সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/টাইমনের উপাখ্যান

উইকিসংকলন থেকে
R. D. SORNOKAR, ENGR
৩২৭

এথেন্স নগরীয় টাইমন্‌।

টাইমনের উপাখ্যান।


 এথেন্স নগরে টাইমন্ নামা ধনবান বদান্য এক ভূম্যধিকারী বাস করিতেন। দানশৌণ্ডতার সম্ভম প্রকাশে তাঁহার নিরন্তর অনুরাগ ছিল। অপরিমিত সম্পত্তির আশু ক্ষয় সম্ভাবনা না থাকাতে মুক্ত হস্তে অনবরত ধন বিতরণ করিতেন। তাঁহার বদান্যতায় দীন হীন অনাথ জনের উপকার ব্যতীত ভাগ্যধর মহৎ লোকেরও বিশেষ কার্য্য দর্শিত সুতরাং আপামর সাধারণ সকলে তাঁহার অনুগত হইয়া অধীনতার শৃঙ্খল বহন করিতে অনুরাগী হয়। যে সকল ব্যক্তিরা বহু ভােক্তা, তাহারা প্রায় প্রতিদিন তদীয় নিকেতনে নিমন্ত্রিত হইত এবং এথেন্স নগরে উপস্থিত ধনার্থি লােকদিগের নিমিত্ত তাঁহার ভবন অবারিত দ্বার ছিল ইহাতে অহরহ কত লােক তদীয় আগারে গমনাগমন করিত সংখ্যা করা যাইতে পারিত না। ফলতঃ টাইমনের দানশীলতা ও উদার চরিত্রে এথেন্স নগরের আবাল বৃদ্ধ সমস্ত লােক সাতিশয় প্রীত হইয়াছিল এবং সকলেই তাঁহার উপাসনা করিয়া কৃতকার্য্য হইবার প্রত্যাশা করিত। যে সকল লােক চাটুকার, সর্ব্ব বিষয়ে কেবল প্রিয় বাক্য প্রয়ােগ পুরঃসর প্রতিপালকের ভাবে গদ্গদ হওত চিত্তানুবৃত্তি করে তাহারা অসৎ প্রবৃত্তি প্রত্যক্ষ নিরীক্ষণ করিয়াও প্রভুর অপ্রিয় বােধে ব্যক্ত করে না। বিদূষক লােকেরা অকারণ বিদ্বেষ ও নিন্দা করণে নিয়ত রত হইয়া থাকে বটে কিন্তু মহাত্মা টাইমনের সুশীলতা ও মহৌদার্য্য দর্শনে তাহাদের স্বভাবের পরিবর্ত্ত হইয়াছিল। তাঁহার সম্ভাষণে এবং অজস অর্থ বিতরণে পরিতুষ্ট হইয়া তদীয় মনোরঞ্জন নিমিত্ত তাহাদিগকে তাঁহার ভাবে চলিতে হইত সুতরাং অসৎ ভাব মনোেমধ্যে লব্ধাস্পদ হইতে পারিত না।

 টাইমন্ বিদ্যাবান্ ব্যক্তি দিগের যথেষ্ট সমাদর করিতেন এবং বিদ্যার বিষয়ে উৎসাহ প্রদানে কোন অংশে পরাঙ্মুখ হইতেন না। কোন কবি নূতন কাব্য রচনা করিয়া যদি সাধারণ সমীপে প্রকাশের মানস করিতেন তাঁহার নামে স্বীয় গ্রন্থ উৎসর্গ করিবামাত্র অনায়াসে মানস সফল করিতে পারিতেন। চিত্রকরেরা বিচিত্র কোন চিত্র প্রস্তুত করিয়া যদিস্যাৎ তাঁহার সমীপে গমন পূর্ব্বক দর্শাইত তৎক্ষণাৎ সমুচিত পুরস্কার প্রাপ্ত হইত। বহু মূল্য বসন ভূষণ নির্ম্মাণানন্তর তত্তদ্ব্যবসায়িরা যদিস্যাৎ অন্যত্র তাহা বিক্রয় হওয়া দুর্ঘট বোধ করিত উদার চরিত্র টাইমনের সম্মুখে উপস্থিত করিলেই অভীষ্ট লাভ করিতে পারিত। টাইমন এইরূপে সর্ব্বপ্রকার ব্যবসায়ির পুরস্কার করাতে সকলে স্ব২ ব্যবসায়ে যথেষ্ট উৎসাহান্বিত এবং তাঁহার আলয় বিবিধ বিচিত্র দ্রব্যে পরিপূর্ণ হইতে লাগিল। কিন্তু তাঁহার বদান্যতার খ্যাতি ক্রমশঃ সর্ব্বত্র প্রচারিত হওয়াতে চতুর্দিক্ হইতে যেমন দীন দরিদ্র লোকে শরণাকাঙ্ক্ষী হইয়া আসিতে আরম্ভ করিল মিথ্যা চাটুকার ও ধূর্ত্ত ব্যবসায়ি ব্যক্তি ব্যূহও অর্থ গৃধ্নুতা প্রযুক্ত তদ্রূপে আগমন করিতে লাগিল। এই সকল ব্যক্তি ভবনের চতুর্দ্দিকে দণ্ডায়মান হইয়া নানা প্রকার প্রশংসা ও স্তব স্তুতি করিত। তাহাদের চাটু বচন নিরন্তর শ্রুতিগোচর হওয়াতে ক্রমে টাইমন্ তাহাতে অনুরাগী হইতে লাগিলেন। ঐ সকল চাটুবাদী মিথ্যা স্তাবক মণ্ডলী আপনাদের অর্থাকাঙ্ক্ষা পূর্ত্তি নিমিত্ত ঈশ্বর বলিয়া তাঁহার স্তব করত কহিত আপনকার বদান্যতা প্রভাবে আমরা জগজ্জীবন সমীরণেরও সেবা করিয়া প্রাণ ধারণ করিয়া থাকি

 কতিপয় ভদ্র সন্তান স্ব২ বিভব অবিবেচনা পূর্ব্বক ব্যয় করিয়া অবশেষে ঋণগ্রস্ত হইয়াছিল। তাহারা ঋণাপকরণে অক্ষমতা প্রযুক্ত উত্তমর্ণের অভিযোগে কারারুদ্ধ হইলে পরোপকারী টাইমন্ তাহাদের ঋণ পরিশোধ পুরঃসর অবরোধ মোচন করেন। এই উপকৃত ব্যক্তিরা তাঁহার প্রিয় চিকীর্ষায় নিরন্তর প্রশংসা করিত। তাঁহার সহিত প্রণয় নিবদ্ধ হইলে ক্রমে আপনাদের ন্যায় অপরিমিত ব্যয়ে তাঁহার প্রবৃত্তি জন্মাইতে লাগিল। যাহারা স্বকীয় ধনে স্নেহ শূন্য তাহাদের পরকীয় বিত্তে মমতা হইবার সম্ভাবনা কি? সর্ব্বদা দুষ্প্রবৃত্তি দিয়া ক্রমশঃ অপব্যয়ে প্রবর্ত্ত করাইল। মাংসাশি দলের মধ্যে বেন্তিদিয়স্ নামা এক ব্যক্তি অবিহিত ব্যয়ে ঋণী হইয়া শরণাপন্ন হইলে দয়ালু টাইমন্ কারুণ্যগুণে ভূরি বিত্ত প্রদান পুরঃসর তাহাকে তৎক্ষণাৎ ঋণ হইতে উদ্ধার করিলেন।

