স্রোতের গতি/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

স্রোতের গতি

প্রথম পরিচ্ছেদ

মাসী বোন‍্ঝী

“বিবাহ-নিবারিণী” সভার সহকারী-সম্পাদিকা অমিয়ার ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ হওয়ায়, সেদিন তাহার বাড়ীতে অনেকগুলি মহিলা-বন্ধুর সমাগম হইয়াছিল। বন্ধুরা রোগী দেখিতে—সহানুভূতি জানাইতে আসিয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদের সুবাস স্নিগ্ধ মূল্যবান্ প্রচুর পোষাক-পরিচ্ছদ, পরিপাটি কেশ বিন্যাস প্রভৃতি দর্শকের চক্ষে উৎসব গৃহের সম্ভাবনারই ধাঁধা জন্মাইতেছিল।

 ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ সংক্রামক জ্বর। তাই ইঁহারা অত্যন্ত সংক্ষেপে ও অল্পকালে যথাযোগ্য সম্ভাষণাদি জানাইয়া, আল‍্গোছে থাকিয়া, বিদায়-গ্রহণ করিতেছিলেন। কি জানি, সংক্রামক রোগের জীবাণু অলক্ষ্যে কখন শরীরাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া যায়! গৃহে সেদিন সকলেরই প্রায় বিশেষ প্রয়োজন—দুই দণ্ড বসিয়া গল্প করিবারও অবকাশ নাই ইত্যাদি শিষ্টাচার-সম্মত বাঁধা বুলি চলিতেছিল। অমিয়া বিছানায় শুইয়া সকলের সহিত যথাযোগ্য আলাপসম্ভাষণ করিতেছিল।

 হেমাঙ্গিনী অমিয়াদের সভার মেম্বার। সে রুমালে মুখ মুছিয়া, মাথার চুল দু-একটি যাহা স্থানচ্যুত হইয়া মুখে আসিয়া পড়িয়াছিল, তাহা ঘরের বড় আয়নাখানার পানে চাহিয়া সুবিন্যস্ত করিয়া লইয়া ক্ষীণস্বরে কহিল—“ভাল করে চিকিৎসা করান্—অসুখের সময়—আমার মনে হয়-ও পুরুষ-ডাক্তার দেখানই ভাল। যতই হোক্ ওঁরা হাতেকলমে শিক্ষা পেয়েছেন বেশী কিনা, রোগ নির্ণয়ে ওঁদের ক্ষমতা বেশী, তা’ অবশ্য স্বীকার কতে হবে।”

 বিধুমুখী কহিলেন—“আমিও সেই কথা বলি, সভা কর যা কর—ওঁদের বাদ দিতে গেলে কি চলে? না না, চিকিৎসার সঙ্গে ছেলেমানুষি কোরো না। একজন বড় নামজাদা কোন ডাক্তারকে ডাক। লেডি ডাক্তারদের কর্ম্ম নয় এসব।”

 মিসেস্ নাগ অনেকদিন হইতেই এই বুদ্ধিমতী সুন্দর মেয়েটিকে একটু বিশেষভাবে স্নেহ জানাইয়া আসিতেছেন। তাঁহার আশা আছে, অদূর ভবিষ্যতে তাঁহার ইংলণ্ডপ্রবাসী ভাগিনেয়ের জন্য এই পুরুষ-বিদ্বেষিণী মেয়েটির বিমুখ মন একদিন তিনি ফিরাইয়া আনিতে পারিবেন। তাই তাঁহার টান কিছু বেশী,—কহিলেন—“ও-সব সভা-টভার হাঙ্গাম তুমি ছেড়ে দাও বাছা, এই শরীর নিয়ে খেটে-খেটে শেষে কি একটা বিপদ্ বাধিয়ে বস‍্বে? বরং বিকেল-বেলা আমার ওখানে মধ্যে-মধ্যে যেও। ডলি, অফি এসেচে ছুটিতে, মাঝে মাঝে গড়ের মাঠে হাওয়া খেয়ে এস। আগে শরীর তারপর অন্য কিছু। আমি গাড়ী পাঠিয়ে দেব, যেও মাঝে-মাঝে—বুঝলে?”

