হারানো খাতা/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ

তবে পরণে ভালবাসা কেন গো দিলে, রূপ না দিলে যদি বিধি হে!
পূজার তরে হিয়া, উঠে যে উথলিয়া, পূজিব তারে গিয়া কি দিয়ে?

—মানসী

 বিবাহিত জীবনের এই কয়টা বৎসরে স্বামীর যে পরিচয় পরিমল পাইয়াছিল, তাহাতে তাঁহার চরিত্রে আর যতই যা থাক একটা প্রচণ্ড জিদ যে ছিল ইহা নিঃসন্দেহ রূপেই সে জানিয়াছে। স্বামী তাহার সদানন্দ ভোলানাথ কিন্তু একটুখানি অবাধ্যতায় আবার তাঁর সেই সদাশিব রুদ্ররূপে পরিবর্ত্তিত হইয়া দাঁড়াইতে দেখা যায়। স্বামীর অসঙ্গত খামখেয়ালীর কথা মনে করিয়া পরিমলের মনটা অত্যন্ত উত্যক্ত হইয়া উঠিল। তাহার মন বিদ্রোহ করিয়া বলিল, মানুষের সকল ইচ্ছা ও সকল কাজের উপর দখল নওয়া এ যে বিষম অত্যাচার! উচিতের দিক্ দিয়া যতই দাবী করা যাক্ না কেন, মানুষ নিজেকে কোন অবস্থাতেই এমন ব্যক্তিত্বহীন করিয়া ফেলিতে সমর্থ হয় না যে, আর একজনের প্রত্যেক খুঁটিনাটীর সকল আদেশকেই সে তার নিজের করিয়া লইতে পারে। অন্ততঃ হাসিমুখে যে পারে না, সেটা সে নিজেকে দিয়াই বুঝিত। নতুবা জুলুমের ভয়ে ক্ষুদ্রের ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে প্রবল পক্ষের প্রচণ্ড ইচ্ছাস্রোতে মগ্ন করা, সে ত সংসারশুদ্ধ লোকে বাধ্য হইয়াই করিতেছে। পরিমল রাগ করিয়া অনেকক্ষণ বিছানার বালিশে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিল। অভিমান করিয়া মনে মনে আহত হইয়া ভাবিল, লোকে যে বলে সমানে সমানে না পড়লে কোন পক্ষেরই ঠিক মান থাকে না, তা ঠিকই। আমি গরীব অনাথা বলেই আমার উপর উনি সকল তা’তেই জবরদস্তি চালান। হতুম আমি বাগবাজারের রায়েদের মেয়ে কি চো-গাঁয়ের জমিদার-রাজাদের কেউ, তা’হলে কক্ষণই আমার উপর এতটা জোর উনি চালাতে পারতেন না। আমি দুঃখী, আমার কেউ কোথাও নেই, মনে কষ্ট হ’লে যে একদিন বাপের বাড়ী যাবার ভয় দেখাব, তারও আমার উপায়টুক যে নেই সে জানেন কি না, তাই না আমায় সব কিছুতেই বাধ্য করতে সাহস করেন!”