 টাইমনের মুক্তহস্ততা দেখিয়া তাঁহার নিকট ধন লাভের আশয়ে কত ব্যক্তি কত প্রকার কৌশল করিত তাহার সংখ্যা হয় না। অনেকে উপহার দিয়া তদ্বিনিময়ে বহু মূল্য পারিতোষিক লাভ করিত। মহানুভব টাইমন তাহাদের সৌভাগ্যক্রমে আনীত উপায়ন মধ্যে যদি কোন সামান্য দ্রব্যের প্রশংসা করিতেন তাহা হইলে ঐ ব্যক্তিরা পর দিবস পনর্ব্বার তথাবিধ সামগ্রী আনয়ন পুরঃসর শিষ্টতা ও বিনয় সহকারে নিবেদন করিত এবং পুনশ্চ বহু গুণ পারিতোষিক প্রাপ্ত হইত। মহাত্মা টাইমন্ বদান্যতায় কাহার নিকট পরাভব স্বীকার করিতে ইচ্ছা করিতেন না যৎকিঞ্চিৎ গ্রহণ করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার বিনিময়ে প্রচুর প্রদান করিতেন। একদা লুসিয়স নামা এক ব্যক্তি তাঁহার প্রমুখাৎ একটা শ্বেতাশ্বের প্রশংসা শ্রবণ করাতে রৌপ্যালঙ্কারে ভূষিত চারিটী শুভ্র ঘোটক তাঁহার নিকট উপঢৌকন স্বরূপে প্রেরণ করে তাহাতে অবিলম্বে তাহার বিস্তার লাভ হয়। অন্য এক সময় লুকলস নাম অপর এক ব্যক্তি তাঁহার মুখে শীকারী কুক্কুরের গুণানুবাদ শুনাতে দুইটী তাদৃক্ কুকুর দিয়া প্রচুর পারিতোষিক প্রাপ্ত হইল। সরল স্বভাব বদান্য টাইমন্ উপহার দাতাদিগের প্রতারণা পূর্ব্বক ধনাপহরণের মানস তর্ক করিতেন না সুতরাং প্রতারক মণ্ডলী উপায়ন প্রদান দ্বারা সম্ভ্রম প্রকাশ চ্ছলে যৎসামান্য বা নগণ্য পদার্থ সম্মুখে আনয়ন করত সর্ব্বদাই বহু মূল্য পারিতোষিক লাভ করিত।

 টাইমনের ঔদার্য্য দর্শনে শঠ দিগের শাঠ্য পূর্ব্বক ধন গ্রহণে কত প্রকারে প্রবৃত্তি হইতে লাগিল ইয়ত্তা হয় না। তিনি ঔদার্য্য প্রযুক্ত প্রিয় ভাষায় শীঘ্র সন্তুষ্ট হন এতদ্বিষয় অবগত হইয়া অনেক লোক তদীয় সদনে গমন পুরঃসর বিবিধ দ্রব্যাবলোকনে তৎ প্রত্যাশায় অকস্মাৎ গুণানুবাদ করিত। তাহাদের প্রশংসা বচনে অজ্ঞান হইয়া আপনার অধিকৃত বা ক্রীত সেই দ্রব্য তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে পুরস্কার স্বরূপে প্রদান করতেন। এক সময় কোন প্রতারক ভূম্যধিকারী তাঁহার সুরঙ্গ একটী তুরঙ্গ নিরীক্ষণ করিয়া অনর্গল তাহার গুণানুবাদ করিতে লাগিল তাহাতে তিনি মনে২ বিবেচনা করিলেন এ ব্যক্তি অবশ্য এই ঘোটক লাভ করিবার আশয়ে প্রশংসা করিতেছে অতএব তাহাকে তদণ্ডে সেই অশ্ব দান করিলেন। বন্ধুবর্গ মধ্যে কে কৃত্রিম কে অকৃত্রিম এতদ্বিষয়ে অনুসন্ধান লইতেন না, বাহ্যে সদ্ব্যবহার ও বাক্যেতে প্রীতির নিদর্শন প্রকাশ হইলেই সন্তুষ্ট হইতেন। অপর দান বিষয়ে ঈদৃশ অনুরাগ ছিল যে অনেক রাজ্য থাকিলে যাচককে তাহাও প্রদান করিতে সঙ্কুচিত হইতেন না।

 টাইমনের বিপুল বিত্ত কেবল প্রতারক প্রিয়বাদি লোকদের সন্তোষার্থ ব্যয়ীকৃত হইত এমত নহে সদ্ব্যয় করিয়াও সতত সৎপ্রতিষ্ঠা লাভ করিতেন। এতদ্বিষয়ের একটা নিদর্শন এই, এক সময়ে তাঁহার এক জন কিঙ্কর এথেন্স নগরীয় কোন ধনির কন্যার রূপ লাবণ্য অবলোকনে তাহার প্রাণিগ্রহণার্থ ব্যাকুল হয়। ধনী স্বীয় দুহিতার বিবাহ নিমিত্ত আপন অপেক্ষা অধিক ধনবান্ ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় পাত্রের অনুসন্ধান করিতেছিলেন, ভৃত্যের সহিত তনয়ার বিবাহ দিবেন কেন? অধিকন্তু পরিণয়ের পণ বহুল বিত্ত নিরূপণ করিয়াছিলেন সুতরাং ভৃত্য প্রেমাস্পদ প্রমদা লাভের সম্ভাবনা বিরহে উন্মত্ত প্রায় হইল। টাইমন্ পরম্পরায় তদ্বিষয় অবগত হওয়াতে প্রচুর ধন প্রদান পুরঃসর সেই ধনি তনয়ার সহিত তাহার পরিণয় করিয়া দেন। টাইমনের ধনাপহারিগণের মধ্যে তাঁহার বন্ধুবর্গই অধিকাংশ। তাহারা চাটু বচনে মৌখিক মিত্রতা প্রদর্শন করিত কিন্তু তিনি তাহাদের মনোগত ভাব তর্ক করিতেন না স্বয়ং সরল স্বভাব এ প্রযুক্ত তাহাদিগকে তাদৃক্ জ্ঞান করত ক্রমাগত এক প্রকার সৌহৃদ্য ব্যবহার করিতেন এবং তাঁহার সন্নিধানে নিয়ত অবস্থান পূর্ব্বক স্তব স্তুতি করিলে তাহা শুনিতে মহা আহ্লাদিত হইতেন। কৃত্রিম মিত্র গণের ব্যাজ স্তুতি নিমিত্ত তাঁহার মনে ক্রমে২ এরূপ অহমিকা আশ্রয় করিল যে চিন্তা করিতে লাগিলেন আমার সদাচরণে ইহারা সন্তুষ্ট আছে এবং আমার হিতার্থ সকলে অনুরাগী। পরন্তু তাঁহার ঔদার্য্য গুণে খলের খলতার অনুসন্ধান না হওয়াতে তাহারা কেবল তদীয় বিত্ত ব্যয় করত তাঁহাকে নিঃস্ব করিতে লাগিল। বহু২ ব্যক্তি তাঁহার কুশল বৃদ্ধি চ্ছলে নিরন্তর মদ্যপান ও বিবিধ সুস্বাদ দ্রব্যাহারে নিরত হইল সুতরাং ধনসম্পত্তি ক্ষয় হইতে লাগিল।

