হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/গুরুবাক্য

উইকিসংকলন থেকে

গুরুবাক্য

অচ্যুত, অপূর্ব, উমেশ কার্তিক ও খগেন্দ্র

 অচ্যুত। গুরুদেব এখনো এলেন না, উপায় কী?

 কার্তিক। আমি তো বিষম মুশকিলে পড়েছি। আমার নাম কার্তিক, আমার ছোটো শালার নাম কীর্তি। আমার স্ত্রী তার ভাইকে কীর্তি বলে ডাকতে পারে কি না এটা স্থির করে না দিলে স্ত্রীর সঙ্গে একত্র বাস করাই দায় হয়েছে। তার উপর আবার গয়লা বেটার নাম কীর্তিবাস; এখন গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, আমার স্ত্রী যদি কীর্তিবাস গোয়ালাকে বাসুদেব বলে ডাকে তাহলে বৈধ হয় কি না। বাড়িতে কার্তিকপূজার সময় স্ত্রী কার্তিককে নাত্তিক বলে; নাম খারাপ করার দরুন ঠাকুরের কিম্বা তাঁর মার কোনো অসন্তোষ ঘটে কিনা এও জিজ্ঞাস্য।

 অপূর্ব। আমারও একটা ভাবনা পড়েছে। সেবার শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে জগন্নাথকে কুল দিয়ে এসেছিলুম, এখন, এই গরমির দিনে কুলটুকু বাদ দিয়ে যদি তার ঝোলটুকু খাই তাতে অপরাধ হয় কি না।

 অচ্যুত। আমি সেদিন গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেম যে, শাস্ত্রমতে ভোক্তা শ্রেষ্ঠ না ভোজ্য শ্রেষ্ঠ, অন্ন শ্রেষ্ঠ না অন্নপায়ী শ্রেষ্ঠ? তিনি, এমনি এক গভীর উত্তর দিলেন যে, তখন যদিচ আমরা সকলেই জলের মতো বুঝে গেলুম কিন্তু এখন আমাদের কারও একটি কথাও মনে পড়ছে না।

 উমেশ। আমার যতদূর মনে হচ্ছে, বোধ হয় তিনি বলেছিলেন, অন্নও শ্রেষ্ঠ নয়, অন্নপায়ীও শ্রেষ্ঠ নয়, কিন্তু আর-একটা কী শ্রেষ্ঠ, সেইটে যে কী মনে পড়ছে না।

 অপূর্ব। না না, তিনি বলেছিলেন অন্নও শ্রেষ্ঠ, অন্নপায়ীও শ্রেষ্ঠ। কিন্তু অন্নই বা কেন শ্রেষ্ঠ, আর অন্নপায়ীই বা কেন শ্রেষ্ঠ তখন বুঝেছিলুম এখন কোনোমতেই ভেবে পাচ্ছি নে।

 খগেন্দ্র। অন্ন এবং অন্নপায়ীর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, সহজবুদ্ধিতে পূর্বে সেটা একরকম ঠাউরেছিলুম কিন্তু গুরুদেবের কথা শুনে বুঝলুম যে পূর্বে কিছুই বুঝি নি, এবং তিনি যা বললেন তাও কিছুই বুঝলুম না।

 অচ্যুত। যা হোক সে-ও একটা লাভ।

বদনচন্দ্রের ছুটিয়া প্রবেশ

 বদন। (হাঁপাইতে হাঁপাইতে) গুরু কোথায়? আমাদের শিরোমণি মশায় কোথায়? বলো না হে কোথায় গেলেন তিনি?

 অচ্যুত প্রভৃতি। কেন কেন?

