হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/কৌলীন্য মর্য্যাদা

উইকিসংকলন থেকে

কৌলীন্য মর্য্যাদা।

 আমাদিগের বৈদ্য বংশীয় মহারাজ বল্লালসেন এই দেশের সর্ব্ব সাধারণ জনগণকে যে মান ও উপাধি দিয়াছিলেন, সেই মানই এই ক্ষণে আমাদিগের দেশের অপমান স্বরূপ হইয়াছে। তিনি আপনার নাম চিরস্মরণীয় করণাভিলাষেই হউক অথবা বঙ্গদেশীয়দিগের আচরিত ব্যবহার বশতই হউক এই কুলীন মৌলিকের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে তাহা অতি অনিষ্টের হেতু হইয়াছে। কুলীন সন্তানদিগের মধ্যে প্রায় অনেকেই বলিয়া থাকেন, ঈশ্বর আমাদিগের যে মান সম্ভ্রাম দিয়াছেন তাহাই আমাদিগের যথেষ্ট, আবার বিদ্যা শিক্ষা করিবার প্রয়োজন কি? আমরা যাহার বাটীতে একবার পদার্পণ করি তাহার বাটী একেবারে পবিত্র হইয়া যায়। তাঁহারা এইরূপ গর্ব্বে গর্ব্বিত হইয়া মৌলিকদিগের প্রতি অতিশয় ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং মৌলিকদিগের তাঁহাদিগকে দেবতার ন্যায় পূজা করিয়া থাকেন। কুলীনেরা যদ্যপি কোন কার্য্যোপলক্ষে মৌলিকদিগের বাটীতে গমন করেন, তবে সেই মৌলিকদিগের আর গৌরবের পরিসীমা থাকে না। হা কি অসঙ্গত! মৌলিক যদ্যপি সর্ব্ব গুণালঙ্কৃত হন আর কুলীন যদি যথার্থই কুলীন হন, তবে সেই মৌলিক অপেক্ষা কুলীনের সম্মানই অধিক হইয়া থাকে, এবং ঐ মৌলিকদিগের সন্তান সন্ততি জন্মাইলে তাহাদিগের বিবাহের নিমিত্ত উহাদিগকে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইতে হয়। কিন্তু মধ্যবিধ ও সামান্য গৃহস্থদিগের এ বিষয়ে যত ক্লেশ সহ্য করিতে হয় ধনিদিগের তাদৃশ নহে, কারণ তাঁহারা বহু ধন দ্বারা সকলকেই বশীভূত করিতে পারেন। কিন্তু সামান্য ও মধ্যবিধদিগকে সেই কর্ম্ম সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত যে কত কষ্ট সহ্য করিতে হয়, এবং কত লোকেরই যে উপাসনায় প্রবৃত্ত হইতে হয় ও কত দেশই যে পর্য্যটন করিতে হয়, তাহা বলিবার নহে। উহাঁদিগের মধ্যে কেহ কেহ আপনাদিগের স্থাবর অস্থাবর যে কিছু সম্পত্তি থাকে তাহা বিক্রয় করিয়াও ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিয়া থাকেন। ইতিমধ্যে যদ্যপি তাঁহাদিগের কন্যা দশম বা একাদশ বৎসর বয়স্কা হয়, তবে পিতা মাতা অতিশয় ব্যস্ত সমস্ত হইয়া এবং হিতাহিত বিবেচনা না করিয়া যাহাকে সম্মুখে দেখেন তাহাকেই কন্যা দান করেন, এবং বাপ-মা-মরা দায় তুল্য সেই কন্যাদায় হইতে উদ্ধার হইয়া সুখ স্বচ্ছন্দে আহার বিহার করেন। কিন্তু ইহাদিগের মধ্যে যাঁহাদের কন্যাগণ অতিশয় কুৎসিতা ও বিকলাঙ্গী হয় তাহাদিগের আর কষ্টের পরিসীমা থাকে না। তাঁহারা সেই কন্যাগণের বিবাহের নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা পান ও বিপুলার্থ ব্যয় করিয়া তাহাদিগের বিবাহ দেন। বরেরা মালা বদল করিয়া এবং দান পণ প্রভৃতি গ্রহণ করিয়া স্বদেশে প্রস্থান করেন। কন্যাগণ তদবস্থায়ই চিরকাল পিত্রালয়ে অবস্থিতি করে। ইহার মধ্যে আবার কেহ কেহ পাত্রাভাবে ফুল গাছাদির সহিতও বিরাহ কার্য্য সম্পন্ন করিয়া থাকেন। হায়! এইরূপ বিবাহের ফল কি তা তাঁহারাই জানেন, এবং তদ্বিষয়ে কেহ কিছু জিজ্ঞাসিলে কহেন, কন্যাগণ অবিবাহিতা থাকিলে আমাদিগের পিতৃ মাতৃ উভয় কুলস্থ পিতৃ পুরুষগণ নরকস্থ হয়েন সুতরাং ইহাদিগের বিবাহ দিতে হয়। আহা! এইরূপ বিবাহ না দিয়া যদ্যপি ঐ কন্যাগণকে কন্যাবস্থাতেই রাখেন অথবা তাহাদের সদৃশ পাত্রে প্রদান করেন, তবেই মঙ্গল, নচেৎ এরূপ বিবাহ দেওয়া কেবল ভ্রম মাত্র। হে পরম কারুণিক পরমেশ্বর! কত দিনে আমাদিগের প্রতি সদয় হইয়া এই ভ্রমমূলক কার্য্য সমূহকে নষ্ট করিবে, ও কত দিনে আমাদিগের বন্ধুগণেরা এই বৃক্ষাদিতে কন্যা দানাদি অতি গর্হিত আচরণ হইতে নিরস্ত হইবেন। কুল মর্য্যাদা প্রায় সকল বর্ণেরই একরূপ, কেবল ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদিগের কিছু বিশেষ আছে, তন্নিমিত্ত তাহা পৃথক রূপে লিখিত হইতেছে। অতি প্রধান বংশীয় কায়স্থ মহাশয়েরা আপনাপন কুল গৌরব বৃদ্ধি করণাভিলাষে কুলীনদিগকে পণ স্বরূপ বিপুলার্থ দান করিয়া তাঁহাদিগের দুহিতাগণের সহিত স্ব স্ব জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিবাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া থাকেন। কন্যাকর্ত্তাগণও অর্থ লোলুপ হইয়া কন্যা বিক্রয় করেন। পরে ঐ কুলীন মহাশয়েরা এইরূপ ক্রিয়ার দ্বারা স্ব স্ব কুলগ্রন্থি সকল দৃঢ় রূপে বন্ধন করিয়া অপর প্রধান বংশীয় কন্যাগণের সহিত ঐ পুত্রগণের পুনর্ব্বার বিবাহ দেন এবং ঐ প্রধান বংশীয়েরাও সেই পাত্রগণকে অতি পবিত্র জ্ঞানে বহুবিধ রত্ন ও অলঙ্কারাদির সহিত স্বীয় কন্যা সম্প্রদান করেন। আহা! কি পরিতাপের বিষয়, ইহারা এই দ্বিপত্নী-রূপ বিষম গরম আপন ইচ্ছাতেই গ্রহণ করেন এবং এই গরল জনিত অতি ভীষণ যন্ত্রণা চিরকাল ভোগ করেন।