 টাইমন স্বীয় কোষাধ্যক্ষকে কুবের তুল্য বোধ করিয়া নিরন্তর ধন বিতরণের আদেশ করিতেন আয়াবস্থিতির প্রতি নেত্রপাত করিয়া ঐ রূপ ব্যয় চিরকাল প্রচলিত থাকিবে কি না এ বিষয় বিবেচনা করিতেন না, কেবল দীয়তাং ভুজ্যতাং শব্দ প্রয়োগ করত আমোদেই থাকিতেন। তাঁহার ধন বাস্তব অক্ষয় নহে সুতরাং বহু ব্যয়ের সম্মুখে ক্রমে বিনষ্ট হইবে বিচিত্র কি? অজস্র বিশ্রাণনে সম্পত্তি ক্রমশঃ অল্পীয়সী হইয়া পরিক্ষীণআ হইতে লাগিল। তিনি স্বয়ং তদ্বিষয় অবগত হইলেন না, পারিষদ বর্গের মধ্যেও কেহ সহসা বিজ্ঞাপন করিল না ফলতঃ যাহারা তাঁহার নয়নাবরোধ পুরঃসর অর্থ মোষণ করিবার সংকল্প করিয়াছিল তাহারা অপব্যয়ে ধন ক্ষয়ের কথা কহিয়া সচেতন করিয়া দিবে সম্ভাবনা কি? তাঁহার ধনধ্যক্ষ ফ্লাবিয়স্ যখন দেখিলেন কোষ শূন্য হয় আর বিলম্ব নাই তখন স্বয়ং আয় ব্যয় স্থিতির একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া এক দিন নির্জনে প্রভুর সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক সজল নয়নে নিবেদন করিলেন প্রভো নিরন্তর ধন বিতরণের আমোদে কাল হরণ করিতেছেন একবার আয়াবস্থিতির বিষয় অবলোকন করিতে আজ্ঞা হউক। হে মহাশয় ভৃত্যের পক্ষে এবম্বিধ ব্যবহার ধৃষ্টতার লক্ষণ বটে কিন্তু আপনার যে অবস্থা হইবার উপক্রম দেখিতেছি তাহাতে নিবেদন না করিলে চলে না। কিন্তু টাইমন্ তাহার ঐ কথায় মনোেযোগ করিলেন না অন্য বিষয়ের প্রসঙ্গ করিয়া তদুপলক্ষে কথোপকথন করত বিদায় করিলেন কেননা বদান্য ব্যক্তিরা ধন ক্ষয়ের কথা শ্রবণে প্রায় বধির হয়। প্রভু আত্ম বিষয় অবলোকন করেন না। কোষাধ্যক্ষ কি করিবেন আপন মনে খিন্ন হইয়া যৎপরোনাস্তি বিষাদ করিতে লাগিলেন। এক দিন যে সময় পাত্রে সমিত সহচর গণের আমোদ প্রমোদে প্রভুর সদনে কোলাহল এবং তাহাদের পীতাবশিষ্ট সুরা ইতস্ততঃ পতিত হইতেছিল তৎকালে কোষাধ্যক্ষ তথায় উপস্থিত হওয়াতে ধন ক্ষয়ের কারণ প্রত্যক্ষ নিরীক্ষণ করত মহা বিষন্ন হইলেন। কিয়ৎ ক্ষণ চিন্তা করিয়া মনে২ কহিতে লাগিলেন স্বামী কি উন্মত, ধনের কি বিচিত্র মহিমা, প্রভু ধন প্রভাবে এই সমস্ত জনের ধন্যবাদাস্পদ হইয়াছেন কিন্তু নিঃস্ব হইলে স্তুতি বা প্রশংসাবাদ কোথায় অন্তর্ধান হইবেক। স্বামী এক্ষণে এ সকল লোককে যথেচ্ছ আহার প্রদান করিতেছেন এতন্নিমিত্ত ইহাদের প্রশংসা ধ্বনির এই কোলাহল কিন্তু নিঃস্বাবস্থায় ইহারা শীতকালীন নীহার পতনে মক্ষিকা পুঞ্জ তুল্য কোথায় অন্তর্হিত হইবেক তাহার নিদর্শন হইবে না।

 টাইমন কোষাধ্যক্ষের আবেদনে অগ্রে মনোযোগ করেন নাই বটে কিন্তু অবিলম্বে ঈদৃশী অবস্থা ঘটিয়া উঠিল যে তাহার কথায় বাধির্য্য অথবা অবিশ্বাস অবলম্বন করিতে আর সক্ষম হইলেন না। অর্থের প্রয়োজন হওয়াতে কোষাধ্যক্ষকে আজ্ঞা করিলেন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া মুদ্রা সংকলন কর। তাহাতে ধনাধ্যক্ষ বিনয় পুরঃসর নিবেদন করিলেন প্রভো ভূমি সম্পত্তির অধিকাংশ বিক্রীত হইয়া গিয়াছে তন্মূল্যেই এত দিন ব্যয় ভূষণ করিলেন এক্ষণে যৎকিঞ্চিন্মাত্র অবশিষ্ট আছে তাহা বিক্রয় করিলে আপনার ঋণ পরিশোধও হইবেক না। টাইমন্ এতৎ শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন কি আমার আর ভূমি নাই এথেন্স অবধি লেসিদিমন পর্য্যন্ত সমুদায় ভূমি যে আমার অধিকৃত ছিল। ধনাধ্যক্ষ উত্তর করিলেন মহাশয় আপনার সকল সম্পত্তিই প্রচুর পরিমাণে ছিল কিন্তু কোন ধন অপরিমিত বা অক্ষয় নহে এই ব্রহ্মাণ্ডেরও সীমা আছে আপনি যদিস্যাৎ সমস্ত জগতের অধিকারী হইতেন নিমেষ মধ্যে তাহাও বিতরণ করিয়া ফেলিতেন।

 টাইমন্ ধনধ্যক্ষের প্রমুখাৎ আপন নির্দ্ধনতার সংবাদ প্রাপ্ত হওয়াতে যদিও ক্ষণকাল বিস্ময়ব্যাকুল হইলেন তথাপি মনোমধ্যে এই বলিয়া প্রবোধ প্রদান করিতে লাগিলেন আমি কখন বুদ্ধি পূর্ব্বক দুষ্কর্মে ধন ব্যয় করি নাই যদিও অপব্যয় করিয়া থাকি কিন্তু কদাপি দুষ্ক্রিয়া করি নাই ফলতঃ বন্ধবর্গের পরিতোষ ও উপকার নিমিত্তই অনুদিন ধন বিতরণ করিয়াছি অতএব কোষাধ্যক্ষ কোষ শূন্য হইবার সমাচার দিয়া রোদনারম্ভ করিলে তাঁহাকে শান্ত্বনা করিতে লাগিলেন ধন নাই বলিয়া কেন বিষাদ কর। আমার অনেক মিত্র আছেন তাঁহারা সর্ব্বদা আম হইতে যথেষ্ট উপকার প্রাপ্ত হইয়াছেন অবশ্য আমার এই দৈন্যাবস্থায় আনুকূল্য করিয়া অভাব মোচন করিবেন। ফলতঃ মনেই আশা করিলেন যে নির্ধনতার প্রতীকার নিমিত্ত অন্য উপায় অবলম্বনের প্রয়োজন নাই বন্ধুবর্গের নিকট ঋণ যাচ্‌ঞা করিলেই তাঁহারদের হইতে সাহায্য হইবেক। অনন্তর লুসিয়স্ লুকলস্ এবং সেম্প্রোনিয়স্ নামক কতিপয় ব্যক্তি তাঁহার নিকট যথেষ্ট লাভ করাতে পরম মিত্র ভাবিয়া তাহাদের সন্নিধানে দূত পাঠাইয়া দিলেন। অপর বেন্তিদিয়স নামা এক জন মিত্রের ঋণ শোধন পুরঃসর তাহাকে কারাগার হইতে মুক্ত করিয়াছিলেন পরম্পরায় শুনিতে পাইলেন সে ব্যক্তি আপন পিতার পরলোক হওয়াতে পৈত্র প্রচুর বিভব প্রাপ্ত হইয়াছে অতএব তাহা হইতে এই দুঃসময়ে বিশেষ আনুকূল্য পাইবার প্রত্যাশা করিলেন এবং তাহার সমীপে এক জন কিঙ্কর প্রেরণ পূর্ব্বক কহিয়া পাঠাইলেন অসময়ে আপনাকে যে সমস্ত মুদ্রা প্রদান করিয়াছিলাম এক্ষণে আমার দুঃসময়ে প্রত্যর্পণ করুন। পূর্ব্বোক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট কিয়ৎ সংখ্যক মাত্র মুদ্রা প্রার্থনা করতে মনে২ আশা করিতে লাগিলেন আবশ্যক মতে যাচ্‌ঞা করিলে তাঁহারা আমার পূর্ব্বোপকার স্মরণ করিয়া অবশ্য সাহায্য পাঠাইয়া দিবেন।

