হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/ত্রিকুলীন দুহিতাদিগের বিবরণ

উইকিসংকলন থেকে

ত্রিকুলীন দুহিতাদিগের বিবরণ।

 যাঁহারা নৈকষ্য দৌহিত্র ও নৈকষ্যের পুত্র হইয়া আবার নৈকষ্য কুমারীদিগকে বিবাহ করেন আর তাহাদের গর্ভে যদি কন্যা জন্মে, তবে সেই কন্যাদিগকে ত্রিকুলাত্মজা কহে। এই ত্রিকুলাত্মজাদিগের প্রায় বিবাহ হয় না। তাঁহারা মহাভারতীয় বৃদ্ধা কন্যার ন্যায় চিরকালই কম্যাবস্থায় অবস্থিতি করেন। যদি দৈবানুকূল্য বশতঃ ঐ কুলীন মহোদয়গণ সমবংশীয় কোন বরপাত্রের সন্ধান প্রাপ্ত হন, তবে অতিশয় যত্ন পূর্ব্বক সেই পাত্রকে আনিয়া এবং হিতাহিত বিবেচনা শূন্য হইয়া তাহাকেই আপনাপন তনুজা ও অনুজাদিগকে সম্প্রদান করেন এবং অবিবেচনার ফল স্বরূপ তাহাদের বয়সের যেরূপ ন্যূনাধিক্য হইয়া থাকে তাহা দৃষ্টি করিলে সকলকেই হাস্য করিতে হয়।