 পরিমলের দুঃখ যেন বুক তার ছাপাইয়া উঠিতে গেল। তারপর মুখ তুলিতেই হঠাৎ নজর পড়িল তাহার খাটের সামনাসামনি রক্ষিত কাপড়ের আলমারিটার আয়না আঁটা কবাটের উপর। দুচোখ ভরা জলের উপর আরও খানিকটা জলের আমদানী করিয়া সে সবেগে মুখখানা ফিরাইয়া লইল। তাই কি ছাই শরীরে তার খুব খানিকটা রূপই আছে! ওই যে বিধাতার পরম করুণার দান,—পার্থিব কোন কিছুরই বিনিময়ে যেটা ক্রয় করিবার উপায় নাই বলিয়া কত কত ধনী গৃহের বিলাসী মেয়েরা অসাধ্য সাধনার আরাধনায় সারাজন্ম ধরিয়া লাগিয়া আছেন এবং সম্পূর্ণরূপে সকলপ্রযত্ন হইতে না পারায় ভাগ্য ও তাহার নিয়ন্তাকে মনে মনে অভিশাপ দিতেও ত্রুটী করিতেছেন না,—পরিমলও সেই বস্তুটার অভাব আজ যেন বড় বেশী করিয়াই নিজের মধ্যে অনুভব করিল। এতদিন নিজের রূপহীনতার কথা মনে করিবার অবসরটুকুও তাহার ঘটে নাই বলিয়াই বোধ করি সেকথা তাহার মনে ছিল না। বরং ভোগে ও স্বাস্থে যে দরিদ্র জীবনের অপরিজ্ঞাত সৌন্দর্য্য সে তাহার এই নবযৌবনোদ্ভাসিত নবজীবনে লাভ করিয়াছিল,তাহাই ছিল এতদিন তাহার কাছে পরমাশ্চর্য্যের মতই পরম বিস্মিয়কর। কিন্তু আজ সেদিক দিয়া নহে, আর একটা দিক হইতে—অতিরিক্ত পাওয়ার গুরু বোঝার ভারটা যখন মাথার উপর বড় বিষম বলিয়া ঠেকিতেছিল, তখন নিঃস্ব দেনদার চারিদিকে হাতড়াইয়া ঋণশোধের একটা সিকি পয়সা পর্য্যন্ত খুঁজিয়া না পাইয়া ধনীর ঘরের লোহার সিন্দুকের দিকে তাকাইয়া মনেরমধ্যে তার সৃষ্টিকর্ত্তার উপর স্বামীর চাইতেও বড় বেশী অভিমানী হইয়া উঠিল। সে এই বলিয়া তাঁহার দরবারে নালিশ রুজু করিয়া দিল যে, বড় লোকের মেয়ে, যাদের মা আছে, বাপ আছে, মা বাপের রাশিকরা টাকা আছে তারা কালো কুৎসিত হইলেও তাদের ভাল ঘরে বরে পড়িতে এতটুকুও আটকায় না যখন, তখন অনর্থক ও অ-দরকারে তাহাদের ঘাড়ে বাড়ায় ভাগ —রূপের বোঝাগুলা না চাপাইয়া সেগুলা আমাদের মতন অধম, অক্ষম ও অভাগা জীবদের জন্য রাখা কি চলিত না? স্বামী যেমন দয়া করিয়া আমায় পথের পাশ হইতে কুড়াইয়া লইয়াছেন, তা আমার যদি একটুখানি রূপও এই দেহের মধ্যে থাকিত, তো না হয় তাই দেখিয়াই মনে মনে একটু গুমোরও রাখিতে পারিতাম যে, এই দেখিয়াই হয়ত তিনি আমায় নিজের করিতে পারিয়াছেন। তাঁর এই অগাধ দয়ার মূল্যে নিঃস্বত্বভাবে বিকাইয়া যাওয়া হইতে হয়ত বা তাহাতে আমি একটুখানিও বাঁচিয়া থাকিতে পারিতাম। তিনি অত দিলেন,একবারেই যে সমুদয়টুকুই নিঃস্বার্থভাবে দিয়া ফেলিলেন, এর বদলে যে এতটুকু একটু কিছু ফেরৎ পাইলেন না, এইখানেই যে মনে প্রচণ্ড একটা আঘাত লাগে। এইখানেই যে এই বিনামূল্যের কেনা বাঁদীরও অযোগ্যা যে, সে তাঁর দয়ায় দামে বিকাইয়া যায়।— তাই অভিমান উথলানো বুকে পরিমল মনে মনে ভাবিল, যার জোরে পরাজিত দৈত্যের মেয়ে শচীদেবী ইন্দ্রের পাশে মাথা উঁচু কৱেই বসতে পেরেছিলেন, মৎস্যগন্ধা জেলের মেয়ে ভারত সম্রাটের মহিষী হতে লজ্জা পাননি, সেই রূপ থাক্‌লেও ত আমার একটুখানি মনের ইজ্জতও থাক্‌ত। আমার যে একেবারেই দয়া! দেবার তো আমার এতটুকু কিছুই নেই, কেবল বোঝা বেঁধে নেওয়া মাত্র, মান এতে থাক্‌বেই বা কিসে?

