পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬ আমি বিষ খাইব ।” হরবল্লভ প্রতিজ্ঞ করিলেন, "এবার দেবতা ব্ৰজেশ্বরকে বঁাচাইলে, আর আমি তার মন না বুঝিয়া কোন কাজ করিব না।” ঐ ব্ৰঞ্জেশ্বর বাচিল । ক্রমে আরোগ্যলাভ করিতে #art শয্যা ত্যাগ করিল। একদিন হরবল্ল ড়ের পিতার সাম্বৎসরিক শ্ৰাদ্ধ উপস্থিত। হরবল্লভ শ্ৰাদ্ধ করিতেছেন, ব্ৰজেশ্বর সেখানে কোম কার্য্যেপলক্ষে উপস্থিত আছেন । তিনি শুনিলেন, শ্ৰাদ্ধান্তে পুরেহিত মন্ত্র পড়াইলেন— “পিতা স্বৰ্গঃ পিতা ধৰ্ম্মঃ পিতা হি পরমং তপঃ । * পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রায়ন্তে সৰ্ব্বদেবতাঃ ” কথাটি ব্রজেশ্বর কণ্ঠস্থ করিলেন । প্রফুলের জন্য যখন বড় কান্না আসিত, তখন মনকে প্রবোধ দিবার জন্য বলিতেন,— “পিতা স্বৰ্গঃ পিতা ধৰ্ম্মঃ পিতা হি পরমং তপঃ । পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সৰ্ব্বদেবতাঃ ॥” এইরূপে ব্ৰজেশ্বর প্রফুল্লকে ভুলিবার চেষ্টা করিতে 'লাগিলেন ; ব্রজেশ্বরের পিতাই যে প্রফুল্লের মৃত্যুর কারণ, সেই কথা মনে পড়িলেই ব্রজেশ্বর ভাবিতেন, — “পিতা স্বৰ্গঃ পিতা ধৰ্ম্মঃ পিতা হি পরমং তপঃ ” প্রফুল্ল গেল, কিন্তু পিতার প্রতি তবুও ব্রজেশ্বরের ভক্তি অচলা রহিল । পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ প্রফুল্লের শিক্ষা আরম্ভ হইল। নিশি ঠাকুরাণী রাজার ঘরে থাকিয়া, পরে ভবানী ঠাকুরের কাছে লেখা-পড়া শিখিয়াছিলেন –বর্ণশিক্ষা, হস্তলিপি, কিঞ্চিৎ শুভঙ্করী অঁাক, প্রফুল্ল তাহার কাছে শিখিল । তার পর পাঠক ঠাকুর নিজে অধ্যাপকের আসন গ্রহণ করিলেন । প্রথমে ব্যাকরণ আরম্ভ করাইলেন । আরম্ভ করাইয়া দুই চারি দিন পড়াইয়া অধ্যাপক .বিস্মিত হইলেন। প্রফুল্লের বুদ্ধি অতি তীক্ষু, শিখিবার ইচ্ছা অতি প্রবল-প্রফুল্ল বড় শীঘ্র শিখিতে লাগিল । তাহার পরিশ্রমে নিশিও বিস্মিত হইল । প্রফুল্লের রন্ধন, ভোজন, শয়ন—সব নাম মাত্র । কেবল, “সু ঔ জস, অম্ ঔ শস ইত্যাদিতে মন । নিশি বুঝিল যে, প্রফুল্ল সেই ‘দুই নুতনকে ভুলিবার জন্য অনন্যচিত্ত হইরা বিদ্যাশিক্ষার চেষ্টা করিতেছে । ব্যাকরণ কয়েক মাসে অধিকৃত হইল। " তার পর প্রফুল্ল ভটিকাব্য জলের মত সাতার দিয়া পার হইয়া গেল ! . সঙ্গে সঙ্গে অভিধান অধিকৃত হইল। রঘু, কুমার, নৈষধ, শকুন্তলা