 পরন্তু টাইমনের দূত লুকলস্ সন্নিধানে গিয়া উপস্থিত হইলে ঐ ব্যক্তি তাহাকে দেখিয়া মনে করিল কল্য নিশাভাগে স্বপ্নে রৌপ্য পাত্র দেখিয়াছি বোধ হয় স্বপ্ন সত্য হইল পরম বন্ধু টাইমনের দূত অবশ্য তদ্রূপ সামগ্রী উপহার আনিয়া থাকিবে কিন্তু যখন বার্ত্তাবহ প্রভুর বৃত্তান্ত বিজ্ঞাপন পূর্ব্বক মুদ্রা প্রার্থনার কথা কহিল তখন আপনার বন্ধুত্ব ব্যবহার কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল। সে মিত্রের আনুকূল্যার্থ কোন প্রকার ঔৎসুক্য প্রকাশ না করিয়া দূতের নিকট এই বলিয়া আক্ষেপ করিতে লাগিল আমি তোমার প্রভুর ভাবি অমঙ্গল পূর্ব্বেই অনুধাবন করিয়াছিলাম তাঁহাকে শুদ্ধ ঐ বিষয়ে সচেতন করিয়া দিবার নিমিত্ত মধ্যাহ্ণে ভোজন কালে তাঁহার আগরে গমন করিতাম এবং সায়ং কালে আহারাদির সময়েও একত্র বসিয়া ব্যয়লাঘব নিমিত্ত মন্ত্রণা দিতাম কিন্তু তিনি সৎপরামর্শ গ্রহণ করেন নাই সদুপদেশেও মনোযোগ দেন নাই এক্ষণে তাহার ফল ভোগ করুন। এই ব্যক্তি এবম্প্রকারে পাকতঃ স্বীকার করিল বটে যে টাইমনের নিকট ধন প্রাপ্ত হইয়াছিল কিন্তু সৎপরামর্শ প্রদান নিমিত্ত কদাপি গমন করিত না তাহা হইলে এক্ষণে তদনুরূপ ব্যবহার করিত। এখন ভৃত্যকে এই বলিয়া বিদায় করিল তোমাকে কিছু পারিতোষিক দিব তুমি আপন প্রভুর নিকট গিয়া মিথ্যা করিয়া বল আমার দেখা পাইলে না।

 অপর লুসিয়সের সমীপে যে দূত গমন করিয়াছিল সেও অকৃতকার্য্য হইয়া প্রত্যাগমন করিল। ঐ ব্যক্তি টাইমনের ভবনে নিরন্তর পলান্নাদি বিবিধ সুখাদ্য পুষ্টিকর আহার করিয়া সবল হইয়াছিল এবং তাঁহার বদান্যতার প্রভাবে প্রচুর ধন সঞ্চয় করিয়াছিল প্রেষ্যের প্রমুখাৎ তাঁহার দৈন্যের কথা শ্রবণ করিয়া সন্দেহ প্রযুক্ত আদৌ তাহাতে বিশ্বাস করিল না পরে দূতের সটীক বচনে মনোেযোগ করাতে যখন তাঁহার নিঃস্বতা প্রতীত হইল তখন কাপট্যাবলম্বন পূর্ব্বক খেদ করিয়া কহিতে লাগিল হায় মহাত্মা টাইমন দুরবস্থায় পতিত হইয়াছেন আমি কি পাপাত্মা তাঁহার দুঃসময়ে আনুকূল্য করিতে পারিলাম না। ওহে বার্ত্তাবহ আমি এখনি তোমার প্রভুর প্রার্থনা পূর্ণ করিতাম কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ তাহাতে অক্ষম হইলাম, কল্য বহুমূল্যের একটা বস্তু ক্রয় করিয়াছি তাহাতে তাবৎ ধন আবদ্ধ হইয়াছে। আমার অতিশয় দুরদৃষ্ট, উপকারি মহাত্মার সন্তোষ প্রদানে কিঞ্চিন্মাত্র সামর্থ্য হইল না।

 অতএব যে সকল ব্যক্তি এক পাত্রে ভোজন করে তাহারাও মিত্র হয় না। প্রিয়ম্বদ ধূর্ত্ত লোকের স্বভাব এই সম্পদ সময়ে মৌখিক মৈত্রী প্রদর্শন পূর্ব্বক কেবল আপন অভীষ্ট সিদ্ধ করে কিন্তু বিপদে বাক্য দ্বারাও উপকার করে না। এই লুসিয়ম্ বিপন্ন হইয়া টাইমনের শরণাপন্ন হইলে তিনি জনকবৎ পরম স্নেহে প্রতিপালন করেন এবং আপনার ধনাগার হইতে বিপুল বিত্ত প্রদান পুরঃসর ঐ ব্যক্তির মনোহর অট্টালিকা নির্মাণ করিয়া দেন ও সকল সময়ে সর্ব্ব বিষয়ে আনুকূল্য করেন কিন্তু এক্ষণে প্রতিপালকের বিপদ বৃত্তান্ত অবগত হইয়াও প্রত্যুপকার করণে উন্মুখ হইল না। আঃ কৃতঘ্নতা কি ভীষণ পদার্থ, এ পাপাত্মা তাদৃশ উপকার প্রাপ্ত হইয়া এক্ষণে কতিপয় মুদ্রার প্রার্থনাও অগ্রাহ্য করিল। টাইমন তাহাকে যে প্রকার দান করিয়াছিলেন তাহার সহিত তুলনা করিলে এক্ষণকার ঐ প্রার্থনা যৎসামান্য। বদান্য পুরুষ তাদৃশ দানে লজ্জা বোধ করিয়া থাকেন কিন্তু কি আশ্চর্য্য তাহা দিয়া প্রত্যুপকার করিতেও মানস হইল না অবলীলা ক্রমে মিথ্যাচ্ছলে বঞ্চনা করিল।

 সেম্প্রোনিয়স্ ও অন্যান্য যে ব্যক্তির প্রতি কৃত উপকার স্মরণ করিয়া আনুকূল্য প্রার্থনা হয় তাহারাও টাইমনের দৈন্য দশা শ্রবণে তৎ প্রতি হতাদর হইয়া উপেক্ষা করিল। অধিকন্তু টাইমন আপনার শেষ দশায় বেন্তিদিয়স্ নামা যে ব্যক্তিকে অর্থ দান পূর্ব্বক তদীয় দুরবস্থার সময় সাহায্য করিয়াছিলেন সে ব্যক্তি এক্ষণে পৈতৃক বিভব লাভে মহা ধনী হইয়াছিল সেও তাহার আনুকূল্য করণে উন্মুখ হইল না।

 সম্পদ সময়ে যে টাইমনের সহিত সমাগম ও সহবাস নিমিত্ত লোকে মহা২ অনুরাগ প্রকাশ করিত অধুনা ধন ক্ষয়ে দৈন্য দশা হওয়াতে তাঁহার সহিত দৈবাৎ সাক্ষাৎ হইলে আলাপ করিতেও বিরক্ত হইতে লাগিল। অপর সৌভাগ্য সময়ে যাহাদের রসনা হইতে সদাশয় এবং মুক্তহস্ত বলিয়া প্রশংসাবাদ অনর্গল নির্গত হইত ইদানীং তাহারা ব্রীড়াশূন্য হইয়া তাঁহাকে উন্মত্ত নির্বোধ বলিয়া মুক্তকণ্ঠে নিন্দা করিতে লাগিল। অথচ তিনি তাহাদের সংসর্গ ও প্ররোচনাতেই উন্মত্ততাদির কার্য্য করেন। অপর এক্ষণে তাঁহার ভবনে কেহ ভ্রমক্রমেও পদার্পণ করিতে উৎসুক হইল না। পথিকেরা পূর্ব্বে পুরী প্রবেশ পূর্ব্বক পানীয় পান করত কতই আমোদ প্রমোদ করিত এখন নিকট দিয়া গমনাগমন করিয়াও তৎপ্রতি নেত্রপাত করে না। কিয়দ্দিন অগ্রে তাঁহার আলয় ভোক্তাদের কোলাহলে সতত শব্দায়মান হইত এক্ষণে উত্তমর্ণ গণের চীৎকার শব্দে ভীষণ হইয়া উঠিল। মহাজনেরা কেহ আপনার প্রাপ্য মুদ্রা আদায় নিমিত্ত অঙ্গীকার পত্র, কেহ বন্ধকী পত্র, কেহ বা কুষীদ গণনার তালিকা করতলে লইয়া অবিশ্রান্ত তর্জ্জন আরম্ভ করিল। অতএব টাইমনের পক্ষে নিজালয়ও কারালয় স্বরূপ হইয়া উঠিল কেননা তথায় অবস্থানে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ হইতে লগিল। অন্য ধনিকগণ তাহাকে যে সকল ঋণ দান করিয়াছিল তাহার নিমিত্ত বাটী আসিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল। তিনি কি প্রকারে তাহাদের ঋণ হইতে পরিত্রাণ পাইবেন কোন উপায় দেখিতে পাইলেন না।

