সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/বুনো-ছেলে

উইকিসংকলন থেকে

বুনো-ছেলে

সূর্য গেল অস্তাচলে;—
মাঠের পথে ফিরতে বাড়ি
তাড়াতাড়ি
পড়ে গেলাম ঝড়-বাদলে।

হঠাৎ মেঘের দাপট শুরু আকাশ ব্যেপে,—
ঝড়ের বাতাস ছুটলো তোড়ে, উঠলো ক্ষেপে।
অল্প পরেই মুষলধারে নামবে ধারা,
হতেই হবে ভিজে সারা।
ধারে-কাছে নাই কোনো আশ্রয়,
জাগলো মনে ভয়।

গাছপালাদের মাথায় মাথায়
পাতায় পাতায়
দোলন লাগে ক্ষণে ক্ষণে,
কোন্ সে ক্ষ্যাপা উঠলো ক্ষেপে মাঠের শেষে বনে বনে।

বন‍্বনিয়ে ঘূর্নি-হাওয়ায়
ঘুরপাকেতে শূন্যে কে ধায়?
কোন্ খেয়ালীর পাগলামিতে
ঝড় উঠেছে আচম্বিতে!
অন্ধকারের আবছা-আলো
তাও মিলালো
গগনতলে,
মাঠের পথে ফিরতে বাড়ি পড়ে গেলাম ঝড়-বাদলে।

নিরুপায়েই ভিজতে হবে মাঠের মাঝে
আজকে সাঁঝে,
তাড়াতাড়ি চলছি দ্রুত চরণ ফেলে,
এমন সময় দৌড়ে এলে ছোট্ট কালো বুনো-ছেলে;

বললে আমার হাতটি ধ’রে
“চল বাবুজি শীঘ্র ক’রে,
ঐ যে আমার পাতার কুটির তেঁতুল তলার পিছে,
ভিজবি কেন মিছে?”

সাঁওতালদের ছোট্ট বুনো-ছেলে
অশিক্ষিত জংলী-শিশু অভয় দিল ডাগর দুটি
কালো-নয়ন মেলে।

কালো আকাশ নিবিড় হ’ল ক্রমে,
মেঘের উপর মেঘ উঠেছে জ’মে—
চিকমিকিয়ে বিদ্যুতেরই প্রখর আলো থেকে থেকে
ঝিলিক মারে আকাশ জুড়ে সাপের মতো এঁকে বেঁকে।

মেঘ ডেকে যায় কড়কড়িয়ে,
বুক কেঁপে যায় থরথরিয়ে।
সাঁওতালদের ছোট্ট ছেলে আবেগ-ভরে
হাতটি আমার পাক‍্ড়ে ধ’রে
চললো ছুটে ঘরের পানে তার,
আমায় যেন ছাড়বে না সে আর।

এই জীবনে কত ব্যাপার ঘটছে অবিরত,
বিস্মৃতিযরই অতল তলে তলিয়ে যে যায় বুদ্ধ দেরই মত।
জীবনস্রোতে স্মৃতির কত কুসুমরাশি
কোন্ অকুলে যায় যে ভাসি’—
কে খোঁজ রাখে তার,
কেই বা ধারে ধার।

অতীত্ দিনের অখ্যাত এক বুনো-ছেলের স্মৃতি
কিন্তু আজো মনের কোণে জাগছে নিতি নিতি,—
কালের স্রোতে শুভ্র তাজা শতদলের প্রায়—
চির-দীপ্ত হয়ে আছে মনের নিরালায়॥