 অমিয়া ধন্যবাদ জানাইয়া কহিল—“সুবিধা হয় ত খবর দেবো।”

 “না বাছা, সুবিধা-টুবিধা ওসব চালাকী আমি শুনব না—যেতেই হবে” বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বাহিরে তাঁহার মোটরের হর্ণ ঘন ঘন শব্দ করিয়া ত্বরা জানাইয়া দিতেছিল।

 অমিয়ার মাসীমা সত্যবতীকেও অনেকে অমিয়ার শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখিবার অযাচিত উপদেশ দিলেন। সত্যবতী শুধু একটুখানি হাসিলেন, কোন জবাব দিলেন না। বিদায়-পর্ব্ব সারিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। মাথার যন্ত্রণায় অমিয়া “আঃ উঃ” করিতেছিল। সত্যবতী মাথার কাছে বসিয়া সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন।

 এই দুইটি মাত্র নারীকে লইয়া ইহাদের ক্ষুদ্র সংসারটি গঠিত হইয়াছিল। অমিয়ার মা যেদিন বিপত্নীক পিতার হাতে এগারো মাসের শিশু অমিয়াকে সঁপিয়া দিয়া পরলোকের পথে যাত্রা করিলেন, সেদিন রাগে ও শোকে অকালবৃদ্ধ ত্রিপুরাচরণের এই শিশুর ভার, দুঃসহ বলিয়া অনুভূত হইয়াছিল। কিন্তু নিরানন্দ মৃত্যুপুরীর ন্যায় নির্জ্জন এই অন্ধকার-গৃহে যখন শিশু-কণ্ঠের কলহাস্য আবার জীবনের চাঞ্চল্য জাগাইয়া তুলিল, তখন বুদ্ধের জীবনসায়াহ্নটা আবার সহনীয় ও বহনীয় বলিয়া মনে হইল। এই মেয়েটিকে খেলা দেওয়া, সঙ্গ দেওয়া, শিক্ষা দেওয়া, যত্ন করাই যেন তাহার জীবনের একমাত্র কার্য্য হইয়া উঠিল। ইহাকে ছাড়িয়া তিনি কোথাও যাইতে পারেন, এক মুহূর্ত্ত চোখের বাহিরে রাখিতে অন্ধকার দেখেন। মেয়েটিও তাঁহাকে সর্বান্তঃকরণে ভালবাসিত। কান্নাকাটি ছিলই না। শিশুকাল হইতে নারীহীন সংসারে পুরুষসাহচর্য্যে বর্জিত হওয়ায়, তাহার ধরণ-ধারণে বালিকাভাবের পরিবর্ত্তে বালকের ভাবই অধিক দেখা যাইত। হাঁড়িকুঁড়ি পুতুল লইয়া খেলার চেয়ে বই বগলে স্কুলে যাওয়া, কঞ্চির তীর ধনুক, ঘুড়ী লাটাই লইয়া খেলা করা—তাহার ভাল লাগিত। মেয়েটির বয়োবৃদ্ধির সহিত ত্রিপুরাচরণ তাহাকে লেখাপড়া শিক্ষা দিতেছিলেন। মেধাবিনী বালিকা অতি দ্রুত শিক্ষা করিয়া মাতামহকে বিস্মিত ও পুলকিত করিয়া তুলিতেছিল। কিন্তু এ অনাবিল শান্তি-সুখটুকুও ত্রিপুরাচরণের অদৃষ্টে সহিল না।

 অমিয়ার মা ছাড়া তাঁহার আর এক কন্যা ছিল। ছোট মেয়ে সত্যবতীর অল্প-বয়সে বিবাহ হইয়াছিল— সেই পর্য্যন্ত সে শ্বশুরগৃহেই বাস করিতেছিল। ত্রিপুরাচরণ মেয়েকে আনিবার জন্য অনেকবার চেষ্টা করিয়া শেষে হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। লোকমুখে মধ্যে-মধ্যে জামাতার দুশ্চরিত্রতা ও দুর্ব্বৃত্ততার সংবাদ পাইতেন। নিরুপায়ে নীরবে সহ্য করিয়া থাকা ছাড়া তাঁহার আর উপায় কি ছিল? অমিয়ার প্রতি অধিক মনোযোগী হইয়া তাই তিনি মনের ক্ষোভ মিটাইতে চাহিতেন।

 বালিকা-বধূ সত্যবতীর স্বামীর নিকট অমানুষিক নির্য্যাতনভোগ ছাড়া অন্য কোন পাওনাই ছিল না। স্বামীকে সে যমের ন্যায় ভয় করিত। তিনি সজ্ঞানে বাড়ী আসিলে সে যে কোথায় গিয়া লুকাইবে, তাহার স্থান খুঁজিয়া পাইত না। পৌষ মাসের দারুণ শীতে একবস্ত্রা বালিকা ছাদের চিলের ঘরের কার্ণিশের ধারে উবুড় হইয়া পড়িয়া থাকিত। কখনও অন্ধকারে আমবাগানে গাছের তলায়, অথবা পুকুরঘাটের অব্যবহৃত ভগ্ন অংশে, লেবুগাছের ঝোপের আড়ালে লুকাইয়া থাকিত। সাপের ভয়, কাঁটার ভয়, ভূতের ভয়ও তার স্বামীর ভয়ের কাছে তুচ্ছ ছিল। পরদিন বাড়ীর লোকে যখন তাহাকে আবিষ্কার করিত, তখন সেই মৃত প্রায় ভয়ার্ত্তা বালিকার উপর স্বামীর যে অমানুষিক অত্যাচার চলিত, তাহা কোন মানুষে যে মানুষের উপর করিতে পারে, তাহা মনে হয়। বধূর ‘একগুঁয়েমি’র জন্য বিরক্তচিত্ত হৃদয়হীন সংসারের লোকেরাও তার রক্ষার উপায় দেখিত না— ছাড়াইয়া লইত না। পদাঘাতে মূর্চ্ছিতা, মৃতপ্রায় পত্নীকে ফেলিয়া রাখিয়া স্বামী যখন বীরদর্পে বাহির হইয়া যাইতেন, তখনও কেহ কাছে আসিয়া, একটা সান্ত্বনার ভাষা ব্যবহার করিত না। মেয়েমানুষের এত ‘গোঁ’—‘যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল’—ইহাতে বলিবার কথা ছিলই বা কি?