 টাইমন এই দুরবস্থায় পতিত হইয়া বন্ধু বান্ধব সকলের অনালাপ্য হইলে মনোমধ্যে যৎপরোনাস্তি সন্তাপিত হইলেন এবং কৃতঘ্ন মিত্রদিগের ভর্ৎসনা করণাশয়ে এক দিন কৌশল করিয়া আপন ভবনে মহাভোজের আয়োজন করিলেন। তাঁহার এই দৈন্য দশায় পূর্ব্ববৎ ভোজের সমারোহ দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হইল কিন্তু পূর্ব্বালাপিত ভোক্তা ও কুলীনবর্গ নিমন্ত্রিত হইবামাত্র আহ্লাদ পূর্ব্বক গমন করিল। যে লুসিয়স, লুকলস ও বেন্তিদিয়স কিয়দ্দিন হইল দৈন্য দশা শুনিয়া মৈত্রীভাব ত্যাগ করিয়াছিল তাহারাও ভোজের আয়োজনে তদীয় ধন সম্পত্তি অক্ষয় বিবেচনা করিয়া পুনর্বার পরম মিত্রতা প্রকাশ করিতে আসিল। কিন্তু আপনাদের মনে এই বলিয়া বিলাপ করিতে লাগিল আমরা অতি মূর্খ, মহানুভব টাইমনের ভাব বুঝিতে পারি নাই। ইনি দৈন্য দশাগ্রস্ত হন নাই, কেবল আমাদের প্রণয় পরীক্ষা নিমিত্ত কপটতা পূর্ব্বক নিঃস্বতা প্রকাশ করিয়া আনুকূল্য চাহিয়াছিলেন। হায়২ কি কুবুদ্ধির কর্ম্ম করিয়াছি, সে সময় যদিস্যাৎ উপকার করিতে উন্মুখ হইয়া মিত্রতা প্রদর্শন করিতাম তাহা হইলে এত দিন কত প্রকারে তাঁহার বদান্যতায় আপনাদের অভীষ্ট সিদ্ধ করিয়া লইতে পারিতাম। অতএব নিকটে আসিয়া মনঃ ক্ষোভ ও অপত্রপা প্রকাশ পূর্ব্বক প্রত্যেকে বিজ্ঞাপন করিল মহাশয় ইতিমধ্যে আপনার দূত একবার আমার সমীপে আনুকূল্য করিবার কথা কহিতে গিয়াছিল দুর্ভাগ্য বশতঃ আমার হস্তে সে সময় অর্থ না থাকাতে মহোপকারি মহাশয়ের প্রত্যুপকার করিতে পারি নাই, অনুগ্রহ প্রকাশ পুরঃসর অপরাধ, মার্জ্জনা করিবেন। টাইমন তাহাদের কাপট্য ব্যবহার এক্ষণে বুঝিতে পারিয়াছিলেন অতএব আপনিও কপট ভাবে সুললিত বচনে বলিলেন আঃ সামান্য বিষয়ের জন্য আপনারা সঙ্কুচিত হইতেছেন কেন? কি কথা বলিয়া পাঠাইয়াছিলাম আমার মনেও নাই। পরন্তু অন্তঃকরণ মধ্যে এই বিবেচনা করিতে লাগিলেন অহো মানবগণ সম্পদ্ ঋতুর আশ্চর্য্য বিহঙ্গ। এই সকল লোক আমার ব্যসনের কথা শুনিয়া আলাপ করণেও পরাঙ্মুখ হইয়াছিল এক্ষণে ভোজের আয়োজন ও ধন সম্পত্তির প্রভা দেখিয়া পুনর্ব্বার পূর্ব্ববৎ মিত্রতা প্রকাশ করিতেছে। তৃষিত চাতক যদ্রূপ সজল জলদের প্রতি ধাবমান হয় নির্বারি বারিদের দিকে দৃক্‌পাতও করে না ইহারাও তদ্রূপ আমার নির্ধনতার সংবাদে বিমুখ হইয়া এক্ষণে ধনবত্তার নিদর্শনে ব্যগ্রতা সহকারে মিলিত হইতেছে। অনন্তর যাবতীয় নিমন্ত্রিত ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত হইলে সুশ্রাব্য তূর্য্য ধ্বনি আরম্ভ হইল এবং অভ্যবহারের দ্রব্য সামগ্রী পরিবেশিত হইতে লাগিল। উপস্থিত লোকদিগের মধ্যে কেহ২ ভোজন পাত্র অবলোকন করিয়া আপনার অন্তঃকরণ মধ্যে কহিতে লাগিল টাইমন নিঃস্ব হইয়াছেন শুনিয়াছিলাম, কি প্রকারে বহু ব্যয় সাধ্য এতাদৃশ ভোজের আয়োজন করিলেন? কেহ২ কহিল আমার তো দৃষ্টি বিভ্রম হয় নাই এ কি আয়োজন? যাহা হউক উদর পূর্ত্তি করিয়া আহার করিব। পরন্তু অবিলম্বে যখন সঙ্কেতানুসারে ভোজন পাত্র সকল অনাবৃত হইল তখন সকলের আশা লতা ভগ্নী হইয়া গেল। লুব্ধ উদরম্ভরি জনগণ আবৃত ভোজন পাত্র দেখিয়া মনে করিয়াছিল এতন্মধ্যে পূর্ব্ববৎ কেবল সুখাদ্য সামগ্রী সকল আছে কিন্তু আবরণ মোচনে দেখিতে পাইল টাইমনের অবস্থানুরূপ দ্রব্যে ভোজন পাত্র পরিপূর্ণ অর্থাৎ কেবল সধূম ঈষদুষ্ণ যৎকিঞ্চিৎ জলমাত্র তাহাতে রহিয়াছে। যে সকল ব্যক্তি এই ভোজে অভ্যবহার নিমিত্ত আমন্ত্রিত হয় তাহারা সকলেই টাইমনের কৃত্রিম মিত্র অতএব তাহাই তাহাদের উপযুক্ত খাদ্য কেননা তাহাদের ব্যবহার ধূমবৎ, প্রভিন্ন করিতে পারা যায় না। তাপর তাহাদের অন্তঃকরণ জলবৎ তরল। সে যাহা হউক। টাইমন্ উক্ত প্রকার আহারীয় সামগ্রী সমস্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিবেশন পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন অরে কুক্কুরগণ পাত্রাচ্ছাদন মোচন করিয়া অবলোকন কর্। পরে তাহারদের এতদ্বিষয়ে যে বিস্ময় জন্মে তাহার মোচন না হইতেই সেই অশীতল সলিল তাহাদের মুখে সেচন করিতে২ বলিতে লাগিলেন খাও যেন উদর পুর্ত্তি ও পরিতৃপ্তি হয়। অবশেষে ভোজন পাত্র ও জল পাত্রাদি গ্রহণ পুরঃসর তাহাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হইতে আরম্ভ হইল তাহাতে তাহারা স্ব২ বসন ভূষণ গ্রহণ পুরঃসর ব্যস্ত সমস্ত হইয়া পলায়ন পরায়ণ হইল। ভয়ে স্ত্রী পুরুষ কে কাহার গাত্রে পতিত হয় জ্ঞান রহিল না, মহা গোলযোগ উপস্থিত হইল। টাইমন্ তাহাদের পশ্চাৎ গমন করিয়া সমুচিত সম্বোধন পুরঃসর কহিতে লাগিলেন অহে হাস্যবদন, প্রিয়ম্বদ মানবগণ, তোমরা নীতিমণ্ডিত লোকের নিপাতকারী, ধার্ম্মিক শার্দ্দূল, সুধী ভল্লূক, সম্পদে উন্মাদ দাও, ভোজে বন্ধুতা প্রকাশ কর, পলায়ন কর কেন? তাহারা তাঁহার এই ঈর্ষান্বিত বচনে আরো ত্রস্ত হইয়া মনে করিল বুঝি আবার অন্য প্রকার লাঞ্ছনা করিবে অতএব সত্বর প্রস্থান করিতে লাগিল, গতিবেগে কাহার অঙ্গ বসন, কাহার ভূষণ পতিত হইতে লাগিল কিন্তু তাহাতে কেহ দৃকপাত করিল না। দ্রুতগতি গমন করিয়া টাইমনের হস্ত হইতে আপনাদিগকে পরিত্রাণ করত নিরাপদ্ জ্ঞানে হর্ষিত হইল।


