সে/১৪

উইকিসংকলন থেকে
(পৃ. চিত্র-)

১৪

 পরদিন সকালবেলায় প্রাতরাশে আমার নির্দ্দেশ মতো পুপেদিদি নিয়ে এল পাথরের পাত্রে ছোলাভিজে এবং গুড়। বর্ত্তমান যুগে পুরাকালীন গৌড়ীয় খাদ্যবিধির রেনেসাস্ প্রবর্ত্তনে লেগেছি। দিদিমণি জিগেস করলে, চা হবে কি। আমি বললুম, না, খেজুর রস।

 দিদি বললে, আজ তোমার মুখখানা মন দেখছি কেন। কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছ না কি।

 আমি বললুম, স্বপ্নের ছায়া তো মনের উপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছেই, স্বপ্নও মিলিয়ে যায় ছায়ারও চিহ্ন থাকে না। আজ তোমার ছেলেমানুষির একটা কথা বারবার মনে পড়ছে—ইচ্ছে করছে বলি।

 বলো না।

 সেদিন লেখা বন্ধ ক’রে বারান্দায় বসে ছিলুম। তুমি ছিলে, সুকুমারও ছিল। সন্ধে হয়ে এল, রাস্তার বাতি জ্বালিয়ে গেল, আমি বসে বসে সত্যযুগের কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছিলুম।

 বানিয়ে বলছিলে। তার মানে ওটাকে সত্যযুগ ক’রে তুলছিলে।

 ওকে অসত্য বলে না। যে রশ্মি বেগনির সীমা পেরিয়ে গেছে তাকে দেখা যায় না ব’লেই সে মিথ্যে নয়, সেও আলো। ইতিহাসের সেই বেগ্নিপেরোনো আলোতেই মানুষের সত্যযুগের সৃষ্টি। তাকে প্রাগ্-ঐতিহাসিক বলব না, সে আলট্রা-ঐতিহাসিক।

 আর তোমার ব্যাখ্যা করতে হবে না। কী বলছিলে বলো।

 আমি তোমাদের বলছিলুম, সত্যযুগে মানুষ বই প’ড়ে শিখত না, খবর শুনে জান্ত না, তাদের জানা ছিল হয়ে-উঠে জানা।

 কী মানে হোলো বুঝতে পারছি নে।

 একটু মন দিয়ে শোনো বলি। বোধ হয় তোমার বিশ্বাস তুমি আমাকে জানো।

 দৃঢ় বিশ্বাস।

 জানো কিন্তু সে জানায় সাড়ে পনেরো আনাই বাদ পড়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই তুমি যদি ভিতরে ভিতরে আমি হয়ে যেতে পারতে তাহোলেই তোমার জানাটা সম্পূর্ণ সত্য হোত।

 তাহোলে তুমি বলতে চাও আমরা কিছুই জানিনে।

 জানিইনে তো। সবাই মিলে ধরে নিয়েছি যে জানি, সেই আপোষে ধরে নেওয়ার উপরেই আমাদের কারবার।

 কারবার তো ভালোই চলছে।

 চলছে, কিন্তু এ সত্যযুগের চলা নয়। সেই কথাই তোমাদের বলছিলুম, সত্যযুগে মানুষ দেখার জানা জান্ত না, ছোঁওয়ার জানা জাত না, জান্ত একেবারে হওয়ার জানা।

 মেয়েদের মন প্রত্যক্ষকে আঁকড়ে থাকে, ভেবেছিলেম আমার কথাটা অত্যন্ত অবাস্তব ঠেকবে পুপুর কাছে—ভালোই লাগবে না। দেখলুম একটু ঔৎসুক্য হয়েছে। বললে, বেশ মজা। একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেই বললে, আচ্ছা দাদামশায়, আজকাল তো সায়ান্সে অনেক বুজরুগী করছে, মরা মানুষের গান শোনাচ্চে, দূরের মানুষের চেহারা দেখাচ্ছে, আবার শুনছি শিষেকে সোনা করছে, তেমনি একদিন হয়তো এমন একটা বিদ্যুতের খেলা খেলাবে যে ইচ্ছে করলে একজন আর একজনের মধ্যে মিলে যেতে পারবে।

