পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ર সম্ভবে । “যে কথা কাল শুনিতে চাহিয়াছিলে, সে কথা শুনিবে ?" সে কি ? প্রণয়-কথা ? ব্রাহ্মণবেশী মৃন্ময়ীর উপপতি ? যে ব্যক্তি পূৰ্ব্বরাত্রের বৃত্তাস্ত অনবগত, তাহার পক্ষে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত সন্তবে না । পতিব্ৰতা, স্বামীর সহগমনকালে অথবা অন্য কারণে যখন কেহ জীবিতে চিতারোহণ করিয়া চিতায় অগ্নি সংলগ্ন করে, তখন প্রথমে ধূমরাশি আসিয়া চতুর্দিক বেষ্টন করে, দৃষ্টিলোপ করে, অন্ধকার করে ; পরে ক্রমে কাষ্ঠরাশি জলিতে আরম্ভ হইলে প্রথমে নিম্ন হইতে সপজিহবার দ্যায় দুই একটি শিখ আসিয়া অঙ্গের স্থানে স্থানে দংশন করে, পরে সশব্দে অগ্নিজাল চতুৰ্দ্দিকু হইতে আসিয়া বেষ্টন করিয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যাপিতে থাকে ; শেষে প্রচণ্ডরবে অগ্নিরাশি গগনমণ্ডল জ্বালাময় করিয়া মস্তক অতিক্রম পূৰ্ব্বক ভস্মরাশি করিয়া ফেলে । নবকুমারের লিপি পাঠ করিয়৷ সেইরূপ হইল । প্রথমে বুঝিতে পারিলেন না ; পরে সংশয়, পরে ...নিশ্চয়তা, শেষে জালা । মনুষ্যহৃদয় ক্লেশাধিক্য বা মুখাধিক্য একেবারে গ্রহণ করিতে পারে না, ক্রমে ক্রমে গ্রহণ করে। নবকুমারকে প্রথমে ধূমরাশি বেষ্টন করিল ; পরে বহ্নিশিখ হৃদয় তাপিত করিতে লাগিল ; শেষে বহিরাশিতে হৃদয় ভস্মীভূত হইতে লাগিল। ইতিপূৰ্ব্বেই নবকুমার দেখিয়াছিলেন ষে, কপালকুণ্ডল কোন কোন বিষয়ে তাহার অবাধ্য হইয়াছেন । বিশেষ কপালকুণ্ডল তাহার নিষেধসত্ত্বেও যখন যেখানে ইচ্ছা, সেখানে একাকিনী যাইতেন ; যাহার তাহার সহিত যথেচ্ছ আচরণ করিতেন ; অধিকন্তু তাহার বাক্য হেলন করিয়৷ নিশীথে একাকিনী বন ভ্রমণ করিতেন । আর কেহ ইহাতে সন্দিহান হইত, কিন্তু নবকুমারের হৃদয়ে কপালকুগুলার প্রতি সন্দেহ উত্থাপিত হইলে চিরানিবাৰ্য্য বৃশ্চিকদংশনবৎ হইবে জানিয়া, তিনি এক দিনের তরে সন্দেহকে স্থান দান করেন নাই । অদ্যও সন্দেহকে স্থান দিতেন না, কিন্তু অদ্য সন্দেহ নহে, প্রতীতি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে । যন্ত্রণার প্রথমবেগের শমত হইলে, নবকুমার নীরবে বসিয়া অনেকক্ষণ রোদন করিলেন । রোদন করিয়া কিছু স্বস্থির হইলেন। তখন তিনি কিংকৰ্ত্তব্যসম্বন্ধে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইলেন। আজ তিনি কপালকুণ্ডলাকে কিছু বলিবেন না । কপালকুণ্ডলা যখন সন্ধ্যার সময় বনাভিমুখে ধাত্রা করিবেন, তখন গোপনে তাহার অনুসরণ করিবেন, কপালকুণ্ডলার বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী মহাপাপ প্রত্যক্ষীভূত করিবেন, তাহার পর এ জীবন বিসর্জন করিবেন। কপালকুণ্ডলাকে কিছু বলিবেন না ; আপনার প্রাণসংহার করিবেন । না করিয়া কি করিবেন ? এ জীবনের দুৰ্ব্বহ ভার বহিতে র্তাহার শক্তি হইবে না । এই স্থির করিয়া কপালকুণ্ডলার বহির্গমনপ্রতীক্ষায় তিনি খড়কীদ্বারের প্রতি দৃষ্টি করিয়া রছিলেন । কপালকুণ্ডলা বহির্গত হইয়া কিছু দূরে গেলে নবকুমারও বহির্গত হইতেছিলেন ; এমন সময়ে কপালকুণ্ডলা লিপির জন্য প্রত্যাবৰ্ত্তন করিলেন, দেখিয়া নবকুমারও সরিয়া গেলেন । শেষে কপাল" কুণ্ডল পুনৰ্ব্বার বাহির হইয়৷ কিছু দূর গমন করিলে, নবকুমার আবার তদনুগমনে বাহির হইতেছিলেন, এমত সময়ে দেখিলেন, দ্বারদেশ আবৃত করিয়া এক দীর্ঘাকায় পুরুষ দণ্ডায়মান রহিয়াছে। কে সে ব্যক্তি, কেন দাড়াইয়া, জানিতে নবকুমারের কিছুমাত্র ইচ্ছা হইল না—তাহার প্রতি চাহিয়াও দেখিলেন না। কেবল কপালকুণ্ডলার প্রতি দৃষ্টি রাখিবার জন্য ব্যস্ত। অতএব পথ মুক্তির জন্য আগন্তুকের বক্ষে হস্ত দিয়া তাড়িত করিলেন : কিন্তু তাহাকে সরাইতে পারিলেন না । নবকুমার কহিলেন, “কে তুমি ? আমার পথ ছাড় ।” আগন্তুক কঠিল, “কে আমি, তুমি কি চেন না ?” শব্দ সমুদ্রনাদবৎ কর্ণে লাগিল । নবকুমার চাহিয়া দেখিলেন ; দেখিলেন, সে পূৰ্ব্বপরিচিত জটাজুটধারী কাপালিক ! নবকুমার চমকিয়া উঠিলেন ; কিন্তু ভীত হইলেন ন। সহসা তাহার মুখ প্রফুল্ল হইল –কহিলেন, “কপালকুণ্ডল কি তোমার সহিত সাক্ষাতে যাইতেছে ?” কাপালিক কহিল, “না” । জালিতমাত্র আশার প্রদীপ তখনই নিৰ্ব্বাণ হওয়াতে নবকুমারের মুখ পূৰ্ব্ববৎ মেঘময় অন্ধকারাবিষ্ট হইল কহিলেন, “তবে তুমি পথ মুক্ত কর ।” কাপালিক কহিল, “পথ মুক্ত করিতেছি, কিন্তু তোমার সহিত আমার কিছু কথা আছে—অগ্রে শ্রবণ কর ” নবকুমার কহিলেন, “তোমার সহিত আমার কি কথা ? তুমি আবার আমার প্রাণনাশের জন্য আসিয়াছ ? প্রাণ গ্রহণ কর, আমি এবার কোন ব্যাঘাত করিব না। তুমি এক্ষণে অপেক্ষা কর, আমি দূর হও—