বিষয়বস্তুতে চলুন

১৫১৩ সাল/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 বাটী আসার অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই বন্ধুর নিকট এই বার্ত্তা আসিল:—“এখনই আসিবে। আর এক বিপদ উপস্থিত।”

 তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া গেলাম এবং অতি ব্যস্তভাবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ব্যাপার কি?”

 তিনি বলিলেন:—

 “বাটী আসিয়া দেখি পক্ষীকাগারে যে মার্ব্বেল নির্ম্মিত চৌবাচ্চায় সমুদ্র জল থাকে তাহা কেহ ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। যে সেফে আমাদের নক্সা ও সুবর্ণ প্রস্তুত করিবার উপায়ের বিবরণী থাকিত তাহার চাবীও কে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু ঐ দুইটী জিনিষ চুরি করিতে পারে নাই। বোধ হয় সেই সময় কেহ ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল।”

 “তাহা হইলে তুমি কার্য্যস্থলে যাইবার পর এই ঘটনা ঘটিয়াছে?”

 “নিশ্চয়ই”।

 “তুমি বাটী হইতে যাওয়ার সময় এখানে কে কে ছিল জান?”

 “শুনিলাম দুইজন ঝি ব্যতীত আর কেহ ছিল না।”

 “হরিশ কোথায়?”

 “সেও এক কথা। কাল প্রাতে আহারাদির পর সে চলিয়া যায়। এখনও পর্য্যন্ত আসে নাই—”।

 “এই যে, আপনার দাস উপস্থিত। প্রণাম।” এই কথা আমাদের পশ্চাতে কে বলিয়া উঠিল।

 চাহিয়া দেখি, হরিশ। তার মুখে কেমন একটা হাস্যের তরঙ্গ প্রবাহিত হইতেছে।

 বন্ধুবর বিরক্তভাবে প্রশ্ন করিলেন:—

 “তুই না বলেকয়ে কোথায় গিয়েছিলি?”

 সে সহাস্যে বলিল:—“প্রণাম। আমার বক্‌সিস্।”

 বন্ধুবর রাগিয়া বলিলেন:—“আমি কি তোর ইয়ার, গর্দ্দভ?”

 “আজ্ঞে না! তবে বক্‌সিস্ কত দিবেন বলুন। এক অতি প্রয়োজনীয় সংবাদ আনিয়াছি। এতক্ষণ কোথায় ছিলাম পরে বলিব|”

 আমি বলিলাম:—

 “যদি বাস্তবিকই তুই কোন অতি প্রয়োজনীয় সংবাদ দিতে পারিস্ তবে তোকে ১০০০৲ টাকা বক্‌সিস্ দিব”।

 “আচ্ছা বেশ। এখন শুনুন। আপনারা মনে করিবেন না যে আমি আর নেমকহারামী করিব। একবার যাহা করিয়াছি, তাহার জন্য এখনও অনুতাপ করিয়া থাকি। স্বকৃত অপরাধের যথাসাধ্য প্রায়শ্চিত্য করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। এখন এই কাগজখানি পাঠ করুন।”

 উহা পাঠ করিয়া দেখি যে, বল মহাশয় আমাদের কোম্পানীতে তাঁহার যে পাঁচলক্ষ টাকার অংশ ছিল তাহা গতকল্য “প্রভাতী” সম্পাদককে বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন!

 বন্ধুবর এক দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন:—

 “ওঃ এখন বুঝা গেল, বল মহাশয় কেন আমাদের কোম্পানীকে সাধারণ করিবার জন্য জেদ্ করিতেছেন। তাঁহার ইচ্ছা, এরূপ হইলে অধিকাংশ অংশ নিজে ক্রয় করিয়া লইয়া সর্ব্বপ্রধান অংশীদার হইলে কোম্পানীকে যথাইচ্ছা চালাইতে পারিবেন। চাই কি পরে আমাদিগকে দূর করিবার চেষ্টাও করিতে পারেন। এ দেখিতেছি ঊনবিংশ-শতাব্দীর শেষভাগে Rockfeller ও Rogers, Standard Oil-Trust ও Amalgamated Copper Company গঠন করিয়া যেরূপে রাতারাতি ফাঁপিয়া উঠে, সেই রকম একটা মতলব বল মহাশয়েরও আছে। তবে সুখের বিষয় সেদিন আর নাই।”