 রাগের মাথায় সে নরেশচন্দ্রের উদ্ভট দারিদ্র্য-প্রেমকে মনে মনে যৎপরোনাস্তি অপভাষা প্রয়োগ করিল। এমন কি অন্নদা দাসী, তাহার চুল বাঁধা যে তখনও সমাধা হয়ে উঠে নাই—এই বিস্মৃত সংবাদটা জানাইতে আসিলে, তাহারই সহিত সে এ বিষয়ে আলাপ করিতে বসিয়া জোর করিয়া বলিল “তাবলে কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি রকমের ‘ভাল’ হওয়া ও মানুষের পক্ষে ভাল নয়। যা’ রয় সয় সকল বিষয়ে সেই মতন চলাই সঙ্গত। গরীবকে দয়া দেখাতে হবে বলেই কি তাকে সিংহাসনে বসিয়ে পূজো করতে হবে নাকি?”

 অন্নদার সহিত যে তাহার মনিব-পত্নীর মতের এমন সামঞ্জস্যও আছে, ঘুণাক্ষরেও এ সংবাদটা জানা থাকিলে আর সে বেচারা ইহার সম্বন্ধে বোধ করি পড়সীর বাড়ী বাড়ী গিয়া অনর্থক দশকথা প্রচার না করিয়া বেড়াইয়া তাহার সহিতই উহাদের সম্বন্ধীয় দু’চারিটা মুখরোচক আলোচনা ঘরে বসিয়াই সে চালাইতে পারিত। পরম উৎসাহিত হইয়া উঠিয়া সে হাতমুখ নাড়িয়া মনিব-গৃহিণীর স্বপক্ষ সম্পূর্ণ সমর্থনপুর্ব্বক সোৎসাহে কহিয়া উঠিল, “ও মা, তা’ আর বল্‌তে রাণীমা! রাজাবাবুর আমাদের পছন্দর ছিরিই যদি থাক্‌বে তা’হলে আর আমাদের ভাবনাটাই বা কি? এই দেখ না কত কত রাজা জমিদার হেঁটে হেঁটে তাদের পায়ের বাঁধন ছিড়ে ফেল্‌লে, তা তাদের পরী পরী সব মেয়ে ফেলে উনি কিনা কোন পাড়া’গাঁর মরুকগে, মুখে আগুন লাগুক আমার! ওমা কি, কথা বল তে কি বলি দেখ একবার! এই জন্যই বলে গো, বুড়ো হলে বাহাত্তুরে ধরে যায়। কিছু মনে নিওনা মা! কার সাম্‌নে যে কি কথা হচ্ছে, তোমার দিব্যি মা; এক্কেবারে নিজ্যুস্ ভুলে গেছি। ন্যাও বাছা! এখন চুলটো ফিরিয়ে ন্যাওসে, অবলার মা আট্‌কে রয়েছে, তাকে আবার পাঁচ বাড়ী তো ঘুরতে হবে।”

 পরিমল ঢিলটী মারিয়াই সঙ্গে সঙ্গে পাটকেলটি খাইল, এবং খাইয়াই সে টুকু সে তৎক্ষণাৎ বুঝিল।