 এমনি করিয়া জীবনের স্মরণীয় সুদীর্ঘ চারিটি বৎসর কাটাইয়া, চতুর্দশবর্ষীয়া সত্যবতী একদিন শুনিল, লাঞ্ছনা, নির্য্যাতন এবং সধবার সর্ব্ব-সৌভাগ্য হইতে নির্ব্বাসিত করিয়া তাহার অভাগা স্বামী তাহাকে চিরদিনের জন্যই মুক্তি দিয়া গিয়াছেন। বেশ্যালয়ে অত্যধিক মদ্যপানে যকৃৎ বিদীর্ণ হইয়া তাঁহার অকস্মাৎ মৃত্যু ঘটিয়াছে। শুনিয়া বাড়ীর আর সকলের সহিত সেও প্রথমটা খানিক কাঁদিয়াছিল। তারপর, হাতের লোহা, চুড়ী খুলিয়া, সিঁদূর মুছিয়া শান্তমুখে বিধবার বেশ গ্রহণ করিল।

 এবার ত্রিপুরাচরণ মেয়েকে লইয়া যাইতে চাহিলেন— কেহ আর কোন আপত্তি করিল না। ‘অপয়া’ ‘রাক্ষসী’ বধূ বিদায় হওয়াই সংসারের পক্ষে মঙ্গল—এই বয়সে যাহার অনাচারে স্বামী মরিল, তাহার সংস্পর্শে না জানি আবার কি বিপদ্ ঘটিবে?

 শ্বাশুড়ী কাঁদিয়া কহিলেন—“বাছা আমার যে ক’দিন বেঁচে ছিল, এ হতভাগী রাক্ষুসীর জ্বালায় হাড়েনাড়ে জলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল। এক দিনের তরে সংসারের সুখ পেয়ে গেল না। ওর নিশ্বাসে-নিশ্বাসে শুখিয়ে কাট হ’য়ে গেল। নৈলে সে কি আমার বাবার ছেলে? ওর জ্বালাতেই না মন্দসঙ্গ কর‍্তে শিখেছিল, নৈলে বাছা আমার কখন উপরপানে চোক তুলে চাইতে জান‍্ত না। দেখ‍্চ না, রাঁড় হয়ে যেন ষাঁড় হয়েছে। সে চোরের মতন ভয়ে-ভয়ে চাউনিও নেই, কিছুই নেই, ওর আর কি? যেতে দুঃখিনীর ধন আমারই গেল।”

বন্ধুর প্রতি আক্রোশে তাঁহার মনে পড়িল না যে, সপ্তদশ-বর্ষীয় পুত্রের দুশ্চরিত্রতার ভূরি-ভূরি প্রমাণ পাইয়াই তিনি অনেক চেষ্টায় তাড়াতাড়ি তাহার বিবাহ দিয়া চরিত্রসংশোধন করিতে চাহিয়াছিলেন। যে কার্য্য শাসনভয়প্রদর্শন প্রভৃতিতে তাঁহাদের দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, একটি ভয়চকিতা দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকার শক্তিতে তাহা হইল না বলিয়াই তাঁহারা জাতক্রোধ হইয়া উঠিলেন। দুরূহ কার্য্যে তাহার সহায় হইলেন না, সান্ত্বনা দিলেন না, সহানুভূতি দেখাইলেন না। পশুপ্রকৃতি স্বামীর চিত্তবিনোদনে অসমর্থ বলিয়া তাঁহারাও তাহাকে নির্য্যাতন করিতে ছাড়িলেন না। মানুষ দুর্ব্বলের প্রতি এমনি করিয়াই অবিচার করে।