 টাইমনের পক্ষে এই জনতা সঙ্গতিই শেষ সঙ্গতি হইল। তাহার পর ক্ষণে এথেন্স নগর এবং লোকালয় হইতে বহির্গত হইয়া অরণ্যে প্রবেশ করিলেন। গমন কালে ঘৃণ্য পুরী ও পুরবাসি কৃতঘ্ন মানবদিগের প্রতি পশ্চাৎ করিয়া সকোপ বচনে আক্রোশ করিতে লাগিলেন আশু যেন দৈবী বিড়ম্বনা ঘটিয়া এই পুরীর উচ্চতর প্রাচীর ভূমিসাৎ হয় এবং প্রকাণ্ড অট্টালিকা যেন ভগ্নী হইয়া কৃতন্ন পৌর জনের মুণ্ডে পড়ে। অনন্তর দুঃখাবেগে অধীর হইয়া কহিতে লাগিলেন হে ধর্ম্ম, এথেন্স নগরীয় আবাল বৃদ্ধের আচার দেখিলে, এখন বিচার করিয়া ইহাদের প্রতিফল প্রদান কর। এই মানবগণ অতিশয় দুরাত্মা, ইহাদের বিড়ম্বনা নিমিত্ত অবিলম্বে যেন মারীভয়, সংগ্রাম, দারিদ্র্য এবং রোগ আবির্ভূত হয়। এই রূপে নগরবাসি লোকের অনিষ্টাকাঙ্ক্ষা করিতে২ বিপিনে প্রবেশ করিয়া বলিলেন এখানে সেই সকল কৃতঘ্ন মানবাপেক্ষা নিষ্ঠুর পশুগণেরও দয়া দেখিতে পাইব। পরে আপনার শরীরে কোন প্রকার মনুষ্যের চিহ্ণ না থাকে এতন্নিমিত্ত অঙ্গের বসন পর্যন্ত পরিত্যাগ করিলেন এবং বসতির নিমিত্ত একটা গহ্বর খনন করিয়া পশুর ন্যায় নিরাশ্রয়ে তন্মধ্যে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। বন্য ফল মূল অশনে তাঁহার জীবন ধারণ হইতে লাগিল। মনুষ্যের মুখাবলোকনে একেবারে বিরতি হইল। নরাপেক্ষা বরং বানর দিগের সহিত প্রণয় করিয়া একত্র বাস করিতে অনুরাগী হইলেন।

 আহা যে টাইমন্ পূর্ব্বে মহা পরিচ্ছদ ধারণ করিতেন এবং সকলের আনন্দ ভাজন হইয়া সুখে কাল যাপন করিতেন এক্ষণে তিনি বিবসন ও বিদ্বেষী হইয়া মনোদুঃখে সময়াতিবাহন করিতে লাগিলেন। এখন তাঁহার সেই সমস্ত প্রিয়ম্বদ পরিষদ্‌গণ কে কোথায় গেল নিদর্শন থাকিল না। অধুনা গহন বনে শীতকালীন শীতল সমীরণ কি স্বয়ং বসন অনিয়া দিয়া তাঁহার কলেবর রক্ষা করিবে? অচল তরুনিকর নবানুরাগ বশতঃ মনোহর বেশ ধারণ পুরঃসর তাঁহার সহচরতা করত আদেশ মাত্রে কি কার্য্য সম্পাদন করিবে? উৎকট ভোজন বশতঃ পীড়িত হইলে বনভ্যন্তর দিয়া প্রবহমানা সরিৎ কি সেবা শুশ্রূষা করত উষ্ণ যূষ প্রস্তুত করিয়া দিবে? অপর কাননবাসি মাংসাশি জীবজন্তু কি নিকটস্থ হইয়া কর চুম্বন ও চাটুবাদ করিবে?


 পরন্তু দৈবযোগে টাইমনের অদৃষ্ট পুনর্ব্বার প্রসন্ন এবং সুখ সম্পত্তি পুনশ্চ প্রত্যাগত হইবার সুযোগ হইল। অরণ্য মধ্যে এক দিন প্রাণ ধারণোপযোগি আহারীয় মূল আহরণ নিমিত্ত মৃত্তিকা খনন করিতে ছিলেন হঠাৎ তাঁহার অস্ত্র কোন কঠিন দ্রব্যের উপর আহত হওয়াতে চতুর্দিক্ বিস্তৃত রূপে খনন করিয়া দেখিলেন বৃহদাকার একটা তৈজস পাত্র সুবর্ণে পরিপূর্ণ। কোন কৃপণ দস্যুভয়ে ভীত হইয়া ধন ঐ স্থানে ধরণী গর্ত্তে নিক্ষিপ্ত করিয়া রাখিয়া থাকিবে বোধ হয় তাহার এই মানস ছিল সময়সুসারে উত্তোলন পূর্ব্বক লইয়া যাইবে সুবিধার কাল আগত না হইতে২ স্বয়ং কাল গ্রাসে পতিত হওয়াতে ঐ স্থানেই চির নিখাত রহিয়াছিল যাহা হউক এক্ষণে দৈবপ্রসন্নতায় ধরিত্রী টাইমনের প্রতি সেই নিধি প্রসব করিয়া দিলেন।

