পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুণ্ডল চঞ্চল হইলে কে তাহার স্থিতিস্থাপন করিবে ? নবীন করিকরভ মাতিলে কে তাহাকে শান্ত করিবে ? কপালকুণ্ডলা আপন চিত্তকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেনই বা এ শরীর জগদীশ্বরীর চরণে সমর্পণ না করিব ? পঞ্চভূত লইয়া কি হইবে ?” প্রশ্ন করিতেছিলেন, অথচ কোন নিশ্চিত উত্তর দিতে পারিতেছিলেন না । সংসারে অন্ত কোন বন্ধন না থাকিলেও পঞ্চভূতের এক বন্ধন আছে। কপালকুণ্ডল অধোবদনে চলিতে লাগিলেন। যখন মচুন্যহৃদয় কোন উৎকট ভাবে আচ্ছন্ন হয়, চিস্তার একাগ্রতায় বাহ্যস্থষ্টিব প্রতি লক্ষ্য থাকে না, তখন অনৈসর্গিক পদার্থও প্রত্যক্ষীভূত বলিয়। বোধ হয়। কপালকুণ্ডলার সেই অবস্থা হইয়াছিল । যেন উৰ্দ্ধ হইতে র্তাহার কর্ণকুহরে এই শব্দ প্রবেশ করিল, “বতসে !—আমি পথ দেখাইতেছি ” কপালকুণ্ডল চকিতের ন্যায় উৰ্দ্ধদৃষ্টি কয়িলেন। দেখিলেন, যেন আকাশমণ্ডলে নবনীরদ নিন্দিত মূৰ্ত্তি! গল বিলম্বিতনরকপালমাল হইতে শোণিতশ্রুতি হইতেছে ; কটিমণ্ডল বেড়িয়া নরকররাজি দুলিতেছে—বামকরে নরকপাল—অঙ্গে রুধিরধারী, ললাটে বিষমোজ্জলজ্বালাবিভাসিত লোচন-প্রাস্তে বালশশী সুশোভিত । যেন ভৈরবী দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করিয়া কপালকুণ্ডলাকে ডাকিতেছেন । কপালকুণ্ডলা উৰ্দ্ধমুখী হইয়। চলিলেন । সেই নবকাদম্বিনীসন্নিভ রূপ আকাশমার্গে তাহার আগে আগে চলিল। কখন কপালমালিনীর অবয়ব মেঘে লুক্কায়িত হয়, কখন নয়নপথে স্পষ্ট বিকসিত হয় ৷ কপাল" কুণ্ডলা তাহার প্রতি চাহিয়৷ চলিলেন । নবকুমার বা কাপালিক এসব কিছুষ্ট দেখেন নাই । নবকুমার মুরা-গরলপ্রজলিতস্থদয়—কপালকুণ্ডলার ধীরপদক্ষপে অসহিষ্ণুহইয় সঙ্গীকে কহিলেন, “কাপালিক ?” কাপালিক কহিল, “কি ?” “পানীয়ং দেহি মে।” কাপালিক পুনরপি তাহাকে মুরা পান করাইল । নবকুমার কহিলেন, “আর বিলম্ব কি ?” কাপালিক উত্তর করিল, “আর বিলম্ব কি ?” নবকুমার ভীমনাদে ডাকিলেন, “কপালকুণ্ডলে ।” কপালকুণ্ডলা শুনিয়া চমকিত হইলেন । ইদানীন্তন কেহ তাহাকে কপালকুণ্ডলা বলিয়া ডাকিত না । তিনি মুখ ফিরাইয়া দাড়াইলেন । নবকুমার ও কাপালিক র্তাহার সম্মুখে আসিলেন । কপালকুণ্ডল৷ প্রথমে তাহাদিগকে চিনিতে পারিলেন না—কছিলেন, “তোমরা কে ? যমদূত ?” 8이 পরক্ষণেই চিনিতে পারিয়া কহিলেন, “না না, ” পিতঃ, তুমি কি আমায় বলি দিতে আসিয়াছ ?” নবকুমার দৃঢ়মুষ্টিতে কপালকুণ্ডলার হস্ত ধারণ করিলেন। কাপালিক করুণাদ্র, মধুময় স্বরে কহিলেন, “বৎসে । আমাদিগের সঙ্গে আইস " এই বলিয়া কাপালিক শ্মশানাভিমুখে পথ দেখাষ্টয়া চলিলেন। কপালকুণ্ডলা আকাশে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন – যথায় গগনবিহারিণী ভয়ঙ্করী দেখিয়াছিলেন, সেই দিকে চাহিলেন । দেখিলেন, রণরঙ্গিণী খল খল হাসিতেছে ; এক দীর্ঘ ত্রিশূল কবে ধরিয়া কাপালিকগত পথপ্রতি সঙ্কেত করিতেছে । কপালকুণ্ডল অদৃষ্টাবমূঢ়ার ন্যায় বিনা-বাক্যব্যয়ে কাপালিকের অনুসরণ করিলেন । নবকুমার পূৰ্ব্ববত দৃঢ়মুষ্টিতে র্তাহার হস্ত ধারণ করিয়া চলিলেন । নবম পরিচ্ছেদ প্রেতভূমে “বপুষকরণোজ ঝিতেন স নিপতন্তী পতিমপ্যপাতযুৎ। নতু তৈলনিষেকবিন্দুন সহ দীপ্তাৰ্চিরুপৈতি মেদিনীম্।।” —রঘুবংশ । চন্দ্রম অস্তমিত হুইল । বিশ্বমণ্ডল অন্ধকারে পরিপূর্ণ হইল। কাপালিক যথায় আপন পূজাস্থান ংস্থাপন করিয়াছিলেন, তথায় কপালকুণ্ডলাকে লইয়া গেলেন । সে গঙ্গাতীরে এক বৃহৎ সৈকতভূমি । তাহারই সম্মুখে আরও বৃহত্তর দ্বিতীয় এক খণ্ড সিকতাময় স্থান । সেই সৈকতে শ্মশানভূমি । উভয় সৈকতমধ্যে জলোচ্ছ্বাসকালে অল্প জল থাকে, ভাটার সময় জল থাকে না, এক্ষণে জল ছিল না । শ্মশানভূমির যে মুখ গঙ্গাসমুখীন, সেই মুখ অত্যুচ্চ ; জলে অবতরণ করিতে গেলে একেবারে উচ্চ হইতে অগাধ জলে পড়িতে হয় তাহাতে আবার অবিরতবায়ু তাড়িত তরঙ্গাভিঘাতে উপকুলতল ক্ষয়িত হইয়াছিল ; কখন কখন মুক্তিকাখণ্ড স্থানচ্যুত হইয়া অগাধ জলে পড়িয়া যাইত। পূজাস্থানে দীপ নাই—কাষ্ঠখণ্ডমাত্রে অগ্নি জলিতেছিল, তদালোকে অতি অস্পষ্টদৃষ্ট শ্মশানভূমি আরও ভীষণ দেখাইতেছিল, নিকটে পূজা, হোম, বলি প্রভৃতির সমগ্র আয়োজন ছিল। বিশাল তরঙ্গিণীহাদয় অন্ধকারে বিস্তৃত হইয়। রহিয়াছে। চৈত্রমাসের বায়ু অপ্রহিতবেগে গঙ্গা হৃদয়ে প্রধাবিত হুইতেছিল ; তাহার কারণে তরঙ্গাভিঘাতজনিত কলকলরব গগন ব্যাপ্ত করিতেছিল । শ্মশানভূমিতে শবভুকু পশুগণ কর্কশকণ্ঠে কচিৎ ধ্বনি করিতেছিল।