 অসম্ভব নয়। কিন্তু তুমি তাহোলে কী করবে। কিছুই লুকোতে পারবে না।

 সর্বনাশ। সব মানুষেরই যে লুকোবার আছে অনেক।

 লুকোনো আছে ব’লেই লুকোবার আছে। যদি কারো কিছুই লুকোনো থাকত তাহোলে দেখা-বিনতি খেলার মতো সবার সব জেনেই লোকব্যবহার হোত।

 কিন্তু লজ্জার কথা যে অনেক আছে।

 লজ্জার কথা সকলেরই প্রকাশ হোলে লজ্জার ধার চলে যেত।

 আচ্ছা আমার কথা কী বলতে যাচ্ছিলে তুমি।

 সেদিন আমি তোমাকে জিগেস করেছিলুম, তুমি যদি সত্যযুগে জন্মাতে তবে আপনাকে কী হয়ে দেখতে তোমার ইচ্ছে হোত। তুমি ফস করে ব’লে ফেললে, কাবুলি-বেড়াল।

 পুপে মস্ত ক্ষাপা হয়ে ব’লে উঠল, কখ্খনো না। তুমি বানিয়ে বলছ।

 আমার সত্যযুগটা আমার বানানো হোতে পারে কিন্তু তোমার মুখের কথাটা তোমারই। ওটা ফস্ ক’রে আমি-হেন বাচালও বানাতে পারতুম না।

 এর থেকে তুমি কি মনে করেছিলে আমি খুব বোকা।

 এই মনে করেছিলুম যে, কাবুলি-বেড়ালের উপর অত্যন্ত লোভ করেছিলে অথচ কাবুলিবেড়াল পাবার পথ তোমার ছিল না, তোমার বাবা বেড়াল জন্তুটাকে দেখতে পারতেন না। আমার মতে সত্যযুগে বেড়াল কিনতেও হোত না পেতেও হোত না, ইচ্ছে করলেই বেড়াল হোতে পারা যেত।

 মানুষ ছিলুম বেড়াল হলুম এতে কী সুবিধেটা হলো। তার চেয়ে যে বেড়াল কেনাও ভালো, না কিনতে পারলে না পাওয়া ভালো।

 ঐ দেখো সত্যযুগের মহিমাটা মনে ধারণা করতে পারছ না। সত্যযুগের পুপে আপনার সীমানা বাড়িয়ে দিত বেড়ালের মধ্যে। সীমানা লোপ করত না। তুমি তুমিও থাকতে বেড়ালও হোতে।

 তোমার এসব কথার কোনো মানে নেই।

 সত্যযুগের ভাষায় মানে আছে। সেদিন তো তোমাদের অধ্যাপক প্রমথবাবুর কাছে শুনেছিলে, আলোকের অণুপরমাণু বৃষ্টির মতো কণা বর্ষণও বটে আবার নদীর মতো তরঙ্গধারাও বটে। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি, হয় এটা নয় ওটা, কিন্তু বিজ্ঞানের বুদ্ধিতে একই কালে দুটোকেই মেনে নেয়। তেমনি একই কালে তুমি পুপুও বটে বেড়ালও বটে, এটা সত্যযুগের কথা।

 দাদামশায় যতই তোমার বয়স এগিয়ে চলছে ততই তোমার কথাগুলো অবোধ্য হয়ে উঠছে তোমার কবিতারই মতো।

 অবশেষে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যাব তারই পূর্ব্বলক্ষণ।

