বিষয়বস্তুতে চলুন

হারানো খাতা/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

“কাঙ্গাল বলিয়া করিও না হেলা—আমি পথের ভিখারী নহিগো”

—রবীন্দ্রনাথ 

 মানুষের হৃদয়রহস্য যে দেবতাদেরও অপরিজ্ঞাত,—এ কথা অস্বীকার করা চলে না; এবং বোধ করি অস্বীকারও কেহ করে না! কিসে যে তার সুখ, আর কত অল্পেই যে তার দুঃখ, সে বুঝিয়া ওঠাই ভার। নিরঞ্জন যতদিন পরিমলের শিক্ষকতা করিতেছিল, অস্বস্তির তার যেন অন্ত ছিল না, এমন কি একদিন অশান্তি তার সীমা ছাড়া হইয়া গিয়া বাড়ী ছাড়িয়া তাহাকে পলাইতে উদ্যত করিয়াছিল। আবার যখন আপনা হইতে সেই দুরূহ কার্য্যটা তার ঘাড় হইতে নামিয়া পড়িল, অমনি বুঝিতে পারা গেল যে, যেটাকে সে অসহ্য পীড়ন বোধ করিতেছিল, ঠিক সেইটিতেই যেন তার সব চেয়ে বড় সুখের উপাদান অলক্ষ্যভাবেই নিহিত ছিল। বিগত জীবন প্রিয়তমের মূর্ত্তি মানুষ প্রাণপণে স্মরণে আনিয়া তাহারই ধ্যানস্থ হয়, অথচ প্রাণও কাঁদে। ওই সম্মানিতা ছাত্রীটীর সর্ব্বায়বে কোন হারানিধির পূর্ণ সাদৃশ্য অনুভব করিতে থাকিয়া তাহাকে সহ্য করা যেমন নিরঞ্জনের পক্ষে কঠিন আবার তেমনই বুঝি তাহার মধ্যে একটা দুরন্ত লোভও তাহারও অজ্ঞাতে তাহার সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে প্রচণ্ড অধিকার স্থাপন করিয়া দিয়াছিল, তাহাকে সে পূর্ব্বে বুঝে নাই, পরে বুঝিল। পরিমল যে আর তাহার নিকটে পড়া লইতে আসে না, একদিকে ইহাতে সে খুসী হইয়াও আর একদিকে কিন্তু হইতে পারিল না। আবার নিজের মনের এই ত্রুটীটুকু লক্ষ্যে আসিতেই অত্যন্ত অপ্রসন্নচিত্তে মনকে কঠিন-ভাবে সে পীড়ন করিয়া বলিল,—

 “খবরদার! পাগলামী করো না; তোমার স্বপ্ন তোমার মধ্যেই থাক, বাইরে তার ছবি যেন কোন মতেই না ফুটে!”—

 প্রেসের অল্প স্বল্প কাজ হাতে লইয়া সে ক্রমে তার প্রায় সব টুকুই নিজের উপর টানিয়া লইবার উপক্রম করিল এবং ইহাকেই আশ্রয় করিয়া তার এতদিনের যে শক্তি, যে অধ্যবসায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাই আবার জাগিয়া উঠিল। একবাক্যে সবাই স্বীকার করিল যে, এমন উদ্দীপনা, সহিষ্ণুতা, কর্মমক্ষমতা আর তীক্ষ্ণধী সর্ব্বদা এসব কাজে পাওয়া যায় না। যারা এতদিন তাহাকে অপ্রকাশ্যে উপহাস ও প্রকাশ্যে তাচ্ছিল্য করিয়া আসিতেছিল, তা’রাও লজ্জা পাইল।

 বস্তুতঃ মানুষের শক্তির আধার কখন যে খালি হইয়া যায় আবার কিসে ভরিয়া উঠে, তার কোন সময় ঠিক করা নাই। উপযুক্ত কার্য্যক্ষেত্রের অভাবে কত উৎকৃষ্ট বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, অথবা বপন করাই ঘটে না। নিরঞ্জন একটু একটু করিয়া যেন তার হারানো শক্তি এই আশ্রয়ে আসিয়াবধি খুঁজিয়া পাইতেছিল। পরিমলের সঙ্গে মাসখানেকের মেলামেশায় তার মরিচাধরা বুদ্ধির কৃপাণে শান পড়িয়াছে; এবার কাজের মধ্যে ডুবিতে পাইয়া তার উপরের সমস্ত ধুলী জঞ্জাল যেন ধুইয়া গেল। এখন সে আর তত অন্যমনস্ক হয় না; মাসমাহিনার টাকাগুলা দিতে আসিলে খাজাঞ্চিকেই উহা জমা রাখিতে বলিয়া গোটাকতক শুধু চাকরমহলে বাঁটিয়া দেয়। হরে খানসামার দল মুখ বাঁকাইয়া উহা গ্রহণ করে ও নিজেদের মধ্যে তীব্র সমালোচনা করিয়া বলে, “বাছা হনু আমাদের এবার চালাক হচ্চেন দেখি যে!” আর একজন বলেন “হবে নাই বা কেন? এখন যে পেটে রাজা সায়েবের ভাত পড়েছে। ভাতকে হজম করে চলতে পারা কঠিনরে ভাই; ওর জোরে অনেক ‘পোঁটাচুন্নির বেটা চন্দন বিলাস’ হয়ে উঠ্‌লো! তা দেখিস্‌নে?”

