সুলোচনা কাব্য/প্রথম অঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

সুলোচনা কাব্য।


প্রথম অঙ্ক।

 খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ব্বে, বাঙ্গালা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজধানী মুরসিদাবাদ নগরীর উপকণ্ঠে অর্থাৎ যে স্থলে প্রসন্নসলিলা জহ্নুতনয়া, পবিত্র তীর্থ স্বরূপা সগরবংশাবতংশ পরম কীর্ত্তিবান্‌ ভগীরথের নির্ম্মলকীর্ত্তি ভাগীরথী চিরপ্রবাহিত; তত্তীরে উপনগরী নসীপুরনামে এক রম্য স্থান আছে, তথায় ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভব বীরজিৎসিংহ নামধেয় মহাবল পরাক্রান্ত দোর্দ্দণ্ড প্রতাপান্বিত নরপতি বাস করিতেন। ইঁহার রাজত্বকালে প্রকৃতিপুঞ্জের সুখের পরিসীমা ছিল না। প্রজাগণ সতত এই মনে করিত যে, রাজা রামচন্দ্রের যে কুলে জন্মগ্রহণ হইয়াছিল; ইনিও সেই ক্ষত্রকুলোদ্ভব, বুঝি সূর্য্যবংশের রাজাদিগের প্রজাপালনের রীতি একই রূপ হইবে। বাস্তবিক প্রজাগণ তাঁহার সুপ্রতিষ্ঠিত শাসনপ্রণালীর গুণে সর্ব্বদা সর্ব্ববিষয়ে প্রফুল্লচিত্তে কালাতিপাত করিত। মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, চৌর্য্য কি দস্যুবৃত্তি, কি পরপীড়ন, এ সকল নাম মাত্র ছিল কার্য্যতঃ কিছুই দৃষ্ট হইত না; তাহারা ঐ সকল কথা অলীক উপন্যাসের ন্যায় জ্ঞান করিত। বীরজিৎসিংহের ভুজবলে, তৎকালে কোন প্রকার অত্যাচারই অধিকার মধ্যে হইবার সম্ভাবনা ছিলনা।

 কুলক্রমাগত শৌর্যবীর্য্যের কিছুমাত্র ক্রটি ছিল না, পারিপার্শ্বিক রাজন্যবর্গ, তদীয় অপ্রতিহত প্রতাপে নতশির ছিলেন; কেহই তাহার বিপক্ষে মস্তকোত্তলন করিতে সাহসী ছিলেন না। বীরজিৎসিংহের অনন্য সাধারণ ভুজবল সত্ত্বেও পরস্বাপহারক অর্থগৃধ্নু নরপতিদিগের ন্যায়, পরস্বলোভে লোলুপ ছিলেন না। তিনি শরণাপন্নকে আশ্রয় দান, বিপন্নের বিপদোদ্ধার, দীন দরিদ্রের প্রতি বদান্য ও নিরাশ্রয় অনাথদিগের সর্ব্বাচ্ছাদক ছিলেন। মহীপতির সুমতীনাম্নী মহিষী ছিলেন; ইঁহাকে লক্ষী বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সুমতীর স্বভাবসিদ্ধ সদ্গুণে নরপতি এরূপ বাধ্য হইয়া ছিলেন যে, সাক্ষাৎ বিদ্যাধরী তুল্য রূপলাবণ্যবতী, কোন কামিনীর হাবভাব লাবণ্য সন্দর্শনেও তদীয় মন তাহাতে আকৃষ্ট হইত না। ফলতঃ মহারাজ সুমতীর প্রণয়পাশে একান্ত আবদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি সর্ব্ববিষয়ে উদ্বেগশূন্য হইয়া প্রসন্নমনে প্রফুল্লচিত্তে রাজমহিষীসহবাসে যৌবনসুখানুভব করিতে লাগিলেন। বীরজিৎসিংহের বুদ্ধিবলে ও বাহুবলে রাজ্যের আর কোন প্রকার অমঙ্গল সম্ভাবনা রহিল না, তিনি নিশ্চিন্তভাবে প্রজাদিগের পরিপালন ও মহিষীর মনানন্দ বর্দ্ধন করতঃ পরম সুখে রাজ্যভোগ করিতে রহিলেন। রাজার এরূপ অসুলভ সুখসম্ভোগ সন্দর্শনে ঈর্ষাবিষদগ্ধহৃদয় বিধাতার অন্তঃকরণ উদ্বেল হইয়া উঠিল। সুতরাং কিয়দ্দিবস অতীত হইতে না হইতে কোন এক দুর্লক্ষ সূত্র অবলম্বন করিয়া দুঃখ তাঁহার হৃদয়রাজ্য অধিকার করিল।

 ইত্যগ্রে সুমতীর গর্ভে শরদেন্দু বিনিন্দিত অতি সুকুমার একটা নবকুমার জন্ম পরিগ্রহ করেন। শৈশব হইতে কুমারের নির্ম্মল শশধরের ন্যায় যশঃকিরণ বিকাশ সন্দর্শনে এবং লক্ষণবিৎ পণ্ডিতগণের প্রমুখাৎ ভবিষ্যদ্বাণী শ্রবণে যশোবর্ণাত্মক শ্বেত নাম প্রদান করিয়া জাতকর্ম্মাদি সমুদয় ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করিলেন। শুক্লপক্ষীয় শশিকলার ন্যায়, দিন দিন শ্বেতের বয়োবৃদ্ধি সহকারে শরীর বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। বালকটীর বুদ্ধিশক্তির প্রভাব দর্শনে, অনেকেরই মনে এরূপ ভাবোদয় হইত যে, বুঝি কোন কার্য্যগতিকে বৃহস্পতিদেব শাপগ্রস্ত হইয়া স্বর্গবাসের অনুপযুক্ত হওয়ানন্তর নরদেহধারণপূর্ব্বক রাজা বীরজিৎসিংহের সঞ্চিত পুণ্যফলে তাঁহাকে কৃতার্থ করিবার অভিলাষে তদীয় সন্তানরূপে ভূমিষ্ঠ হইয়াছেন। শ্বেতের বিদ্যারম্ভের পূর্ব্বে অর্থাৎ পঞ্চম বৎসর বয়ঃক্রম পূর্ণ হইতে না হইতেই সুমতীর দ্বিতীয়বার গর্ভ লক্ষণ আভাস্‌মাত্রে প্রকাশ পাইল। পুরস্ত্রীবর্গ মহিষীর অবস্থা দৃষ্টে পরস্পর কাণাকানী করিতে আরম্ভ করিল। পরম্পরা ঐ কথা শ্রুতিগোচর করিয়া বীরজিৎসিংহ একদিন কৌতূহলচিত্তে রাজ্ঞীর নিকট উপনীত হইয়া প্রফুল্লবদনে জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রিয়ে! পুরনারী মধ্যে যে কথার আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছে তাহা কি সত্য? নৃপতি কৃত প্রশ্ন শ্রবণে মহিষী, স্ত্রীজাতি স্বভাবসুলভ লজ্জাবশতঃ কোন উত্তর প্রদান না করিয়া মৌনীব্রতাবলম্বনপূর্ব্বক অবনতবদনে পৃথিবীর প্রতি নেত্রপাত করিতে লাগিলেন। মহারাজ বারম্বার অনুরোধ করায়, স্বামীর নির্বন্ধাতিশয় দর্শনে চলচিত্ত হইয়া আর লজ্জার অনুরোধ রক্ষা করিতে না পারিয়া, অগত্যা কৌশলে এই উত্তর প্রদান করিলেন যে, সৌভাগ্যদেবীর অনুগ্রহে দশজনের কথা মিথ্যা হইবে এরূপ বোধ হয় না। মহারাজ মহিষীর নিকট ঐরূপ উত্তর শুনিয়া মনে মনে বিশ্বস্ত হইয়া আশার কুহুকে নিপতিত হইয়া মনে মনে এই সকল কথা কহিতে লাগিলেন; আমার ন্যায় সৌভাগ্যশালী নরপতি সংসারে অতি বিরল। এই পৃথ্বিতলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নরপতি দেখিতে পাই না; সকলেই ভুজবলে হয় অধিকার ভুক্ত না হয় মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হইয়া কালাতিপাত করিতেছেন; রাজলক্ষ্মী চঞ্চলস্বভাবা হইয়াও আমার গৃহে স্থিরভাব অবলম্বন করিয়া অবস্থিতি করিতেছেন, সুতরাং কস্মিন্‌কালেও যে অর্থের অনাটন হইবে তাহার কোন সম্ভাবনা দেখিতেছি না; আবার অদৃষ্ট ক্রমে যে ভার্য্যা পাইয়াছি তাহা, হরের পার্ব্বতী, ইন্দ্রের শচী, বিষ্ণুর লক্ষ্মী এ সকল হইতে, কি রূপে, কিগুণে, কোন অংশেই ন্যূন নহেন। এক্ষণে সংসারাশ্রমের সারভূত যে সন্তান, যাহার অভাবে নরগণ পুন্নামনরক হইতে উদ্ধার হইতে পারে না; এবং যে সন্তান ভিন্ন অর্থ অনর্থের কারণ, দেহভার দুর্ব্বিসহভার জ্ঞান, জীবনে বিড়ম্বনা জ্ঞান হয়; তাহাতেও একপ্রকার সৌভাগ্যশালী বলিতে হইবে। পরন্তু এক পুত্ত্রে বিশ্বাস নাই বলিয়া বিধাতা অনুগ্রহপূর্ব্বক দ্বিতীয় সন্তান প্রদানেও উদ্যত হইয়াছেন, সুতরাং কোন দিকেই আর আমার অসুখ সঞ্চার হইবার সম্ভাবনা দেখিতেছি না। বীরজিৎ-সিংহের অন্তরে এইরূপ নানা বিষয়ের আলোচনা হওয়াতে সৌভাগ্যগর্ব্ব উপস্থিত হইল।

