বিষয়বস্তুতে চলুন

হারানো খাতা/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

এত নহে তৃণদল ভেসে আসা ফুল ফল
ব্যথা ভরা মন এ যে ব্যথা ভরা মন, মনে রাখিও।

—রবীন্দ্র নাথ।

 প্রবল মানসিক উদ্বেগে ও উত্তেজনায় সুষমার সে রাত্রে জ্বর আসিল এবং দিন দুই সে সেই জ্বরের কষ্টে ও মনের কষ্টে বিছানা লইয়া রহিল।

 নিজের উপরে তার যেন ঘৃণা ধরিয়া গিয়াছিল। এমন কালামুখ তাহার, যে সেকি কোথাও বাহির করিবার উপায় নাই? যাক্ তবে সুড়ঙ্গের মধ্যে বিষেভরা সাপের মত এ জন্মটা তার লোকচক্ষের বাহিরে, শুধু তাহাদের নির্ম্মম আলোচনার মধ্যেই কাটিয়া যাক! মনে পড়িল, নরেশ সেদিন তাহাকে বলিয়াছিলেন “স্বাধীনতার মধ্যে কি দুঃখ নাই? লজ্জা নাই?” সে বিছানার উপর উঠিয়া বসিয়া গলদশ্রু-নেত্রে দু’হাত জোড় করিয়া আত্মগতই কহিতে লাগিল, “দেবতা আমার। দেবতা আমার! তোমার দিব্যদৃষ্টি যে সে দিন এত সূক্ষ্মভাবে আমার এই অপমানগুলা দেখতে পেয়েছিল, তা তো আমি জানিনি! কেন তবে আমার অজ্ঞতার আব্দার গ্রাহ্য করলে?” তারপর সবিস্ময়ে সে ভাবিল, যে পৃথিবীতে নরেশ্চন্দ্র আছেন, মিঃ গুহর মত লোকেও সেখানে কেমন করিয়া জন্মায়!

 ডাকের পিয়ন একখানি পত্র দিয়া গেল। সুষমার নামে কালে ভদ্রে একখানা পত্র আসিলে সেখানা নরেশচন্দ্রের নিকট হইতেই আসে। আজও সেই বিশ্বাসেই পরিপূর্ণচিত্তে সাগ্রহে পত্রখানা লইয়া মাথায় ঠেকাইতে গিয়া হঠাৎ সুষমার লক্ষ্য হইল, উপরের হস্তাক্ষর নরেশচন্দ্রের নহে এবং খামখানা অন্যছাঁদের। চিঠি লিখিবার লোকের বালাই তাহার কোনখানেই তো নাই, কে লিখিল তাহাকে এই চিঠি! এই কথা ভাবিতে ভাবিতে মোটা খামখানা সে মাথার কাঁটা দিয়া খুলিয়া ফেলিল। সম্পূর্ণরূপেই অপরিচিত হাতের লেখা, আর সম্পূর্ণরূপেই অবমাননাজনক ইহার বর্ণবিন্যাস! ক্রুদ্ধ এবং বিস্মিত হইয়া চারি পৃষ্ঠা চিঠির শেষে নামের স্বাক্ষরটা উল্টাইয়া দেখিতে গেল। সেখানে লেখা আছে—“তোমার একান্ত দর্শনাভিলাষী সুরেশ্বর বসু।” চিঠির উপরে এ বাড়ীর ঠিক পাশের বাড়ীর নম্বর দেওয়া রহিয়াছে। তখন মিঃ গুহর কথা তাহার স্মরণ হইল। তাহার প্রতিবেশী সুরেশ্বর বোসকে সে চেনে কিনা এই প্রশ্ন তিনি তাহাকে সেদিন কহিয়াছিলেন এবং সুরেশ্বর মিঃ গুহর বন্ধু। প্রচণ্ড ক্রোধে তাহার ব্রহ্মরন্ধ্র অবধি জ্বলিয়া গেল। অতি সামান্য পঠিত পত্রখানা সে মর্দ্দিত করিয়া ফেলিয়া দিতেছিল, আবার কি ভাবিয়া তাহা গদির তলায় তদবস্থাতেই রাখিয়া দিল। সে পত্রে যে সব কথা লেখা হইয়াছে তাহার আভাস দু’চার পংক্তির মধ্যেই পাওয়া যায় এবং সেদিন মিঃ গুহের মুখে সে কথা শুনিতেও তো তার বাকি নাই। রাজা নরেশচন্দ্র তাহাকে যে ভাবে রাখিয়াছিলেন এবং যাহা হইতে এক্ষণে বঞ্চিত করিতে উদ্যত হইয়াছেন, তদপেক্ষায় অনেক বেশী সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে তাহারা উহাকে রাখিতে প্রস্তুত, ইত্যাদি অনেক কথাই সেই পত্রে লেখা আছে। পত্রখানা, নরেশকে দেখান উচিত বোধেই সে ছিঁড়িয়া ফেলিল না।