 সেদিনকার কথাটা কি ঐ কাবুলি-বেড়ালের পরে আর এগোল না।

 এগিয়েছিল। সুকুমার এককোণে বসে ছিল, সে স্বপ্নে-কথা-বলার মতো ব’লে উঠল, আমার ইচ্ছে করে শাল গাছ হয়ে দেখতে। সুকুমারকে উপহসিত করবার সুযোগ পেলে তুমি খুসি হোতে। ও শাল গাছ হোতে চায় শুনে তুমি তো হেসে অস্থির। ও চমকে উঠল লজ্জায়। কাজেই ও বেচারীর পক্ষ নিয়ে আমি বললেম—দক্ষিণের হাওয়া দিল কোথা থেকে, গাছটার ডাল ছেয়ে গেল ফুলে, ওর মজ্জার ভিতর দিয়ে কী মায়ামন্ত্রের অদৃশ্য প্রবাহ বয়ে যায় যাতে ঐ রূপের গন্ধের ভোজবাজি চলতে থাকে। ভিতরের থেকে সেই আবেগটা জানতে ইচ্ছা করে বৈ কী, গাছ না হোতে পারলে বসন্তে গাছের সেই অপরিমিত রোমাঞ্চ অনুভব করব কী ক’রে।—

 আমার কথা শুনে সুকুমার উৎসাহিত হয়ে উঠল,—বললে, আমার 
—পৃঃ ১৪০
শোবার ঘরের জানলা থেকে যে শালগাছটা দেখা যায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার মাথাটা আমি দেখতে পাই, মনে হয় ও স্বপ্ন দেখছে।—

 শালগাছ স্বপ্ন দেখছে শুনে বোধ হয় বলতে যাচ্ছিলে, কী বোকার মতো কথা।—বাধা দিয়ে ব’লে উঠলুম, শালগাছের সমস্ত জীবনটাই স্বপ্ন। ও স্বপ্নে চলে এসেছে বীজের থেকে অঙ্কুরে, অঙ্কুর থেকে গাছে। পাতাগুলোই তো ওর স্বপ্নে-কওয়া-কথা।

 সুকুমারকে বললুম, সেদিন যখন সকালবেলায় ঘন মেঘ ক’রে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি দেখলুম তুমি উত্তরের বারান্দায় রেলিং ধ’রে চুপ ক’রে দাঁড়িয়েছিলে। কী ভাবছিলে বলো দেখি।

 সুকুমার বললে, জানিনে তো কী ভাবছিলুম।

 আমি বললুম, সেই না-জানা-ভাবনায় ভরে গিয়েছিল তোমার সমস্ত মন মেঘেভরা আকাশের মতো। সেই রকম গাছগুলো যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওদের মধ্যে যেন একটা না-জানা ভাব আছে। সেই ভাবনাই বর্ষায় মেঘের ছায়ায় নিবিড় হয়, শীতের সকালের রোদ্রে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই না-জানা ভাবনার ভাষায় কচি পাতায় ওদের ডালে ডালে বকুনি জাগে, গান ওঠে ফুলের মঞ্জুরীতে। আজো মনে পড়ে সুকুমারের চোখ দুটো কী রকম এতখানি হয়ে উঠল; সে বললে, আমি যদি গাছ হোতে পারতুম তাহোলে সেই বকুনি সির্সির্ করে আমার সমস্ত গা বেয়ে উঠত আকাশের মেঘের দিকে। তুমি দেখলে সুকুমার আসরটা দখল ক’রে নিচ্চে। ওকে নেপথ্যে সরিয়ে তুমি এলে সামনে। কথা পাড়লে, আচ্ছা দাদামশায়, এখন যদি সত্য যুগ আসে তুমি কী হোতে চাও। তোমার বিশ্বাস ছিল আমি ম্যাসটোডন কিম্বা মেগাথেরিয়ম হোতে চাইব, কেননা জীব-ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ের প্রাণীদের সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে এর কিছুদিন আগেই আলোচনা করেছি। তখন তরুণ পৃথিবীর হাড় ছিল কঁআচা, পাকা রকম ক’রে জমাট হয়ে ওঠেনি তার মহাদেশ, গাছপালা-গুলোর চেহারা ছিল বিশ্বকর্ত্তার প্রথম তুলির টানের। সেইদিনকার আদিম অরণ্যে সেইদিনকার অনিশ্চিত শীতগ্রীষ্মের অধিকারে এই সব ভীমকায় জন্তুগুলোর জীবযাত্রা চলছে কী রকম ক’রে, তা স্পষ্টরূপে কল্পনা করতে পারছে না আজকের দিনের মানুষ এই কথাটা তোমার শোনা ছিল আমার মুখে। পুথিবীতে প্রাণের প্রথম অভিযানের সেই মহাকাব্য যুগটাকে স্পষ্ট ক’রে জানবার ব্যাকুলতা তুমি আমার কথা থেকে বুঝতে পেরেছিলে। তাই আমি যদি হঠাৎ ব’লে উঠতুম, সে কালের রোঁয়াওয়ালা চার দাঁতওয়ালা হাতি হওয়া আমার ইচ্ছে, তাহোলে তুমি খুসি হোতে। তোমার কাবুলিবেড়াল হওয়ার থেকে এই ইচ্ছে বেশি দূরে পড়ত না, আমাকে তোমার দলে পেতে। হয়তো আমার মুখে ঐ ইচ্ছেটাই ব্যক্ত হোত। কিন্তু সুকুমারের কথাটা আমার মনকে টেনে নিয়েছিল অন্যদিকে।

