পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

• ు " উপকূল কোন দিকে কিছুই দেখ ৰাইজেছ না। বুঝিলেন, নাবিকদিগের দিগভ্রম হইয়াছে । এক্ষণে কোনূ দিকে যাইতেছে, তাহার নিশ্চয়তা পাইতেছে ন –পাছে বাহির সমুদ্রে পড়িয়া অকুলে মারা যায়, এই আশঙ্কায় ভীত হইয়াছে। হিমনিবারণ জন্য সম্মুখে আবরণ দেওয়৷ ছিল, এ জন্য নৌকার ভিতর হইতে আরোহীর। এ সকল বিষয় কিছুই জানিতে পারেন নাই । কিন্তু নব্য যাত্রী অবস্থা বুঝিতে পারিয়া বৃদ্ধকে সবিশেষ কহিলেন ; তখন নৌকা-মধ্যে মহাকোলাহল পড়িয় গেল । যে কয়টি স্ত্রীলোক নৌকামধ্যে ছিল, তন্মধ্যে কেহ কেহ কথার শব্দে জাগিয়াছিল, শুনিবামাত্র তাহার আৰ্ত্তনাদ করিয়া উঠিল ! প্রাচীম কহিল, “কেনারায় পড় ! কেনায়ায় পড় ! কেনারায় পড় ।” নব্য ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “কেনার কোথ ?” তাহা জানিতে পারিলে এত বিপদ হইবে কেন ?” ইহা শুনিয়া নৌকারোহীদিগের কোলাহল আরও বৃদ্ধি পাইল । নব্য ষাত্রী কোন মতে তাহাদিগকে স্থির করিয়া নাবিকদিগকে কহিলেন, “আশঙ্কার বিষয় কিছু নাই, প্রভাত হইয়াছে—চার পাঁচ দণ্ডের মধ্যে অবশু সুৰ্য্যোদয় হইবে । চার পচে দণ্ডের মধ্যে নৌকা কদাচ মারা যাইবে না । তোমরা এক্ষণে বাহন বন্ধ কর, স্রোতে নৌক যথায় যায় যাক ; পশ্চাৎ রৌদ্র হইলে পরামর্শ কর। যাইবে ।” নাবিকেরা এই পরামর্শে সন্ম ত হইয়৷ তদনুরূপ আচরণ করিতে লাগিল । অনেকক্ষণ পর্য্যস্ত নাবিকের নিশ্চেষ্ট হষ্টয়া রহিল ; যাত্রীর ভয়ে কণ্ঠাগত প্রাণ ৷ বায়ুমাত্র নাই । সুতরাং তাহার তরঙ্গান্দোলনকম্প বড় জানিতে পারিলেন না। তথাপি সকলেই মৃত্যু নিকট নিশ্চিত করিলেন। পুরুষেয় নিঃশব্দে দুর্গানাম জপ করিতে লাগিলেন, স্ত্রীলোকের মুর তুলিয়া বিবিধ শব্দ-বিন্যাসে কাদিতে লাগিল । একটি স্ত্রীলোক গঙ্গাসাগরে সস্তান বিসর্জন করিয়া আসিয়াছিল, ছেলে জলে দিয়া আর তুলিভে পারে নাই,-সেই কেবল কঁাদিল ন! । প্রতীক্ষা করিতে করিতে অনুভবে বেল প্রার এক প্রহর হইল। এমত সময়ে অকস্মাৎ নাবিকেরা দরিয়ার পাচপীরের নাম কীৰ্ত্তন করিয়া মহা কোলাহল করিয়া উঠিল । সকলেই জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, “কি ! কি ! মাঝি, কি হইয়াছে ?” মাঝিরাও একবাক্যে কোলাহল করিয়া কহিতে লাগিল, “রোদ উঠেছে! রোদ উঠেছে! ডাঙ্গা ! ডাঙ্গা ! ডাঙ্গা ।” যাত্রীরা সকলেই ঔৎসুক্যসহকারে নৌকার বাহিরে আসিয়া, কোথায় আসিয়াছেন, কি বৃত্তাস্ত, দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, সুর্য প্রকাশ হইয়াছে, কুজঝটিকার অন্ধকাররাশি হইতে দিষ্মণ্ডল একেবারে বিমুক্ত হইয়াছে । বেল প্রায় প্রহরাতীত হইয়াছে । যে স্থানে নৌকা আসিয়াছে, সে প্রকৃত মহাসমুদ্র নহে, নদীর মোহান মাত্র, কিন্তু তথায় নদীর সেরূপ বিস্তার, সেরূপ বিস্তার আর কোথাও নাই। নদীর এক কুল নৌকার অতি নিকটবৰ্ত্তী বটে,—এমন কি, পঞ্চাশং হস্তের মধ্যগত ; কিন্তু অপর কুলের চিহ্ন দেখা যায় না । আর যে দিকই দেখা যায়, অনন্ত জলরাশি চঞ্চল রবিরশ্মিমালাপ্রদীপ্ত হইয়া গগনপ্রান্তে গগনসহিত মিশিয়াছে। নিকটস্থ জল, সচরাচর সকর্দম নদীজলবৰ্ণ ; কিন্তু দূরস্থ বারিরাশি-নীলপ্রভ । আরোহীরা নিশ্চিত সিদ্ধাস্ত করিলেন যে, তাহার। মহাসমুদ্রে আসিয়া পড়িয়াছেন ; তবে সৌভাগ্য এই যে, উপকূল নিকটে, আশঙ্কার বিষয় নাই। স্বৰ্য্যপ্রতি দৃষ্টি করিয়া দিক্ নিরূপিত করিলেন । সম্মুখে যে উপকুল দেখিতেছিলেন, সে সহজেই সমুদ্রের পশ্চিম ভট বলিয় সিদ্ধান্ত হইল । তটমধ্যে নৌকার অনতিদূরে এক নদীর মুখ মন্দগামী কলপেীতপ্রবাহবৎ আসিয়া পড়িতেছিল । সঙ্গমস্থলের দক্ষিণপাশ্বে বৃহৎ সৈকতভূমিখণ্ডে টিটিভাদি পক্ষিগণ অগণিত সংখ্যায় ক্রীড়া করিতেছিল। এই নদী এক্ষণে “রসুলপুরের নদী" নাম ধারণ করিয়াছে । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ উপকূলে “ingratiude ! Thou mal bel-heartedfiend !" —King Lear. আরোহীদিগের স্ফূৰ্ত্তিব্যঞ্জক কথ। সমাপ্ত হইলে, নাবিকেরা প্রস্তাব করিল যে, জোয়ারের আরও কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে ;–এই অবকাশে আরোহিগণ সন্মুখস্থ সৈতকে পাকাদি সমাপন করুন, পরে জলোচ্ছ্বাস আরম্ভেই স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করিতে পরিবেন। আরোহিবৰ্গও এই পরামর্শে সম্মতি দিলেন । তখন নাবিকের তরী তীরলগ্ন করিলে, আরোহিগণ অবতরণ করিয়া স্নানাদি প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনে প্রবৃত্ত হইলেন। স্নানাদির পর পাকের উদ্যোগে আর এক নূতন বিপত্তি উপস্থিত হইল—নৌকায় পাকের কাষ্ঠ নাই । ব্যাঘ্রভয়ে উপর হইতে কাষ্ঠ সংগ্ৰহ করিয়া আনিতে কেহই স্বীকৃত হইল না । পরিশেষে সকলের উপবাসের