 কানাই সিং বিস্তর রাগারাগি করিয়া তাহাকে রাঁধাইতে না পারিয়া বিষম ক্রোধে গজ গজ করিতে করিতে উঠিয়া গেল, “তা’হলে আমিও আজ আর রুটি বানাবে না। এমন করে রোজ রোজ উপোস দিলে যে তোর জান বার হয়ে যাবে খুকি বউয়া! খোড়া কুচ তো আদমী মুহেমে দেয়।”

 তারপর নিজের তৈরি আটার রুটি ও আলুর তরকারি বানাইয়া এক ঘটি জলও থালায় খাবার আনিয়া তাহার সামনে ধরিয়া দিয়া বলিল “লে’ এখন উঠে বৈঠকে খা’লে বাবা; দুটো খা’লে।”

 সুষমার চোক দিয়া এতক্ষণের পর তাহার চোক নাক জ্বালা করিয়া অকথ্য যন্ত্রণারাশি তপ্ত অশ্রুর আকারে ছুটিয়া বাহির হইল। নিজের যে অরুন্তদ মর্ম্মব্যথা তার মনের ভিতরে জমাট বাঁধিয়া উঠিয়া তাহাকে প্রচণ্ডবলে আঘাত করিতেছিল, এই একমাত্র স্নেহ করিবার বুড়া সাথীটির এইটুকু স্নেহাভিব্যক্তিতে সেই অব্যক্ত দুঃখ তাহার ব্যক্তের সীমায় ফিরিয়া আসিল। সে খাবার কোলে করিয়া ক্রমাগত চোখই মুছিতে লাগিল।

 কানাই সিং সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “খেয়ে লে বউয়া; খেয়ে লে, তোর অসুখ কুচ্ছু বাড়বে না, আমার কথায় বিশোয়াস্ কর। কচি বাচ্চা, কত উপোস কর্‌বি বল দেখি?”

 অনেক কষ্টে গলাধঃকরণ করিয়া সুষমা তার পুরাতন বন্ধুর যত্নের দান মোটা রুটির দু’এক খানা খাইয়া তখন বুঝিতে পারিল, এটুকু পাওয়ার তাহার বিশেষ প্রয়োজন ঘটিয়াছিল। অনেকটা ঠাণ্ডা হইয়া সে তখন স্নেহকারীকে একটু খুসী করিবার জন্য তাহার সঙ্গে গল্প আরম্ভ করিয়া দিল, “সিং-জী! আচ্ছা তোমার বউমেয়েরা সেখানে গেলে তোমার রুটি গড়ে দেয় তো? সেখানে তো নিজে রাঁধতে হয় না?”

