;
আমি  দেখেছিলাম গরুর গাড়ির থেকে।