 “লোকটার কি আস্পর্দ্ধা দেখ। অদ্য সে যখন তাহার অদ্ভুত প্রস্তাব করিতেছিল তখন তাহার কোন Locus standi ছিল না।”

 “আরও কথা আছে। এইখানা দেখুন,” বলিয়া হরিশ একখানা কাগজ দিল।

 পড়িয়া দেখি সেখানা “প্রভাতীর” যে সান্ধ্য-সংস্করণে প্রতিদ্বন্দী কোম্পানী গঠন করিবার কথা লেখা ছিল তাহারই একখানি অনুষ্ঠান-পত্র (prospectus)। সভাপতি সম্পাদক-প্রবর স্বয়ং! বল মহাশয় ইহার একজন ডাইরেক্টর! মূলধন ৫০ লক্ষ টাকা ও কার্য্যস্থল মান্দ্রাজের নিকট স্থির হইয়াছে। অনুষ্ঠান-পত্রখানা আমাদের অনুষ্ঠান পত্রের একরূপ অনুলিপি বলিলেই হয়। আমি প্রশ্ন করিলাম, “এই দুইখানা পাইলে কোথা হইতে?”

 হরিশ শান্তভাবে উত্তর দিল:—“এ আর বুঝিতে পারিলেন না? চুরি করিয়া আনিয়াছি।”

 “অ্যাঁ, কি রকমে?”

 “মাপ করিবেন। তাহা এখন বলিব না।”

 “আচ্ছা, ইহার সন্ধান পাইলে কিরূপে?”

 “সম্পাদক মহাশয় আমায় বড়ই বিশ্বাস করেন। আমি সর্ব্বদা ভৃত্যের মত তাঁহার সেবা করি। তাঁহার কার্য্যকলাপ আমি লক্ষ্য করিয়া থাকি। আজি কয়েক দিন হইতে দেখিতেছি যে বল মহাশয় তাঁহার নিকট ঘন ঘন যাতায়াত করিতেছেন। এক দিন রাত্রে দেখি উঁহারা কি পরামর্শ আঁটিতেছেন। আড়াল হইতে সকল কথা শুনিলাম। এই স্থির হইল যে বল মহাশয় সম্পাদক মহাশয়কে তাঁহার অংশ বিক্রয় করিবেন। সম্পাদক মহাশয় একজন অংশীদার হইলে পর যেরূপে পারেন আপনাকে ডাইরেক্টার নিযুক্ত করিয়া লইবেন। পরে যাহাতে আপনাদের কোম্পানী ভাঙ্গিয়া যায় তাহার উপায় করিবেন। এদিকে আমায় দিয়া আদি নক্সা চুরি করাইবেন এবং আর এক কোম্পানী গঠন করিয়া সেই নক্সা অনুসারে কার্য্য করিবার জন্য গভর্ণমেণ্টের নিকট একচেটিয়া ব্যবসায়ের অনুমতি প্রার্থনা করিবেন।”

 “আচ্ছা, হাসানজীদের কে ভাঙ্‌চি দিয়াছে শুনিয়াছ?”

 “হাঁ। সম্পাদক মহাশয়ের প্ররোচনায়, বল মহাশয় উহাদিগকে এক পত্র লেখেন। তাহার মর্ম্ম এই যে, তিনি Sea Gold Syndicate এর একজন ডাইরেক্টর। কিন্তু অধুনা স্থাপয়িতাদিগের কার্য্যের উপর সন্দেহ হওয়ায়, তিনি শীঘ্রই নিজের পদত্যাগ করিবেন এবং আপনাদের কার্য্যের জন্য তিনি দায়ী হইবেন না।”

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “তাহা হইলেই সকল কথা বুঝা গেল। এই ভাঙ্‌চির পর হইতে হাসানজী কোম্পানীর সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে। তাই তাহারা ঐরূপ পত্র আমাদের লিখিয়াছে। তাহদের কোন দোষ নাই। ওঃ! আমাদের অনিষ্ট করিবার জন্য সম্পাদক প্রবর কত ক্লেশই না স্বীকার করিতেছেন। ধন্য শিক্ষা! ধন্য দীক্ষা!!”

 হরিশ বলিল:—“আমার বক্তব্য এখনও শেষ হয় নাই। নক্সাদি যে চুরি করিয়াছিল তাহাকে ধরিয়াছি।”

 আমরা উভয়ই আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “বল কি! চোর এই বাটীতেই আছে?”

