হারানো খাতা/বিংশ পরিচ্ছেদ
বিংশ পরিচ্ছেদ
“হত ভাল যদি হতে কুৎসিত অথবা সে হ’তে বলী
ভয়ে আসিত না ভালবাসিত না চরণে যেত না দলি।”
অশান্তির আগুন যখন জ্বলিতে আরম্ভ হয়, ইহার যেন আর শেষ দেখা যায় না। কোথা দিয়া ও কেমন করিয়া যে রাজা নরেশচন্দ্রের সহিত সুষমার বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবরটা দেশময় প্রচার হইয়া পড়িল বলা কঠিন, কিন্তু কলিকাতার ধনী মহলে যাঁহারা ও-সকল সংবাদ রাখিয়া থাকেন এবং নরেশচন্দ্রের সুন্দরী আশ্রিতার সম্বন্ধে যাঁদের বিশেষ একটু আগ্রহ মনের মধ্যে এতদিন চাপা ছিল, তাঁদের মধ্যের দু এক জন ধনীলােকের মােটর সুষমার দরজায় ধাক্কা মারিয়া গেল। কেহ বা পত্র কেহ বা বন্ধু পাঠাইলেন। কানাই সিং হুকুমবরদারী করিল। রাজার পত্রবাহক ভিন্ন সকলকেই বিদায় করিয়া দিতে হুকুম ছিল, ধরিয়া আনিতে বলিলে বাঁধিয়া আনা কানাইয়ের স্বভাব, কানাই সে বিষয়ে কোন ত্রুটী দেখাইল না।
শেষে ডাক্তার করুণানিধান বাবু দেখা করিতে আসিলেন। ইঁহার সম্বন্ধে কি করা উচিত ঠিক না পাইয়া কানাই সিং মুনিবকে খবর দিতে গেল। ডাক্তার নােটবুকের পাতা ছিঁড়িয়া পেন্সিলে লিখিয়া দিলনে,—“সে যে কাহারও সহিত দেখা করিতেছে না, তাহা তিনি শুনিয়াছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা স্বতন্ত্র। তিনি সুষমার বাল্যকালে কতবার রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আসিয়া তার গান শুনিয়া গিয়াছেন রােগের চিকিৎসা করিয়াছেন যে! তা তখন হইতেই তিনি সুষমার জন্য পাগল, কেবল নরেশের বন্ধুত্বের খাতিরেই এতদিন চুপ করিয়াছিলেন। তাঁর স্ত্রী এখন মারা গিয়াছে।—সুষমার রূপ ধ্যান করিয়াই তিনি আর নূতন করিয়া সং সাজিতে পারেন নাই।”
কানাই সিং ঈষৎ ক্ষুব্ধভাবে ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, “আজ নয়, আপনি কাল আসিবেন।” এদের উদ্দেশ্য সেও এখন বুঝিতে পারিয়াছিল এবং সুষমার কার্য্যে তার বুক অহঙ্কারে ভরিয়া উঠিয়াছিল। এবার তাহা চূর্ণ হইতে বসিল, ভাবিয়া সে মর্ম্মে আহত হইল।
ডাক্তারকে বিদায় দিয়া বিষণ্ণচিত্তে নিজের খাটিয়ায় বসিয়া পড়িয়া সবেমাত্র উচ্চারণ করিয়াছে “সীতারাম। সীতারাম!”—এমন সময় উপর হইতে ডাক আসিল “সিং-জী!”