 যে খাতাখানার কথা সেদিন পরিমল তার স্বামীর কাছে বলিতেছিল, সেখানার মধ্যে মধ্যে নিরঞ্জন নিবিষ্ট হইয়া কি লিখিত। সেটার আর ছিল এই রকম—

 এই মলাট-ছেঁড়া চার পয়সা দামের খাতাখানা হাতে পেয়ে আজ হঠাৎ ডায়রি লেখার কথা মনে পড়ে গেল। মনে যে পড়লো তা সেটা কিছু আর বিচিত্র নয়! কতকালেরই যে অভ্যাস ছিল। কিন্তু নয়ই বা কেন? আমার এ জীবনটার সকলই যে বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে পূর্ব্ব সংস্কারগুলো এখনও যে কেমন করেই না মরে গিয়ে বেঁচে আছে এবং সুযোগ পেতেই মাথা তুলে খাড়া হচ্ছে, এইটেই তো ঘোর আশ্চর্য্যের বিষয়! নিজেই আমি অবাক হয়ে গিয়ে ভাবচি যে তাহলে আমার দ্বারা এখনও আবার এ পৃথিবীর কোন কোন কাজ কর্ম্মও চালিয়ে নিলে চলে! আশ্চর্য্য, ভারি অশ্চের্য্য লাগ্‌ছে কিন্তু।

 “আচ্ছা, আমি আগে কি ছিলুম, সেটাও একটু একটু করে মনে কর্ব্বার চেষ্টা করা বোধ হয় নেহাৎ মন্দ নয়! যা’ ছিলুম আর এখন যা’ হয়ে দাঁড়িয়েছি এ থেকে আমিই আমার নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনে, তা আর পাঁচজনে কেমন করে পারবে? কিন্তু সে পারবার কিছু দরকারও ত নেই। সে লজ্জা আমি আমাকে যে কোন মতেই দিতে পারবো না।—না, না, আমার অতীত। আমার সোনার স্বপন! আশার আনন্দে উৎসাহে সম্মানে ভালবাসায় ভরা আমার বাল্য কৈশোর যৌবনের অতীত! যত মাধুর্য্য যত আকর্ষণই তোমার মধ্যে থাকে থাক, তুমি শুধু আমার ধ্যানধারণার মধ্যেই লিপ্ত হয়ে থাক। পথের ভিখারী নিরঞ্জনের কাছে তুমি ঐশ্বর্য্যমণ্ডিত রাজপ্রাসাদের মত গোপন আকাঙ্ক্ষার ধন হয়েই থাক, এই কর্কশ বন্ধুর শুষ্ক বর্ত্তমানের মধ্যে টেনে নিয়ে এসে আমি তোমায় আঘাত করবো না, লজ্জা দেব না।

 “নিজের কথা ভাব্‌তে গেলেই মনে হয় এর আগে যে জন্মটা আমার চলছিল, সেটা যেন শেষ হয়ে গিয়ে এখন আর একটা নূতন জন্ম চলছে। আর বস্তুতঃও তো তাই! আমার সে জন্মে আমার চেহারাখানা ঠিক কার্তিকের মতন নাই থাক্, ঘরে পরে সবাই যে আমার রূপের তারিফ করেছে, সে তো আমি নিজের কানেই শুনেছি। আর এখন, আমায় দেখলে লোকে শিউরে উঠে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আবার ছোট ছোট ছেলেরা ভয়ে কেঁদে ফেলে— পালিয়ে যায় সেও আমি জানি। জন্ম আমার ঠিকই বদলে গেছে, তবে এবারে জাতিস্মর হয়ে জন্মেছি বলেই এত জ্বালা। পুরানো কথা মধ্যে যেন কিছুদিন ভুলে গিয়েছিলেম, তেমনি বরাবরের জন্য একেবরেই যদি ভুলে যেতেম, সে যেন ঢের ভাল হতো। তবে দুঃখ এই যে, জন্ম নতুন পেলেও এবারে আর কচি ছেলেটী হয়ে জন্মে মারবুকে ঠাই পেলেম না। আর একটু একটু করে বাড়্‌তে গিয়ে ছেলেরা যে অবসরটুকু পেয়ে নেয়, সেও আমার ভাগ্যে যুটলো না।—একবারে এই বাজপড়া তাল গাছের মতন আমাকে নিয়ে আমার এই নবীন জন্ম আরম্ভ হলো!

