বিষয়বস্তুতে চলুন

সেই সব শহীদেরা/একটি শহীদ ও কয়েকটি ক্লীব

উইকিসংকলন থেকে

একটি শহীদ ও কয়েকটি ক্লীব

সুদীর্ঘ তেত্রিশ বৎসরকাল রাজত্বে সিপিএম সরকার একটি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। মানুষ অমানুষ, না-মানুষ নির্বিশেষে সবাইকে তারা করে তুলেছে বামপন্থী। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন লাল বাংলার ঘেয়ো কুকুর, কালো পাঁঠা, সাদা গরু এমনকি শেয়াল, শকুন ও কিছু কিছু ছুঁচোও ভীষণ পরিমাণে বামপন্থী। দোহাই, হাসবেন না, হাসির কথা হচ্ছে না, এটা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য। এ মাটি প্রগতিশীলতার দুর্জয় ঘাঁটি, বিপ্লবের সূতিকাগৃহ। প্রতি মুহূর্তে বিপ্লব পয়দা হয় মোদের সুমহান বঙ্গভূমে। কখনো কফি হাউসের টেবিলে কখনো বা অরকুটের ফোরামে, তবে মাঝে মাঝে গর্ভপাতও হয়ে থাকে আর গর্ভস্রাবের সঙ্গে যে নোংরা আবর্জনা বেরিয়ে আসে বোঝা গেল কলকাতা বইমেলা চলাকালীন একটি ঘটনার পর। বামমার্গী প্রগতি, সংস্কৃতির মচ্ছোব বইমেলা-২০১০ অনেক ভজন কেত্তন করে সাঙ্গ হলো। খুবই দুঃখের কথা ময়দান নিয়ে পুরোনো মড়াকান্না ও ন্যাকামিটা এবার দেখা যায়নি। আসলে ঝানু ব্যবসায়ী ও খাবার দোকানীরা বুঝেছেন বিক্রিবাট্টা নতুন মাঠেও যথেষ্ট ভালো সুতরাং ওসব ছেঁদো নস্টালজিয়ায়, যাকে নিন্দুকেরা আদিখ্যেতা বলবেন তাতে আক্রান্ত না হলেও চলবে।

 গত ২রা ফেব্রুয়ারি রেজিস্টার্ড পত্রিকা বাংলা পিপলস্ মার্চের সম্পাদক, প্রকাশক স্বপন দাশগুপ্তের মৃত্যু ঘটল। প্রকৃতপক্ষে সুপরিকল্পিতভাবে তিলে তিলে তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ভয়াবহ UAPA আইনের প্রথম শিকার তিনি। সম্ভবত ভারতে প্রথম। ৬ই অক্টোবর ২০০৯ তাঁকে Unlawful Activities Prevention Act (UAPA), ধারা 18/20/39 এবং I.P.C. ধারা 121/121A / 124A অনুযায়ী গ্রেপ্তার করে ২৮ দিন ধরে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালানো হয়। অ্যাজমার রুগি ও আগে থেকে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও সরবরাহ করা হয়নি প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র এমনকি যথেষ্ট ওষুধ! জেলবন্দির মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্যতম দৃষ্টান্ত এই মৃত্যু। কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতায় গুরুতর অসুস্থ স্বপনবাবুকে জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত SSKM হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় যখন, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওই দিনই বিকেলে বইমেলা লিটল ম্যাগাজিন চত্বর জুড়ে USDF নামক ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা ধিক্কার কর্মসূচী গ্রহণ করে। বিভিন্ন স্তরের সচেতন মানুষ ও গণসংগঠনকে নিয়ে বের হয় প্রতিবাদ মিছিল। ঘটনাচক্রে লেখক অর্থাৎ এই অধম তখন সেখানে উপস্থিত ছিল, সূচনায় যে কথাগুলো লিখেছি তা আমার সেদিনের অভিজ্ঞতার মর্মান্তিক ফসল মাত্র। অনেক সাধারণ মানুষ যেমন যেচে গ্রহণ করেছেন কালো ব্যাজ তেমনি কিছু অতিবিপ্লবীর সাহসের নমুনা দেখে হতবাক হতে হয়েছে। নতুনরূপে জানলাম এসব প্রবলতম বিপ্লবীদের। ভ্যারাইটি আছে বটে। হিসেব করে পা ফেলতে হয় তাদের। সিপিএম হারার আনন্দে দুটো বিড়ি বেশি খেয়ে ফেলেন তবে উদ্বাহু হন না কারণ তৃণমূল জিতেছে। ইরাক, আফগানিস্থান, নিকারাগুয়া মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সই সংগ্রহ হয়। সাম্রাজ্যবাদের গুষ্টির তুষ্টি করেন অথচ কাশ্মীর প্রসঙ্গ এলেই কেমন যেন এলিয়ে পড়েন। কেউবা এককালে কাঁচা আগুন (নাকি বেগুন!) কচ্ মচ্ করে চিবিয়ে খেয়েছেন এখন উঞ্ছবৃত্তি করে পেট চালান। মহাভারত হয়ে যাবে তাই মাত্র দুটো উদাহরণ রাখবো এবং সেই সমস্ত অমেরুদণ্ডীদের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের জবাব দিয়ে ইতি টানবো এই বিরক্তিকর রচনার।