মুখভার করিয়া কানাই গিয়া নিরুত্তরে কাছে দাঁড়াইল। বিস্মিত হইয়া দেখিল, ঘরের মেজেয় বসিয়া সুষমা চোখ মুছিতেছে, বোধ করি কাঁদিতেছিল। তাহাকে দেখিয়াই সে আহত-শিশুর ন্যায় ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া মর্ম্মবিদারীস্বরে যেন আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল “সিং-জী, ভাইয়া। আরতো আমি এদেশে থাকতে পারচিনে, আমায় তোমার দেশে তুমি নিয়ে চলো।”
কানাই সিং এই দুদিনের ব্যাপারে মনে মনে অত্যন্ত চটিয়াই ছিল। সে যেমন প্রীত তেমনি ক্রুদ্ধ হইয়া রুখিয়া উঠিল “বউয়া! তুই কাঁদিস্ নে, তুই হামার বেটী আছিস, বেটীসে বড়্ করে আমি তোকে মেনিছি, আমি তোর হুকুম পেলে ওই দুষমণ্-বাবুদের নাক ভেঙ্গে দিতে পারি। তুই হুকুম দে, দেখি তোকে কোন জানোয়ার কাঁদাতে আস্তে পারে।”
সুষম কাঁদিতে কাঁদিতে প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল “না কানাই ভাইয়া! কারুকে আমি কিছু বলবো না ওদের দোষ কি? ওরা চিরদিন আমাদের মতন লোকেদের সঙ্গে যে ব্যবহার করে আসতে পেয়েছে, পারছে, ওরা তাই জানে। আমাদের মধ্যেও যে মানুষের প্রাণ আছে, ইজ্জতবোধ আছে, তাতো কোনদিন কেউ ভাবতে শেখেনি। সমাজ তো আমাদের রক্ষার কোন উপায় করেনি, কেউতো আমাদের দোরে দোরে গিয়ে উদ্ধারের উপদেশ শোনায়নি, আমাদের নিয়ে শুধু পুতুল খেলাতেই পেরেছে। আমরা যে মানুষ সেটুকু শুদ্ধ ভুলে গিয়েছে। ওদের বলবার আছে কি? এর জন্য আমরাও যে দায়ী। শুধু ওরাই নয়, আমরাও যে ভুলে গিয়েছিলুম যে আমরাও মানুষ।”
কানাই সিং রাগিয়াই ছিল, সে তেমনি উদ্ধতকণ্ঠে কহিয়া উঠিল,“রাজা বাবুরই তোমার খবর না লেওয়া খুব কসুর হচ্চে। আমি এখনি গিয়ে সব হাল ওঁকে জেনিয়ে আসছি।”
“সিংজী ভাইয়া! আমায় একা রেখে তুমি যেওনা, তবে আমায় শুদ্ধ সঙ্গে করে নিয়ে চলো।”
কানাই যেন এতক্ষণের পর নিজে আশ্বস্ত হইয়া উহাকেও আশ্বস্ত করিতে চাহিয়া বারবার করিয়া বলিতে লাগিল; “তাই চল্ বউয়া! তাই চল্। হামার রাজাবাবু তোকে দুষ্কু পেতে দেবে না; এমনি করে থাকিলে তুই মরিয়ে যাবি।”
বেলা তখনও সম্পূর্ণ শেষ হয় নাই। রুদ্ধদ্বার ঘরের মধ্যে পাখার হাওয়ায় গ্রীষ্মতাপ কিছুই অনুভূত হইতেছিল না বটে; তবে বহির্জগতে তখনও পচা ভাদ্রের রৌদ্রতপ্ত দীর্ঘ বেলা অবসানের পথে আলস্য শ্লথ গতিতে ধীরে ধীরেই অগ্রসর হইতেছিল, যাইবার জন্য তার বিশেষ তাড়াতাড়ি ছিল না। পশ্চিমাকাশে সূর্য্যের দেখা নাই; কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত রাজচক্রবর্ত্তী রাজার শাসনকাল উত্তীর্ণ হইয়া গেলেও যেমন তাহার শাসন প্রভাব কিছুকাল পর্য্যন্ত তাঁহার শাসিত প্রদেশকে প্রভাবান্বিত রাখে, তেমনি তাঁর মহিমাজাল তখনও আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে গৌরব বিস্তৃত করিতেছিল। নরেশচন্দ্র নিজের আফিস ঘরে দু’একজন কর্ম্মচারীর সহিত কাজকর্ম্ম দেখিতেছিলেন; এইবার উঠি উঠি করিতেছেন, এমন সময় কানাই সিং দ্বারে দাঁড়াইয়া বরকতক কাশিয়া নিজের পরে তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষিত করিয়া লইল এবং তারপর দীর্ঘ সেলাম ঠুকিয়া ডাকিল “মহারাজ!”