 কানাই সিং একগাল হাসিয়া জবাব দিল “আরে নারে বউয়া। সেখানে হামি কিসের দুখে নিজে রান্‌তে যাবে? কিস্‌মতিয়া, ববুয়া হামার বড়া পুতৌ নান্‌কিয়া মাই সবকোই রুটি পেকিয়ে দেয়, হামি বৈঠে বৈঠে খাই। সেখানে রুটি বড় মিট্‌ লাগে। পানীয়ে মিঠা বহুত। আহা কব্ না কব্ সেহাতি খেতে পারবে, সে তো না জানে কুছ।”

 সুষমা অকস্মাৎ কি যেন একটা ক্ষীণ আলোক-রেখা ঐটুকু পরিতাপের বেদনার মধ্যে জ্বলিয়া উঠিতে দেখিতে পাইল। সে একেবারে কাঙ্গালের মতন ব্যাকুল হইয়া দুচোকভরা আগ্রহ লইয়া কানাই সিংহের মুখের পানে চাহিল।

 “সিং-জি। আমায় তুমি ফেলে যেও না! বরং আমায় সঙ্গে করে তোমার দেশে নিয়ে চলো, তাই নিয়ে চল সিং-জি! যাবে?

 কানাই এই কাতর ও ব্যর্থ আবেদনে পূর্ণ আস্থা স্থাপন করিতে না পারিলেও এ প্রস্তাবেই মহা সন্তুষ্ট হইয়া গেল। আপ্রান্তমুখ দন্ত বিকশিত করিয়া গদগদকণ্ঠে কহিয়া উঠিল “হামার বাড়ী গিয়ে কি তুই থাকতে পার্‌বি খুঁকি বউয়া! সে যে মাটির বাড়ী, তার ফুসের চাল। কি করবো গরীব আদ্‌মী। রাজা বাবু তোকে যেতে দেবে কেন?”

 সুষমা উত্তেজিত আবেগে অধীর হইয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি কহিল “খুব দেবেন, খুব দেবেন। আমি কোথাও সরে যেতে পেলে তিনিও যে রাহুমুক্ত হন,—কেন দেবেন না। কিন্তু আমি গেলে তারা কি আমায় ঘরে ঢুকতে দেবে, সিং-জী? আমি কোথায় থাকবো?” সুষমার অর্দ্ধেকটুকু উৎসাহ এই চিন্তাভিব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গেই ভাঁটার টানের মতই চলিয়া গেল।

 কানাই সিং জিব কাটিয়া ত্রস্তস্বরে “সে কি রে বাবা! কেন তুই কার কাছে কি কছুর করেছিস্ রে?” বলিয়া সস্নেহআদরে আরও কি বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় বহির্দ্বারে খটাখট খটাখট করিয়া অসহিষ্ণুভাবে কাহাকে কড়া নাড়িতে শোনা গেল। রাজাবাবুর পত্রবাহক বিশ্বাসে দুজনেই ত্রস্ত হইল। নতুবা এমন সুখজনক আলোচনার মধ্য হইতে কানাই সিংকে এত শীঘ্র কেহ উঠাইতে পারিত না।

 খানিক পরে উত্তেজিতভাবে ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, রাজাবাবুর লোক নয়, ব্যারিষ্টার সাহেব সুষমার দুদিনের কাজ কামায়ের কৈফিয়ৎ কাটিতে আসিয়াছেন। সে অনেক করিয়া বলিয়াছিল যে ববুয়ার এখন বড় অসুখ, দেখা কিছুতেই হইবে না, তাহাতে কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করিতে চাহেন না। শেষকালে কানাই সিংকে বিরক্ত দেখিয়া একখানা পাঁচ টাকার নোট বাহির করিয়া তাহাকে বলেন, দেখা করাইয়া দাও তো এটা পাইবে! কানাই তাঁহাকে উত্তম মধ্যম ঝাড়িয়া দিত, শুধু পাছে ববুয়ার মনীবকে চটাইলে ববুয়া তার উপর রাগ করে, তাই সে পারে নাই। এই বলিয়া বৃদ্ধ কাঁদো কাঁদো গলায় সাগ্রহে বলিয়া উঠিল “অমন নোকরী তুই করিস নে খোঁকি! হামি রাজাবাবুকে বল্‌বো তোর টাকায় আঁটচে না আর কিছু বেড়িয়ে দিতে। হামার রাজাবাবু তেমন নয়।”