 বদন। হঠাৎ কাল রাত্রে আমার মনে একটা প্রশ্ন উদয় হল, সে অবধি আহার-নিদ্রা প্রায় ছেড়েছি।

 কার্তিক। তাই তো। বিষয়টা কী বলো তো।

 বদন। কী জান? কাল মশারি ঝাড়তে ঝাড়তে হঠাৎ মনে একটা তর্ক এল যে, এত দেশ থাকতে জটায়ু কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে মারা পড়ল? জটায়ু যে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে ম’ল তার অর্থ কী, তার কারণ কী, এবং তার তাৎপর্যই বা কী। এর মধ্যে যদি কোনো রূপক থাকে তবে তাই বা কী। যদি কোনো অর্থ না থাকে তাই বা কেন?

 কার্তিক। বিষয়টা শক্ত বটে। শিরোমণি মশায় আসুন।

 খগেন্দ্র। (ভয়ে ভয়ে) ঠিক বলতে পারি নে কিন্তু আমার বোধ হয় জটায়ুর মৃত্যুর একমাত্র কারণ, যুদ্ধের সময় রাবণ তাকে এমন অস্ত্র মেরেছিলেন যে সেটা সাংঘাতিক হয়ে উঠল।

 বদন। আরে রাম, ও কি একটা উত্তর হল? ও তো সকলেই জানে।

 কার্তিক। ও তো আমিও বলতে পারতুম।

 অপূর্ব। ও-রকম উত্তরে কি মন সন্তুষ্ট হয়?

বদন চিন্তান্বিত, খগেন্দ্র অপ্রতিভ

 অচ্যুত। (শশব্যস্ত) ওই যে গুরু আসছেন।

 উমেশ। ওই যে শিরোমণিমশায়।

 বদন। (সহসা চিন্তাভঙ্গে চকিত হইয়া) অ্যাঁ গুরুদেব আসছেন। বাঁচলুম, আমার অর্ধেক সংশয় এখনি দূর হয়ে গেল।

শিরোমণি মহাশয়ের প্রবেশ। সকলের ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম

 শিরোমণি। স্বস্তি, স্বস্তি।

 বদন। গুরুদেব, কাল মশারি ঝাড়তে ঝাড়তে মনে একটা প্রশ্ন উদয় হয়েছে।

 শিরোমণি। প্রকাশ করে বলো।

 বদন। বিহগরাজ জটায়ু রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে কেন নিহত হলেন?

অঙ্গুলি নিদেশপূর্বক

 আমাদের খগেন্দ্রবাবু

খগেন্দ্র অত্যন্ত লজ্জিত ও কুণ্ঠিত

বলছিলেন অস্ত্রাঘাতই তার কারণ।

 শিরোমণি। বটে? হাঃ হাঃ হাঃ, আধুনিক নব্যতন্ত্র কালেজের ছেলের মতোই উত্তর হয়েছে। শাস্ত্রচর্চা ছেড়ে বিজ্ঞান পড়ার ফলই এই। প্রশ্ন হল, জটায়ুর মৃত্যু হল কেন, উত্তর হল, অস্ত্রাঘাতে। এ কেমন হল জান? কাশীধামে বৃষ্টি হল আর খড়দহে পঙ্গপালে ধান খেলে। হা হা হাঃ।

 অপূর্ব। ঠিক তাই বটে। আজকাল এইরকমই হয়েছে বুঝেছেন শিরোমণিমশায়?

 শিরোমণি। আচ্ছা বাপু খগেন্দ্র, তুমি তো অনেকগুলো পাস দিয়েছ, তুমিই বলো তো অস্ত্রাঘাতেই বা জটায়ুর মৃত্যু হল কেন, রক্তপিত্ত রোগেই বা না মরে কেন? রাবণের সঙ্গেই বা যুদ্ধ হয় কেন, ভস্মলোচনের সঙ্গেই বা না হল কেন? অত কথায় কাজ কী, জটায়ুই বা মরে কেন, রাবণ মলেই বা ক্ষতি কী ছিল?

বদন পূর্বাপেক্ষা চিন্তান্বিত

 অচ্যুত ও অপূর্ব। (গভীর চিন্তার সহিত) তাই তো, এত দেশ থাকতে জটায়ুই বা মরে কেন।

 উমেশ। কী হে খগেন্দ্র, একটা জবাব দাও না। তোমাদের রস্কো সাহেব কী লেখেন?