 পুপে ব’লে উঠল, জানি, জানি, সুকুমারদার সঙ্গেই তোমার মনের মিল ছিল বেশি।

 আমি বললুম, তার একমাত্র কারণ, ও ছিল ছেলে, আমিও ছেলে হয়েই জন্মেছিলুম একদিন। ওর ভাবনার ছাঁচ ছিল আমারই শিশু ভাবনার ছাঁচে। তুমি সেদিন তোমার খেলার হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে ভাব গৃহস্থালির যে স্বপ্নলোক বানিয়ে তুলে খুসি হোতে সেটা দেখতে পেতুম একটু তফাৎ থেকে। তুমি তোমার খেলার খোকাকে কোলে ক’রে যখন নাচাতে তার স্নেহের রসটা ষোলো আনা পাবার সাধ্য আমার ছিল না।

 পুপু বললে,আচ্ছা সে কথা থাক্, সেদিন তুমি কী হোতে ইচ্ছে করেছিলে বলো।

 আমি হোতে চেয়েছিলুম একখানা দৃশ্য় অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সকালবেলার প্রথম প্রহর, মাঘের শেষে হাওয়া হয়েছে উতলা, পুরোনো অশথ গাছটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে ছেলেমানুষের মতো, নদীর জলে উঠেছে কলরব, উচুনিচু ডাঙায় ঝাপ্সা দেখাচ্চে দলবাঁধা গাছ। সমস্তটার পিছনে খোলা আকাশ, সেই আকাশে একটা সুদূরতা,—মনে হচ্চে যেন অনেক দূরের ওপার থেকে একটা ঘণ্টার ধ্বনি ক্ষীণতম হয়ে গেছে বাতাসে, যেন রোদ্দুরে মিশিয়ে দিয়েছে তার কথাটাকে—বেলা যায়—।

 তোমার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল একখানা গাছ হওয়ার চেয়ে নদী বন আকাশ নিয়ে একখানা সমগ্র ভূদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কল্পনা তোমার কাছে অনেক বেশি সৃষ্টিছাড়া বোধ হোলো।

 সুকুমার বললে, গাছপালা নদী সবটার উপরে তুমি ছড়িয়ে মিলিয়ে গেছ মনে করতে আমার ভারি মজা লাগছে। আচ্ছা, সত্যযুগ কি কোনোদিন আসবে।

 যতদিন না আসে ততদিন ছবি আছে কবিতা আছে। আপনাকে ভুলে গিয়ে আর কিছু হয়ে যাবার ঐ একটা বড়ো রাস্তা!