 কানাই সিংহের আনিত সংবাদে এদিকে সুষমার অবস্থা একেবারেই শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। আতঙ্কে আঁৎকাইয়া উঠিয়া সে ঘরের দিকে সভয় দৃষ্টি রাখিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে বলিয়া উঠিল “কিছুতে না, কিছুতে না, সিং-জী। দেখ যেন সে আমার বাড়ীতে না ঢুকতে পারে। তুমি যে করে হয়, তাড়াও ওকে, তাড়াও।—যদি এখানে এসে পড়ে— শিগগির যাও।”

 বিস্মিত কানাই সিং কি বলিবার জন্য মুখ খুলিতে গেলে, দারুণ অধৈর্য্যের সহিত সে তাহাকে ঠেলিয়া দিল’ “আঃ যাও না সিং-জী, এক্ষুণি হয়ত এখানে এসেই উপস্থিত হবে।”

 কানাই সিং প্রস্থান করিলে ছুটিয়া আসিয়া সুষমা ঘরের সকল কয়টা দরজা জানালায় খিল আঁটিয়া দিল। তার হাত পা তখন ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতেছে এবং দাঁতে দাঁতে ঘষিয়া যাইতেছে।

 বিশ্বপ্রিয় বাবু পরের দিন সকাল বেলায় আসিয়া নিজের নাম ছাপা কার্ড পাঠাইয়া দিলেন। সঙ্গে একটুকরা কাগজে লিখিয়া দিলেন “সবিনয় নিবেদন,—রাজাবাহাদুরের অনুরোধে আমিই আপনার জন্য মিঃ গুহর বাড়ীর চাকরী জোগাড় করিয়াছিলাম, যদি সেখানে কোন অসঙ্গত কিছু ঘটিয়া থাকে, তার জন্য আমিই প্রধানতঃ দায়ী, এবং আমিই তার জবাব দিতে বাধ্য। সেজন্য আমার সব কথা জানাও উচিত। অতএব যদি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে মিনিট কতকের জন্য আপনার বাহিরের ঘরে আপনার কোন বিশ্বাসী লোকের উপস্থিতিতে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটিতে পারে।”

 পত্র লেখার ধরণে বিশেষতঃ পূর্ব্বেই নরেশের পত্রে তাঁহার ‘বন্ধু’ বলিয়া ইহার উল্লেখ থাকাতে সুষমা কানাই সিংকে সঙ্গে লইয়া রাস্তার ধারের অব্যবহারে পতিত আসবাবহীন বৈঠকখানা ঘরখানায় বিশ্বপ্রিয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিল।

 বিশ্বপ্রিয় তাহাকে নমস্কার করিয়া সম্ভ্রমের সহিত উঠিয়া দাঁড়াইল এবং সবিনয়ে কহিল, “মিঃ গুহর কাছে কালরাত্রে শুনলুম, আপনি আর তাঁর স্ত্রীকে বাজনা শেখাতে যাচ্চেন না; আপনার না যাবার কারণ জানতে কাল তিনি এখানে এসেছিলেন, আপনি দেখা করেন নি, অপরন্তু আপনার চাকরের হাতে তিনি অত্যন্ত অপমানিত হয়ে ফিরে গেছেন।