 একবার শুনিয়াছিলাম, ভাগীরথীর পূর্ব্বকুলস্থ কোন গণ্ড গ্রাম বাসিনী এক ত্রিকুল দুহিতার বিবাহ দিবার নিমিত্ত তাঁহার আত্মীয়গণ বহু বর্ষ বয়স্ক এক বরপাত্র আনয়ন করিয়াছিলেন। কন্যা ঐ বৃদ্ধ বরকে বরণ করিতে অনিচ্ছুক হইয়া কহিল, তোমরা বলপূর্ব্বক আমাকে একাদশী ব্রত গ্রহণ করাইও না, আমি এই অবস্থাতেই থাকিব, আর তোমরা যদ্যপি নিতান্তই আমার বিবাহ দিতে ইচ্ছা কর তবে উহার পুত্রের সহিত বিবাহ দেও। এই কথায় তাহার বন্ধু বর্গ ঐ বৃদ্ধের সহিত তাহার বিবাহ না দিয়া ঐ বৃদ্ধের দ্বাদশ বর্ষীয় পুরে সহিত ঐ ত্রিংশৎ বর্ষীয়া নারীর বিবাহ দিল এবং ঐ নারী সেই দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের হস্ত ধারণ পূর্ব্বক লইয়া গেল। হে পাঠকবর্গ! এই স্থলে বিবেচনা করিয়া দেখুন কত দূর উপহাস জনক কার্য্য হইল। কোথায় বর কন্যার পাণি গ্রহণ করিবে না কন্যাই বরের পাণি গ্রহণ করিল। এইরূপ ইহাদিগের আরও অনেক ঘটিয়া থাকে। হুগলি জেলার অন্তঃপাতি কোন গ্রামে এক প্রধান বংশীয় ত্রিকুল কন্যা ষড়বিংশতি বর্ষবয়স পর্য্যন্ত অবিবাহিতাবস্থায় অবস্থিতি করিয়া পরে এক দিন তাহার মাতাকে কহিল তুমি যদ্যপি আমার বিবাহ না দেও তবে আমি কুপথগামিনী হইব। কিন্তু তাহার মাতা বলিল আমি এরূপ দুঃসাহসিক কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে পারিব না। তোমার বৈমাত্রেয় ভ্রাতাগণ আমার প্রতি অতিশয় মন্যু করিবেন ও তাঁহাদিগের কুল একেবারে ক্ষয় হইবে, কারণ আমাদিগের সদৃশ ঘর প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না; আমি তোমার নিমিত্ত এত বড় কুলটা একেবারে নষ্ট করিব? কুলনাশিনী দোষে দূষিত হইয়া পরলোকে নিরয় গামিনী ও ইহলোকে কুলনাশিনী নামে বিখ্যাত হইব? তুমি যাহা ইচ্ছা তাই কর। উহার মাতা এই কথা বলিয়া পক্ষান্ত হইলেন, পরে তোক পরম্পরায় ঐ কথা ব্যক্ত হইলে সেই গ্রামস্থ কতিপয় ভদ্র সন্তান একত্রিত হইয়া তাহার বিবাহ দিবার জন্য বর অন্বেষণ করিতে লাগিলেন, পরে বংশ বাটীস্থ কোন ভদ্র গৃহস্থের দৌহিত্রকে প্রাপ্ত হইয়া তাহার সহিত ঐ কন্যার বিবাহ দিলেন, কন্যার মাতা মাতামহ আশ্রমে বাস করিতেন, তাহার মাতার মাতুল ঐ বিষয়ে অতিশয় রুষ্ট হইয়া উভয়কে আপন আলয় হইতে দূরীভূত করিলেন, তাহাতে যাহারা ঐ কন্যার বিবাহ দিয়াছিল তাহারা ঐ কন্যাকে লইয়া তাহার স্বামীর নিকট রাখিয়া আসিল, এই ঘটনার কিছু দিন পরে সেই কন্যার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা এক বরপাত্র ও এক ঘটক সমভিব্যাহারে লইয়া চটগ্রাম হইতে আগমন করিলেন, তদৃষ্টে ঐ কন্যার মাতা বিষম বিপদে পতিত হইলেন এবং উহাকে কি বলিযাই বা উত্তর প্রদান করিবেন তাহা চিন্তা করিতে লাগিলেন। ইতি মধ্যে ঐ কন্যাকর্ত্তা জিজ্ঞাসিলেন মাতঃ ভগিনী কোথায়? তিনি বলিলেন সে শ্বশুরালয়ে আছে, এই কথা শুনিবামাত্রই তিনি একেবারে হুতাশনের ন্যায় জ্বলিয়া কহিলেন, কি ভগিনী শ্বশুরালয়ে? তাহার বিবাহ কে দিল? হা! কে আমার এই সর্ব্বনাশের হেতু হইল, কেই বা আমাদিগের জীবন স্বরূপ এই কুল রত্ন একেবারে নষ্ট করিল। এই রূপ নানাবিধ বিলাপ ও কপালে এমত করাঘাত করিতে লাগিলেন যে তাহা দর্শন বা শ্রবণ করিলে সকলেরই অশ্পাত হয়, পরে তাঁহাকে সা্না করিবার নিমিত্ত সকলে নানাবিধ প্রবোধ বাক্য দ্বারা বুঝাইতে লাগিল, কিন্তু তিনি কিছুতেই প্রবোধ না মানিয়া বরং বারম্বার ইহা বলিতে লাগিলেন তোমরা আমার ভগিনীকে আনিয়া দেও আমি পুনর্ব্বার তাহার বিবাহ দিয়া কুল রক্ষা করিব, এই কথা শ্রবণ করিয়া সকলে কহিলেন তাহা কি প্রকারে হইতে পারে যাহার একবার বিধিপূর্ব্বক বিবাহ হইয়াছে আবার কি প্রকারে তাহার বিবাহ দিবে, তাহা কখনই হইতে পারিবে না। তখন তিনি নিরুপায় হইয়া কহিলেন, তবে তামরা তাহার মৃত্যু সংবাদ লিখিয়া দেও, আমি স্বদেশে প্রচার করিব যে আমার ভগিনীর মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহারা তাহাতেই সম্মত হইলেন। এই প্রকারে ঐ ত্রিকুল দুহিতাগণের কতই দুর্দ্দশা ঘটিয়া থাকে তাহা বর্ণনা করা যায় না। ইহার মধ্যে যহারা অবিবাহিতাবস্থায় চিরকাল অতিবাহিত করে, তাহাদিগের আর দুঃখের সীমা থাকে না, তাহারা প্রায় অনেকেই কুলকলঙ্চিনীহইয়া কুলে কালি দিয়া কুপথ গামিনী হয় এবং ঐ দুষ্কর্ম্মের ফল স্বরূপ ভ্রণ হত্যাদি মহাপাপে পতিত হয়। আহা! কি দুঃখের বিষয় যে তাহারা বিবাহ না হওয়া প্রমুক্তই এইরূপ দুষ্করমে রত হয়।