 আশ্চর্য! এও আবার মানুষকে কাণে ধরিয়া গালে চড় মারিয়া মনে পড়াইয়া দিতে হয়? ‘রাজাবাবুর যদি পছন্দর শ্রীই থাকিবে’ তবে বাগবাজারের চন্দ্ররায়ের সেজ মেয়ে সুন্দরী সাগরিকা, অথবা চৌগাঁয়ের রাজা ভুবনমোহন মল্লিকের মেয়ে সুখলালিতা সুধালতা আজ রাজা নরেশচন্দ্রের রাণী না হইয়া এই পথে কুড়ান কুরূপা পরিমল এই আসনে দখল লইল কেন? আজ একটা বসন্তক্ষত বিকৃত কদাকার ভিখারীর প্রতি সমাদরকে সে যে যে ঘৃণার চক্ষে দেখিতেছে, তাহাকে সে আদর দেখায় নাই বলিয়া তার উপর বিরক্তি প্রকাশ করায় এই যে রাগে অভিমানে অভিভূত হইয়া রহিয়াছে, আর শত শত ধনী মানী সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সুশিক্ষিত ও সুন্দরী কন্যা সকলকে তুচ্ছ করিয়া দিয়া নির্ব্বান্ধব এবং এমনকি পূর্ণ যৌবনে অশন বসনের অভাবে পরাশ্রিতা, অপরিচিতা এই যুবতীকে আপনি যাচিয়া বিবাহ করিয়া এই ধনীর দুলাল তাহাকে যেদিন ঘরে তুলিলেন, সেদিন তাঁর পরিচিত এবং অপরিচিত সকলকার অধরে ও নেত্রপ্রান্তে কি ঘৃণা তাচ্ছিল্যের হাসি কি ক্রোধাভাষই না ব্যক্ত হইয়ছিল!—তা, সে কি তা জানেই না? মূর্খ তাতে পাড়গাঁয়ে মেয়ে হলেও এই অপরিচিত ঐশ্বর্য্যপ্রাচুর্য্যময় নগর নিবাসে, এই খেতাবী রাজার রাজপ্রাসাদে আনিতা হইবার পর হইতেই পদে পদে যে সেটাকে সে হাড়ে হাড়ে অনুভব করিয়াছে। যখন আসিয়াছিল এ বাড়ীর দাসীচাকরদের শুদ্ধ নাকি তাহাকেও তাহার আচার ব্যবহার দেখিয়া ঘৃণালজ্জায় ধরণীগর্ত প্রবেশেচ্ছা জন্মিতে ছাড়ে নাই, তা অন্যে পরে কা কথা! তার নিজের সংসারে আত্মীয়জন বেশী নাই। বৌ-ভাত উপলক্ষে দেশের বাড়ী হইতে সৎশাশুড়ী ও তাঁর মেয়ে অলকানন্দা এই দুজন মাত্র লােক এখানে আসিয়াছিলেন। সৎমা হইয়াও যে তিনি নরুর পাশে অমন বউ সহ্য করিতে পারেন নাই, এঠাও অকৃত্রিম সত্য সংবাদ। তিনিও নাকি গরীবেরই মেয়ে। চেলি-নন্দন ও ফুলের মালায় সাজাইয়া তাঁর গরীব বাপ তাঁহাকে লক্ষপতি গিরীশচন্দ্রের পঞ্চান্ন বৎসর বয়সের সময় তাঁর হাতে সম্প্রদান করেন। কিন্তু এক হিসাবে যে সেই নিঃস্ব গরীবের মেয়ে অনেক ধনাঢ্য কন্যাকে লজ্জা দিয়া দশের মধ্যে মাথা খাড়া করিয়া দাঁড়াইতে পারিতেন, সে তাঁর অনবদ্য সৌন্দর্য্যের জোরে। সেই জিনিষটারই যে পরিমলের বিশেষ অভাব ঘটিয়া গিয়াছে। তাই ধনীর মেয়ে না হইয়াও যিনি রাজার মেয়ের মতই নিজের আনমিত রূপের গৌরবে, উচ্চ গ্রীবায়, বক্র কটাক্ষে, মাটির জগৎকে তাচ্ছিল্য ভরে চাহিয়া দেখিতে অভস্ত, তাঁরও কঠিন নেত্রের অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিতে এই নিঃস্ব ভিখারিণী পরিমল ঘৃণা-লজ্জায় পলে পলে মাটিতে মিশিতে চাহিয়াছে। সে সব কথা ফিরিয়া ফিরিয়া আজ তাহার মনের বুকে ফুটিয়া থাকা কাঁটার মতই আবার খচ খচ করিয়া উঠিল। সেই সময়কার একদিনের মাতা-পুত্রের আলাপ দৈবাৎ তার কাণে যায়, সেই কথা কয়টা ব্যথার উপর তীক্ষ্ণ-প্রলেপের জ্বালার মতই স্মৃতির মধ্যে ভাসিয়া উঠিল। তাহার স্বামীকে ডাকাইয়া তাঁর প্রায় সমবয়সী বিমাতা পদ্মাবতী অনুযােগ করিয়া বলিলেন “দেশে থেকেই শুনেছিলেম যে, তুমি এক চাটগেঁয়ে ধেড়ে মেয়ে কুড়িয়ে এনে এতবড় মিত্তির বাড়ীর বউ করে দিচ্চো; কিন্তু তখন স্বপ্নেও ভাবিনি যে সে মেয়ের রূপের দিকটাতেও এখন কালিঢালা। এ কেলেঙ্কারী করার চাইতে তুমি এত দিন বিয়ে করবে না বলে যে পথ নিয়ে চল্‌ছিলে—সেও যে ছিল ভাল। সে তবু না হয় বােঝা যায়, এ যে একেবারেই দুর্ব্বোধ্য!”