 নয়া গণতন্ত্রের পূজারী একদল আছেন যারা চারু মজুমদারের ছবিতে ফুলমালা টাঙিয়ে বই বিক্রি করেন। জানিনা অঞ্জলি দেন কিনা। আপনারা বলতে পারবেন? নানা ধরনের বৈপ্লবিক বইপত্র বিক্রিবাটা হয়। এঁরা তো কালো ব্যাজ দেখেই চমকে গেলেন। “কে স্বপন? অঃ বিনা চিকিৎসায়, রিয়েলি? ওকে। রেখে যান”। রেখে এলাম এই ভরসা থেকে হয়তো পরবেন কোনো একসময়। কোনো একদিন হয়তো বা ওদের অবকাশ হবে ধিক্কার জানাবার। ঢুকলাম এবার বিজ্ঞানমনস্কের দরবারে। এরা হেতুপন্থী। সবকিছুর পশ্চাতে হেতু অন্বেষণ যাদের প্রধান কাজ। দোষটা আমাদেরই কেন যে ‘অহেতুক’ এসব কর্মসূচীটুচী করে থাকি! ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে বাছা বাছা কিছু প্রশ্ন এলো। যথারীতি “কে স্বপন? কিভাবে জানা গেল এটা হত্যা? কেনই বা বিশ্বাস করব?” পরিশেষে “যাকে চিনিনা তার জন্য এসব পরবো কেন?” লে ঠেলা, ঘাবড়ে গিয়েও কিছু বলার চেষ্টা করেছিল অনেকে। কেউ বা বিরক্ত, বিব্রত। আমি সেদিন ছিলাম নীরব দর্শক, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে উত্তর দেওয়া জরুরী বলে মনে করি। যাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না তার জন্য কালো ব্যাজ পরা যায় কি? যায় যায়, Zনতি পারোনা। হে হেতুবাদীর দল সোমালিয়া, জিম্বাবোয়ের অপুষ্ট, অনাহারক্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ শিশুদের জন্য যখন বেদনায় উদ্বেল হও, গুজরাট গণহত্যায় মৃত মানুষদের লাগি তোমাদের কুম্ভীরাশ্রু যখন শতধারায় বয়ে যায় তখন কি জোর করে বিশ্বাস করাতে হয় এগুলি হত্যা ছিল? ইজরায়েলী হানায় নিহত, গৃহহারা অসংখ্য নিষ্পাপ শিশুদের ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়ই চেনো না। তবে?

 বাপু হে, আমরা জানি রাষ্ট্রের বুলেট যে কলমের দিকে ধেয়ে আসেনা, সে কলম বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে ঝুঁকির গন্ধ আছে। এও জানি ঝুঁকির দিকটি সযত্নে এড়িয়ে, ধরপাকড়ের মাহেন্দ্রক্ষণে ভেগে পড়েই তোমরা বিপ্লবী হয়েছ। নইলে যে শাসকশ্রেণীর সাংস্কৃতিক ঠিকাদারী পাওয়া যায় না।

 কিন্তু কে এই মানুষটি; কে স্বপন দাশগুপ্ত, যার জন্য আমাদের শোকগ্রস্ত হতে হবে? সত্যিই তো, ইনি এমন কোনো মহান কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন না যাঁর মৃত্যুতে লক্ষ টাকার ফুল, আলো, গ্লোসাইন-বোর্ড সহযোগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হবে। হবে ব্যয়বহুল পারলৌকিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, শোকবার্তা আসবে দেশ-বিদেশ থেকে, নিদেনপক্ষে ‘চব্বিশঘণ্টা’ চ্যানেলে চ্যানেলে বেজে যাবে ইণ্টারন্যাশনাল।