 এদিকে রাজমহিষীর গর্ভ দিন দিন উপচীয়মান হওয়াতে অপূর্ব্ব শ্রীধারণ করিয়া পুরস্ত্রীগণের নয়নানন্দদায়িনী হইতে লাগিলেন। যখন রাজ্ঞীর গর্ভ পূর্ণাবস্থায় উপস্থিত, তৎকালে মহারাজ আর প্রতিদিন অন্তঃপুরে গমন করিতেন না, সপ্তাহে একদিন মাত্র প্রেয়সীর তত্ত্বাবধান জন্য গমন করিয়া তথায় অবস্থিতি করিতেন। কিন্তু এই সপ্তাহ কালান্তেও রাণীর নব নব ভাবের আবির্ভাব অনুভূত হইত। এইরূপে নবম মাস অতীত দশম মাস প্রবৃত্ত, এমন সময়ে এক দিবস রাজমহিষী নরপতিগোচরে বিজ্ঞাপন করিলেন যে, মহারাজ! এবার আমার শরীর দিন দিন দুর্ব্বল ও ক্ষীণ বোধ হইতেছে; বিশেষতঃ দিবাভাগে যখন আলস্যের বশবর্ত্তিনী হইয়া নিদ্রা যাই, তখন নানামত কুম্বপ্ন সন্দর্শন করি অতএব এবারে যে, একটা বিষম বিভ্রাট্‌ ঘটিবে, তাহারই পূর্ব্ব লক্ষণ সকল, অগ্রসূচী লক্ষিত হইতেছে। মহিষীর বাক্যাবসানে ভূপতি কহিলেন, প্রিয়ে! প্রায় মাসাবধি হইতে আমার মনোমধ্যে একটা অভূতপূর্ব্ব ভয়সঞ্চার হইয়া অশেষবিধ অনিষ্টসূচন করিতেছে; পূর্ব্বে তোমার যখন গর্ভের পূর্ণ লক্ষণ আবির্ভূত হইয়াছিল তৎকালে অন্তঃকরণে দিন দিন নবনব ভাবোদয় হইয়া আনন্দসঞ্চার হইত। এবারে কেন যে এত আশঙ্কা উপস্থিত হইতেছে তাহার নিশ্চয় করিতে না পারিয়া নিতান্ত বিষণ্ণভাবে কালযাপন করিতেছি; পাছে এ অবস্থা শুনিয়া তোমার মনে আশঙ্কা উপস্থিত হয় এই ভয়ে এতদিন মনের ভাব গোপন রাখিয়াছিলাম, এক্ষণে উভয়ের মনের অবস্থা একরূপ্‌ দেখিয়া প্রকাশ করিতে সাহসী হইলাম। আহা! অকৃত্রিম প্রণয়ের কি মহিয়সীশক্তি, কি সুখ কি দুঃখ উভয় অবস্থাই যুগপৎ উভয়ের উপস্থিত হইয়া থাকে।

 শরৎকালে পৌর্ণমাসী রজনী পৃথিবী চন্দ্রিকাবসনে আবৃতাঙ্গ হইয়া অপূর্ব্ব শোভায় শোভিত, চকোর চকোরীগণ একবার ঊর্দ্ধ্বদিকে একবার নিম্নভাগে দোদুল্যমান দোলার ন্যায় গমনাগমন করতঃ সুধাকরের সুধাপানে সুতৃপ্ত হইতেছে। উজ্জ্বল চন্দ্রমালোকে নভমণ্ডলস্থিত নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান সুম্পষ্টরূপে লক্ষিত হয় না। কোকিল কোকিলাগণ জাগ্রত হইয়া প্রদীপ্তচন্দ্রকিরণে দিনমান মনে করিয়া মধুরস্বরে কুজন করিতেছে। পেচকগণ নির্ম্মল আলোক সন্দর্শনে ক্ষুব্ধচিত্তে গুপ্তস্থানে অবস্থান করিতেছে। এরূপ সময়ে রাজমহিষীর প্রসববেদনা উপস্থিত, কিছুকাল অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিয়া একটী আশ্চর্য্য পুত্ত্রসন্তান প্রসব করিলেন। সদ্যপ্রসূত সন্তানের অঙ্গকিরণে সূতিকাগার আলোকময় হইল। পুত্ত্রের মুখাবলোকনে সুমতী প্রসবের দুঃসহ যন্ত্রণা বিস্মৃত হইলেন। পুরীর অভ্যন্তরে শঙ্খধ্বনি, হুলুহুলুধ্বনি প্রভৃতি নানাপ্রকার মঙ্গল ধ্বনি; লাজাবর্ষণ, মঙ্গল কলস স্থাপন, তদুপরি চ্যুতশাখা প্রদান; বহির্দ্বারে চ্যুতশাখার মালা প্রদত্ত হইল; পরদিন নগর উৎসবপূর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু সুমতির অন্তর্জ্বালা নিবৃত্তি হইল না, দিন দিন অসুখ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল; রাজ্ঞীর শরীরের অবস্থা দেখিয়া পুরস্ত্রীগণ শঙ্কিত হইতে লাগিলেন, পুষ্টিকর খাদ্য সকল প্রদত্ত হইতে লাগিল, তথাপি শরীরে বলাধান হইল না; এরূপে দুই এক করিয়া পঞ্চমদিবস অতীত, ষষ্ঠদিবসে মহারাজ সূতিকাষষ্ঠি পূজোপলক্ষে সূতিকাগারে প্রবেশ করিলেন। পুত্ত্রের মুখচন্দ্রিমা রত্নদানে সন্দর্শন করিবার উপক্রম করিতেছেন, মহিষীও মহারাজকে সমাগত দেখিয়া তাঁহার সংবর্দ্ধনা করিবার নিমত্ত সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিতে ছিলেন, শরীরের দৌর্ব্বল্যনিবন্ধন মস্তক বিঘূর্ণিত হওতঃ ভূমিতে পতিত ও মূর্চ্ছিত হইলেন। নৃপতি রাজ্ঞীর দশা দর্শনে বিস্ময়োৎফুল্ললোচনে সেই নিষ্প্রভ মুদিত নয়ন ও মলিনবদন নিরীক্ষণে একবারে স্তম্ভিত ও হতবুদ্ধি হইয়া চিত্রার্পিতের ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন, কোন প্রকার উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলেন না। পরিচারিকাগণ, কেহবা তালবৃন্ত হস্তে লইয়া ব্যজন করিতে লাগিল; কেহবা সুবর্ণের পানপাত্র বারিপূর্ণ করিয়া মহিষীর বক্ষঃস্থলে, মস্তকে এবং মুখে অনবরত জলসেচন করিতে লাগিল; কেহবা শুষ্কবস্ত্র দ্বারা গাত্রের স্বেদবিন্দুসকল বিদূরিত করিতে লাগিল; কেহ অতি সাবধানে ধাতুময় শলাকা দ্বারা দন্তসংযোগ নষ্ট করিতে লাগিল; এইরূপে চেতনা সম্পাদনের জন্য নানা উপায় হইতে লাগিল। মহারাজ সেই ভাবে শূন্যনয়নে কিছুকাল অলক্ষিত দৃষ্টিপাত করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক তথা হইতে নিষ্কান্ত হইয়া সভামণ্ডপে মন্ত্রিগণসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। তথায় সকলের সহিত মন্ত্রণা করিয়া স্থির করিলেন যে, ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ কোন সুবিজ্ঞ চিকিৎসক ব্যতিরেকে ইহার আর উপায়ান্তর হইবার সম্ভাবনা নাই। তদনুসারে নানা স্থানে দূত প্রেরিত হইল, অনতিবিলম্বে সূতিকাক্ষেত্রের চিকিৎসায় পারদর্শী এরূপ দুই তিন জন চিকিৎসক আসিয়া উপস্থিত হইল।

 কিছুকাল শুশ্রূষার পর রাজ্ঞীর চেতনা সঞ্চার হইল, পরে কিঞ্চিদ্দুগ্ধ পান করিয়া মৃদুস্বরে বাক্য কহিতে লাগিলেন। পরিচারিকাগণ মহিষীর চেতনাসম্বাদ মহারাজের গোচর করিয়া আসিল। বীরজিৎসিংহ আগন্তুক চিকিৎসকগণকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় সূতিকাগৃহে প্রবেশ করিলেন। রাণী বসনাঞ্চলে মুখমণ্ডল আচ্ছাদন করিয়া অবগুণ্ঠনবতী হইয়া উপবিষ্ট রহিলেন, এবারে আর পূর্ব্বের ন্যায় গাত্রোত্থান করিলেন না। চিকিৎসকেরা প্রথমতঃ শরীর পরীক্ষা করিয়া পরে রোগের সমুদায় বিবরণ শ্রবণানন্তর চিকিৎসারম্ভ করিলেন, কিন্তু সেই অনুপশম্য দুশ্চিকিৎস্য করালকাল রোগের হস্ত হইতে মহিষীর পরিত্রাণ করিতে পারিলেন না। নরপতি প্রতিদিনের অবস্থা দর্শনে হতাশ হইতে লাগিলেন; অবশেষে সহসা একদিন মনে উদয় হইল “নচ দৈবাৎ পরংবলং,” এই প্রাচীন বাক্য স্মৃতিপথে উদিত হওয়াতে বেদবিধিজ্ঞ আচার্য্যের দ্বারা স্বস্তয়ন ও যপাদি মাঙ্গল্য আপদোদ্ধারক অনুষ্ঠান করিতেও ক্রটী করিলেন না। রীতিমত চিকিৎসা, শুশ্রূষা ও দৈবকার্য্য প্রভৃতি বহুবিধ হইল না। ক্রমাগত দুই মাস কাল, রোগের অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিয়া পরে জীবনের সহিত যাতনার শেষ হইল।