 নরেশচন্দ্র এই ভীষণ অভিযােগের বিরুদ্ধে একটিমাত্র বর্ণও ব্যবহার করেন নাই।

 সেদিনে কৃতজ্ঞতার মাত্রাটা এত বড়ই হইয়া পড়িয়াছিল যে, ইহাতে তাহার মনকে ধাক্কা দিতে পারে নাই, কিন্তু আজ এই গােপনীয় কথার সবটুকু যখন জানা শুনা হইয়া গিয়াছে, তখন এত বড় অবমাননা-জনক তুলনাটা স্মরণে আনিয়া এবং এই লজ্জাকর অভিযোগের বিরুদ্ধে স্বামীর মৌনভাবকে সম্মতিলক্ষণ বােধে তাহার বুকের মধ্যে অভিমানের তুমুল তরঙ্গ চঞ্চল হইয়া উঠিতে লাগিল। নাঃ—ঠিক কথাই ঐ অন্নদা বলিয়াছে। নরেশচন্দ্রের প্রবৃত্তিই যদি নিম্নভিমুখী না হইবে, তবে সেই বা আজ এই ঐশ্বর্য্য-স্বর্গে প্রতিষ্ঠিতা কেন? রাগ করিবার কিছুইতো নাই। যা সত্য, তা অস্বীকার করিলেও সে মিথ্যা হয় না।

 পরিমল নেহাৎই গরীব ঘরের মেয়ে। আবার শুধুই যে সে দরীদ্র কন্যা তাহাই যথেষ্ট নয়, এ সংসারে আত্মজন বলিতে তাহার কোন দিক দিয়া কোন বালাই ছিল না। তার উপর বাস তাহাদের সে এক কোন্ সুদূর উত্তরবঙ্গের অজ পাড়াগাঁয়ে। কলিকাতা সহর নিবাসী আধুনিক সভ্যতা ও নব্য শিক্ষাপ্রাপ্ত অতুল ধন সম্পত্তির অপ্রতিহত অধিকারী খেতাবধারী ‘রাজা’ নরেশচন্দ্র রায় বাহাদুরের পত্নীপদ লাভ করিবার মত কোনই সুযোগ বা সামর্থ যে ঐ মেয়েকে বিধাতা বা মানুষে যে দান করে নাই, এ কথা একেবারে অবিসম্বাদী সত্য। তথাপি যে এমন অঘটনও ঘটিয়া গেল, এর জন্য ভদ্র ইতর নির্ব্বিশেষে সকলেই খামখেয়ালী বিশ্বনিয়ন্তা এবং তাঁহারই সৃষ্টিছাড়া-সৃষ্টিকরা তদপেক্ষারও খামখেয়ালী নরেশচন্দ্রকেই দায়ী করিয়া অবাক হইয়া গালে হাত দিত।