 সুষমা আসিবার সময় নিজের রুক্ষচুলগুলাকে টানিয়া মাথার উপর কুণ্ডলী করিয়া জড়াইয়া আসিয়াছিল, চোখে একজোড়া চোক ওঠায় সময়কার নীল চশমা ও গায়ে একখানা মোটা র‍্যাপারে সে নিজেকে লুকাইবার ইচ্ছায় ঢাকা দিয়া আসিয়াছিল। কিন্তু তাহার দিকে চোখ পড়িতেই বিশ্বপ্রিয় যেন আশ্চর্য্য বোধ করিলেন। রাজা নরেশের আশ্রিতা যে এতটাই ছেলে মানুষ এ ধারণা তাঁর মোটেই ছিল না। আরও বিস্ময়বোধ হইল তার নিরাড়ম্বর ও অদ্ভুত বেশভূষা দেখিয়া। —এ যেন একটী নেহাৎ সাদাসিদা স্কুলের মেয়ে। একে আর কিছু যে মনে করিতেই পারা যায় না।

 ধীর এবং স্থিরকণ্ঠে সুষমা উত্তর করিল, “তিনি যা বলেছেন সবই সত্যি। শুধু তাঁকে অনুগ্রহ করে বলে দেবেন, আমি তাঁর বাড়ী আর চাকরী করবো না, তাঁরা যেন দয়া করে আমায় বিরক্ত না করেন।”

 অনুমানে সকল কথাই বুঝিয়া লইয়া বিশ্বপ্রিয় কিছু দুঃখিত কিছু অপ্রতিভ হইয়া পড়িয়াছিলেন, মৃদু মৃদু বলিলেন “রাস্‌কাল! আচ্ছা তাকে আমি দেখে নেবো। কিন্তু আপনার কাছে আমিই অপরাধী হয়ে পড়লেম। আচ্ছা এবারে আমি বিশেষ জানাশোনা ভদ্রঘর দেখে আপনার জন্য খুব ভাল চাকরী ঠিক করে দেব দেখবেন।”

 সুষমা নতমুখে বলিল “আমার আর চাকরীর ইচ্ছা নেই।”

 বিশ্বপ্রিয় সলজ্জে মাথা হেঁট করিলেন এবং তারপর নত মুখেই কহিলেন “সংসারে মিঃ গুহ অল্পই জন্মায় জান্‌বেন।”

 সুষমা কহিল “তা, আমি জানি, কিন্তু আমার স্থানও যে বড়ই স্বল্প পরিসর। ক’জন আমায় বাড়ী ঢুকতে দিতে রাজী হবেন?”

 এই অকুণ্ঠিত ও নির্ভীক আত্মাভিব্যক্তিতে বিশ্বপ্রিয় একদিকে যেমন অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন তেমনি আর একদিক দিয়া ইহাতে তাঁহার আলোচনার পথও মুক্ত হইয়া গেল। তিনি তখন ঘরের মধ্যের দ্বিতীয় চৌকিখানি টানিয়া দিয়া সুষমাকে বলিলেন “বসুন, আপনার সঙ্গে এ সম্বন্ধে আমি একটুখানি আলোচনা করিতে চাই। আপনার বিষয়ে রাজবাহাদুরের কাছ থেকে আমার যতটা জানা আছে, আর নিজেও যেটুকু আজ আপনাকে দেখেও আমি বুঝেছি, তাতে সাধারণ সমাজ আপনাকে স্থান দিতে কুণ্ঠিত হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমি সব কথা জানিয়ে বিশেষরূপ চেষ্টা করবো এবং ধরে নিচ্ছি, তাতেও যদি না কৃতকার্য্য হতে পারি, তা হলে—”

 বিশ্বপ্রিয় একটুখানি ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। ততক্ষণে সুষমা জিজ্ঞাসা করিল “আমার সমস্ত খবর পেয়েও কি ব্রাহ্মসমাজ আমায় তার মধ্যে স্থান দিতে প্রস্তুত হবে?”

