পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

అ প্রাণ দেওয়া—তাও সিপাহীর মাহিয়ান পায় না । তার পর শেষ কথা সাহস, কামানের গোলা এক জায়গায় বৈ দশ জায়গায় পড়বে না—সুতরাং একটা গোলা দেখে দশ জন পলাইবার দরকার নাই । কিন্তু একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীশুদ্ধ পলায়। আর গোষ্ঠীশুদ্ধ গেলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না । মহে । তোমাদের এ সব গুণ আছে ? ভবা । না, কিন্তু গুণ গাছ থেকে পড়ে না । অভ্যাস করিতে হয় । মহে । তোমরা কি অভ্যাস কর ? ভবা । দেখিতেছ না, আমরা সন্ন্যাসী । আমা দের সন্ন্যাস এই অভ্যাসের জন্য । কার্য্য উদ্ধার হইলে, অভ্যাস সম্পূর্ণ হইলে আমরা আবার গৃহী হইব । আমাদেরও স্ত্রী-কন্যা আছে । মহে । তোমরা সে সকল ত্যাগ করিয়া মায়। কাটাইতে পারিয়াছ ? ভবা । সন্তানকে মিথ্যা কথা কহিতে নাই— তোমার কাছে মিথ্যা বড়াই করিব না । মায়। কাটাইতে পারে কে ? যে বলে, আমি মায়া কাটাইয়াছি, হয় তার মায়া কখন ছিল মা-বা সে মিছা বড়াই করে । আমরা মায়া কাটাই ন!— আমরা ব্রত রক্ষা করি । তুমি সস্তান হইবে ? মহে । আমার স্ত্রী-কন্যার সংবাদ না পাইলে আমি কিছু বলিতে পারি না । ভবা । চল, তবে তোমার স্ত্রী-কন্যাকে দেখিবে চল । এই বলিয়া দুই জনে চলিলেন ; ভবানন্দ আবার “বন্দে মাতরম্ গায়িতে লাগিলেন । মহেন্দ্রের গলা ভাল ছিল, সঙ্গীতে একটু বিদ্যা ও অনুরাগ ছিল । মুতরাং সঙ্গে গায়িলেন –দেখিলেন যে, গায়িতে গায়িতে চক্ষে জল আইসে । তখন মহেন্দ্র বলিলেন, —“ষদি স্ত্রী-কন্যা ত্যাগ না করিতে হয়, তবে এ ব্রত অামাকে গ্রহণ করাও * ভবা । এ ব্ৰত যে গ্রহণ করে, সে স্ত্রী-কন্ত। পরিত্যাগ করে । তুমি যদি এ ব্রত গ্রহণ কর, তবে স্ত্রী-কন্তুার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হইবে না। তাহাদিগের রক্ষা হেতু উপযুক্ত বন্দোবস্ত করা যাইবে ; কিন্তু ব্রতের সফলতা পৰ্য্যস্ত তাহাদিগের মুখদর্শন নিষেধ । মহে । আমি এ ব্রত গ্রহণ করিব না । একাদশ পরিচ্ছেদ রাত্রি প্রভাত হইয়াছে। সেই জনহীন কানন, —এতক্ষণ অন্ধকার, শব্দহীন ছিল—এখন আলোকময়—পক্ষিকুজনশদিত হইয়া আনন্দময় হইল। সেই আনন্দময় প্রভাতে—আনন্দময় কাননে “আনন্দমঠে”. সত্যানন্দ ঠাকুর হরিণচৰ্ম্মে বুসিয়া সন্ধ্যাহিক করিতে, ছেন । কাছে বসিয়া জীবানন্দ । এমন সময় ভবানন্দ মহেন্দ্র সিংহকে সঙ্গে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন । ব্রহ্মচারী বিনা বাক্যব্যয়ে সন্ধ্যাহিক করিতে লাগিলেন, কেহ কোন কথা কহিতে সাহস করিলেন না । পরে সন্ধ্যাহিক সমাপন হইলে, ভবানন্দ জীবানন্দ উভয়ে তাহাকে প্রণাম করিলেন এবং পদধূলি গ্রহণ পূৰ্ব্বক বিনীতভাবে উপবেশন করিলেন । তখন সত্যানন্দ ভবানন্দকে ইঙ্গিত করিয়া বাহিরে লইয়া গেলেন । কি কথোপকথন হইল, তাহ আমরা জানি না । তাহার পর উভয়ে মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করিলে, ব্রহ্মচারী সকরুণ সহাস্তবদনে মহেন্দুকে বলিলেন, “বাবা, তোমার দুঃখে আমি অত্যন্ত কাতর হইয়াছি, কেবল সেঈ দীনবন্ধুর কৃপায় তোমার স্ত্রী-কন্যাকে কাল রাত্রিতে আমি রক্ষা করিতে পারিয়াছিলাম !" এই বলিয়। ব্রহ্মচারী কল্যাণীর রক্ষাবৃত্তাস্ত বণিত করিলেন । তার পর বলিলেন যে, "চল, তাহারা যেখানে আছে, তোমাকে সেখানে লইয়। যাই ।” এই বলিয়া ব্রহ্মচারী অগ্ৰে অগ্রে, মহেন্দ্র পশ্চাৎ পশ্চাৎ দেবালয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন । প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্ৰ দেখিলেন, অতি বিস্তৃত, অতি উচ্চ প্রকোষ্ঠ । এই নবারুণ-প্রেফুল্ল প্রাতঃকালে যখন নিকটস্থ কানন স্থৰ্য্যালোকে হীরক-খচিতবৎ জলিতেছে, তখনও সেই বিশাল কক্ষায় প্রায় অন্ধকার । ঘরের ভিতরে কি আছে, মহেন্দ্র প্রথমে তাহ দেখিতে পাইলেন না।--দেখিতে দেখিতে, ক্রমে দেখিতে পাইলেন, এক প্রকাণ্ড চতুভূজ মূৰ্ত্তি, শঙ্খচক্ৰগদাপদ্মধারী, কৌস্তুভশোভিত হৃদয়, সম্মুখে সুদর্শনচক্র ঘুর্ণ্যমানপ্রায় স্থাপিত। মধুকৈটভম্বরূপ দুইটি প্রকাও ছিন্নমস্তক মূৰ্ত্তি রুধিরপ্লাবিতবৎ চিত্রিত হইয়৷ সম্মুখে রহিয়াছে। বামে লক্ষ্মী আলুলায়িতকুস্তল৷ শতদলমালামণ্ডিত ভয়ত্রস্তার স্তায় দাড়াইয়া আছেন। দক্ষিণে সরস্বতী পুস্তক, বাদ্যযন্ত্র, মূৰ্ত্তিমান রাগ রাগিণী প্রভৃতি পরিবেষ্টিত হইয়া দাড়াইয়া আছেন। বিষ্ণুর অঙ্কোপরি এক মোহিনী মূৰ্ত্তি— লক্ষ্মী ও সরস্বতীর অধিক সুন্দরী, লক্ষ্মীসরস্বতীর অধিক