 সুকুমার বললে, তুমি যেটা বললে ওটা কি ছবিতে এঁকেছ।

 হাঁ এঁকেছি।

 আমিও একটা আঁকব।

 সুকুমারের স্পর্দ্ধার কথা শুনে তুমি ব’লে উঠলে, পারবে না কি তুমি আঁকতে।

 আমি বললুম, ঠিক পারবে। আঁকা হয়ে গেলে ভাই তোমারটা আমি নেব আমারটা তোমাকে দেব।

 সেদিন এই পর্য্যন্ত হোলে। আমাদের আলাপ।

 এইবার আমাদের সেদিনকার আসরের শেষ কথাটা ব’লে নিই। তুমি চলে গেলে তোমার পায়রাকে ধান খাওয়াতে। সুকুমার তখনো বসে বসে কী ভাবতে লাগল। আমি তাকে বললুম, তুমি কী ভাবছ বলব।

 সুকুমার বললে, বলো দেখি।

 তুমি ভেবে দেখছ আরো কী হয়ে যেতে পারলে ভালো হয়, হয়তো প্রথম মেঘকরা আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা আকাশ, হয়তো পূজোর ছুটিতে ঘরমুখে। পাল-তোলা পান্সি নেীকোখানি। এই উপলক্ষ্যে আমি তোমাকে আমার জীবনের একটা কথা বলি। তুমি জানো ধীরুকে আমি কত ভালোবাসতুম | হঠাৎ টেলিগ্রামে খবর পেলুম তার টাইফয়েড, সেই বিকেলেই চলে গেলুম মুন্সিগঞ্জে তাদের বাড়িতে। সাতদিন সাতরাত কাটল। সেদিন ছিল অত্যন্ত গরম, রৌদ্র প্রখর। দূরে একটা কুকুর করুণ সুরে আর্ত্তনাদ করে উঠছিল— শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে রোদ পড়ে আসছে, পশ্চিম দিক থেকে ডুমুর গাছের ছায় পড়েছে বারান্দার উপরে। পাড়ার গয়লানী এসে জিগেস করলে, তোমাদের খোকাবাবু কেমন আছে গা। আমি বললুম, মাথার কষ্ট গা জলি আজ কমেছে। যারা সেবা করছিল তারা আজ কেউ কেউ ছুটি নেবার অবকাশ পেলে। দুজন ডাক্তার রুগী দেখে বেরিয়ে এসে ফিস্ ফিস্ ক’রে কী পরামর্শ করলে; বুঝলেম আশার লক্ষণ নয়। চুপ ক’রে বসে রইলুম, মনে হোলো, কী হবে শুনে। সায়াহ্নের ছায়া ঘনিয়ে এল। দেখা গেল সামনের মহানিম গাছের মাথার উপরে সন্ধ্যাতারা দেখা দিয়েছে। দূরের রাস্তায় পাটবোঝাই গোরুর গাড়ির শব্দ আর শোনা যায় না। সমস্ত আকাশটা যেন ঝিমঝিম করছে। কী জানি কেন মনে মনে বলছি, পশ্চিম আকাশ থেকে ঐ আসছে রাত্রিরূপিনী শান্তি, স্নিগ্ধ, কালো, স্তব্ধ। প্রতিদিনই তো আসে কিন্তু আজ এল বিশেষ একটি মূর্ত্তি নিয়ে স্পর্শ নিয়ে, চোখ বুজে সেই ধীরে চলে-আসা রাত্রির আবির্ভাব আমার সমস্ত অঙ্গকে মনকে যেন আবৃত করে দিলে। মনে মনে বললুম, ওগো শান্তি, ওগো রাত্রি, তুমি আমার দিদি, আমার অনাদি কালের দিদি, দিন অবসানের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে টেনে নাও তোমার বুকের কাছে আমার ধীরুভাইকে, তার সকল জ্বালা যাক্ জড়িয়ে একেবারে।