 স্বাধীনতা সংগ্রামী শিশির কুমার দাশগুপ্ত ও মনিকা দাশগুপ্তের সন্তান স্বপন দাশগুপ্তের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৯শে এপ্রিল দিল্লিতে। পিতা ছিলেন অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত। স্বপন দাশগুপ্তর পথচলা শুরু ৬৬-র বিখ্যাত খাদ্য আন্দোলন থেকে, তরুণ বয়সে নকশালবাড়ির দুরন্ত আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে গ্রেপ্তার হন। প্রমাণাভাবে মুক্তি পান। CPI(ML) গোষ্ঠী ভাঙনের পর ১৯৭৩ সালে যোগ দেন মহেন্দ্র সিং গোষ্ঠীর সাথে। চিনতে পারছেননা বুঝি? আচ্ছা আপনারা তো আশুতোষ মজুমদারকে চেনেন। যাদবপুরের সেই মেধাবী ছাত্রটি যে কিনা কবিতা লিখত, যে কিনা বন্ধুদের বাঁচাতে বুক পেতে দেয় মিলিটারীর উদ্যত রাইফেলের সামনে। ১৯৭১-র ১০ই মার্চ আশু শহীদ হন। অ্যাই! চিনেছেন তো। স্বপন দাশগুপ্ত ছিলেন সেই দ্রোহকালের উজ্জ্বল তরুণ আশুর অভিন্নহৃদয় সাথী। প্রথমদিকে ১৯৭২ সালে জয়েন করেন Central Exise এ উড়িষ্যায়, ‘৭৪-এ সব ছেড়ে আত্মনিয়োগ বিপ্লবী রাজনীতিতে। ‘৮০ সালে পিতার মৃত্যুর পর জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত অকৃতদার মানুষটির উপর অনেক দায়িত্ব এসে পড়ে। কোর্ট টাইপিস্ট থেকে বোম্বে ডাইং-এর স্টেনো এমন অজস্র কাজ তিনি করেছেন তবু আপোষের পথে কখনো হাঁটেননি। বরাবর যুক্ত থেকেছেন বামপন্থী বিভিন্ন গণসংগঠনের সাথে। বন্দীমুক্তি আন্দোলন থেকে শুরু করে টালিনালা বস্তি উচ্ছেদ বিরোধী সংগ্রামে তিনি ছিলেন প্রথম সারির কর্মী অথচ প্রচারবিমুখ। ২০০৪ সালে আবার গ্রেপ্তার হন। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও নিয়মিতভাবে তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে বাংলা পিপলস্ মার্চ, চালিয়ে গেছেন সম্পাদনার কাজ, র‍্যাডিকাল প্রকাশনী একা হাতে। কালা আইনের গিলোটিনে মাথা রেখেও কলম ছাড়েননি।

 তবু কমরেড দাশগুপ্ত তো কোনো চে’গুয়েভারা নন যে তাঁর মৃত্যু সখের বিপ্লবীদের অপরাধী করে দেবে। তথাকথিত ভদ্রজনমণ্ডলী বা কোনো ভাঁড় কবিও “অনবরত দেরী হয়ে যাচ্ছে” বলে কেঁউ কেঁউ করবেন না। নাহ্, তাঁর এবং তাঁর মতো অসংখ্য শহীদের বীরগাথা রচনা করবে না ভাড়াটে কলমবাগীশ বা আত্মরতিসর্বস্ব ক্লীবের দল।

 কিন্তু —

 শ্রমিকের কলে, খনিতে, কারখানায়, মাঠে, ময়দানে, কামারশালায়, কৃষকদের পর্ণকুটীরে, অখ্যাত চারণকবির কণ্ঠে আপনা আপনিই তাদের চিন্তা-চেতনা গান হয়ে ছড়িয়ে পড়বে মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে বিছন হয়ে ভেসে যাবে পাখির মুখে মুখে, দেশ হতে দেশান্তরে।

“মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ হলো জীবন।
সে জীবনও সে পায় মাত্র একবার, কাজেই সে
তার জীবন এমনিভাবে ব্যয় করবে যেন মরবার
সময় সে বলতে পারে আমার সমস্ত শক্তিসামর্থ্য
পৃথিবীর মহত্তম কাজের জন্য দান করেছি।
সে কাজ—মানব সমাজের মুক্তি”
(ইস্পাত: নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি)

 মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী, কে তাকে আটকাবে। তবে তার তাৎপর্য ভিন্ন ভিন্ন। ঠিক এমন মৃত্যুর ওজনই হিমালয় পর্বতকে চ্যালেঞ্জ জানায়। হুঙ্কার দিয়ে বলে “তফাতে থাক্” ৷

এই মুহূর্তে, আগস্ট-২০১০