সোনার তরী/প্রতীক্ষা

উইকিসংকলন থেকে

প্রতীক্ষা।

ওরে মৃত্যু, জানি তুই আমার বক্ষের মাঝে
বেঁধেছিস্‌ বাসা,
যেখানে নির্জ্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর
স্নেহ ভালবাসা,
গোপন মনের আশা, জীবনের দুঃখ সুখ,
মর্ম্মের বেদনা,
চির দিবসের যত হাসি-অশ্রু-চিহ্ণ আঁকা
বাসনা সাধনা;
যেখানে নন্দন ছায়ে নিঃশঙ্কে কবিছে খেলা
অন্তরের ধন,
স্নেহের পুত্তলিগুলি, আজন্মের স্নেহস্মৃতি,
আনন্দ-কিরণ;
কত আলো, কত ছায়া, কত ক্ষুদ্র বিহঙ্গের
গীতিময়ী ভাষা,—
ওরে মৃত্যু, জানিয়াছি, তারি মাঝখানে এসে
বেঁধেছিস্‌ বাসা!

নিশিদিন নিরন্তর জগৎ জুড়িয়া খেলা
জীবন চঞ্চল!
চেয়ে দেখি রাজপথে চলেছে অশ্রান্ত গতি
যত পান্থ দল;
রৌদ্রপাণ্ডু নীলাম্বরে, পাখীগুলি উড়ে যায়
প্রাণপূর্ণ বেগে,

সমীরকম্পিত বনে নিশিশেষে নব নব
পুষ্প উঠে জেগে;
চারি দিকে কত শত দেবাশোনা আনাগোনা
প্রভাতে সন্ধ্যায়;
দিনগুলি প্রতি প্রাতে খুলিতেছে জীবনের
নূতন অধ্যায়;
তুমি শুধু এক প্রান্তে বসে আছ অহর্নিশি
স্তব্ধ নেত্র খুলি’,—
মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা উঠ পক্ষ ঝাপটিয়া
বক্ষ উঠে দুলি’!

যে সুদূর সমুদ্রের পরপার রাজ্য হতে
আসিয়াছি হেথা,
এনেছ কি সেথাকার নূতন সংবাদ কিছু
গোপন বারতা!
সেথা শব্দহীন তীরে উর্ম্মিগুলি তালে তালে
মহামন্ত্রে বাজে,
সেই ধ্বনি কি করিয়া ধ্বনিয়া তুলিছ মোর
ক্ষুদ্র বক্ষ মাঝে!
রাত্রি দিন ধুক্‌ ধুক্‌ হৃদয়পঞ্জর তটে
অনন্তের ঢেউ,
অবিশ্রাম বাজিতেছে সুগম্ভীর সমতানে
শুনিছে না কেউ!

আমার এ হৃদয়ের ছোট খাট গীতগুলি,
স্নেহ-কলরব,
তারি মাঝে কে আনিল দিশাহীন সমুদ্রের
সঙ্গীত ভৈরব!

তুই কি বাসিস ভাল আমার এ বক্ষবাসী
পরাণ পক্ষীরে?
তাই এর পার্শ্বে এসে কাছে বসেছিস্ ঘেঁষে
অতি ধীরে ধীরে!
দিনরাত্রি নির্ণিমেষে চাহিয়া নেত্রের পানে
নীরব সাধনা,
নিস্তব্ধ আসনে বসি একাগ্র আগ্রহভরে
রুদ্র আরাধনা!
চপল চঞ্চল প্রিয়া ধরা নাহি দিতে চায়
স্থির নাহি থাকে,
মেলি নানাবর্ণ পাখা উড়ে উড়ে চলে যায়
নব নব শাখে;
তুই তবু একমনে মৌনব্রত একাসনে
বসি নিরলস।
ক্রমে সে পড়িবে ধরা, গীত বন্ধ হয়ে যাবে,
মানিবে সে বশ!

তখন কোথায় তারে ভুলায়ে লইয়া যাবি
কোন্ শূন্যপথে!

অচৈতন্য প্রেয়সীরে অবহেলে লয়ে কোলে
অন্ধকার রথে!
যেথায় অনাদি রাত্রী রয়েছে চির-কুমারী,—
আলোক পরশ
একটি রোমাঞ্চ রেখা আঁকেনি তাহার গাত্রে
অসংখ্য বরষ;
সৃজনের পরপ্রান্তে যে অনন্ত অন্তঃপুরে
কভু দৈববশে
দূরতম জ্যোতিষ্কের ক্ষীণতম পদধ্বনি
তিল নাহি পশে;
সেথায় বিরাট পক্ষ দিবি তুই বিস্তারিয়া
বন্ধন বিহীন,
কাঁপিবে বক্ষের কাছে নবপরিণীতা বধু
নূতন স্বাধীন!