 কার্তিক। তোমাদের টিণ্ডালই বা কী বলেন― রাবণের সঙ্গেই বা যুদ্ধ হয় কেন?

 অচ্যুত। রক্তপিত্তে না মরে অস্ত্রাঘাতে মরবার জন্যেই বা তার এত মাথাব্যথা কেন? হক্‌স্‌লি সাহেব কী মীমাংসা করেন, শুনি।

 খগেন্দ্র। (আধমরা হইয়া) গুরুদেব, আমি মূঢ়মতি, না বুঝে একটা কথা বলে ফেলেছি। মাপ করুন। শ্রীমুখের উত্তরের জন্যে উৎসুক হয়ে আছি।

 শিরোমণি। তোমরা বলছ রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে জটায়ু ম’ল কেন— এক কথায় এর উত্তর দিই কী করে?

 সকলে। তা তো বটেই। তা তো বটেই।

 শিরোমণি। প্রথমে দেখতে হবে, “রাবণের”ই সঙ্গে যুদ্ধ হয় কেন, তারপরে দেখতে হবে, রাবণের সঙ্গে “যুদ্ধ”ই বা হয় কেন, তার পরে দেখতে হবে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে “জটায়ু”ই বা মরে কেন, সব শেষে দেখতে হবে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে জটায়ু “মরে”ই বা কেন?

বদন হাল ছাড়িয়া দিয়া চিন্তাসাগরে নিমজ্জমান

 অচ্যুত। (খগেন্দ্রকে ঠেলিয়া) শুনছ খগেনবাবু?

 অপূর্ব। কী খগেনবাবু, মুখে যে কথাটি নেই?

 কার্তিক। খগেন্দ্র সাহেব, তোমার কেমিষ্ট্রি গেল কোথায় হে?

খগেন্দ্র রক্তমুখচ্ছবি

 শিরোমণি। তবে একে একে উত্তর দিই। প্রথম প্রশ্নের উত্তর, নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে।

 বদন। (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) আঃ বাঁচলুম। এ ছাড়া আর কোনো উত্তর হতেই পারে না।

 শিরোমণি। যদি বল “নিয়তিকে কে বাধা দিতে পারে” এ কথার অর্থ কী, তবে সরল করে বুঝিয়ে দিই। নিয়তত্বই হচ্ছে নিয়তির গুণ এবং নিয়তের গুণই হচ্ছে নিয়তি। তা যদি হয় তবে নিয়তকালবর্তী যে নিয়তি তাকে পুনশ্চ নিয়ত নিয়ন্ত্রিত করতে পারে এমন দ্বিতীয় নিয়তির সম্ভাবনা কুতঃ? কারণ কিনা, নিত্য যাহা তাহাই নিয়ত এবং তাহাই নিয়ন্তা, অতএব রাবণের সঙ্গেই যে জটায়ুর যুদ্ধ হবে এ আর বিচিত্র কী।

 সকলে। এ আর বিচিত্র কী।

 বদন। অহো, এ আর বিচিত্র কী।

 শিরোমণি। এক্ষণে দ্বিতীয় প্রশ্ন―

 বদন। কিন্তু আর নয়, প্রথমটা আগে ভালো করে জীর্ণ করি।

 অচ্যুত। কিন্তু কী চমৎকার উত্তর।

 অপূর্ব। কী সরল মীমাংসা।

 কার্তিক। কী পরিষ্কার ভাব।

 উমেশ। কী গভীর শাস্ত্রজ্ঞান।

বদন। (শিরোমণির মুখের দিকে অনেকক্ষণ চাহিয়া) গুরুদেব, আপনার অবর্তমানে আমাদের কী দশা হবে।

সকলের বাষ্পবিসর্জন

১২৯৩