 মহিষীর মৃত্যু হইলে, বীরজিৎসিংহ ছিন্নমূল তরুর ন্যায় ভূতলশায়ী এবং গতচেতনা হইলেন। সহসা ভূপতিকে ভূপতিত ও মূর্চ্ছিত দেখিয়া সমীপস্থ ব্যক্তি মাত্রেই আস্তে ব্যস্তে দ্রুতপদে নিকটস্থ হইয়া তদীয় চৈতন্যসম্পাদন জন্য ব্যগ্রতার সহিত কেহবা ব্যজন, কেহবা জলসেচন, কেহবা ঘর্ম্মনিবারণ জন্য অঙ্গে হস্তমর্দ্দন করিতে লাগিলেন। বহুতর শুশ্রূষারপর মহারাজ সচেতন হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক, কহিতে লাগিলেন, হা প্রিয়সি! হা প্রাণপ্রিয়তমে! হা লোচনানন্দদায়িকে! হা হৃৎপথপ্রকাশিনি! হা সর্ব্বসন্তাপনাশিনি! হা জীবিতেশ্বরি! হা সুহাস্যবদনি! হা কুরঙ্গনয়নি! তুমি এ হতভাগ্যকে, এ নরাধমকে, এ পাপাত্মাকে পরিত্যাগ করিলে কেন? আমি এমন কি অপরাধ করিয়াছি যে, আর জন্মাবচ্ছিন্নে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব না? তোমার সহিত আর বাক্যালাপ হইবে না? তোমার সহিত আর একত্রে অবস্থান করিতে পাইব না? তুমি সেই অসামান্য স্নেহ, দয়া ও মমতা কিরূপে বিস্মৃত হইলে? যদি আমার কোন দোষ হইয়া থাকে ক্ষমা করিয়া একবার দেখা দাও; তোমার অদর্শনে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হইয়াছে, তুমি কোথা গিয়া নিশ্চিন্তভাবে অবস্থিতি করিতেছ, এই তোমার প্রতিমা নিষ্পন্দভাবে আমার নেত্রপথে পতিত রহিয়াছে; কৈ ওত আমার হৃদয় শীতল করিতে পারিতেছে না। আমার এই হৃদয়বিদারক কাতরধ্বনি শুনিয়াও কি তোমার করুণার উদয় হইতেছে না? তুমিত এত নির্দ্দয়, এমন পাষাণহৃদয়, এরূপ নির্ম্মম ছিলেনা; তুমি যে কখন আমার দুঃখ সহ্য করিতে পার না, তবে আজি এভাবে কোথায় রহিলে? প্রিয়ে একবার আসিয়া আমার এই দুর্দ্দশা দেখিয়া যাও? তোমার সহিত সাক্ষাৎ না হওয়াতে যাতনায় আমার প্রাণপ্রয়াণের উপক্রম হইয়াছে? হা প্রাণাধিকে তুমি কি আর এজন্মে আমার মুখাবলোকন করিবে না? এমন কি অযথা ব্যবহার দেখিয়াছ যে, একেবারে আমায় পরিত্যাগ করিলে? এমন কি অবিচার হইয়াছে যে, এরাজ্যে আর বাস করিবে না? আচ্ছা! যদি কোন প্রকার অসদ্ব্যবহার করিয়া থাকি, কি অন্যায় আচরণ হইয়া থাকে, না হয় আমাকেই পরিত্যাগ করিবে? তোমার এই সন্তানগণ কি দোষ করিয়াছে যে, তাহাদিগের স্নেহ, দয়া ও মমতায় জলাঞ্জলি দিলে? যদিও শ্বেতের কোন প্রকার দোষাচার সম্ভবে; কারণ ও প্রায় পঞ্চম বর্ষীয় বালক; কথঞ্চিৎ তাহার দুর্ব্বাক্য কহিবার ও আদেশলঙ্ঘন করিবার ক্ষমতা জন্মিয়াছে, কিন্তু এই সদ্যজাত, উপায়বিহীন, অনন্যগতি শিশুর ত আর কোন প্রকার অপরাধ সম্ভবে না, তবে উহাকে পরিত্যাগ করিতেছ কেন? তোমার অভাবে যে, ইহার জীবনধারণ করা কঠিন হইবে? এত আর প্রসূতি ভিন্ন অন্যকে জানে না, এত আর তোমা ব্যতিরেকে জীবিত থাকিবে না, ইহার দশা কি হইবে? ইহাকে কে প্রতিপালন করিবে? আহা! জীবিতাধিকে! তুমি কি জন্য যে, ইহলোক পরিত্যাগপূর্ব্বক উপরত হইলে, আমি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া ওষ্ঠাগতপ্রাণ হইয়াছি। যদি একান্তই এ পাপপুরীতে অবস্থান না কর, তবে অন্ততঃ একবার আসিয়া তোমার বিরক্তির ও অসন্তোষের যে কারণ হইয়াছে তাহা ব্যক্ত করিয়া আমার উৎকণ্ঠাকুল চিত্তের স্থৈর্য্য সম্পাদন করিয়া যাও। আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে আর এ জীবন সত্ত্বে তোমার অবাধ্য হইব না; তুমি অন্ততঃ এই কুমার দুইটীর মুখ চাহিয়া একবার গাত্রোত্থান কর, একবার নয়ন উন্মীলন কর, একবার মাত্র পরিত্যাগের কারণ নির্দ্দেশ করিয়া আমার এই দুরপনেয় সংশয়ের মূলচ্ছেদ কর, নতুবা আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি নিশ্চয়ই তোমার অনুগামী হইব।

 রাজা মহিষীর শোকে অনুতপ্তহৃদয় ও ব্যাকুলিতচিত্ত হইয়া নির্জনে বসিয়া কেবল দিবারাত্রি শোক ও বিলাপ করিয়া কালযাপন করিতে লাগিলেন। রাজকার্য্যের সংস্পর্শপর্য্যন্ত একবারে পরিত্যাগ হইয়া আহারনিদ্রা প্রভৃতি অন্তর্হিত হইল। কিন্তু অপত্যস্নেহের কি অসীম পরাক্রম এমন প্রবল শোককেও পরাভূত করিল, এই বিষম অবস্থাতেও সেই সদ্যজাত সন্তানের প্রাণবিয়োগশঙ্কা তাঁহার অন্তঃকরণে অনুক্ষণ জাগরূক রহিল; তখন আর স্থির থাকিতে না পারিয়া ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক নবকুমারের রক্ষাবিষয়ে মনোনিবেশ করিলেন। বুদ্ধিমান সুচতুর সভাসদ্‌গণের সহিত উপায়চিন্তনে প্রবৃত্ত হইয়া পরিশেষে স্থিরীকৃত হইল, বিশুদ্ধচরিত্রা, মৃদুস্বভাবা, সুরূপা ও সুলক্ষণা একটী নবপ্রসূতা কামিনীকে আনয়নপূর্ব্বক তদীয় হস্তে এই নবকুমারের প্রতিপালনভার অর্পিত হইলে ইহার জীবনরক্ষাবিষয়ে প্রত্যাশাপন্ন হইতে পারেন, নতুবা উপায়ান্তর নাই। যেরূপ পরামর্শ, কার্য্যে তাহাই পরিণত হইল, কথিতরূপ লক্ষণাক্রান্তা একটী নবপ্রসূতিকে আনয়নপূর্ব্বক রাজপুরীর অভ্যন্তরে তাহার বাসস্থান নির্দ্দেশ করিয়া ঐ কুমারটীকে তদীয় হস্তে অর্পণ করিলেন, আর কহিলেন তোমার যখন যে দ্রব্যের প্রয়োজন হইবে দাস দাসীর নিকট প্রার্থনা করিলেই তৎক্ষণাৎ তাহা প্রাপ্ত হইবে। সুকুমারমতি শিশু জননীর বিয়োগে একেবারে বিকলান্তঃকরণ হইয়া অনবরত রোদন করিতেছিল, এক্ষণে ঐ প্রসূতিকে প্রাপ্ত হইয়া স্বীয় গর্ভধারিণীর বিয়োগদুঃখ দিন দিন বিস্মৃত হইয়া তাহাকে নিজ জননীর ন্যায় জ্ঞান করিতে লাগিলেন। ফলতঃ কুমারের সেই বিকাশোন্মুখ কমলকলি সদৃশ মুখারবিন্দ, জননীর জীবননাশসন্তাপে আকুঞ্চিত হইয়াছিল, এক্ষণে সুধাংশুর অংশুসম প্রসূত্যন্তর প্রাপ্তিতে তদীয় স্তন্যরূপ সুধাবর্ষণে তাহার সজীবতা ও প্রফুল্লতা সম্পাদন করিল। যখন দেখিলেন নবকুমারের বয়োবৃদ্ধির সহিত শরীরও বদ্ধিত হইতে লাগিল, তখন মহারাজ ঐ বিষয়ে এক প্রকার নিরুদ্বেগ হইলেন। কিন্তু কেমন বিধাতার বিড়ম্বনা তথাপি সুস্থচিত্ত হইতে পারিলেন না। নরপতির মনে মহিষীশোক পুনর্ব্বার নবভাবে আবির্ভূত হওয়াতে সর্ব্বদা জ্বলিতাঙ্গ হইয়া অন্যের গতি প্রতিরোধপূর্ব্বক নির্জনপ্রদেশে বিষণ্ণমনে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন।

 এদিকে নবকুমারের অন্নপ্রাশনের কাল উপস্থিত দেখিয়া পুরোহিতগণ সমবেত হইয়া ভূপতিসন্নিধানে উপনীত হইলেন। বীরজিৎসিংহ পুরোহিতবর্গের একত্রে সমাবেশ দেখিয়া, আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহারা কহিলেন; মহারাজ! দ্বিতীয় রাজকুমারের অন্নাশনের কাল অতীত হয় বলিয়া সম্বাদপ্রদানে আসিয়াছি; এক্ষণে জ্যোতির্বিদ্‌পণ্ডিত দ্বারা রাশির নিরাকরণ ও দিনাবধারণ করুন।

