পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আনন্দমঠ বলিতে লাগিলেন, “আমি ভালই করিয়াছি। ছার স্ত্রীলোকের জন্য পাছে তুমি দেবতার কাজে অযত্ন কর । দেখ, আমি দেববাক্য লঙ্ঘন করিতেছিলাম, তাই আমার মেয়ে গেল । আর অবহেলা করিলে পাছে তুমি যাও।” মহেন্দ্র কঁাদিয়া বলিলেন, “তোমায় কোথাও রাখিয়া আসিতাম—আমাদের কাজ সিদ্ধ হইলে আবার তোমাকে লইয়া সুখী হইতাম । কল্যাণী আমার সব । কেন তুমি এমন কাজ করিলে ? যে হাতের জোরে আমি তরবারি ধরিতাম, সেই হান্তই কাটিলে ! তুমি ছাড়া আমি কি ?” কল্যাণী । কোথায় আমায় লষ্টয়া যাইতে ?— স্থান কোথায় আছে ? মা, বাপ, বন্ধুবৰ্গ এই দারুণ দুঃসময়ে সকলষ্ট দ্য মরিয়াছে ! কার ঘরে স্থান আছে, কোথায় ঘাইবার পথ আছে, কোথায় লক্ট য়। যাইবে ? আমি , গলগ্ৰহ । আমি মরিলাম, ভালই করিলাম । আমার আশীৰ্ব্বাদ কর, যেন আমি সেই –সেই তালে’ম স্ন লোকে গিয়! আবার তোমার দেখ। পাই ।” এষ্ট বলিয়। কল্যাণী আবার স্বামীর পদরেণু গ্রহণ করিয়। মাথায় দিলেন । মহেন্দ্র কোন উত্তর ন! করিতে পারিয়! আবার র্ক দিতে লাগিলেন । কল্যাণী আবার বললেন,-অতি মৃত্যু, অতি মধুব, অতি স্নেহময় কষ্ঠে,--আবার বলিলেন, “দেখ, দেবতার ইচ্ছা, কীর সাপ। লঘেন করে ? অামায় যাইহে আজ্ঞা করিয়াছেন, আমি মনে করিলে কি থাকি:ত পারি।--আপনি ম| মরিতাম ত অবস্থা আর কেহ মারিত আমি মরিয়া ভালই করিলাম । তুমি বে ব ত গ্রহণ করিয়াছ, কায়মনোবাকো তাহা সিদ্ধ কর পুণ্য হইবে । আমার তাহাতে স্বৰ্গলাভ হইবে । দুই জন একল অনন্ত স্বর্গ ভোগ করিব ।" এদিকে বালিকাটি একবার দুধ তুলিয়া সামলাইল । তাহার পেটে বিষ যে অল্প পরিমাণ গিয়াছিল, তাহা মারাত্মক নহে । কিন্তু সে সময়ে সে দিকে মহেন্দ্রের মন ছিল ন! ! তিনি ক্যাকে কল্যাণীর কোলে দিয়া উভয়কে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়। অবিরত কঁাদিতে লাগিলেন। তখন যেন অরণ্যমধ্য হইতে মৃদু অথচ মেঘগম্ভীর শব্দ শুন গেল ;– “হরে মুরারে মধুকৈটভারে । গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে!” কল্যাণীর তখন বিষ ধরিয়া আসিতেছিল, চেতনা কিছু অপহৃত হইয়াছিল, তিনি মোহভরে শুনিলেন,

  • 、>

যেন সেই বৈকুণ্ঠে শ্রুত অপূৰ্ব্ব বংশীধ্বনিতে বাজি । তেছে — . “হরে মুরারে মধুকৈটভারে । গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে " . তখন কল্যাণী অঙ্গরোনিন্দিতকণ্ঠে মোহভরে ডাকিতে লাগিলেন ;– g “হরে মুরারে মধুকৈটভারে ” মহেন্দ্রকে বলিলেন, “বল – হরে মুরারে মধুকৈটভারে! কানননির্গত মধুর স্বর আর কল্যাণীর মধুরস্বরে বিমুগ্ধ হইয়া কাতরচিত্তে ঈশ্বরমাত্র সহায় মনে করিয়া মহেন্দ্রও ডাকিলেন ;– “হরে মুরারে মধুকৈটভারে ।” তখন চারিদিক্ হইতে ধ্বনিত হইতে লাগিল,— “তরে মুরারে মধুকৈটভারে !" তখন যেন গাছের পার্থীরাও বলিতে লাগিল,— “হরে মুরারে মধুকৈটভারে !" কলকলেও যেন শব্দ হষ্টতে লাগিল— “হরে মুরারে মধুকৈটভারে !" তখন মহেন্দ্র শোক ভাপ ভুলিয়া গেলেন— উন্মক্ত হইয়। কল্যাণীর সঙ্গে একতানে ডাকিতে লাগিলেন – “হরে মুরারে মধুকৈটভারে " কানন হইতেও যেন তাহদের সঙ্গে একতানে শব্দ হইতে লাগিল,--- - “হরে মুরারে মধুকৈটভারে ” কল্যাণীর কণ্ঠ ক্রমে ক্ষীণ হইয়া আসিতে লাগিল ; তবু ডাকিতেছেন, — “হরে মুরারে মধুকৈটভারে !" তখন ক্রমে ক্রমে কণ্ঠ নিস্তব্ধ হইল, কল্যাণীর মুখে আর শব্দ নাই, চক্ষু নিৰ্মীলিত হইল, অঙ্গ শীতল হইল। মহেন্দ্ৰ বুঝিলেন যে, কল্যাণী হরে মুরারে’ ডাকিতে ডাকিতে বৈকুণ্ঠধামে গমন করিয়াছেন । তখন পাগলের ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে কানন বিকম্পিত করিয়া, পশুপক্ষিগণকে চমকিত করিয়া মহেন্দ্র ডাকিতে লাগিলেন,— “হরে মুরারে মধুকৈটভারে !"