 স্বামীদত্ত আঘাতের অলঙ্কার-চিহ্ন সর্ব্বাঙ্গে বহন করিয়া, তাঁহারই স্মরণার্থ বাকী জীবনের সমস্ত সুখ-সাধে জলাঞ্জলি দিয়া, অনেক দিনের পর সত্যবতী আবার তাহার স্নেহময় পিতৃক্রোড়ের নিরাপদ আশ্রয়নীড়ে ফিরিয়া আসিল। বাপের চোখের জলের সহিত চোখের জল মিলাইয়া সে আজ নিজের জন্য কাঁদিতে পারিল না। তাহার জ্বালাময় অশ্রুহীন নেত্র নিয়ত অর্থহীনভাবে চাহিয়া থাকে। মুখে চোখে শোক বেদনার কোন ছায়া ফুটে না। শান্তি বা তৃপ্তির তাহার আর ছিলই বা কি যে পাইবে? বাহির হইতে তাহাকে দেখিয়া অনেকে মনে করিত, স্বামীর নির্য্যাতন-অত্যাচারের হাত হইতে মুক্তি পাইয়া অকালবৈধব্যেও সত্যবতী হয়ত মনে-মনে খুসী হইয়াছে। কিন্তু আমরা বলিব তাহা নহে। সত্যবতী খুসী ত হয়ই নাই, বরং তাহার শোচনীয় পরিণামে ব্যথিতই রইয়াছিল। কিন্তু সে দুঃখ তাহার নিজের জন্য নহে। ‘আমার কি হইল’ তাহাতে এ ভাব ছিল না, ‘তোমার কি হইবে’ এই চিন্তাই তাহাতে বর্ত্তমান। মনের যখন এমনি অবস্থা, তেমনি সময় বালকণ্ঠের মধুমাখা স্বরে মাতামহের শিক্ষানুসারে ‘মা’ বলিয়া ডাকিয়া অমিয়া মাসীর ক্রোড়ে আশ্রয় লইল— দু’খানি কোমল বাহুলতায় তাহার কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া ধরিল। তখন সুখদুঃখের অতীত অবস্থা হইতে ধীরে-ধীরে সত্যবতীর সংসার-বিরাগী চিত্ত আবার সংসারের মায়াজালে কেমন করিয়া যে বাঁধা পড়িয়া গেল, তাহা সেও অনুভব করিতে পারিল না। বালিকার ‘মা’-ডাক বড় মধুর, বড় স্নিগ্ধ লাগিলেও সত্যবতী তাহাকে মা বলিয়া ডাকিতে দিল। যে নারী স্ত্রীর অধিকার লইল না—মনে-প্রাণে স্ত্রী। হইতে পারিল না, ‘মা’ হইবার অধিকার তাহাকে কে দিয়াছে? না—সে ‘মা’ নয়, শুধু মাসী!

 জীবনে স্বামীকে সে ভালবাসিতে পারে নাই। তাঁহার মৃত স্মৃতিকে পূজা করিতেও পারিল না। সত্যবতী এখন আর বালিকা নাই—তাহার জীবনের আকস্মিক পরিবর্ত্তন সুধু অবস্থায় নয়, তাহার শরীর-মনেও গভীর ছায়া ফুটাইয়া, হাত বুলাইয়া দিয়া গিয়াছিল, যৌবনেই তাহাকে প্রৌঢ়ার মত দেখাইত। বিধবার আচার সংযম সাধন সমস্তই সে খুঁটাইয়া পালন করিত। আর, বাপ ছাড়া জগতের পুরুষজাতিকে সে ঘৃণা করিত। অমিয়ার বাপের হৃদয়হীনতা তাহার এই অশ্রদ্ধার অনলে আহুতি যোগাইয়া দিল। ভগিনীপতি তাঁহার নিজের সংসারে এমনি তদগতচিত্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, একদিন পত্রদ্বারাও মেয়ের একটা কুশল সংবাদ লইবার সময় করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সত্যবতীর মনে হইল, সাধারণ পুরুষের কাছে পত্নীপ্রেম ও সন্তানবাৎসল্যের মূল্য তবে একই!

 সংসারের নানা প্রতিকূল ঘটনায় এ বিশ্বাসের ভিত্তি দৃঢ়ই হইতেছিল। বাড়ীর পাশেই এক অবিবাহিত ইংরাজ-মহিলার বাসা। জানালায় দাঁড়াইয়া সত্যবতী তাঁহার সহিত গল্প করিত। আর খ্রীষ্টীয়-সমাজে বিবাহিতা নারীমণ্ডলীর ভূরি-ভূরি দুরবস্থার কাহিনী সংগ্রহ করিয়া লইত। মাসীর শিক্ষা অনুসারে অমিয়া যদি কোনদিন শাড়ীর আঁচল মাথায় দিয়া বলিত,—“মাছীমা, আমি ছছুলবালী দাব”—সত্যবতী বাধা দিয়া কহিত—“ছিঃ শ্বশুরবাড়ী যেতে নেই, সেখানে ‘জুজু’ থাকে। তুমি আমার কাছে থেকো—কক্ষনো শশুর-বাড়ী যেও না।” বালিকা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথার কাপড় খুলিয়া ফেলিয়া, হাত দিয়া চোখ মুছিয়া বলিত—“ছিঃ, ছছুবালী দুত্তূ—দেতে নেই—দাব না।