 মহারাজ পুরোহিতদিগের বাক্যে অনুমোদন করিয়া তাঁহাদিগকে বিদায় দিলেন। আর অনর্থ কাল হরণ না করিয়া মুখ্যকালের মধ্যে ক্রিয়া সম্পাদনার্থ নরেন্দ্র রাজসভায় উপস্থিত হইয়া জ্যোতির্ব্বিদ্‌পণ্ডিতদিগকে আনয়ন করিয়া শুভকর্ম্মের দিনাবধারণ, দ্রব্যাদির আয়োজনভার যোগ্যপাত্রে অর্পণ ও নিমন্ত্রণপত্র প্রেরণপূর্ব্বক পূর্ব্বস্থানে গিয়া তদবস্থায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। এমন আহ্লাদের কার্য্য, তথাচ মহারাজের মনে আমোদ সঞ্চার হইল না; তদ্দর্শনে অধীনস্থ রাজন্যবর্গ, মন্ত্রিগণ ও পুরোহিতবর্গ এবং প্রজাপুঞ্জের মনে বিশেষ আক্ষেপ উপস্থিত হইল। তাঁহারা ভূপেন্দ্রের অবস্থা দৃষ্টে রাজ্যের বিশৃঙ্খলা ঘটিবার আশঙ্কায় পরস্পর কহিতে লাগিলেন যে, ভার্য্যান্তর পরিগ্রহ ব্যতিরেকে মহারাজের মনঃস্থির হইবার সম্ভাবনা দেখিতেছি না; দ্বিতীয় রাজকুমারের প্রাশনের পরে পরিণয় প্রস্তাব করাই সদ্যুক্তি বিবেচনা হইতেছে।

 বীরজিৎসিংহ নির্দ্ধারিত দিবসে নান্দিমুখাদি বৃদ্ধি সমাপনান্তে রাশি সম্বন্ধীয় নামাতিরিক্ত যে কালে শুভকর্ম্ম হইল সেই ঋতুনামানুসারে বসন্ত নাম রক্ষা করিলেন। এইরূপে কুমারের অন্নপ্রাশন নির্ব্বাহ হইল; মহারাজ মহিষীর শোক বিস্মৃত হইতে পারিলেন না, তিনি দিবাবিভাবরী সেই প্রণয়িনীর চিন্তায় নিমগ্ন রহিলেন। সভাস্থ সমস্ত ব্যক্তির মতানুসারে প্রধান মন্ত্রী উদয়নারায়ণ ও সভাপণ্ডিত অচ্যুতানন্দ তর্কবাগীশ, এই উভয়ে নরেন্দ্রসমীপে গমন করিলেন। মহারাজ, প্রধান মন্ত্রী ও সভাপণ্ডিতকে সমীপস্থ দেখিয়া আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহারা কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রে নির্দ্দেশ আছে যে, গৃহী ব্যক্তি গৃহশূন্য থাকিলে নানাপ্রকার অনর্থ সংঘটন হয়; অতএব আপনি পুনর্ব্বার দার পরিগ্রহ করিয়া সাংসারিক নিয়মাধীন হইয়া রাজকার্য্যে মনোনিবেশ করুন, নতুবা ঔদাস্য প্রকাশ হওয়ায় নানামতে অনিষ্টসূচনা হইতেছে। আরও দেখুন ইহাও শাস্ত্রের চিরপ্রসিদ্ধ বচন বটে, “সস্ত্রীকধর্ম্মমাচরেৎ” সুত রাং গৃহীব্যক্তি স্ত্রীশূন্য হইলে শাস্ত্রানুসারে ধর্ম্মকর্ম্ম করিতে হইলে সস্ত্রীক হইয়া কার্য্য করাই কর্ত্তব্য; বিশেযতঃ রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ প্রভৃতি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা রাজাদিগের সাধ্য তাহা সস্ত্রীক ভিন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই, সুতরাং নানাকারণে আপনকার বিবাহ করা সর্ব্বতোভাবে উচিত। বীরজিৎসিংহ উদ্বাহের কথায় কোন উত্তর দান না করিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক নীরবে অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে কেবল, হা প্রিয়সি! হা চিত্তরঞ্জনকারিনি! হা প্রাণেশ্বরি! তোমার স্নেহ, দয়া, মমতাতে একেবারে জলাঞ্জলি দিয়া আমি আবার কি পরিণয় আমোদে আমোদিত হইব? আবার কি প্রণয়ডোরে আকৃষ্ট হইব? আমি কি এমনি পাপিষ্ঠ, এমনই নরাধম, এমনি কৃতঘ্ন যে, প্রাণাধিক প্রিয়তমার প্রণয় বিস্মৃত হইয়া, নিতান্ত পামরের ন্যায়, অপরস্ত্রীতে আসক্তি প্রকাশ করিব? পুনরায় বিবাহ করিব? অন্য কামিনীকে মন সমার্পণ করিব? আবার কৌতুকরসে মজিব? তাহা কখনই হইবে না; এবম্প্রকার আত্মভর্ৎসন শ্রবণ করিয়া অনুরোধকারী ব্যক্তিদ্বয় মনে করিলেন; আপাততঃ এ প্রস্তাব করা অনুচিত, এক্ষণে সান্ত্বনাবাক্যে প্রবোধ দান করাই কর্ত্তব্য। এরূপ দুঃখাকৃষ্টচিত্তকে সহসা সুখাস্বাদনের প্রলোভনে প্রলোভিত করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে।

 এইরূপ কল্পনা হওয়াতে উদয়নারায়ণমন্ত্রীর ও তর্কবাগীশের মনে উদয় হইল যে, এক্ষণে প্রতিদিন গতায়াত ও সান্ত্বনাবাদ দ্বারা প্রবোধ দান ভিন্ন মনঃস্থির করিতে পারা যাইবে না। প্রবল প্রবাহে কি মৃত্তিকাবাঁধ রক্ষা পায়, যতই মৃত্তিকা প্রদত্ত হয় সমস্তই খরস্রোতে স্থানচ্যুত ও বিগলিত হইয়া দূরে চালিত হয় তবে ক্রমে ঐ প্রবাহ মন্দীভূত হইলে, তৎকালে পূর্ব্বোপায় উদ্ভাবন করা কর্ত্তব্য। অতঃপর উভয়ে প্রতিদিন ভূপতি সন্নিধানে উপনীত হইয়া মহিষীর গুণানুকীর্ত্তন ও তৎসংক্রান্ত নানাকথার আলাপন দ্বারা প্রবোধ দানে প্রবৃত্ত হইলেন। কি শোক, কি তাপ, কি মনঃপীড়া, কোন ভাবই স্বভাবের সহিত সমভাবে অবস্থিতি করিতে পারে না। নরপতির শোকানল দিন দিন হ্রাস হইতে লাগিল। মহারাজের মনের অবস্থা ক্রমেই সুস্থির হইতে দেখিয়া, সময় বুঝিয়া তাঁহারা উদ্বাহ প্রস্তাব করিলেন। কালগতিকে মনের অবস্থার পরিবর্ত্তণ হইলে বীরজিৎসিংহও তাঁহাদিগের প্রবর্ত্তনায় দার পরিগ্রহ করিতে সম্মত হইলেন। মহারাজ বিবাহ করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন, এই কথা রাষ্ট্র হইবামাত্র চারিদিক হইতে পাত্রীর সম্বাদ আসিতে আরম্ভ হইল। সম্বাদানুসারে ভট্টগণ নানাপ্রদেশে গমন ও কন্যাদিগের প্রতিমূর্ত্তি আলেখ্যে অঙ্কিত করিয়া আনয়ন করিতে আরম্ভ করিল। বীরজিৎসিংহ ঐ সকল চিত্রপটস্থ প্রতিকৃতি নির্জনে বসিয়া সন্দর্শন করিতে করিতে সহসা একটী কন্যার প্রতিমূর্ত্তি তাঁহার নয়ন ও মনের বিনোদকারিনী বলিয়া মনোনীত করিলেন। তদনুসারে তাঁহারই পাণিগ্রহণ মনস্থ করিয়া ঐ আলেখ্যখানি সভাসদ্গণের হস্তে বিন্যস্ত করিলেন। তাঁহারা আলেখ্যঅঙ্কিত প্রতিকৃতির রূপলাবণ্য দর্শনে মনেমনে স্থির করিলেন যে, মহারাজ যোগ্য পাত্রীতে প্রকৃষ্ট হইয়াছেন, অতএব জ্যোতির্ব্বিদ্‌পণ্ডিতগণ দ্বারা ইহার লক্ষণ সকল বিবেচিত হইলে যদি ইনি যোগ্যপাত্রী হন, তবে যথোপযুক্ত পরিণয়ই হইবে। পরে লক্ষণবিদ্‌পণ্ডিত দ্বারা সমস্ত লক্ষণ পরীক্ষিত হইয়া সেই কন্যা সর্ব্বসুলক্ষণা স্থিরীকৃত হইল। তখন তাঁহার একবাক্যে নৃপতিগোচরে বিজ্ঞাপন করিলেন, মহারাজ! এই কুমারী সর্ব্বাংশে আপনকার যোগ্যপাত্রী, কি রূপলাবণ্য, কি আঙ্গিক লক্ষণ, কোন অংশেই নৃপাসনের অননুরূপ নহেন; ইঁহার সকলই শুভলক্ষণ। এমন কি ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, ইনি কস্মিন্‌কালেও দুঃখভাগিনী হইবেন না। ইঁহার ভাগ্যলক্ষ্মীতে আকৃষ্ট হইয়া মহারাজের রাজলক্ষ্মী চিরস্থায়িনী হইবেন; অতএব আমাদের বিবেচনায়, মহারাজের সম্মত হইলে এই কন্যার পাণিগ্রহণ করাই সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।