“কে? কানাই সিং?—যুগল! পালমশাই! আজ আমি এইবার উঠি, কাল আর একবার ঐ খসড়াটা ভাল করে দেখেশুনে দেওয়া যাবে।”
নরেশ কানাই সিংয়ের কাছাকাছি হইয়া নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমাদের খবর ভাল তো কানাই সিং?” হাতে চিঠি আছে কিনা উদ্বিগ্ন চোখে দেখিয়া লইলেন।
কানাই সিং দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া জানাইল, “খবর কাঁহা কুছু আচ্ছা হায় মহারাজ! বউয়াজী বহুত তক্লিবসে হ্যায়। হাম উন কো সাথ্ করকে হিঁয়া লে আয়া।”
“নিয়ে এসেছ! তাকে!—” নরেশ যেন ভয়ত্রস্তভাবে চমকিয়া উঠিলেন।—“কি হয়েছে তার? আমায় খবর দিলেই হোত।”
কানাই সিং সুষমাকে সত্যসত্যই ভালবাসিয়াছিল, একেই সে সুষমার প্রতি মহারাজের ব্যবহারকে প্রশংসা করিতে কোনমতেই সমর্থ হইতেছিল না, তার উপর ইঁহার সুখ ঐশ্বর্য্যের প্রাচুর্য্য অথচ সুষমার অর্থাভাবে অবমাননাজনক চাকরী করিতে যাওয়া, বিশেষ তাহারই পরিণামে এত দুঃখভোগ, তাহার মনকে অত্যন্তই তিক্ত করিয়া তুলিয়াছিল। এক্ষণে সুষমার আগমন সংবাদে নরেশকে বিপন্নভাবাপন্ন দেখিয়া সে আর ধৈর্য্য রাখিতে পারিল না। মনীবের মর্য্যাদা ভুলিয়া গিয়া সে অভিমান-পরিপূর্ণ বিরক্তস্বরে জবাব দিল, “মহারাজ! হুকুম ফরমাইয়েতো হাম হামারা বউয়াজীকো আপনা দেশপর—যাঁহা হামার বেটী পুতৌ হায়, হুঁয়াই লে চলে?—লেকেন গরীব পরবর!—গরীবকা বাচ্চা কো উপ্র এইসা বেখেয়াল হোকে রহ্না ঠিক বাত নেই হ্যায়!”
ভৃত্যের নিকট তিরস্কৃত হইয়া নরেশচন্দ্রের চিন্তা-বিপন্নতা গভীর লজ্জায় পর্য্যবসিত হইয়া আসিল। আত্মচিন্তায় বিরত হইয়া তখন আস্তে আস্তে উহাকে প্রশ্ন করিলেন “সুষমা কোথায়?”
গাড়ীর মধ্যে ফটকের বাহিরে আছে শুনিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ কানাই সিংয়ের সহিত অগ্রসর হইলেন।
পিছনে কর্ম্মচারী দুজনের মধ্যে যুগল তখন নিম্নস্বরে অপরজনকে সম্বোধন করিল “ব্যাপারখানা শুনলেন তো পাল মশাই! বাইজী সাহেব যে বাড়ী চড়োয়া হয়ে এসে উপস্থিত হলেন দেখছি! আসা যাওয়া কমেছে কি না, অম্নি গেরো কষতে বাড়ী বয়ে ছুটে এসেছেন।”
পালমশাই চক্ষের ইঙ্গিত করিয়া মুচকি হাসির সহিত টিপ্পনী কাটিল “ভাইরে! ওরা হল জলের কুমীর। ওদের দাঁতের মধ্যে যার গর্দ্দান খানা গিয়ে পড়েছে, সে কি আর কখন তা’ বার করে নিতে পারে? এতো আর তোমার রাঘব বোয়াল নয় যে ফের উগ্রে দেবে!”
“এইবারেই আমাদের রূপসী-রাণী ঠাক রুণটীর সিংহাসন টলমল হলো বোধ হয়। যা হোক ভাই, আমার কিন্তু একবারটী ওর রূপখানা কোন রকমে দেখে চক্ষু দুটো সার্থক করে নিতে হবে। শুনেছি নাকি মাগীটা আরমানী বিবি?”
পাল কহিল “দুর্ ছোঁড়া! আরমানী কেন হতে যাবে?—সে যে আদত কাশ্মীরী।”