 সত্যবতী হাসিয়া মেয়েকে বুকে তুলিয়া লইয়া বলিত—“মনে রেখো—আলেয়া দূর থেকেই আলো দেখায়, কাছে এলে গলা টিপে ধরে।”

 ত্রিপুরাচরণের ভিতরটা রোগে শোকে অন্তঃসারশূন্য হইয়া গিয়াছিল। একবার একটু বেশী জ্বর হওয়ায় সে ধাক্কা আর সামলাইতে পারিলেন না। অনাথিনী কন্যা ও দৌহিত্রীর চিন্তা করিতে করিতেই তিনি এখানকার হিসাব মিটাইয়া দিলেন।

 পিতার মৃত্যুতে সহায়হীনা সত্যবতী ভগিনীপতিকে উচিত বোধে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিল—“তাহার জন্য না হউক, অমিয়ার জন্যও এখানকার বিষয়-সম্পত্তির বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া একমাত্র ত তাঁহারই উচিত কার্য্য।” ভগিনীপতি নিমন্ত্রিতের মত কেবল শ্রাদ্ধের দিন একবার দর্শন দিয়াই চলিয়া গেলেন। বাড়ীতে স্ত্রীর শরীর খারাপ—ছেলের পরীক্ষা নিকটবর্তী, ছোট মেয়েটির সর্দ্দি দেখিয়া আসিয়াছেন, বিলম্ব করিবার ত উপায় নাই! নহিলে এসব হাঙ্গাম পোহান’ ত তাঁহারই কর্ত্তব্য। কিন্তু কি করিবেন, তিনি যে একান্তই নিরুপায়।

 বাবা আসিয়াছেন শুনিয়া অমিয়া ছুটিয়া বাহিরে আসিয়াছিল। এখন আর সে নিতান্ত ছোটটি নাই। নিজের অবস্থা অনেকখানি বুঝিতে পারে। স্কুলের মেয়েদের বাড়ী গিয়া দেখে, তাহাদের অনেকেরই বাবা আছেন। বাবা কত ভালবাসেন, কত আদর করেন, সে মনে মনে ভাবে, কবে তাহার বাবা তাহাকে দেখিতে আসিবেন, আসিলে সে আর সহজে ছাড়িয়া দিবে না। মাসীমার অনুমতি লইয়া সে একবার তাহার বাবার বাড়ী দেখিয়া আসিবে, তাহার ছোট ছোট ভাই বোন্ গুলিকে আদর করিবে, ভালবাসিবে। মাসীমার কাছে এসব কথা সে কিছুই বলে না, বলিতে সাহসও করে না। তাহার কারণ, সে বুঝিতে পারে, মাসীমা তাহার ভাই বোন্ গুলিকে ভালবাসেন না—আর তার বাবাকে ঘৃণা করেন। তাই অনেক দিনের রুদ্ধ উচ্ছাস সহসা ছুটিয়া বাহির হইতে গিয়া আবার বাধাপ্রাপ্ত হইয়া, এক মুহূর্ত্তে থমকিয়া ফিরিয়া গেল। অমিয়া পিতাকে প্রণাম করিলে, তিনি সবিস্ময়ে এই অপরিচিতা সুন্দরী মেয়েটির পানে চাহিয়া আছেন দেখিয়া, একজন পরিচয় করাইয়া দিলেন— “এটি আপনারই মেয়ে যে—অমিয়া”—।

 ‘ওঃ’ বলিয়া পিতা কন্যার প্রতি সকল কর্ত্তব্য সমাধা করিয়া পার্শ্বোপবিষ্ট ভদ্রলোকটির সহিত আবার আপনার আলোচ্য-বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করিতে আরম্ভ করিলেন—“ছেলেটির অসাধারণ মেধা। বেঁচে থাকে যদি, দেখে নেবেন মশাই, নিজের সন্তান বলে বাড়িয়ে বল্‌চি বলে যেন ভাব‍্বেন না কালে সে একজনা হবে, দেখে নেবেন। ওর গর্ভধারিণীও এই কথা বলেন,—বলেন, তাঁর বরাতে এমন হীরের টুকরো ছেলে বাঁচ‍্লে হয়! এই ধরুন্ না—একটা সামান্য উদাহরণ দিই। বল্লে না প্রত্যয় যাবেন, কি অসাধারণ মেধা আর উপস্থিত বুদ্ধি এইটুকু ছেলের। সেদিন ওদের ইস্কুলের প্রমোশন হ’ল। অনেক ছেলে প্রাইজ্ পেলে, বঙ্কু আমার খালি-হাতে বাড়ী এল দেখে আমি বল্লাম—“কৈ বঙ্কু তোমার প্রাইজ কৈ? তাতে ছেলে কি জবাব দিলে জানেন মশাই? বঙ্কু আমার হেসে বল্লে—“প্রাইজ ত ভারী,—ক’খানা বই আর একটা ঘড়ি! আমার ত আর বইয়েরও অভাব নেই, ঘড়িরও অভাব নেই, দু-দুটো ঘড়ি আমার নিজের। টাকা দিলেই বাজার থেকে অমন কেন ওর চাইতে ঢের ভাল ভাল বই এক্ষুণি সর্দার গিয়ে কিনে এনে দেবে। বিনয় শিশির ওরা গরীবের ছেলে, বাপের জন্মে কখনো ত ঘড়ি দেখেনি —ওরাই দেখুক। ইচ্ছে কল্লে আমিই কি আর সেকেণ্ড, হ’তে পাত্তুম না? দয়া করে কেবল হইনি—তাই ওদের লম্পঝম্প!”