 ভূপতির অনুমত্যানুসারে পরিণয়দিনাবধারণ হইয়া অচিরাৎ উদ্বাহক্রিয়া সুসম্পন্ন হইল। বীরজিৎসিংহ পূর্ব্বমহিষীশোক একেবারে বিস্মৃত হইয়া অল্পকালের মধ্যে নবপ্রণয়িনীর প্রণয়পাশে দৃঢ়তর আবদ্ধ হইয়া উঠিলেন। ক্রমে রাজার এরূপ অবস্থা ঘটিল যে, একবার মাত্র রাজসভায় পদার্পণ করিয়া ও ক্ষণিক বিরহযাতনায় ব্যাকুলচিত্ত হইয়া, একান্ত ব্যস্ততার সহিত যে কিছু অত্যাবশ্যকীয় কার্য্য, তাহারই অবস্থা বিবেচনায় নিষেধ ও বিধির ব্যবস্থা করিয়াই পুনর্ব্বার অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেন। কোনদিন বা তাহাও সম্পন্ন হইয়া উঠিত না, এক এক দিন এমন ঘটিত যে, কার্য্যগতিকে কালবিলম্বের সম্ভাবনা থাকিলে, মুখভঙ্গীতে বিরক্তিভাব প্রকাশ পাইত। এইরূপে নববধূর প্রণয়ে ও কুমারদ্বয়ের স্নেহে, বীরজিৎসিংহ অপার সুখের এবং অতুল ঐশ্বর্য্যের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হইয়া সতত সানন্দচিত্তে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। কি সাংসারিক, কি বৈষয়িক কোন বিষয়ে তাঁহার আর কোন প্রকার অসুখ রহিল না। নব মহিষীর যৌবনকাল অতীত হইল তথাপি সন্তান সন্ততি হইবার কোন লক্ষণ লক্ষিত হইল না, তদ্দৃষ্টে পুরোস্ত্রীবর্গের মধ্যে ঐ কথার আন্দোলন আরম্ভ হওয়াতে, কর্ণপরম্পরায় রাণীর কর্ণগোচর হইল, তাহাতে রাজমহিষী মনে মনে ক্ষুণ্ণ ও নিতান্ত বিষণ্ণ হইয়া উঠিলেন। সেই অবধি রাজমহিষী আর কেশবিন্যাস করিয়া কবরী বন্ধন করিতে চাহেন না, অপরাহ্নে আর গাত্রে গন্ধদ্রব্য লেপন করেন না, আভরণাদি দ্বারা আর অঙ্গের সৌষ্টব সাধন করেন না পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিচিত্র বসন আর পরিধান করেন না, মহারাজের সহিত আর পূর্ব্বের ন্যায় কৌতুক রসে মগ্ন থাকেন না। নরপতি নবপ্রণয়িনীর পূর্ব্বভাবের বৈষম্য দৃষ্টে মনে মনে শঙ্কিত হইয়া নানা বিষয়ের আন্দোলন করিতে লাগিলেন, পুরস্ত্রীদিগকে মহিষীর মানসিক ভাব পরিজ্ঞানার্থ অনুরোধ করিলেন; সখিভাবাপন্ন সহচরীরা রাজমহিষীর অবস্থা দেখিয়া কারণ জিজ্ঞাসু হইলেন বটে কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া ভূপতির নিকট বিজ্ঞাপন করিলেন যে, আমরা রাজ্ঞীর উন্মনার বিষয় জানিবার জন্য বিধিমতে যত্ন ও চেষ্টা করিলাম, কোনরূপে তিনি মনের কথা ব্যক্ত করিলেন না; বোধ হয় কোন গুহ্য কারণ সংঘটন হইয়া থাকিবে, নতুবা আমাদিগের নিকট গোপন রাখিবার তাৎপর্য্য কি?

 রাজ্ঞীর বিষণ্ণভাব দর্শন করিয়া বীরজিৎসিংহ প্রায় সপ্তাহকাল অন্তঃপুরে গমন করিলেন না; তিনি মনে করিলেন যে, আমি সর্ব্বদা নিকটে থাকিলে প্রিয়ার অসুখবৃদ্ধি হইতে পারে, কারণ দুঃখের সময় আমোদোপকরণ প্রীতিপ্রদ হইতে পারে না; অতএব অন্তঃপুরগমনে প্রতিনিবৃত্ত থাকাই শ্রেয়ঃ; কিন্তু স্ত্রৈণ পুরুষ স্ত্রীর মুখাবলোকন না করিয়া শুদ্ধ সখিদিগের প্রমুখাৎ অবস্থা শুনিয়া আর ক্ষান্ত থাকিতে পারিলেন না। লাবণ্যময়ী কয়েকদিনের পর হৃদয়বল্লভের আগমনে দ্বিগুণতর অভিমানভরে অনর্গল অশ্রুধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ভূপতি প্রেয়সীর তাদৃশী দশা দর্শনে একান্ত খিদ্যমান হইলেন; দশদিক অন্ধকারময় অনুভূত হইতে লাগিল; যেমন পূর্ণচন্দ্র ঘনঘটায় আচ্ছাদিত হইলে পৃথিবী তিমিরাবৃত হয়, নরপতি মহিষীর মুখশশী ম্লান দেখিয়া তদবস্থাপন্ন হইলেন। তিনি ক্ষণকাল নিস্তব্ধভাবে অবস্থিতির পর, নানাপ্রকার সান্ত্বনা বাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক, কথঞ্চিৎ রাজ্ঞীর মনঃ স্থির করিয়া নিতান্ত ব্যগ্রতার সহিত ভাবান্তরের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। রাজমহিষী, প্রাণবল্লভের ব্যাকুলতা ও নির্ব্বন্ধতা দর্শনে, আর ক্ষান্ত থাকিতে না পারিয়া, সরলভাবে মহারাজের গোচরে বিষণ্ণতার কারণ ব্যক্ত করিলেন। বীরজিৎ এইরূপে লাবণ্যময়ীর মনোদুঃখের বৃত্তান্ত শ্রবণগোচর করিয়া আশ্বাসিতবাক্যে তাঁহাকে প্রবোধ প্রদানপূর্ব্বক অন্তঃপুর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কিন্তু অনেক চিন্তা ও বিবেচনার পর সেই প্রদীপ্ত অন্তরাগ্নি নির্ব্বাণের উপায়ান্তর নাই দেখিয়া, পুরস্ত্রীগণকে সাবধান করিয়া দিলেন যে, তাহারা কোনরূপ আর অপুত্ত্রতার দোষ কীর্ত্তন করিয়া কোন কথার আন্দোলন না করে। এইরূপে ভূপেন্দ্র রাজ্ঞীর চিত্তের স্থৈর্য্য সম্পাদন করিয়া, স্বয়ং নিশ্চিন্তভাবে সুস্থমনে পূর্ব্বভাবে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। কিয়ৎকাল অতীত হইতে না হইতে একটী অপ্রতিবিধেয় বিষম অনিষ্ট সংঘটন হইয়া উঠিল। মহারাজ ক্রমে ক্রমে লাবণ্যময়ীর প্রণয়ে বিমুগ্ধ হইয়া এরূপ স্ত্রৈণ হইয়া উঠিলেন যে, তাঁহার আর কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য কি কান্তাকান্ত বিচার জ্ঞান রহিল না; স্ত্রৈণতানিবন্ধন প্রাণাধিক প্রিয়তম পুত্ত্রদ্বয়ের স্নেহ দয়া ও মমতায় বিসর্জ্জন দিয়া ছিলেন। ফলতঃ অপত্যস্নেহপ্রবণহৃদয় ব্যক্তিদিগের দ্বারা কদাচিৎ এবম্বিধ নির্দ্দয়াচরণ ও এ প্রকার নিষ্ঠুর ব্যবহার সম্ভবে না।

 অস্মদ্দেশে স্ত্রীজাতির মধ্যে অনেকেরই এরূপ স্বভাব দেখিতে পাওয়া যায় যে, যদি কোন প্রকার অনিষ্ট শঙ্কা করিয়া কোন ব্যাপারে প্রতিনিবৃত্ত করা যায় তাহারা সেই নিবারণ না শুনিয়া ঐ বিষয়ে আরও ঐকান্তিকতা প্রকাশ করে। সেই স্বভাবের অনুবর্ত্তিনী হইয়া পুরস্ত্রীবর্গ কিছুকালমাত্র, নিস্তব্ধভাবে অবস্থিত থাকিয়া, পুনর্ব্বার পূর্ব্ব বাক্যের আন্দোলন আরম্ভ করিল। এবারে আর সে ভাব নহে, এবারে সুখময় কাননমধ্যে দুঃখানল প্রজ্বলিত করিবার আয়োজন করিতে লাগিল। মহিষীর সহচরীগণ, যাহাতে লাবণ্যময়ীর সপত্নীপুত্ত্রে বিদ্বেষ জন্মে, অহর্নিশ কেবল এইরূপ চেষ্টা করিতে লাগিল। চেষ্টাও যত্নের অসাধ্য কিছুই নাই, কালক্রমে তাহারা আপনাদিগের সেই দুরভিসন্ধি সিদ্ধ করিয়া তুলিল, একদিন দিবাবসানসময়ে লাবণ্যময়ী সহচরীগণে পরিবেষ্টিতা হইয়া উপবিষ্টা আছেন, নানাপ্রকার কথার প্রসঙ্গ হইতেছে, কথায় কথায় রাজ্ঞী কহিলেন, আমার শ্বেতও বসন্তের তুল্য সুকুমারমতি, সুশীল ও সুবোধ বালক আর কাহার নাই, ইহার। দুইটিতে আমাকে কত ভক্তিও শ্রদ্ধা করে, মা মা বলিয়া সর্ব্বদা আমার কাছে কাছে বেড়ায়, উহাদিগকে নয়নের অন্তরালে রাখিতে আমার ইচ্ছা হয় না; উহারা যখন পাঠশালে গমন করে তখন আমি এই রাজপুরী অন্ধকারময় জ্ঞান করি, উহারা দুটি ভাইও দর্শন পাইল এইরূপ ভাব প্রকাশ করে। বাস্তবিক উহাদিগের সেই ব্যবহার দর্শন করিলে নবপ্রসূতা গাভীর অবরুদ্ধ বৎসের মুক্তির ভাব মনোমধ্যে উদয় হয়। যাহাহউক উহাদিগের আচরণে আর আমার সন্তান না হওয়ার খেদ নাই; আমি এত দিন কেবল ভ্রান্তিপ্রযুক্তই আপনাকে নিঃসন্তান জ্ঞান করিয়া মনে মনে বৃথা দুঃখ করিতাম; নতুবা স্বপুত্ত্র অপেক্ষা সপত্নী পুত্ত্র হইতে অধিক সুখী হইতে পারা যায়। আমার শ্বেতটি যেমন কিঞ্চিৎ বয়োধিক, তেমন সুবোধও হইয়াছে, শ্বেত কোন কার্য্যেই আমার অবাধ্য হইয়া চলে না, বসন্ত এই কেবল পঞ্চম বর্ষীয় বালক বই নয়, তথাপি আমার বিরক্তিজনক কোন কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে চায় না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় উহারা দুটি ভাই চিরজীবী হইয়া বাঁচিয়া থাকুক্‌; আর আমার সন্তান না হইলেও তজ্জন্য মনস্তাপ নাই। এখন এই একবৎসর কাল অতীত হইলেই, একাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে শ্বেতের উপনয়ন দিয়াই অমনি মহারাজকে বিবাহের উদ্যোগ করিতে বলিব। আমার নিতান্ত অভিলাষ যে, শ্বেতের বিবাহ দিয়া নব বধূর সহিত ব্যবহার করিয়া সকলকে এই উপদেশ দিব যে, সপত্নী পুত্ত্রে বিদ্বেষভাব না থাকিলে, কত সুখে সংসারধর্ম্ম করিতে পারা যায়। রাজমহিষী প্রফুল্লচিত্তে এই সকল কথার আন্দোলন করিয়া হাস্যকৌতুক করিতেছেন, এমন সময়ে তাঁহার প্রিয় দাসী তরঙ্গিনী সহসা তথায় উপস্থিত হইল।