 দুই পহর পেরিয়ে গেল; একটা কান্নার ধ্বনি উঠল রোগীর শিয়রের কাছ থেকে; নিস্তব্ধ রাস্ত বেয়ে গেল চলে ডাক্তারের গাড়ি তার ঘরে ফিরে। সেদিন তামার সমস্ত মন-ভরা একটি রাত্রির রূপ দেখেছি, আমি তাতে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলুম, পৃথিবী যেমন তার স্বাতন্ত্রা মিলিয়ে দেয় নিশীথের ধ্যানাবরণে।

 —কী জানি, সুকুমারের কী মনে হোলো সে অধীর হয়ে ব’লে উঠল, আমাকে কিন্তু তোমার ঐ দিদি অন্ধকারের ভিতর দিয়ে অমন চুপি চুপি নিয়ে যাবে না। পূজোর ছুটির দিনে যেদিন সকালে দশটা বাজবে, কাউকে ইস্কুলে যেতে হবে না, ছেলেরা সবাই যেদিন গেছে রথতলার মাঠে ব্যাটবল খেলতে, সেইদিন আমি খেলার মতে ক’রেই হঠাৎ মিলিয়ে যাব তাকাশে, ছুটির দিনের রোদ্দুরে।—শুনে আমি চুপ করে রইলুম, কিছু বললুম না।

 * * * * * *

 পুপেদিদি বললে, কাল থেকে সুকুমারদা’র কথা তুমি প্রায়ই বলছ। তার মধ্যে আমার উপরে একটুখানি খোঁচা থাকে। তুমি কি মনে করো তোমার ভালোবাসার অংশ নিয়ে সুকুমারদা’র সঙ্গে আমার ছেলেবেলাকার যে ঝগড়া ছিল সেটা এখনো আছে।

 হয়তো একটুখানি আছে বা। সেইটেকে একেবারে ক্ষইয়ে দেব ব’লেই বারবার তার কথা তুলি। আরো একটুখানি কারণ আছে।

 কী কারণ বলোই না।

 কিছুদিন আগে সুকুমারের বাবা ডাক্তার নিতাই এসেছিলেন আমার কাছে বিদায় নিতে।

 কেন, বিদায় নিতে কেন।

 তোমাকে বলব মনে করেছিলুম বলা হয়নি। আজ বলি। নিতাই চাইলে সুকুমার আইন পড়ে, সুকুমার চাইলে সে ছবি আঁকা শেখে নন্দলালবারুর কাছে। নিতাই বললে, ছবি আঁকা বিদ্যেয় আঙুল চলে পেট চলে না। সুকুমার বললে আমার ছবির ক্ষিদে যত, পেটের ক্ষিদে তত বেশি নয়। নিতাই কিছু কড়া ক’রে বললে, সে কথাটা তোমার প্রমাণ ক’রে দেবার দরকার হয়নি, পেট সহজেই চলে যাচ্চে। কথাটা বিশ্রী লাগল তার মনে—কিন্তু হেসে বললে, কথাটা সত্যি, এর প্রমাণ দেওয়া উচিত। —বাবা ভাবলে এইবার ছেলে আইন পড়তে বসবে। সুকুমারের বরিশালের মাতামহ ক্ষ্যাপা গোছের মানুষ, সুকুমাবের স্বভাবটা তাঁরই ছাঁচের, চেহারারও সাদৃশ্য আছে। দুজনের পরে দুজনের ভালোবাসা পরম বন্ধুর মতো। পরামর্শ হোলো দুজনে মিলে— সুকুমার টাকা পেল কিছু, কখন চলে গেল বিলেতে কেউ জানে না। বাবাকে চিঠি লিখে গেল, আপনি চান না আমি ছবি আঁকা শিখি, শিখব না। আপনি চান অর্থকরী বিদ্যা আয়ত্ত করব, তাই করতে চললুম। যখন সমাপ্ত হবে প্রণাম করতে আসব, আশীর্ব্বাদ করবেন।