 তা সামাজিক পদমর্য্যাদা বা ধনরাশি মণ্ডিত পিতামাতা না হয় নাই থাক, শিক্ষিত সমাজে স্থান লাভের যােগ্য শিক্ষাদীক্ষাই কি ছাই তাহার কিছু মাত্রও ছিল? বিদ্যার মধ্যে বাঙ্গালা ভাষার অক্ষর পরিচয়টুকু আবশ্যক ঘটিয়াছিল, আর বুদ্ধির মধ্যে ভাত ডাল ও দু তিনটা সাধারণ ব্যঞ্জন রান্নার যতটুকু খরচ হয় সেই পর্য্যন্তই। তার পর রূপ,—তা সেটা তাহার নিজের দিক হতে বেশ স্পষ্ট করিয়া জানা নাই। কারণ সে যে বাড়ীর মেয়ে এবং যে সমাজের মানুষ, সেখানে আয়না ধরিয়া বসিয়া নিজের রূপের পরিমাপ করার সুবিধা বা প্রয়োজনই ছিল না। মা ছিলেন, স্নানের পর দিনান্তে একবার করিয়া চুলটা তিনি মোটা চিরুণীতে আঁচড়াইয়া একটা আঁটসাঁট শক্ত খোঁপায় বাঁধিয়া দিতেন, শেষের দিকে যখন তাহার রাজা-স্বামীর দৃষ্টি সে আকর্ষণ করে; সে সময়টায় মা ছাড়িয়া রক্তসম্বন্ধে সম্বন্ধ কোন প্রাণীর সহিতই তাহার সকল প্রকার সম্বন্ধের পাঠই উঠিয়া গিয়াছিল; এবং বাহিরের বা অন্তরের অবস্থাও তাহার পক্ষে এমনই প্রতিকুল যে স্বভাবতঃই নারীর সর্ব্বপ্রধান প্রযত্নে, ধন যে সৌন্দর্য্য তাহাকে রক্ষার চেষ্টা তো নহেই, পরন্তু সর্ব্বপ্রযত্নে উহারই ধংস কামনাই তাহার চিত্তে তখন প্রবলতর। কাজেকাজেই তাহার প্রতি এই সুখ সৌভাগ্যসেবিত কমলাবাণীর বর পুত্রটির যে আকর্ষণ ইহার ভিতর রূপক মোহের এতটুকু কণামাত্রও যে স্থান ছিল না, এই কথাটা জোর গলাতেই বলা যায় এবং গুণগ্রাহীতারও কোন প্রমাণ সে সময়ে ত অন্ততঃ পাওয়া যায় নাই। কাজেকাজেই সেই সুদূর চট্টগ্রামের অশিক্ষিতা অত্যন্ত সাধারণ চেহারার দরিদ্রকন্যা তাহাতে একান্তই অসহায় অনাথাকে গ্রহণ করায় এ পক্ষ হইতে কাহারও কোন সহায়তা লওয়া হয় নাই তাহা নিঃসন্দেহ। কেহ কেহ বলে নাকি শুদ্ধ মাত্র প্রবল অনুকম্পা ও উদারতাই নরেশ চন্দ্রের পত্নী নির্ব্বাচনের ঘটক হইয়াছিল, আবার কাহারও কাহারও মতে নরেশের ঘাড়ে ভূতে ভর করিয়া তাহাকে এই অপকর্ম্মে