 এই অপরিচিত পিতা এবং ততোধিক অপরিচিত সন্তান-বাৎসল্য বালিকার স্নেহপিপাসু চিত্তে সবলে একটা বেদনার আঘাত দিয়া মুহূর্তে তাহাকে ঠেলিয়া দূরে সরাইয়া দিল। তাহার কালো চোখে জল ভরিয়া আসিয়াছিল; পাছে এ দুর্বলতাটুকু বাপের চোখে পড়ে এই ভয়ে সে আস্তে আস্তে চিরদিনের জন্যই পিতৃসান্নিধ্য ত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিল। সারাজীবনের পিতৃয়েহের এইটুকু স্মরণচিহ্নই তাহার সম্বল। নিজের ঘরে মেঝের উপর লুটাইয়া পড়িয়া কেনই যে সে ফুলিয়া ফুলিয়া দিয়াছিল, তাহার কারণ হয় ত সে নিজেই জানিত না।

 অনেকক্ষণ কাঁদিয়া মনের ব্যথা যখন কমিয়া আসিল, সে উঠিয়া মাসীমার খোঁজে গেল। সত্যবতী তাঁহার একমাত্র স্নেহময় আশ্রয় পিতার শ্রাদ্ধকার্য্য সমাধা করিয়া, সেই মাত্র পিতার একখানি আলোকচিত্রের কাছে মাটিতে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিতেছিলেন। মুখেও মৃদু মৃদু দুইটি শব্দ উচ্চারিত হইতেছিল—“বাবা বাবা”! যে প্রিয়-সম্বোধন চিরদিনের জন্যই ফুরাইয়াছে, তাহার লোভটুকু যে এখনও ষোল আনাই অপূর্ণ রহিয়া গিয়াছে। অমিয়া নিঃশব্দে মাসীমার অনুকরণে তেমনি করিয়াই মাটিতে মাথা লুটাইয়া মাতামহের চিত্রের কাছে প্রণত হইল। মনে হইতেছিল, দাদামহাশয় স্বর্গে বসিয়া আজ তাহার দুরবস্থা দেখিয়া হয় ত হাসিতেছেন—“কেমন বড় যে বাবার নিন্দা করলে কোঁদল কর্‌তিস্—এখন কেমন জব্দ! বাবা একটা কথাও ত কইলে না!”

 সত্যবতী প্রণাম সারিয়া মাথা তুলিতেই অমিয়া আস্তে আস্তে তাহার কোলের কাছে ঘেঁসিয়া সরিয়া বসিয়া ডাকিল—‘মা’। সত্যবতী চমকিয়া তাহার বিষন্ন মুখের পানে চাহিয়া দেখিলেন; গভীর স্নেহে একটুখানি কাছে টানিয়া ক্ষীণস্বরে কহিলেন—“মা তোমার স্বর্গে আছেন অমি, তিনি যে পুণ্যবতী ভাগ্যবতী, তাই মার কোলে বাবার কোলে আজ তাঁর স্থান! তোমার বাবার কাছে গেছ্‌লে?”

 অমিয়া মাথা হেলাইয়া জানাইল—গিয়াছিল।

 “কিছু বল্লেন? তোমায় ডাকলেন কাছে?”

 সত্যবতীর মুখে উদ্বেগচিহ্ন পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। মেয়ে মাথা নাড়িয়া জানাইল—“না।” চোখের জল পাছে মাসীমার চোখে পড়ে, তাই মুখ না ফিরাইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল।

 এ ছলনাটুকু মাসীমার চোখে কিন্তু চাপা রহিল না। উদ্বেলিত নিশ্বাসটা জোর করিয়া চাপিয়া ফেলিয়া কহিলেন —“কাঙ্গালীরা বোধ হয় খাচ্চে, ওদিক্‌টায় ভারী গোলমাল হচ্চে, চল্ দেখি—দেখে আসি তারা সব পাচ্চে টাচ্চে কি না!”