 টাইমন্ সুদৈবযোগে পুনর্ব্বার প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হইলেন। তাঁহার পূর্ব্বকার অভিপ্রায় বর্ত্তমান থাকিলে পুনশ্চ অনায়াসে বন্ধু বান্ধব ও তোষামোদকারির সম্প্রদায় ক্রয় করিয়া পূর্ব্ববৎ আমোদ প্রমোদে কালযাপন করিতে পারিতেন। কিন্তু মনোমধ্যে বৈরাগ্যের আবির্ভাব হওয়াতে সংসারের প্রতি অনাস্থা জন্মিয়াছিল অতএব ঐ নিধি তাঁহার নয়নাগ্রে বিষ তুল্য বোধ হইতে লাগিল। সুতরাং সেই ধন অবনীর উদরেই স্থাপন করিতে মনস্থ করিলেন। ফলতঃ পূর্ব্বকার ব্যাপার স্মরণ হওয়াতে বিবেচনা করিতে লাগিলেন অর্থই অনর্থের মূল, অর্থেতেই অশেষ অনিষ্ট ঘটে, অর্থের নিমিত্তই চৌর্য্য দস্যুবৃত্তি অন্যায় অবিচার হত্যা ইত্যাদি বিবিধ কুক্রিয়া নিষ্পন্ন হইয়া থাকে অতএব আর অর্থে লিপ্ত হইব না, আমার যে বৈরাগ্য জন্মিয়াছে তাহাকেই পালন করত নিঃস্ব ভাবে শেষ কাল হরণ করি, এই ধন পুনর্বার প্রোথিত করিয়া রাখি, ইহাও সম্পদ্, অবশ্য পুনর্ব্বার ঘোরতর বিপদ্ জন্মাইতে পারে। এই রূপে আপনার মনোমধ্যে চিন্তা করিতেছেন ইত্যবসরে কতকগুলি পদাতিক সেনা সেই স্থান দিয়া গমন করিতে লাগিল। এলসিবাইদিস নামক সেনাপতি এথেন্স দেশের রাজমন্ত্রিদিগের অন্যায়াচরণে বিরক্ত হইয়া তাহাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিমিত্ত সেই সমস্ত সেনা সমভিব্যাহারে গমন করিতে ছিলেন। তাঁহার জয়ী অনীকিনীগণ পূর্ব্বে আর একবার তুমুল রণ করিয়া এথেন্স নগর রক্ষা করিয়াছিল। টাইমন সেনাপতির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ভূমি নিখাত সম্পত্তি প্রদান পূর্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন, আপনি যোদ্ধাদিগের পুরস্কারে বিত্ত ব্যয় করিবেন, কোন প্রত্যুপকার প্রত্যাশায় এই অর্থ প্রদান করিতেছি না, আমার এতাবন্মাত্র প্রার্থনা, আপনকার দিগ্বিজয়ী সেনাগণ এথেন্স নগর যেন সমভূমি করিয়া অগ্নি দাহ দ্বারা তত্রত্য দুরাত্মাদিগকে দগ্ধ করত নিহত করে। হে মহাশয় এথেন্স দেশীয় আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই দুরাত্মা; প্রাচীন লোকদিগের পক্ব শ্মশ্রু দেখিয়া দয়া করিবেন না, তাহারা কুষীদ জীবী। অপর বালক দিগের মৃদু মধুর হাস্য অবলোকনে বিমুগ্ধ হইবেন না, তাহারাও ক্ষমার পাত্র নহে, কেননা বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া পিতৃ পিতামহের বর্ত্মানুসরণ পুরঃসর বিশ্বাসঘাতী হইবে। আপনি এথেন্সের দুষ্ট দমনার্থ যাত্রা করিতেছেন তন্নিমিত্ত নিবেদন করি তথায় উপস্থিত হইয়া দর্শন শ্রবণ দুই ইন্দ্রিয়কে কঠিন করিবেন দুঃখবহ আকৃতি দর্শন ও কাতর শব্দ শ্রবণ মাত্রে যেন অন্তঃকরণে করুণার সঞ্চার না হয় তাহা হইলে কাহারও দমন হইবেক না। কুমারী গণের ক্রন্দন শিশুদের আর্ত্তরব ও প্রসূতিদিগের বিলাপ শ্রবণে দয়ার্দ্র হইবেন না, আবাল বৃদ্ধ সকলের বিনাশ করিয়া যেন নিবৃত্ত হন্। অনন্তর আপনার অন্তঃকরণ মধ্যে এথেন্সের ও মানব জাতির প্রতি সাতিশয় বিদ্বেষ থাকাতে মনে পরমেশ্বর সন্নিধানে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন সেনানী সকল বিনষ্ট হইয়া কৃতকার্য্য হউক কিন্তু এ ব্যক্তিও যেন ত্বরায় কালের করাল গ্রাসে পতিত হয় তাহা হইলেই নগর একেবারে নির্নাম হইবেক।

 সেনানী গমন করিলে টাইমন্ সেই অরণ্যমধ্যে পশুবৃত্তি দ্বারা জীবন ধারণ পুরঃসর পূর্ব্বভাবে কাল যাপন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ কাল গতে এক দিন তাঁহার কুটীর দ্বারে এক ব্যক্তি আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। সে ব্যক্তি সেই হিতৈষী ধনাধ্যক্ষ ফ্লাবিয়স। প্রভুর প্রতি সাতিশয় ভক্তি ও স্নেহ থাকাতে তাঁহার অদর্শনাবধি নানা স্থানে অন্বেষণ করিতেছিলেন। কুটীর দ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া দেখিলেন প্রভু বিবসন পশুবৎ জীবন যাপন করিতেছেন। তাঁহার পূর্ব্বাবস্থা স্মরণ হওয়াতে মনে২ কহিতে লাগিলেন প্রভু জীবন্মৃত হইয়া বুঝি এই কুটীরকে আপনার সমাধি স্থান করিয়াছেন। যাহা হউক ফাবিয়স্ টাইমনের এই অবস্থা অবলোকনে অপার দুঃখার্ণবে মগ্ন হইয়া শোকাবেগে অনেক ক্ষণ নির্বাক ও নিস্পন্দ হইয়া রহিলেন। কতক ক্ষণ পরে চৈতন্যোদয় ও কথা কহিবার শক্তি হইল কিন্তু বাষ্পভারে কণ্ঠাবরোধ হওয়াতে বাক্য স্পষ্ট রূপে বোধগম্য হইল না অতএব টাইমন্ অনেক কষ্টে বহু বিলম্বে তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন। তিনি ফ্লাবিয়সকে নরাকার দেখিয়া আদৌ মনে করিতেছিলেন এ কে? মনুষ্য জাতির মধ্যে এতাদৃশ সৌহৃদ্য ব্যবহার কি কাহার আছে যে আমার এই ব্যসন সময়ে সম্ভাষা করিতে আসিয়াছে? আমি মানব মণ্ডলীর সহিত ব্যবহার করিয়া দেখিয়াছি মনুষ্যের এ ব্যবহার নহে তবে যদি এ ব্যক্তি মনুষ্য হয় অবশ্য পুনর্বার কোন প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা নিমিত্ত আসিয়া থাকিবে। আমার অবস্থা অবলোকনে ইহার লোচন হইতে যে অশ্রু নির্গত হইতেছে এ একটা কুহক। কিন্তু ফ্লাবিয়স্ বিবিধ চিহ্ণ দ্বারা স্বীয় সাধুতা সপ্রমাণ করত নিবেদন করিলেন প্রভো আপনার প্রতি পরম ভক্তি থাকতে এস্থান পর্য্যন্ত আগমন করিয়াছি। টাইমন্ যদিও তাঁহার প্রভু ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা স্মরণ করিলেন তথাপি মানবজাতির প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মিবাতে তাঁহার প্রতি ঘৃণার সহিত দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন এবং তাঁহার বদন বিনির্গত বাক্য শ্রবণে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন সুতরাং প্রভুভক্ত ভৃত্য আপনার মানবাকার দুর্ভাগ্যের কারণ হইল বলিয়া বিলাপ করিতে২ প্রত্যাগমন করিলেন।

 অনন্তর কৃতজ্ঞ মানবদের ন্যায় কৃতঘ্ন লোকেরাও টাইমনের গুণানুস্মরণ পুরঃসর তাঁহার নিমিত্ত পরিতাপ করিতে লাগিল। এলসিবাইদিস সেনানী মহা কোপে এথেন্স নগর আক্রমণ করিলেন এবং প্রাচীর ভগ্ন করিয়া নগর ভূমিসাৎ করিবেন এতাদৃশ ক্রোধ প্রদর্শন করিতে লাগিলেন সুতরাং তৎকালে সকলকে টাইমনের শৌর্য্য বীর্য্য স্মরণ পূর্ব্বক অনুতাপ করিতে হইল। তাহারা কহিতে লাগিল হায় মহানুভব টাইমনকে কেন উচ্ছিন্ন করিলাম তিনি এ সময় উপস্থিত থাকিলে কৌশল প্রকাশ পূর্ব্বক সাহস ও বীর্য্যদ্বারা এ দুর্দান্ত বৈরির অনায়াসে দমন করিতে পারিতেন। পূর্ব্বে কত বার এই নগর বিদেশীয় বলিষ্ঠ শত্রু কর্ত্তৃক বেষ্টিত হইয়াছিল তাহাতে তিনিই প্রবল পরাক্রম প্রকাশ পুরঃসর তাহাদিগের নিরাকরণ করিয়া নগর রক্ষা করেন।