 “আচ্ছা, বাড়ী ছিল আমাদের চট্টগ্রামের যে দিকটায়, সে সবই তো দেখছি ঠিক ঠিক মনে পড়ে যাচ্চে! মধ্যে কিন্তু এসব কথা এমন করে মনে করতে পারতাম না। আমার ঠাকুরদা মশাই শুনেছি নেহাৎ নির্ব্বিরোধী ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁর এক বিশ্বাসী (!) আমলার কারসাজীতে পড়ে সমস্ত জমিদারীটি হারিয়ে ফেলে মনের দুঃখে এইখানে এসে বাস করতে থাকেন, এই আমার মার কাছে শুনেছি, তার আগে তিনি গাজন হাটের এগার আনির জমিদার ছিলেন।

 “আমার বাবাকে আমার বেশ স্পষ্ট করেই মনে আছে। ফরসা রং, দেড়হারা পাতলা লম্বা চেহারা, খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক ছিলেন, কি উদার মনই তাঁর ছিল! আমার বাবা ছিলেন ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট। একবার সূর্য্যাস্ত খাজনার দায়ে ঐ গাজন হাটের তালুক—তখন আর তা এগার আনি নেই,—তার ষোল আনাই তখন গিরিশচন্দ্র মিত্রেরই হয়ে গেছে—সেই তালুক লাটে ওঠে। বাবা খুব সামান্য দামে তাঁর সেই নিজের পৈতৃক বিষয় একজন চাপরাসীকে দিয়ে কিনিয়ে রাখেন এবং পরের দিন নিজের হাতে পত্র লিখে যারা তখন তাঁর ন্যায্য বিষয় অন্যায্য ভাবে ভােগ করছিল, তাদেরই খবর দেন যে কেনবার টাকাটা পেলিই তিনি ওদের তালুক ফিরিয়ে দেবেন। হলােও তাই। আমার আজও সেই কথা মনে কর্‌তে আল্লাদে আর গৌরবে বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি সংসারে এসে কার জন্যে কি করলুম?

 “পিতৃহীন হয়েছিলেম, নিতান্ত অসময়ে। সবে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় পড়তে গেছি, বিনামেঘে যেন বজ্রাঘাত হলো! ভাই বােন আমার আর কেউ ছিল না। মার পক্ষে বড়ই কষ্টকর। ছুটীর সময়টুকুই তাঁর কাছে থাকি, বারমাস তিনি একলা।

 “কল্‌কাতার হােষ্টেলে যাঁরা বাস করেছেন, আমাদের মতন পাড়াগেঁয়ে বিশেষতঃ পশ্চিম বঙ্গ ছাড়া অন্য অঞ্চলের ছেলে গেলে তাদের সেখানে যে কত বড় দুর্দ্দশা ঘটে সে হয়ত তাঁদের জানা আছে। কোন্ সময় অন্যমনস্ক হয়ে একজন ‘কেডারে ডাহে?’ বলে ফেলেছে,— আর রক্ষা আছে! খোঁজ করে করে তাই, নিজের স্বজাতী (?) দেখেই ভাব করে ফেলা যেত এবং আমার এক ঘরের পড়শী হলেও পশ্চিমবঙ্গকে ‘দূরে পরিহার’ চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকতেম। কারণ, আমাদের পক্ষে তাঁরা ছিলেন একটু ‘দুর্জ্জন’।