 তরঙ্গিনী নিতান্ত অসূয়াপরবশ, সে কখন কাহার ভাল দেখিতে পারে না, ইতি পূর্ব্বে তরঙ্গিনী অন্তরালে দণ্ডায়মান থাকিয়া রাজ্ঞীর সমস্ত কথাবার্ত্তা শুনিয়া মনে মনে সাতিশয় বিরক্ত হইয়াছিল, এক্ষণে মনের ভাব গোপন রাখিতে না পারিয়া, রাণীকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ঠাকুরাণি! আজি যে তোমায় অতিশয় প্রফুল্লচিত্ত দেখিতেছি কেন, সন্তান হইবার কোন প্রকার উপায় হইয়াছে নাকি? তরঙ্গিনীর বাক্যে রাজমহিষী এই উত্তর দান করিলেন, পরিচারিকে। আর আমার সন্তানের কামনা নাই; তোমরা ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা কর যে, আমার শ্বেত ও বসন্ত দীর্ঘজীবী হউক, তাহা হইলেই আমি মনের সুখে কাল কাটাইতে পারিব। উহারা যে আমার গর্ভজাত সন্তান নয়, তাহা কি আমার কুমার দুটির মনে একবারও উদয় হয় না। বিধাতা কৃপা করিয়া আমায় যে দুটি অমূল্য নিধি অর্পণ করিয়াছেন, আমি তাহাতেই পরিতৃপ্ত আছি; আর আমার কোন আকাঙ্ক্ষা নাই। এক্ষণে শীঘ্র শীঘ্র শ্বেতের বিবাহ দিয়া একটী নব বধূর মুখাবলোকন করিতে পারলেই আমার মনের সাধ পূর্ণ হয়।

তরঙ্গিনী মহিষীর বাক্য শ্রবণে একবারে চমকিত ও বিস্মৃত হইয়া ললাটে করাঘাত করিয়া কহিলেন, হাঃ পোড়াকপালে! তোমার যেমন বুদ্ধি, যেমন বিবেচনা, উত্তরও তদনুরূপ বটে, পরের ছেলে কখন আপনার হয়? আর ইহা আমি কস্মিন্‌কালেও শুনি নাই যে, সপত্নীপুত্ত্র হইতে বিমাতার সুখ সম্ভোগ হয়। তবে যে, তুমি কি জন্য আশারূপ মৃগতৃষ্ণিকায় বিভ্রান্তচিত্ত হইতেছ, তাহা বলিতে পারি না, বোধ হয় কেবল বিধাতার বিড়স্বনাতেই এরূপ মতিচ্ছন্ন উপস্থিত হইয়াছে। আমরা দেবতাস্থানে মাথা কুঁড়িয়া মরি ও কত মানস করি যে, তোমার গর্ভে একটী সুসন্তান জন্ম গ্রহণ করে; তুমি কি না আমার শ্বেত, আমার বসন্ত, এই করিয়া মর। তোমাকে বিধাতা নিতান্ত বিমুখ হইয়াছেন, তাহাতে শুদ্ধ আমাদের চেষ্টায় কি ফলোদয় হইবে? একটী প্রবাদ আছে, “যার বে তার ধুম্‌ নাই, পাড়া পড়শীর ঘুম্‌ নাই” আমাদেরও ঠিক্‌ সেইরূপ দশা ঘটিয়াছে। তোমার সন্তান হইবে, তুমি সুখ ভোগ করিবে, তাহার জন্যে সদাই আমরা কেবল চিন্তা সাগরে মগ্ন থাকি; তোমার কোন ভাবনা চিন্তা নাই। আমাদের কি? আমরা তোমার দাসী বই ত নয়, তোমার সুখ হইলে যদি সেই সঙ্গে আমাদেরও কিঞ্চিৎ হয় এইমাত্র। যদি বিবেচনা করিয়া দেখ, তবে তোমার সন্তান না হইলে, আমাদের এমন কিছু বিশেষ ক্ষতির সম্ভাবনা নাই; কারণ আমাদের ত চাকরি নিত্য নয়, আজি আছে কালি আবার না থাকিতে পারে। যদি কেবল আমার কথায় মনে প্রত্যয় না জন্মে, তবে রেবতীকে ত বিশ্বাস আছে, তাহাকে ডাকিয়া পরামর্শ করিয়া যাহা কর্ত্তব্য বলিয়া স্থির বোধ হয়, তাহাই না হয় কর; আমি কেবল যাহাতে তোমার পরিণামে ভাল হয়, সেই মন্ত্রণা দিতেছি। রেবতী আমার মতে অনুমোদন করে কি না, তাহাকে একবার বলে দেখ?

 তরঙ্গিনীর বাক্যবিন্যাসে মহিষীর মন অপেক্ষাকৃত বিদ্বেষাকৃষ্ট হইয়া উঠিল। তখন তিনি মনে করিলেন, তরঙ্গিনী যে আমায় এত কথা বলিতেছে, ইহাতে উহার কি স্বার্থ আছে? বিনা স্বার্থে এরূপ ব্যগ্রতা দেখাইবার আবশ্যকতা কি? এইরূপ সাত পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে মহিষীর মনটাও কিছু বিচল হইয়া উঠিল। তখন তিনি মনে করিলেন, যদি উহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া তার আমার প্রতি পূর্ব্বের ন্যায় ভক্তি ও শ্রদ্ধা না করে, তবে তখনকার উপায় কি? হয় ত মহারাজ শ্বেতের হস্তে রাজলক্ষ্মী সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিবেন। সে সময়ে যদি শ্বেত সপত্নীপুত্ত্রবৎ বিদ্বেষপূর্ণনেত্রে সর্ব্বদা আমায় নিরীক্ষণ করে, তাহা হইলে তখন ত আর কোন প্রকার উপায় উদ্ভাবন করিবার সম্ভাবনা থাকিবে না। কিন্তু আবার ইহাও মনে হইতেছে, যদি স্বীয় গর্ভজাত সন্তান স্ববশে না থাকে এবং স্বকীয় জননীর ন্যায় ভক্তি, শ্রদ্ধা কিম্বা আন্তরিক যত্ন না করে, তবে তাহার ত উপায়ান্তর নাই; অতএব সেরূপ স্থলে স্বপুত্ত্র ও সপত্নী পুত্ত্র উভয়ই তুল্য; ফলতঃ আপনাপন ব্যবহার দোষেতেই লোকে পতি কি পুত্ত্রের অশ্রদ্ধেয় হয়। নতুবা সাধু ব্যবহার কিম্বা সদাচরণ দ্বারা কখন কাহার বিরাগভাজন হইতে হয় না। বিশেষতঃ শ্বেত ও বসন্ত শৈশবাবস্থায় মাতৃহীন হইয়াছে, উহাদিগের মনে আমার প্রতি বৈমাত্রেয় ভাব উদয় হইবার সম্ভাবনা নাই। তবে যদি কেহ কুমন্ত্রণা দিয়া বিরাগোৎপাদন করিয়া দেয়, সে স্বতন্ত্র কথা। এইরূপ নানাবিষয়ের আন্দোলন করিয়া, তিনি মনে মনে সংশয়ারূঢ় হইলেন। পরে রেবতীর সঙ্গে পরামর্শ করিয়া কর্ত্তব্য নিদ্ধারণ করা উচিত বলিয়া স্থিরীকৃত হইল। এমন সময়ে সহসা রেবতীকে তথায় উপস্থিত দেখিয়া, রাজমহিষী মনে করিলেন, বিধাতা বুঝি অনুকূল হইয়া আমার মনঃক্লেশ নিবারণ জন্য রেবতীকে আমার সমীপে আনয়ন করিলেন। রেবতী লাবণ্যময়ীর মলিনবদন সন্দর্শনে বিমর্ষভাবের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। মহিষী, রেবতীকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, প্রিয়সখি! তোমরাই আমার প্রিয়সখী, তোমরাই আমার সহচরী, তোমরাই আমার পরিচারিণী, তোমরাই আমার সম দুঃখভাগিনী, তোমরাই আমার পরমহিতৈষিণী, তোমরাই আমার ভাবী সুখ দুঃখের চিন্তাকারিণী, আমি সেই জন্য সমস্ত মনের কথাও অসঙ্কুচিতচিত্তে তোমাদের নিকট ব্যক্ত করিয়া থাকি। ইহাতে আমার মনঃক্লেশও অনেকাংশে হ্রাস হয়। আমি সন্তান না হওয়ায় এত দিন বিষণ্ণমনে তাহার উপায়চিন্তনে প্রবৃত্ত ছিলাম, কিয়দ্দিবস হইল, মহারাজ লোকপরম্পরায় ঐকথা শ্রুতিগোচর করিয়াই নানা প্রকার প্রবোধবাক্যে আমায় সান্ত্বনা করেন, আর আমিও ইদানীং শ্বেত ও বসন্তের সদ্ব্যবহারে বিমুগ্ধ হইয়া সে সকল একবারে বিস্মৃত হইয়াছি। বরঞ্চ, সপত্নীসন্তান বলিয়া দিন দিন বিদ্বেষ পরিবর্দ্ধিত হওয়া দূরে থাকুক্‌, স্নেহ ও মমতার সঞ্চার হইয়া উহাদিগকে স্বীয় গর্ভজাত সন্তাননির্ব্বিশেষে লালন পালন করিতেছি। এক্ষণে আমার অন্তঃকরণ এরূপ স্নেহাকৃষ্ট হইয়াছে যে, উহাদিগের বিপক্ষে কেহ কোন কথা উত্থাপন করিলে, সেই ব্যক্তি আমার বিদ্বেষের পাত্র হইয়া উঠে। বলিতে কি, উহারা সচ্ছন্দে খেয়ে খেলিয়ে বেড়াইলেই আমার সন্তোষ থাকে; যদি কোন দিন কাহারও একটু অসুখ বোধ হয়, তবে আমার মনঃপীড়া উপস্থিত হইয়া থাকে।