 অমিয়া তাড়াতাড়ি হাত দিয়া চোখ মুছিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সত্যবতী বাহিরে আসিলে সে তাঁহার অনুসরণ করিয়া চলিতে চলিতে কহিল—“দাদামশাই কাঙ্গালীদের খাওয়াতে কত ভালবাস্‌তেন—ও বচ্ছর পুরীতে যেদিন কাঙ্গালী-ভোজন করান হ’ল, দাদামশাই নিজে হাতে থালা নিয়ে, আমের ঝুড়ি নিয়ে সব পরিবেশন কর্‌তে লাগ্‌লেন। সেখানে কিন্তু বেশ—না মাসীমা? কম্ পড়্‌লে বাজার থেকে ভাত তরকারী কিনে আনা যায়। দ্রৌপদী বলে—ঠাকুরের প্রসাদ কণারত্তি মুখে দিলে পেট ভরে যায়। কৈ আমার ত তা যেত না, বরং সুমুদ্দুরের হাওয়া খেয়ে-খেয়ে এখানকার চার-ডবল খিদেই হ’ত-তোমার হ’ত না মাসীমা?”

 সত্যবতী একটা ছােট রকম নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন—“হ’ত বােধ হয়! চল অমি, আমরাও নিজে-হাতে ওদের পরিবেশণ করি গিয়ে, বাবা স্বর্গে থেকে দেখ্‌তে পেলে তৃপ্তি পাবেন।”

 বালিকার বিস্মৃতপ্রায় বেদনা আবার সহসা বাজিয়া উঠিল। সে বিষণ্ণ-মুখে কহিল—“সকলের বাবা এক রকম হয় না—না মাসীমা? তােমার বাবা খুব ভাল!”

 এমন সময় সত্যবতী খবর পাইলেন—জামাইবাবু বাড়ী চলিয়া গিয়াছেন। তাঁহার বিলম্ব করিবার সময় নাই— বাড়ীতে ছেলে-মেয়েদের কাহার-কাহার শরীর খারাপ দেখিয়া আসিয়াছেন; বাড়ীর ভিতর গেলে আবার বিলম্ব হইয়া পড়িবে, তাই বাহির হইতেই চলিয়া গিয়াছেন। বলিয়া গিয়াছেন, এ দিকের গােলমাল চুকিয়া গেলে অবসরমত একদিন তখন দেখা করিয়া যাইবেন, আজ বড়ই তাড়াতাড়ি।

  শুনিয়া সত্যবতী স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। এই আত্মীয় বান্ধব ও অভিভাবকহীন সংসারে অনাথা বিধবা ও বালিকার একমাত্র অভিভাবক যে এখন একমাত্র উনিই। বিষয় সম্পত্তি যাহা আছে তাহার, আর এই দুইটি শােকার্ত্তা নারীর রক্ষণাবেক্ষণের কোন ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া—ইহা কি উঁহারই কর্ত্তব্য ছিল না? মনে হইল, জগতের পুরুষমাত্রই তবে এমনই অন্তঃসারশূন্য। সন্তানবাৎসল্য উহাদের স্বার্থের দ্বারে মাথা গলাইতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গীয় পিতৃমূর্ত্তি স্মরণ হওয়ায় সত্যবতী মনে মনে প্রণাম করিয়া ভাবিলেন—“বাবা ত সাধারণ পুরুষদের আদর্শ ছিলেন না। তাই চোদ্দ বছর মৃত স্ত্রীর স্মৃতির গৌরব রক্ষা করেছিলেন। আর অমির বাপ,— ছিঃ।”—সত্যবতী সবেগে চিন্তার ধারা ফিরাইয়া লইলেন। অমিয়াকে, যদি সম্ভব হয়, তিনি আজীবন অনূঢ়াই রাখিয়া দিবেন। পুরুষের ছদ্মবেশ-ভেদের দক্ষতালাভে যখন তাঁহার পিতাও সমর্থ হন নাই, তখন তাঁহারই বা আশা কোথায়? কোন্ অকৃতজ্ঞ হৃদয়হীন পুরুষের হাতে তিনি তাঁহার এই লােকললামভূতা স্নেহের ধনকে তুলিয়া দিবেন? লােকনিন্দা সমাজচ্যুতি—তা সে মাথার মণি করিয়া সগর্ব্বে বহন করিবেন—তবু প্রাণ ধরিয়া পাষাণের কণ্ঠে মুক্তামালা দুলাইবেন না।