প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থ অবাধে অতিক্রাস্ত হইল। তখন আচাৰ্য্য একটু সাংখ্য, একটু বেদান্ত এবং একটু ন্যায় শিখাইলেন । এ সকল অল্প অল্প মাত্র। এই সকল দর্শনে ভূমিকা করিয়া, প্রফুল্লকে সবিস্তার যোগশাস্ত্রাধ্যয়নে নিযুক্ত করিলেন এবং সৰ্ব্বশেষে সৰ্ব্বগ্রন্থশ্রেষ্ঠ শ্ৰীমদ্ভগবদগীতা অধীত করাইলেন। পাঁচ বৎসরে শিক্ষা সম্পূর্ণ হইল । এ দিকে প্রফুল্লের ভিন্ন প্রকার শিক্ষারও তিনি ব্যবস্থা করিতে নিযুক্ত রহিলেন । গোবরার মা কিছু কাজ করে না, কেবল হাট করে, সেটাও ভবানী ঠাকুরের ইঙ্গিতে । নিশিও বড় সাহায্য করে না, কাজেই প্রফুল্লকে সকল কাজ করিতে হয় । তাহাতে প্রফুল্লের কোন কষ্ট নাই—মাতার গৃহেও সকল কাজ নিজে করিতে হইত। প্রথম বৎসরে তাহার আহারের জন্য, ভবানী ঠাকুর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, মোট চাউল, সৈন্ধব, ঘি ও কাচাকলা । আর কিছুই না। নিশির জষ্ঠ তাই। প্রফুল্লের তাহাতেও কোন কষ্ট হইল না । ম’ার ঘরে সকল দিন এত জুটিত না। তবে প্রফুল্ল এক বিষয়ে ভবানী ঠাকুরের অবাধ্য হইল। একাদশীর দিন সে জোর করিয়া মাছ খাইত। গোবরার মা হাট হইতে মাছ না আনিলে, প্রফুল্ল খানা, ডোবা, বিল, খালে আপনি ছাকা দিয়া মাছ ধরিত ; সুতরাং গোবরার ম৷ হাট হইতে একাদশীতে মাছ আনিতে আর আপত্তি করিত না। দ্বিতীয় বৎসরে, নিশির আহারের ব্যবস্থ৷ পূৰ্ব্বমত রহিল, কিন্তু প্রফুল্লের পক্ষে কেবল মুণ, লঙ্কা, ভাত আর একাদশীতে মাছ । তাহাতে প্রফুল্ল কোন আপত্তি করিল ন । তৃতীয় বৎসরে, নিশির প্রতি আদেশ হইল, “তুমি ছানা, সন্দেশ, স্থত, মাখন, ক্ষীর, ননী, ফলমূল, অন্নব্যঞ্জন উত্তমরূপে খাইবে, কিন্তু প্রফুল্পের মুণ, লঙ্কা, ভাত । দুই জনে একত্রে বসিয়া খাইবে।” খাইবার সময় প্রফুল্ল ও নিশি দুই জনে বসিয়া হাসিত। নিশি ভাল সামগ্ৰী বড় খাইত না-গোবরার ম’াকে দিত । এই পরীক্ষাতেও প্রফুল্ল উত্তীর্ণ হইল । চতুর্থ বৎসরে, প্রফুল্লের প্রতি উপাদেয় ভোজ্য খাইতে আদেশ হইল । প্রফুল্ল তাহ খাইল। . ." পঞ্চম বৎসরে, তাহার প্রতি যথেচ্ছ ভোজনের উপদেশ হইল। প্রফুল্ল প্রথম বৎসরের মত খাইল । শয়ন, বসন, নিদ্রা সম্বন্ধে এতদনুরূপ অভ্যাসে ভবানী ঠাকুর শিস্যকে নিযুক্ত করিলেন । পৱিধানে প্রথম বৎসর চারিখানা কাপড়। দ্বিতীয় বৎসরে