 রাজমন্ত্রিগণ এই বিপদে উপায়ান্তর না দেখিয়া এক্ষণে টাইমনের শরণ প্রার্থনা করিতে মানস করিল। ইহারা তাহার দুর্গতির সময় বাক্য দ্বারাও হিত চেষ্টা করে নাই, অধুনা আপনাদের দুর্দশা আপতিত হওয়াতে বনে গিয়া শরণাপন্ন হইতে উদ্যত হইল। স্বার্থ কি চমৎকার পদার্থ, পূর্ব্বে যাঁহাকে রুষ্ট করিতে কোন অংশে ত্রুটি করে নাই ইদানী প্রয়োজন উপস্থিত হওয়াতে তাঁহার নিকট গিয়া নিষ্ঠুর ব্যবহারের পরিবর্ত্তে প্রীতি উৎপাদন নিমিত্ত যত্ন করিতে লাগিল।

 অনন্তর তাহাদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি বিপিন প্রবেশ পূর্ব্বক টাইমনের উদ্দেশ করিতে গেল এবং অনেক অন্বেষণের পর তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া বিবিধ স্তব স্তুতি পুরঃসর নিবেদন করিল মহাশয় অনুগ্রহ করিয়া নগরে প্রত্যাগমন করুন আপনি বিনা আমাদের রক্ষক কেহ নাই। আপনি অস্মাদির নিষ্ঠুর ব্যবহারে সাতিশয় বিরক্ত হইয়াছেন ক্ষমা করুন। আমরা শপথ পূর্ব্বক কহিতেছি আপনি প্রত্যাগমন পুরঃসর দুর্দান্ত বৈরির আক্রমণ হইতে রক্ষা করিলে আমাদের ধন প্রাণ সকলই আপনার প্রতি সমর্পণ করিয়া চিরকাল আজ্ঞাবহ থাকিব। কিন্তু নগ্ন ও নরদ্বেষি টাইমন্ এক্ষণে সে টাইমন্ ছিলেন না পূর্ব্বের ন্যায় বদান্যতা বিক্রম ও মানবের প্রতি দয়া প্রকাশ আভরণ জ্ঞান করিলেন না। স্বদেশীয়দের কৃতঘ্নতায় মর্ম্মান্তিক বেদনা পাওয়াতে এলসিবাইদিস সেনাপতি কর্ত্তৃক তাহাদের নিপীড়ন সংবাদে মনোমধ্যে বরং উল্লাসিত হইলেন। অতএব স্পষ্ট বাক্যে সমাগত লোকদিগকে কহিলেন বিপক্ষগণ স্বর্ণময় এথেন্স নগর আক্রমণ পূর্ব্বক যদিস্যাৎ তত্রস্থ আবাল বৃদ্ধ বনিতার সংহার করিয়া সকলের সর্ব্বস্ব হরণ করিয়া লইয়া যায় তাহাতেও আমার দুঃখ নাই, এক্ষণে বোধ হইতেছে সেই কটকাভ্যন্তরের সামান্য খড়্‌গও দেশীয় প্রাচীন সম্ভ্রান্ত লোকের মস্তক অপেক্ষা অধিক মূল্যবান।

 রাজমন্ত্রিগণ টাইমনের মুখে এবম্প্রকার নির্দয় বচন শ্রবণ করিয়া আর্ত্তস্বরে রোদন আরম্ভ করিল তখনও তিনি পূর্ব্বোক্ত বাক্যমাত্র পুনরুক্তি করিলেন। তদনন্তর তাহারা বিষন্ন মনে বিদায় গ্রহণ করিলে এতাবন্মাত্র কহিলেন তোমরা নগরে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক তত্রস্থ জনগণকে আমার বৃত্তান্ত জ্ঞাপন পুরঃসর কহিও তাহাদের পরিতাপ মোচন ও দুর্দান্ত সেনাপতির কোপ নিবারণের এক মাত্র উপায় আছে। ওহে মন্ত্রিবর্গ, স্বদেশীয় মানবদিগের প্রতি আমার এখনও যথেষ্ট স্নেহ আছে এবং দেহপাতের পূর্ব্বে সাধ্যানুসারে তাহাদের উপকার করিতে বাসনা করি অতএব এক উপায় কহিতেছি শ্রবণ কর। মন্ত্রিরা বিদায়কালে এবম্বিধ সানুকূল বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে করিল ইহাঁর হৃদয়ে বুঝি দয়ার উদ্রেক হইল। কিন্তু টাইমন্ ব্যঙ্গোক্তি পূর্ব্বক সেই উপায়ের এইরূপ বিবরণ করত কহিলেন আমার কুটীর সন্নিকটে একটী প্রকাণ্ড তরু আছে ত্বরায় ছেদন করিতে হইবে অতএব এথেন্স দেশীয় ক্ষুদ্র মহৎ সর্ব্ব সাধারণ জনগণ এস্থানে আগমন পূর্ব্বক যদি সেই তরুর আশ্রয় গ্রহণ করে তাহা হইলে নিষ্কৃতি পাইতে পারে। এ কথার তাৎপর্য্য এই তাহারা যদিস্যাৎ স্ব২ গলে রজ্জু প্রদান করিয়া এই বৃক্ষে উদ্বন্ধন পুর্ব্বক দেহ ত্যাগ করে তাহা হইলে কৃতঘ্নতা হইতে নিস্তার পাইবেক।

 টাইমন্ মানবগণের প্রতি বদান্যতা ও দয়া প্রকাশে যে অনুরাগ করিতেন তাঁহার অন্তর হইতে তাহা একেবারে অন্তর হইলে অবিলম্বে দেহপাত হইল। কিয়দ্দিনানন্তর কোন যোদ্ধা নদী তীর দিয়া গমন করত তাঁহার বাসস্থলী হইতে কিয়দ্দূরে একটা সমাধি স্থান অবলোকন করিল তাহাতে লেখা ছিল নরদ্বেষি টাইমনের এই সমাজ। টাইমন্ বিপিনবাসী হইয়া অবশিষ্ট জীবন নরদ্বেষে যাপন করেন বিশেষতঃ স্বদেশীয় রাজমন্ত্রিদিগের নিকট আপন মানস ব্যক্ত করেন দেশের মানববর্গ যেন দুঃখ ও দৈব উৎপাতে বিনষ্ট হয় অতএব তাঁহার সমাধিতে নরদ্বেষী টাইমন্ বলিয়া তাঁহার নাম অঙ্কিত হইয়াছিল।

 টাইমন আত্মহত্যা দ্বারা দুঃখের অন্ত করেন অথবা দুঃখাবেগে তদীয় অসু বিনাশ হয় এতদ্বিষয়ের কোন বিবরণ প্রকাশ নাই, সমাধির উপরি কেবল পূর্ব্বোক্ত কথা মাত্র লিখিত ছিল। যাহা হউক ঐ কথাতে স্পষ্ট বোধ হয় মনুষ্যজাতির কৃতঘ্নতা দর্শনে তাহাদের প্রতি যে দ্বেষ ভাব উৎপন্ন হয় চরম কাল পর্য্যন্ত তাহা দেদীপ্যমান ছিল। কেহ২ অনুমান করিয়া বলেন তাঁহার সমাধি স্থান সিন্ধুতীরে নির্ণীত হইবার তাৎপর্য্য এই সমাধি অবলোকনে দুষ্ট ও শঠ লোকের নয়ন হইতে নিঃসৃত বারিবিন্দু অপেক্ষা প্রকাণ্ড বারিভাও সাগরের অনবরত তরঙ্গোৎক্ষেপণ দ্বারা সমাধির উপর অশ্রুধারা স্বরূপে জলাভিষেক মনোনীত করিতেন এই নিমিত্ত তদ্রূপ স্থলে সমাধি স্থাপন করিয়া যান্ ইতি।