 মহিষীর বাক্য শেষ হইলে, রেবতী কহিল, ঠাকুরাণি, এটি অস্বাভাবিক কার্য্য, ইহাতে তোমার প্রশংসা ভিন্ন অযশের সম্ভাবনা নাই, তবে যে, আজি এরূপ বিষণ্ণভাব দেখিতেছি, তাহার কারণ কি? আমার অনুভব হইতেছে, বুঝি মহারাজের সহিত কোন প্রকার কথান্তর উপস্থিত হইয়া তোমার মন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে; তুমি ছল করিতেছ, অথবা কৌশল করিয়া লজ্জাবশতঃ মনের ভাব ব্যক্ত করিতে কুণ্ঠিত হইয়া গোপন রাখিতেছ; কি ঘটিয়াছে স্পষ্ট করিয়া বল। লাবণ্যময়ী আর কতক্ষণ মনের কথা গোপন করিয়া রাখিবেন, স্ত্রীজাতি স্বভাবের বশবর্ত্তী হইয়া সকল কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। সখি রেবতি! মহারাজ এমন কোন কুবাক্য বলেন নাই যে, তাহাতে আমার মনঃদুঃখ উপস্থিত হইবে; আমার শ্বেত এবং বসন্তও এরূপ কোন অন্যায়াচরণ করে নাই যে, তাহাতে আমি দুঃখী হইব; অদ্য তরঙ্গিনী, আমারই হিতের নিমিত্ত যে সকল কথার উল্লেখ করিয়াছে তাহাতেই আমার মনের ও বদনের প্রফুল্লতা নষ্ট করিয়াছে। কাহারও দোষ নাই, হয় আমার অদৃষ্টের দোষ, না হয় আমার বুদ্ধির দোষেই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে; পূর্ব্বে শেষ ভাবিয়া কার্য্য না করিলেই পরিণামে মনস্তাপ ও গতানুশোচনা, উপস্থিত হইয়া মর্ম্মান্তিক যাতনা প্রদান করে। রেবতি! এক্ষণে তুমি যদি ইহার একটা উপায় উদ্ভাবন করিতে পার, তবে ত সব দিক্‌ বজায় থাকে, নতুবা ভাবী বিষয়ের ভাবনাতে আমার শরীর ও বল ক্ষয় হইয়া পরিশেষে জীবন নষ্ট হইবার সম্ভাবনা। দেখ রেবতি, তরঙ্গিনী, আমারই যাহাতে ভাল হয়, ভবিষ্যতে আমি যাহাতে সুখী হইতে পারি, সেই উপদেশই দিয়াছে; কেবল মনের স্বভাবানুসারে নানা বিষয় আবির্ভূত হইয়া আমাকে মর্ম্মবেদনা প্রদান করিতেছে। এখন আমি কি করি, কোন পথইবা অবলম্বন করিয়া চলি; তচ্চিন্তাতে অহরহ হৃদয় দগ্ধীভূত হইতেছে। রেবতি, তুমি অতি বুদ্ধিমতী, সকলেই তোমার বুদ্ধি ও বিবেচনার প্রশংসা করিয়া থাকেন, তুমি অবশ্যই ইহার একটা সদুপায় করিতে পারিবে? অতএব আমার সঙ্কটের কথা বলি শ্রবণ কর। রেবতী ইতি পূর্ব্বে তরঙ্গিনীর মুখে সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছিল, তথাচ এক্ষণে যেন বিন্দুবিসর্গও জানেন না, এরূপ ভান করিয়া নিতান্ত ব্যগ্রতার সহিত কহিলেন, রাজ্ঞি! কি ঘটিয়াছে বল, শুনিয়া যদি পারি ত, একটা উপায় করিবার চেষ্টা করিব। রাজমহিষী লাবণ্যময়ী, দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, আমি এক্ষণে কোন দিক রক্ষা করি? সপত্নীসন্তানদিগকে স্বপুত্ত্রনির্বিশেষে একান্ত যত্ন ও স্নেহ সহকারে প্রতিপালন করি, না উহাদিগের প্রতি বিদ্বেষ ভাব প্রকাশ করিয়া, যাহাতে মহারাজেরও বিষদৃষ্টিতে পতিত হয় তদুপায় চিন্তনে সতত রত থাকি; ইহার অন্যতর স্থির করিতে পারিতেছি না। লাবণ্যময়ীর কথা শেষ হইলে, রেবতী কহিল মহারাণি! আমরা তোমার দাসী, সুতরাং সততই তোমার সুখাভিলাষী, যাহাতে তুমি চিরকাল সুখে থাকিতে পার, তাহাই আমরা সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিয়া থাকি; সুতরাং ভাবী মঙ্গলামঙ্গল পরিদর্শনে ব্রতী থাকিতে হয়। আবার স্নেহের এরূপ স্বভাব যে, স্নেহাম্পদের ভাবী অবস্থার অমঙ্গলই অগ্রে দৃষ্টিপথে পতিত হয়; নতুবা শ্বেত আর বসন্ত ইহারা অতিশয় শান্তস্বভাব, কস্মিন্‌কালেও যে, উহারা আমাদের কোন প্রকার অনিষ্ট সংঘটন করিবে তাহার কোন সম্ভাবনা নাই; যদি রাজ্য ও ঐশ্বর্য্য প্রাপ্ত হইয়া তোমার দাসী বলিয়া আমাদের প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার করিতে উদ্যত হয়, তৎকালে দাসীবৃত্তি পরিত্যাগ করিলেই সেই অত্যাচারের হস্ত হইতে পরিত্রাণ হইবে। তবে কি জান, “যার খাই, তার গাই” তোমার কাছে আছি, যাহাতে তোমার হিত হইবে, অগ্রসূচী সে কথা জানাইতে হইবে; তারপর তোমার হিত তুমি বুঝিতে পার ভাল, নচেৎ কষ্ট পাইবে, তাহাতে আর আমরা দোষী হইব না। লাবণ্যময়ী কহিলেন, কিসে যে, তোমরা আমার অনিষ্ট সূচনা করিতেছ, আমি একাল পর্য্যন্ত তাহার কোন সূত্র অন্বেষণ করিয়া পাইলাম না। সেই অনিষ্ট বিশেষরূপে হৃদয়ঙ্গম না হইলে, আমি কদাচ ঐ মাতৃহীন বালক দুটীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ কি উহাদের কোন প্রকার অনিষ্ট চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইতে পারিব না। তোমরা যদিও আমার হিত চেষ্টা করিতেছ, তথাপি আশু আমার নিকট তাহা অহিতরূপে প্রতীয়মান হইতেছে; বলিতে কি, আমার প্রাণ অপেক্ষা, শ্বেতও বসন্ত অধিক প্রিয়। লাবণ্যময়ীর এরূপ বাক্যপরম্পরা শুনিয়া রেবতী কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া কহিল, তোমার ইচ্ছা! আমাদের কি? আমরা নয় তোমার কাছে আর না থাকিব। যখন শ্বেত বয়ঃপ্রাপ্ত হইবে, মহারাজ তাহাকে রাজ্যভার দিবেন, যখন সমস্ত আধিপত্য ও ঐশ্বর্য্য তাহার হস্তগত হইবে, যখন শ্বেতের স্ত্রী রাজমহিষী হইবে, তখন কি আর আমরা দাসীর দাসী হইয়া থাকিব, তাহ কদাচ হইবে না; “যাক্‌প্রাণ থাকুক মান” আমরা এ প্রাণ থাকিতে তাহা সহ্য করিতে পারিব না। লাবণ্যময়ী, রেবতীর উত্তেজক বাক্যে ঈর্ষ্যার বশবর্ত্তী হইয়া কহিতে লাগিল, আমি কি তোমাদের অমতে কখন কোন কার্য্য করিয়া থাকি না করিব। তবে কি জান, কোন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে একবার বিশেষরূপে বিবেচনা ও আত্মীয় স্বজনের সহিত পরামর্শ করিয়া কর্ম্ম করা কর্ত্তব্য। রেবতী কহিল, তবে এখন আর কি; শ্বেত ও বসন্তের উচ্ছেদসাধনে তৎপর হও, নচেৎ ভদ্রস্থতা নাই।