ক্রমে সে কি ভুলে যাবে ধরণীর নীড় খানি
তৃণে পত্রে গাঁথা,
এ আনন্দ সূর্য্যালোক, এই স্নেহ, এই গেহ,
এই পুষ্পপাতা?
ক্রমে সে প্রণয়ভরে তোরেও কি করি লবে
আত্মীয় স্বজন?
অন্ধকার বাসরেতে হবে কি দুজনে মিলি
মৌন আলাপন?

তোর স্নিগ্ধ সুগম্ভীর অচঞ্চল প্রেমমূর্ত্তি,
অসীম নির্ভর,
নির্নিমেষ নীলনেত্র, বিশ্বব্যাপ্ত জটাজূট,
নির্ব্বাক্ অধর;
তার কাছে পৃথিবীর চঞ্চল আনন্দগুলি
তুচ্ছ মনে হ’বে,
সমুদ্রে মিশিলে নদী বিচিত্র তটের স্মৃতি
স্মরণে কি র’বে?

ওগো মৃত্যু, ওগো প্রিয়, তবু থাক্‌ কিছুকাল
ভুবন মাঝারে!
এরি মাঝে বধূবেশে অনন্ত বাসর দেশে
লইয়ো না তারে!
এখনো সকল গান করে নি সে সমাপন
সন্ধ্যায় প্রভাতে;
নিজের বক্ষের তাপে মধুর উত্তপ্ত নীড়ে
সুপ্ত আছে রাতে;
পান্থ পাখীদের সাথে এখনো যে যেতে হবে
নব নব দেশে,
সিন্ধুতীরে কুঞ্জবনে নব নব বসন্তের
আনন্দ উদ্দেশে;
ওগো মৃত্যু কেন তুই এখনি তাহার নীড়ে
বসেছিস্‌ এসে?

তার সব ভালবাসা আঁধার করিতে চাস্‌
তুই ভালবেসে?

এ যদি সত্যই হয় মৃত্তিকার পৃথ্বী পরে
মুহূর্ত্তের খেলা,
এই সব মুখোমুখী এই সব দেখাশোনা
ক্ষণিকের মেলা,
প্রাণপণ ভালবাসা সেও যদি হয় শুধু
মিথ্যার বন্ধন,
পরশে খসিয়া পড়ে, তার পরে দণ্ড দুই
অরণ্যে ক্রন্দন,
তুমি শুধু চিরস্থায়ী, তুমি শুধু সীমাশূন্য
মহা পরিণাম,
যত আশা যত প্রেম তোমার তিমিরে লভে
অনন্ত বিশ্রাম,
তবে মৃত্যু, দুরে যাও, এখনি দিয়োনা ভেঙ্গে
এ খেলার পুরী,
ক্ষণেক বিলম্ব কর, আমার দু’দিন হতে
করিয়ো না চুরী!

একদা নামিবে সন্ধ্যা, বাজিবে আরতি শঙ্খ
অদূর মন্দিরে,
বিহঙ্গ নীরব হবে, উঠিবে ঝিল্লির ধ্বনি
অরণ্য গভীরে,

সমাপ্ত হইবে কর্ম্ম, সংসার সংগ্রাম শেষে
জয় পরাজয়,
আসিবে তার ঘোর পান্থের নয়ন পরে
ক্লান্ত অতিশয়,
দিনান্তের শেষ আলো দিগন্তে মিলায়ে যাবে,
ধরণী আঁধার,
সুদূরে জ্বলিবে শুধু অনন্তের যাত্রাপথে
প্রদীপ তারার,
শিয়রে নয়ন-শেষে বসি যারা অনিমেষে
তাহাদের চোখে
আসিবে শ্রান্তির ভার নিদ্রাহীন যামিনীতে
স্তিমিত আলোকে,—


একে একে চলে যাবে আপন আলয়ে সবে
সখাতে সখীতে,
তৈলহীন দীপশিখা নিবিয়া আসিবে ক্রমে
অর্দ্ধ রজনীতে,
উচ্ছ্বসিত সমীরণ আনিবে সুগন্ধ বহি’
অদৃশ্য ফুলের,
অন্ধকার পূর্ণ করি আসিবে তরঙ্গধ্বনি
অজ্ঞাত কুলের,
ওগো মৃত্যু সেই লগ্নে নির্জ্জন শয়নপ্রান্তে
এসো বরবেশে,

আমার পরাণ বধূ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া
বহু ভালবেসে
ধরিবে তোমার বাহু; তখন তাহারে তুমি
মন্ত্র পড়ি নিয়ো;
রক্তিম অধর তার নিবিড় চুম্বন দানে
পাণ্ডু করি দিয়ো!

১৭ অগ্রহায়ণ, ১৩০০।