প্রবৃত্তি করিয়াছিল। পরিণত যৌবনে অসহায় নারীর যে সকল আপদ ঘটা অবশ্যম্ভাবী তাহারই বিড়ম্বনায় সে সময়ে এই পরগৃহবাসিনী পূর্ণ যৌবনা মেয়েটা একান্তই বিব্রত ও বিপন্ন হইয়া রহিয়াছে। মা মরার পর তাহার পূর্ব্বকার সকল ব্যবস্থাই কোন্ একটা দৈব দুর্ব্বিপাকবশতঃ একেবারেই আগাগোড়া কাঁচিয়া যায়, যে নিরাপদ নীড়ে সে বাসা বাঁধিবার কল্পনা বহুদিন হইতেই তাহার সমস্ত অন্তকরণ দিয়া করিয়া আসিয়াছে, আকস্মিক একটা কালবৈশাখীর ঝড়ের ঝাপটা আসিয়া তাহার সেই আশাতরীখানাকে হঠাৎ মাঝদরিয়ার মাঝখানেই বানচাল করিয়া দেয়, তারপর এই নিরালম্ব জীবন লইয়া সে আকুল-সাগরের ঢেউ খাইয়া খাইয়া ভাসিয়া বেড়াইতেছিল, কুল কোথাও পায় নাই। গ্রামের তাহারা নূতন বাসিন্দা, পুরাতন সুবাদ কাহারও সহিত ছিল না, আর থাকিলেও হিন্দুঘরের আইবুড় ধাড়ী মেয়ে যে কোন ভদ্রলোকে গলায় ঝুলাইবে, ততটা উদারতা পল্লীগ্রামে যখন ছিল সে অতীত যুগের কথা। কাজেই পরিমল স্রোতের ফুলের মত কেবলই ভাসিয়া বেড়াইতেই ছিল, কোথাও কুল পায় নাই। পূর্ব্বাশ্রয় যখন খসিয়া পড়িল ঘর বাড়ী ধন দৌলত সব কিছুই বেদখল যারা লইল, তারা শুধু তাহাকে বাদ দিয়া গেল, এই খবর শুনিয়া একজন প্রতিবেশী তাহাকে ঘরে স্থান দিলেন, সে সময়ে তাঁহার গৃহিণীটী সুতিকাগারে আবদ্ধ থাকায় নিজে হাত পোড়াইয়া রাঁধিয়া খাইতে ও খাওয়াইতে হইতেছিল, গৃহিণী এই অসহায় মেয়েটার খবরও নিয়া কর্ত্তাকে জানাইলে তিনি সহজেই সম্মত হইলেন; কিন্তু মেয়েটি কয়েকদিনের মধ্যেই একটা মধ্যরাত্রে কাঁদো কাঁদো হইয়া অস্পৃশ্য সুতিকাগৃহের আগড় ঠেলিয়া ব্যাধ-বিতাড়িতা হরিণীর মতই ছুটিয়া আসিল এবং গৃহিণীর পায়ে আছড়াইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া কহিল, “মা আপনার বাড়ী বড় নিরাপদ মনে করেই ঢুকেছিলেম, কিন্তু বরং পথে পথে ভিক্ষা করে খাব, তবু এখানে আর থাকতে পরবো না, সকাল হলেই আমি চলে যাব।”