 লাবণ্যময়ী একেত মহারাজের দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী, আদরপেয়ে একেবারে মস্তকে চড়িয়া বসেছেন, সর্ব্বদাই কেবল আত্মগরিমায় প্রমত্ত ও সৌভাগ্যগর্ব্বে গর্ব্বিত; অহঙ্কারে পৃথিবীকে যেন একেবারে সরা খানার ন্যায় জ্ঞান করেন; তাহাতে আবার পরিচারিকাগণের উদ্দীপক বচন পরম্পরা, একেত স্ত্রীজাতির মন সহজে অসূয়াপরবশ, তাহাতে যদি কোন প্রকার দোসর যুটিয়া উঠে, তবে কি আর রক্ষা থাকে? ঐ যে রেবতী কহিয়াছে শ্বেতের স্ত্রী রাজমহিষী হইবে, তুমি তাহার অধীন হইবে, এমন কি দাসীর ন্যায় হইয়া থাকিতে হইবে; আমরা কি দাসীর দাসী হইব? তাহা কদাচ হইবে না। এই কথাতে লাবণ্যময়ীর চিরসঞ্চিত ঈর্ষ্যানল প্রবলবেগে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। যেমন বিবরস্থিত কুণ্ডলিত ফণী অকস্মাৎ অঙ্গস্পর্শে একবারে ফণা উত্তোলিত ও ফোঁস ফোঁস শব্দে গর্জ্জন করিয়া উঠে, রাণী তদ্রূপ শ্বেত ও বসন্তের প্রতি একবারে খড়্গহস্ত হইয়া উঠিলেন। ক্রোধে সর্ব্ব শরীর কাঁপিতে লাগিল, তখন তাঁহার সেই ভাব দেখিয়া অন্যান্য লোকে এই মনে করিয়াছিল, বুঝি তিনি শ্বেত ও বসন্ত কর্ত্তৃক তিরস্কৃত ও অবমানিত হইয়াছেন। মধ্যে মধ্যে রাজমহিষীর মুখ হইতে এই কথা বিনির্গত হইতে লাগিল, “কিঃ!! আমি শ্বেতের স্ত্রীর দাসী হইয়া নিতান্ত অনার্য্যের মত জীবন ধারণ করিব? ইহা কখনই হইবে না"। যাহা হয় অবিলম্বে একটা উপায় উদ্ভাবন করিতে হইবে। শ্বেত ও বসন্তের প্রতি যে, রাণীর স্বপুত্ত্রনির্বিশেষে স্নেহ, দয়া ও মমতা ছিল, তাহা এককালে অন্তর হইতে অন্তর্হিত হইল। অধুনা কিরূপে তাহারা দেশত্যাগ অথবা জীবনত্যাগ করে সর্ব্বদা কেবল তচ্চিন্তাতেই কাল অতিবাহিত হইতে লাগিল। লাবণ্যময়ী, আশু অভীষ্ট সাধনের কোন উপায় দেখিতে না পাইয়া, তরঙ্গিনীকে উপস্থিত ব্যাপারের উত্তরসাধিকা জানিয়া কহিলেন, তরঙ্গিনি। যদি তুমি আমাকে বিষলাড্‌ডু প্রস্তুত করিয়া দিতে পার, তাহা হইলে আমি তদ্দ্বারা ভাবী উৎপাতের নিঃশেষ করিয়া ফেলি। তরঙ্গিনী, রাজমহিষীর বাক্য শ্রবণে চকিত ও বিস্মিত হইয়া কহিল ঠাকুরাণি, তুমি এবম্বিধ দুঃসাহসিক দস্যুবৎ ব্যবহারে প্রবৃত্ত কখনই হইবে না। এইরূপ কার্য্য ঘটিলে আমাদের কাহারও পক্ষে ভদ্রস্থতা নাই। মহারাজ, নিশ্চয়ই এই দুরভিসন্ধির অন্তস্তত্ব জানিতে পারিবেন, তাহা হইলে হয় ত আমাদের জীবনদণ্ডরূপ প্রায়শ্চিত্ত বিধান করিয়া ক্ষান্ত হইবেন। অতএব আমার কথা শুনুন্‌, এরূপ দুরূহ ব্যাপারে কোন রূপেই প্রবৃত্ত হইবেন না; এ পরামর্শ সৎপরামর্শ নহে; ইহাতে অযশ, অপমান, কলঙ্ক না হয় ত জীবনদণ্ড পর্য্যন্ত পরিণামফল হইতে পারে। রামায়ণে শুনিয়াছ ত? রাজা রামচন্দ্র, একজন সামান্য রজকের মুখে জানকীর অযশঃ শুনিয়া, একান্ত বিকলান্তঃকরণ হইয়া প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তমা সীতাকে নির্ব্বাসন দণ্ড দিয়াছিলেন; আমার বিবেচনায় রামচন্দ্রের অপেক্ষা স্ত্রীতে মমতা মহারাজের অধিক নহে। তুমি যদি নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া থাক, তবে রেবতীর সহিত মন্ত্রণা ও যুক্তি করিয়া যাহা সৎ বলিয়া স্থিরীকৃত হয়, সেই পথ অবলম্বন করিয়া চলাই শ্রেয়ঃ। কারণ বিজ্ঞ ব্যক্তিরা এরূপ নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন যে, অধৈর্য্য হইয়া কোন কার্য্য করিবে না। মন যখন নিতান্ত বিচল হয়, তৎকালে কর্ত্তব্যাবধারণ করিতে হইলে, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, দূরদর্শী, আত্মীয় স্বজনগণের সহিত মন্ত্রণাপূর্ব্বক কার্য্য করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। বাস্তবিক এ সকল কার্য্য এরূপ সতর্কতা ও সাবধানতার সহিত সম্পাদন করা উচিত, যাহাতে সকল দিক্‌ বজায় থাকে এবং লোকসমাজে নিন্দাস্পদ ও ঘৃণাস্পদ না হইতে হয়। তরঙ্গিনীর কথায়, লাবণ্যময়ী আপাততঃ কিঞ্চিৎ ধৈর্য্য হইলেন বটে, কিন্তু সেই দুরভিসন্ধি একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। তরঙ্গিনীকে কহিলেন, তবে অচিরে রেবতীকে আমার সমীপে ডাকিয়া দাও; তাহার সহিত যুক্তি করিয়া যাহা সৎ বলিয়া বোধ হয়, সত্বরে তাহার একটা উপায় করা যাউক। কি জানি মনকে ত বিশ্বাস নাই; পাছে আবার ঐ পামরদিগের প্রতি পূর্ব্বেরন্যায় স্নেহ সঞ্চার হয়, তাহা হইলে কি আর অভীষ্টসিদ্ধিতে যত্ন থাকিবে? আমার অন্তঃকরণ ঐ চিরবদ্ধ বৈরীদিগের স্নেহে যেরূপ আকৃষ্ট হইয়া ছিল, সে কথা আর কি বলিব; এত যে বিদ্বেষ জন্মিয়াছে তথাপি ঐ হতভাগাদিগের জন্যে মনটা এক একবার কান্দিয়া উঠে। তোমরা প্রথমে যখন এই কথার প্রস্তাব কর, তখন তোমাদিগকেও শত্রুজ্ঞান করিয়াছিলাম; বলিতে কি, এতদূর পর্য্যন্ত মনে উদয় হইয়াছিল যে, মহারাজের নিকট সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া তোমাদিগকে বিলক্ষণ প্রতিফল প্রদানপূর্ব্বক পুরী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিব। কারণ সে সময়ে আমার মনে এতদূর বিশ্বাস ছিল যে, শ্বেতও বসন্তকৃত ভবিষ্যতে অনিষ্ট হইবার কথাও প্রাণে সহ্য হইত না। এখন আমার চৈতন্য হইয়াছে, দেখিলাম বিপৎপাতসময়ে তোমরাই আমার সহায়, এই আপতিত বিপজ্জাল হইতে কেবল তোমরাই আমাকে মুক্ত করিলে, তোমাদের তুল্য হিতৈষিণী আমার আর জগতে কে আছে? যখন এই অলক্ষিত বিপৎপাত তোমাদিগের কর্ত্তৃক লক্ষিত হইয়াছে, তখন তোমরাই ইহার প্রতিবিধানের উপায় করিয়া দিবে। তবে আর বিলম্ব কর না, রেবতীকে বলিয়া যাহাতে শীঘ্র শত্রুহস্ত হইতে পরিত্রাণ হয় তাহার উপায় স্থির কর।

 সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় যে, বন্ধ্যানারীগণ প্রায়ই এক একটি মার্জ্জার প্রতিপালন করিয়া, অপত্যাভাবদুঃখের হস্ত হইতে কথঞ্চিৎ মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। লাবণ্যময়ীও সেই দেশপ্রচলিত নিময়ের অনুবর্ত্তিনী হইয়া একটি বিড়াল পুষিয়া ছিলেন। এক্ষণে সেই পালিত মার্জ্জারটি উপস্থিত দুরভিসন্ধি সাধনের প্রধান উপকরণ হইয়া উঠিল। রাজমহিষী, স্বীয় প্রিয় পরিচারিকা রেবতী ও তরঙ্গিনীর সহিত যুক্তি ও মন্ত্রণাপূর্ব্বক সপত্নী পুত্ত্রদিগকে মহারাজের বিরাগভাজন করিবার নিমিত্ত এক এক দিন এক এক অদ্ভূতকাণ্ড উপস্থিত করিতে লাগিলেন।