 প্রশ্নের ধরণে, আর ঐ সমস্ত কথাটার উপর জোর দিয়া বলাতে বিশ্বপ্রিয় মনে মনে অস্বস্তি অনুভব করিয়া একটু যেন আম্‌তা আম্‌তা করিয়া এক রকমে জবাব তৈরি করিয়া লইলেন—‘দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম’ সমাজ সে কথাটা জানে বৈ কি।”

 সুষমা নিজের অস্পষ্ট হইয়া পড়া কণ্ঠস্বরকে সুস্পষ্টতর করিয়া তুলিয়া দৃঢ়স্বরে কহিয়া উঠিল “জন্মগত অপরাধের কথা নয়; যে অধিকারে মিঃ গুহ আমায় অবমানিত করাকে অপরাধ বা পাপ বোধ করেন নি, ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা কি আমার উপর থেকে সে দৃষ্টি বদল কর্‌তে পাবেন? অথবা আমি যা আছি, লোকের মনে তাহাই থেকে যাব, অথচ যে দেবদেবীদের আমি মনে মনে বিশ্বাস করি, শুধু বাহিরে স্বীকার করতে বাধ্য হবো যে তা করিনে?—আব যে নির্গুণ পরব্রহ্ম সম্বন্ধে আমার ধ্যান বা ধারণা কাছেও গিয়ে পৌঁছতে পারে না, সকলের মধ্যে সগর্ব্বে স্বীকার করে নিতে হবে যে, তাঁহারই উপাসক আমি? এত পাপের মধ্যে আবার এতবড় একটা প্রতারণা কেন করতে যাব? হিন্দুসমাজে মিশবার অধিকার আমার নাই থাক্‌, তবুও মনে প্রাণে যে আমি হিন্দুই!”

 এর পর আর বিশ্বপ্রিয় কথা খুঁজিয়া পাইলেন না। দু’একবার ক্ষীণ ভাবের প্রতিবাদ চেষ্টা করিতে গিয়া পরাভূতবোধে শেষে অনেক চেষ্টা করিবার পর নিজের সকল দ্বিধা ও লজ্জা সংবরণ করিয়া তিনি অকৃত্রিম সহানুভূতির সহিতই মরিয়াভাবে বলিয়া ফেলিলেন,—

 এই সামান্য ক্ষণের কথায় বার্ত্তায় আপনাকে আমি চিনেছি। রাজার কথা,—সত্য কথাই বল্‌বো—পূর্ব্বে আমার তেমনি বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এখন আমি আপনার তেজস্বিতায় ও সরলতায় মুগ্ধ হয়ে সব কিছুই অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করে নিতে পেরেছি। আপনি আমাদের সমাজে আসতে চান; আমি সযত্নে আপনাকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে আনন্দের সঙ্গেই প্রস্তুত হবে। আপনি যদি ব্রাহ্মধর্ম্মে না আসতে চান, তাহলে আপনাকে নিরাপদ ও সম্মানের স্থান দেবার জন্য আমি অত্যন্ত আহ্লাদের সহিতই আপনাকে সিবিল ম্যারেজ অ্যাক্টের হিসেবে বিবাহ করতেও সম্মত জান্‌বেন। আপনার মত মহিলার এ অবস্থায় থাকা অনুচিত এবং যারা থাকতে দেয়, তারা অপরাধী।”

 সুষমা তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া উঁহাকে যোড়হাতে নমস্কার করিল, কৃতজ্ঞতার সজলকরুণস্বরে সে কহিল, “আপনি আমায় যে কথা আজ মুখেও বলতে পারলেন, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গেই তা আমার চিরদিনই মনের ভিতর গাঁথা থাকবে। কিন্তু আমি যে কোন সমাজের লোকেরই স্ত্রী হবার যোগ্যা নই। আমার সম্বন্ধে এখন থেকে আপনারা শুধু নিরপেক্ষতার অবলম্বন করেন, এই আমার শেষ ভিক্ষা।”

 বিশ্বপ্রিয়রও আর বলিবার কথা যোগাইল না। তখন দুজনেই বিদায় লইল।