 হরিশ বলিল, “অনুমতি করিলে তাহাকে এক্ষণেই উপস্থিত করিতে পারি।”

 আমরা অনুমতি দিলে, পাঁচমিনিট মধ্যে বন্ধুবরের এক বৃদ্ধা ঝিকে সঙ্গে লইয়া হরিশ আসিল এবং তাহাকে দেখাইয়া বলিল—“এই চোর।”

 “এই?” বন্ধুবর চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন। “হাঁরে, তোর এমন মতিগতি কেন হইল?”

 ঝি ন্যাকাভাবে বলিল, “কি বাবু, আমিত কিছুই জানি না”।

 হরিশ ব্যঙ্গভাবে বলিল:—“কি ভাল মানুষগো! সত্য করিয়া বল্ তুই বাবুর কয়েকখানা দরকারী কাগজ মাঝে চুরি করিয়াছিলি কি না?”

 “ওমা! আমি কি জানি, আমি চুরি করিব কেন? কেন মিথ্যা অপবাদ দেও? আজ তিন কাল গেল—”।

 হরিশ তাহাকে শাসাইল:—

 “দেখ্, ভাল চাস তো এখনও সত্য বল্। নইলে তোর ভাল হবে না।”

 তবুও সে দোষ স্বীকার করিল না।

 হরিশ আমাদিগকে বলিল:—

 “তবে সকল কথা শুনুন। একদিন ও আপনার সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে। কখা-প্রসঙ্গে আমি বলিয়াছিলাম যে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রাদি এক সেফে রাখিয়া থাকেন এবং উহার চাবী আপনার মাথার বালিসের নীচে থাকে। তখন বুঝিতে পারি নাই যে তাহার এই কথাগুলি জানার এক গুরুতর অভিপ্রায় ছিল। পরে একদিন সম্পাদক মহাশয় কথা-প্রসঙ্গে আমায় ঐ প্লানাদি চুরি করিয়া তাহাকে দিতে বলেন। আমি কতকগুলি ওজর করিয়া অপারগতা জানাই। তাহাতে তিনি আমায় আর কিছু না বলিয়া এই ঝিকে অর্থলোভে—মাত্র ৫০৲ টাকায়—বশীভূত করিয়া আপনার অনুপস্থিতিতে ঐ কাগজগুলি চুরি করাইয়া লইয়া যান। কথাটা প্রকাশ পাইত না। কিন্তু কি জানেন, স্ত্রীলোকের পেটে কথা থাকে না। কথা-প্রসঙ্গে ঝি উহার কুকার্য্যের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিয়া ফেলে। তাহারই নিকট আমি সকল কথা শুনিয়াছি।”

 বন্ধুবর ক্রুদ্ধ হইয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন:—“হাঁরে মাগি, তোর এই কাজ? আমি দুধ-কলা দিয়ে কি তবে এতকাল সাপ পুষ্‌ছি?”

 “আ—না—না—আমি—না—”, ঝি গোঙ্গাইয়া বলিতে লাগিল। বন্ধুবর হরিশকে জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “আচ্ছা, আমার মার্ব্বেল চৌবাচ্চাটা কে ভাঙ্গিয়াছে বলিতে পার?”

 “এই মাগীর ছেলের কাজ। নিজে বুড়া হইয়াছে, তত সামর্থ নাই। তাই ছেলেকে দিয়া চৌবাচ্চা ভাঙ্গাইয়াছে। বোধ হয়, ঘুস খাইয়া সেফ্‌টাও ভাঙ্গিতে চেষ্টা করিয়াছিল। স্বচক্ষে উহা ভাঙ্গিতে দেখি নাই। কিন্তু চৌবাচ্চা ভাঙ্গা প্রায় শেষ হইয়াছে, এমন সময় আমি আসিয়া পড়ি। আমায় দেখিয়া সে পলায়। আমি তাহাকে ধরিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু পারি নাই।”

 হরিশের কথা শুনিয়া আমরা উভয়েই কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলাম। তাহারপর ঝিকে একটু পীড়াপীড়ি করাতে সে সকল কথা স্বীকার করিল ও পুনঃ পুনঃ ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল। তাহার দোষ বিশেষ কিছু দেখিলাম না। কেন না, সে এক চক্রীর হস্তের ক্রীড়া-পুত্তলিকা মাত্র ছিল।