 সত্যবতীর মনে পড়িতেছিল তাঁহার বাল্যসখী কিরণের কথা। আহা, অভাগিনি কিরণ! রূপ দেখিয়া বিনা পণে যে দিন ধনীগৃহে তাহাকে লইয়া যায়, পাড়ার লােকে বলিয়াছিল,— “কিরণের বাপ ভারী জিতিয়াছে।” কিন্তু সে মত বছর না ফিরিতেই তাহাদের বদল করিতে হইয়াছিল। বিবাহের পর প্রথম যেদিন দুই সখীতে মিলিত হইলেন, সত্যবতীর মনে পড়ে, কিরণকে তিনি আরও কত সুন্দর দেখিয়াছিলেন। কিরণের সুখের কথার সেদিন যেন আর শেষ হইতেছিল না। স্বামীর আদর সোহাগ ভালবাসার অফুরন্ত কথায় সে যেন মাতাল হইয়া উঠিয়াছিল। নিজের সৌভাগ্য-গর্ব্বে মাটীতে পা পাতিয়া চলিতেও যেন তাহার বাধিতেছিল, চোখে-মুখে হাসিতে কি অপরূপ শ্রদ্ধা ও প্রেম ফুটিয়া উঠিয়াছিল! সত্যবতী অবাক্ হইয়া সেদিন ভাবিয়াছিলেন, কি তপস্যা করিলে কিরণ হওয়া যায়—অমনি করিয়া স্বামীর রূপগুণের, স্নেহ ভালবাসার কাহিনী শুনাইতে পারা যায়? হায়, তখন কি তাঁহারা জানিতেন যে বিদ্যুৎশিখা শুধু পথিককে পথভ্রান্ত করিয়া অন্ধকারের গাঢ়ত্বই বাড়াইয়া দেয়! বিলাসী ধনীযুবকের রূপের মোহ দুই দিনেই ফুরাইয়া গেল। পত্নীপ্রেমে তাহার তৃপ্তি হইল না।

 বিধবা হইয়া সত্যবতী যেদিন ফিরিয়া কিরণের মৃত্যু শয্যাপার্শ্বে তাহাকে দেখিতে গেলেন, সেদিন আনন্দময়ী কিরণের কঙ্কালসার ছায়ামূর্ত্তি দেখিয়া, লোকের মুখে তাহার বিবাহিত জীবনের পরিশিষ্টটুকু শুনিয়া তাঁহার মনে হইল, দুর্ভাগ্যে কিরণ তাঁহাকেও জয় করিয়াছে। তাঁহার স্বামী তাঁহাকে দিয়া বারাঙ্গনার পরিচর্য্যা করাইয়া লন নাই। সর্ব্বস্ব কাড়িয়া লইয়া তাঁহাকে দিয়াই সপত্নীকে বরণ করাইয়া ঘরে তুলেন নাই। তাহার পর আসন্নমৃত্যু বুঝিয়া চাকর দিয়া তাঁহাকে একবস্ত্রে বাপের বাড়ী পাঠাইয়াও দেন নাই। তবু কিরণ মরণকালেও সেই স্বামীকে দেখিতে, তাহার পায়ের ধূলা পাইতে চাহিয়াছিল। তাহার শেষ-দৃষ্টি শেষ-বাক্য সেই পাষণ্ডের উদ্দেশেই ব্যয়িত হইয়াছিল। “এলেন না? জন্মশোধ একবার দেখে যেতে পেলাম না?”—এই ছিল তার শেষ কথা। সে নিজের ললাটে হাত দিয়া বলিয়াছিল, সবই তাহার ভাগ্য; স্বামীকে সে এজন্য কোন কটু কথা বলে নাই, নিন্দা করে নাই। জন্মান্তরে যেন তাঁহাকে সুখী করিতে পারে, ইহাই ছিল তাহার কামনা। হা রে অভাগিনি নারি! অস্থি-মজ্জায় অন্তরে-বাহিরে দাসীত্বের শৃঙ্খল কি এমনি করিয়াই পরিতে হয়? এ হীনতার বন্ধন কি জন্মান্তরেও মুক্ত হইবার নয়? যদি কামনার কিছু থাকে, চাহিতেই যদি হয়, তবে বল— “হে ভগবন্, নারীজন্ম যেন আর না হয়।”

 এই মাসীমার শিক্ষা ও সাহচর্য্যে শৈশব অতিবাহিত হওয়ায়, যৌবন অমিয়াকে যে পুরুষদ্বেষিণী করিয়া তুলিবে, ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই ছিল না। প্রতিবেশিনী ইংরাজকুমারী হেলেন অমিয়াকে বড় ভালবাসিতেন। তাঁহারই চেষ্টায় অমিয়ার স্কুলে ও বাড়ীতে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হইয়াছিল। বিবাহ-নিবারিণী সভার তিনি একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষিকা। তাঁহারই চেষ্টায় কলেজ হইতে বাহির হইয়া অমিয়া এই সমিতির সংস্রবে আসিবার সুযোগ পাইয়াছিল।