পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8b কাপালিক, নবকুমার ও কপালকুণ্ডলাকে উপযুক্ত স্থানে কুশাসনে উপবেশন করাইয়। তন্ত্রাদির বিধানমুসারে পূজারম্ভ করিলেন । উপযুক্ত সময়ে নবকুমারের প্রতি আদেশ . করিলেন যে, কপালকুণ্ডলাকে স্বাত করাইয়। আন । নবকুমার কপালকুণ্ডলার হস্ত ধারণ করিয়া শ্মশানভূমির উপর দিয়া স্নান করাইতে লইয়া চলিলেন । র্তাহাদিগের চরণে অস্থি ফুটিতে লাগিল । নবকুমারের পদের আঘাতে একটা জলপূর্ণ শ্মশানকলস ভগ্ন হইয় গেল ! তাহার নিকটেই শব পড়িয়াছিল--হতভাগার কেহ সৎকারও করে নাই। দুই জনেরই তাঁহাতে পদস্পর্শ হইল। কপালকুণ্ডল তাহাকে বেড়িয়া গেলেন, নবকুমার তাহাকে চরণে দলিত করিয়া গেলেন । চতুর্দিকৃ বেড়িয়া শবমাংসভুক্‌ পশুসকল ফিরিতেছিল ; মনুষ্য দুই জনের আগমন উচ্চকণ্ঠে রব করিতে লাগিল, কেহ আক্রমণ করিতে আসিল, কেহ বা পদশব্দ করিয়া চলিয়া গেল। কপালকুগুল দেখিলেন, নবকুমারের হস্ত কঁাপিতেছে ; কপালকুণ্ডলা স্বয়ং নির্ভীকৃ, নিষ্কম্প । কপালকুণ্ডল জিজ্ঞাস করিলেন, “স্বামিন ! ভয় পাইতেছ?” নবকুমারের মদিরার মোহ ক্রম শক্তিহীন হইয়। আসিতেছে। অতি গম্ভীরস্বরে নবকুমার উত্তর করিলেন, “ভয়ে, মৃন্ময়ি ? তাহ! নহে ।” কপালকুণ্ডল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কঁাপিতেছ কেন ?” এই প্রশ্ন কপালকুণ্ডল যে স্বরে করিলেন, তাহ কেবল রমণীকণ্ঠেই সন্তবে । যখন রমণী পরদুঃখে গলিয়া যায়, কেবল তখনই রমণীকণ্ঠে সে স্বর সম্ভবে । কে জানিত যে, আসন্নকালে শ্মশানে আসিয়া কপালকুণ্ডলার কণ্ঠ হইতে এ স্বর নির্গত হুইবে ? নবকুমার কহিলেন, “ভয়ে নহে। পারিতেছি না, এই ক্রোধে কঁাপিতেছি ।" কপালকুণ্ডল জিজ্ঞাসিলন, “র্ক দিবে কেন ?” আবার সেই কণ্ঠ ! নবকুমার কহিলেন, “র্ক দিব কেন ? তুমি কি জানিবে মৃন্ময়ি! তুমি ত কখনও রূপ দেখিয়। উন্মত্ত হও নাই”—বলিতে বলিতে নবকুমারের কণ্ঠস্বর ষাতনায় রুদ্ধ হইয়। আসিতে লাগিল । “তুমি ত কখন আপনার হৃৎপিণ্ড আপনি ছেদন করিয়া শ্মশানে ফেলিতে আইস নাই ।” এই বলিয়া সহসা নবকুমার কাদিতে বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী চীৎকার করিয়ারোদন করিতে করিতে কপালকুণ্ডলার পদতলে আছাড়িয়া পড়িলেন । “মৃন্ময়ি --কপালকুণ্ডলে! আমায় রক্ষা কর। এই তোমার পায়ে লুটাইতেছি—একবার বল যে, তুমি অবিশ্বাসিনী নও—একবার বল, আমি তোমায় হৃদয়ে তুলিয়া গৃহে লইয়া যাই ।” কপালকুণ্ডলা হাত ধরিয়া নবকুমারকে উঠাইলেন —মৃদ্ধস্বরে কহিলেন, “তুমি ত জিজ্ঞাসা কর নাই ?” যখন এই কথা হইল, তখন উভয়ে একেবারে জলের ধারে আসিয়া দাড়াইয়াছিলেন ; কপালকুণ্ডল অগ্রে, নদীর দিকে পশ্চাৎ করিয়াছিলেন, র্তাহার পশ্চাতে এক পদ পরেই জল ৷ এখন জলোচ্ছ্বাস আরম্ভ হহয়ছিল, কপালকুণ্ডল একটা আড়রির উপর দাড়াইয়াছিলেন। তিনি উত্তর করিলেন, “তুমি ত জিজ্ঞাসা কর নাই!” নবকুমার ক্ষিপ্তের ন্যায় কহিলেন, “চৈতন্য হারাইয়াছি, কি জিজ্ঞাসা করিব—বল—মৃন্ময়ি ! বল—বল—বল—আমায় রাখ। গৃহে চল!” কপালকুণ্ডল কহিলেন, “যাহা জিজ্ঞাসা করিলে, বলিব । আজি যাহাকে দেখিয়াছ—সে পদ্মাবতী । আমি অবিশ্বাসিনী নহি । এ কথ। স্বরূপ বলিলাম । কিন্তু আর আমি গৃহে যাব না । ভবানীর চরণে দেহ বিসর্জন করিতে আসিয়াছি—নিশ্চিভ তাহা করিব । স্বামিন্‌ ! তুমি গৃহে যাও । আমি মরিব ! আমার জন্য রোদন করিও না ।" “ন।—মূন্ময়ি !—না —” এইরূপ উচ্চ শব্দ করিয়া নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে হৃদয়ে ধারণ করিতে বাহু প্রসারণ করিলেন ; কপালকুণ্ডলাকে আর পাইলেন ন । চৈত্রবায়ুতাড়িত এক বিশাল নদীতরঙ্গ আসিয়া, তীরে যথায় কপালকুণ্ডল দাড়াইয়া, তথায় তটাধোভাগে প্ৰহত হইল; অমনি তটমৃত্তিকাখণ্ড কপালকুণ্ডল সহিত ঘোররবে নদী-প্রবাহমধ্যে ভগ্ন হুইয়া পড়িল । নবকুমার তীরভঙ্গের শব্দ শুনিলেন, কপালকুণ্ডলা । অন্তৰ্হিত হুইল দেখিলেন । আমনি তৎপশ্চাৎ লম্ফ দিয়া জলে পড়িলেন । নবকুমার সস্তরণে নিতান্ত অক্ষম ছিলেন না। কিছুক্ষণ সাতার দিয়া কপাল" কুণ্ডলার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন । র্তাহাকে পাইলেন না, তিনিও উঠিলেন না । . সেই অনন্ত গঙ্গাপ্রবাহমধ্যে বসন্তবায়ুবিক্ষিপ্ত, বীচিমালায় আনোলিত হইতে হইতে কপালকুণ্ডল ও নবকুমার কোথায় গেল ? সমাপ্ত