 গৃহিণী নিজের ঘরের খবরে অনভিজ্ঞা নহেন; দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কোথায় যাবে?”

 পরিমল চোখ মুছিতে মুছিতে জবাব দিল “যে দিকে দুচোখ যায়।”

 গৃহিণী কুণ্ঠিত মুখে কহিলেন “সে সবখানেই যে মন্দ লোকের কুদৃষ্টি নেই তাই বা কি করে জানবে মা? আমি বলি কি তার চাইতে নিজে একটু সাবধান হয়ে এইখানেতেই থাক। রাত্রে না হয় আমার কাছে এসেই শোবে, সকালে নদী-চান করে আসবে, আমারও বাছারা তবু সময় মতন দুটী ভাত পাবে, আর তোমারও—তা বাছা যে বয়েস তোমার তাতে এই নির্ব্বান্ধব অবস্থা এতে তোমার পক্ষে কোথায় যে ভয় নেই সেত আর বলা যায় না।”

 পরিমল অনেকক্ষণ ঘাড় হেঁট করিয়া ভাবিয়া ভাবিয়া ও এই সংসারাভিজ্ঞা গৃহিণীর সুযুক্তিপূর্ণ উপদেশটাকে কিছুতেই মনের মধ্যে মানিয়া লইতে সমর্থ হইল না। সদ্যপ্রাপ্ত অপমানের আঘাতে তাহার অন্তরের মধ্যে আহত নারীমর্য্যাদা তখন গুমরিয়া ফিরিতেছিল, সে নিঃশব্দেই উঠিয়া আসিল, এবং সেই বাড়ীতে দ্বিতীয় রাত্রি কাটাইবার ভরসা না করিয়াই নিজের পূর্ব্বাশ্রয়েরই দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। সেই তার বুকফাটান অতীতের সকলটুকু অসহ্য স্মৃতির মাঝখানকেও সে নিজের নারী মর্য্যাদা হানির বহু ঊর্দ্ধে বরণ করিয়া লইয়া কাঙ্গালের মতন কাঁদিয়া আসিয়া একটু আশ্রয় ভিক্ষা করিল। ঠিক সেই সময়টাতে নাকি ভাগ্যে ভাগ্যে সে বাড়ীর ঝি ছাড়িয়া যাওয়ায় বড়ই গণ্ডগোল চলিতেছিল, তাই এবার সেখানে আশ্রয় পাওয়া তার পক্ষে তেমন কঠিন হইল না। তবে বাড়ীর কর্ত্তা এইজন্য একটুখানি আপত্তি তুলিতে ছিলেন যে যদি এর পর এই আইবুড় মেয়ের বিয়ে দিতে হয় ত কি হইবে? তবে এ আপত্তিটা তাঁর টিকিল না, যেহেতু বাটীর গৃহিনী বাসন মাজিতে তখন বেজায় নারাজ থাকায়, নথ ঘুরাইয়া ঐ যুক্তিটাকে এই বলিয়া খণ্ডন করিয়া দিলেন যে সেজন্য অত ভাবিতে হইবে না। সে তখন একটা ঝি জুটিলেই উহাকে কোন একটা অছিলায় দূর করিয়া দিলেই হইবে, এখনত দশদিন কাজ চালাইয়া দিক।” তা ঝি কিন্তু সেই দশদিনে পাওয়া গেল না এবং মাসকতকের পরেই একটা অচিন্তনীয় আশ্চর্য্য কাণ্ড ঘটিয়া গিয়া দেশশুদ্ধ লোককে একেবারে বজ্র স্তম্ভিত করিয়াছিল।

 কলিকাতা অঞ্চলের একজন বড়লোক, ওই অঞ্চলেরই কাছাকাছি তাঁর জমিদারী—একদিন আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও উহাদের সম্বন্ধে বিস্তর খোঁজখবর লইয়া হঠাৎ একদিন নিজেই উদ্যোগী হইয়া উহাকে বিবাহ করিয়া বসিলেন। অবশ্য ইহার জন্য তাঁহাকে বিস্তর অযাচিত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিতেও হইয়াছিল। যাহারা ইতঃপূর্ব্বে অনাথাকে অন্ন ও আশ্রয় দিতে নারাজ ছিল, তাহারাই বিশেষ করিয়া তাহার এই আকস্মিকপ্রাপ্ত সুখ সৌভাগ্যের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পুরুষকার প্রদর্শন করিতে পরান্মুখ হন নাই। এমন কি সেখানের একজন উচ্চপদস্থ রাজ কর্ম্মচারী ও অনাহুত উপদেশ এ বিবাহের বিরুদ্ধে বিস্তর অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়া ছিলেন, কিন্তু প্রজাপতির এই আশ্চর্য্য নির্ব্বন্ধ শত বিঘ্ন ঠেলিয়া ফেলিয়াই সম্পন্ন হইয়া গিয়াছিল। বিচিত্রময় জগতে কতই না বিচিত্র ঘটনা ঘটিতেছে, লোকে এই বিবাহকারী যুবককে পাগল বলিয়াই স্থির করিল, ক্কচিৎ কেহ বলিল দয়ালু কিন্তু তাহারাই মুখবিকৃত করিয়া বলিয়াছিল, কিন্তু অতি কিছুই ভাল নয়।

 পরিমলের মনটা সেই সব ভয়াবহ পূর্ব্বস্মৃতির তোলাপাড়ার মধ্য দিয়া কোন্ সময় লঘু হইয়া আসিয়াছিল। স্বামীর জিদকে আর ততটা অন্যায় অত্যাচার ও জুলুম বলিয়া তার মনে রহিল না, বরং চিরদিনের বিপন্ন-বৎসলতা ও অনন্যসাধারণ দয়া গুণের আধার বলিয়া তাঁহার প্রতি তাহার স্বতঃ প্রবাহিত শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতার তরঙ্গ বিপরীত স্রোতকে প্রতিহত করিয়া উথলিয়া উঠিয়া নিজের অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্যকে একেবারেই ছোট করিয়া দিল। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের অবিচারের শাস্তি লইয়া স্বামীকে তুষ্ট করিতে মন তাহার উৎসুক ও অধীর হইয়া উঠিল।