 কোন্ বিদ্যে শিখতে গেল কাউকে বলে নি। একটা ডায়ারি পাওয়া গেল তার ডেস্কে। তার থেকে বোঝা গেল সে য়ুরোপে গেছে উড়ও জাহাজের মাঝিগিরি শিখতে। তার শেষদিকটা কপি ক’রে এনেছি। ও লিখছে— মনে আছে একদিন আমার ছত্রপতি পক্ষীরাজে চ’ড়ে পুপুদিদিকে চন্দ্রলোক থেকে উদ্ধার করতে যাত্রা করেছিলুম আমাদের ছাদের একধার থেকে আর এক ধারে। এবার চলেছি কলের পক্ষীরাজকে বাগ মানাতে। য়ুরোপে চন্দ্রলোকে যাবার আয়োজন চলেছে। যদি সুবিধা পাই যাত্রীর দলে আমিও নাম লেখাব। আপাতত পৃথিবীর আকাশ-প্রদক্ষিণে হাত পাকিয়ে নিতে চাই। একদিন আমি তার দাদামশায়ের দেখাদেখি যে ছবি এঁকেছিলুম, দেখে পুপুদিদি হেসেছিল। সেইদিন থেকে দশ বছর ধরে ছবি আঁকা অভ্যাস করেছি কাউকে দেখাইনি। এখনকার তাঁকা দুখানা ছবি রেখে গেলুম পুপের দাদামশায়ের জন্যে। একটা ছবি জলস্থল আকাশের একতান সঙ্গৎ নিয়ে, আর একটা আমার বরিশালের দাদামশায়ের। পুপের দাদামশায় ছবি দুটো দেখিয়ে পুপেদিদির সেদিনকার হাসি যদি ফিরিয়ে নিতে পারেন তো ভালোই, নইলে যেন ছিড়ে ফেলেন। আমার এবারকার যাত্রায় চন্দ্রলোকের মাঝপথেই পক্ষীরাজের পাখা ভাঙা অসম্ভব নয়। যদি ভাঙে তবে এক নিমেষে সত্যলোকে পৌঁছব—সূর্য্য প্রদক্ষিণের পথে একেবারে মিলে যাব পৃথিবীর সঙ্গে। যদি বেঁচে থাকি, আকাশের খেয়া-পারাপারে যদি নৈপুণ্য ঘটে তাহোলে একদিন পুপুদিদিকে নিয়ে শূন্য পথে পাড়ি দিয়ে আসব মনে এই ইচ্ছে রইল। সত্যযুগে বোধ হয় ইচ্ছে আর ঘটনা একই ছিল। চেষ্টা করব ধ্যানযোগে ইচ্ছেকেই ঘটনা ব’লে ধরে নিতে। ছেলেবেলা থেকে অকারণে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকাই আমার অভ্যাস। ঐ আকাশটা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ যুগের কোটি কোটি ইচ্ছে দিয়ে পূর্ণ। এই বিলীয়মান ইচ্ছেগুলো বিশ্বসৃষ্টির কোন্ কাজে লাগে কী জানি। বেড়াক্ উড়ে আমার দীর্ঘনিঃশ্বাসে উৎসারিত ইচ্ছেগুলো সেই আকাশেই, যে আকাশে তাজ আমি উড়তে চলেছি।

 পুপুদিদি ব্যাকুল হয়ে উঠে জিগেস কর্লে, সুকুমারদার এখনকার খবর কী।

 আমি বললুম, সেইটেই পাওয়া যাচ্চে না ব’লেই তার বাবা বিলেতে সন্ধান করতে চলেছেন।

 বিবর্ণ হয়ে গেল দিদির মুখ। আস্তে আস্তে উঠে ঘরে দরজা বন্ধ করে দিলে।

 আমি জানি সুকুমারের আঁকা সেই ছেলেমান্থষি পুপুদিদি আপন ডেস্কে লুকিয়ে রেখেছে।

 আমি চষমাটা মুছে ফেলে চলে গেলুম সুকুমারদের বাড়ির ছাদে। সেই ভাঙা ছাতাটা সেখানে নেই, নেই সেই আতসবাজির আধপোড়আ কাঠি।