 “কালীপদ আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ হয়ে দাঁড়ালাে। জীবনে সেই বাইরের মানুষের সঙ্গে হৃদয়ের সম্বন্ধ প্রথম স্থাপন করতে যাওয়া,—আর কি ঘনিষ্ট যোগই যে সে হয়েছিল। এত ভালবাসা বোধ হয় আর কারুকেই কখন বাসতে পারিনি, আর না,—বাসতে পারবোও না। এখন কি আর সে ভালবাসবার শক্তিই আমার মধ্যে আছে? মন ছিল তখন একটা কাদার তালের মতন, তাকে রকম বেরকম করে ছাঁচে ঢেলে নিলেই হলো। এখন হয়েছে সে একখানা নিরেট পাথর। তাকে ভাঙ্গাও যায় না, গড়াও যায় না।

 “কালীপদ আমায় প্রাণ দিয়ে ভালবেসে ছিল বটে; তবু আমার মতন নয়। সে তার জীবনের মস্ত বড় কথাটাই আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আমি হলে তা’ পারতুম না। যাকে ভাসবাসলেম, তার সঙ্গে যদি একটা মস্তবড় আড়ালই রেখে দিলেম, তাহলে আর প্রাণে প্রাণে যোগ হবে কোনখান দিয়ে? গঙ্গাযমুনার মধ্যভাগে যদি একটা প্রকাণ্ড পাহাড় গেঁথে ওঠে, তাহলে যুক্তবেণীর সব মহিমাই যে তুচ্ছ হয়ে যায়! কালীপদর যে আমায় না জানানো গোপন কথা ছিল, সে আমি জানতে পারলেম একেবারেই অসময়ে।—যেদিন পুলিসের লোকে আরও কজন ছেলের মধ্যে তারও ঘর তোলপাড় করে’ একটা ছোট্ট রকম বোমার সরঞ্জামের সঙ্গে তাকেও ধরে হাতে হাতকড়ি দিয়ে ও কোমরে বেঁধে নিয়ে চলে যায় সেই ঘোর দুর্দ্দিনে। আমাকেও দুদিন একটু টানাটানি করেছিল; কিন্তু নিতান্ত অজ্ঞ বুঝে শেষটা ছেড়ে দিলে।

 ‘পদ’র সঙ্গে শেষ দেখা তার আন্দামানে যাবার আগের দিন। দেখা হতেই খুব হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কোলাকুলি করলে। হাত তার বাঁধা। দণ্ডিত অপরাধী পাছে কিছু করে বসে—তার কিন্তু সে মতলবই নয়। খুব প্রফুল্ল হয়ে সোৎসাহে অনেক কথাই সে অনর্গল বলে গেল। তারপর সব্বের শেষ অনুরোধ আমায় এ জন্মের মতই সে জানিয়ে দিলে।

 “‘রমেশ! তোমার তো আজও বিয়ে হয়নি, তুমি সুখদাকে বিয়ে করতে পারবে না? তাহলে এ জন্মটার মতন নিশ্চিন্ত হয়েই ঘানি ঘোরাই এবং যাতে শীঘ্রই আর একটা নূতন জন্ম পাওয়া যায় তারই চেষ্টা দেখি।’

 “আমি বিস্মিত হয়ে বল্লাম ‘সুখদা কে?

 “‘কেন তোমায় তো আমার বোনের কথা আমি বলেছিলুম। সুখদা তারই নাম। ধরো এই আমার মতনই তাকে দেখ্‌তে।— পারবে না?’

 “আমি দৃঢ়স্বরে উত্তর করলেম ‘কেন পারবো না, ঈশ্বর সাক্ষী তোমার বোনের জন্য তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।’

 “‘পদ’ খুসী হয়ে আমায় তার বাঁধা হাত দিয়ে জীবনের শেষ আলিঙ্গন চুকিয়ে দিলে। সেই শেষ! জীবনের প্রথম প্রভাতে যা পেয়েছিলেন, জীবনের প্রথম প্রভাতেই তাকে হারিয়ে ফেল্লেম! বিশ্বাসের গণ্ডী দিয়ে বেঁধে সে যাকে আমায় সঁপে দিয়ে গেল, তাকেও আমি নিজের পাপে নষ্ট করে ফেলেছি—হারিয়ে গেছে। কিন্তু দুজনকার স্মৃতিই আজও আমার বুকে আগুন হয়ে ঠিক রে পড়চে, উল্কা হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে! ভুলতে আজও একজনকেও তে পারিনি!—আর কি কোন দিন পারবো?

 “—কে আস্‌চে? তিনিই কি? কেন তাঁকে দেখলেই আমার সুখদাকে মনে পড়ে? সুখদা যদি রাণী হতো, তাহলে তাকেও ঐ রকম সুন্দর দেখাতে পারতো। মানুষে মানুষে মিল থাকে দেখেছি, কিন্তু এতটা মিল এর আগে কখনও দেখিনি!”