পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ჯ8 নাবিক বসিয়াছিল । যেমন শাক বাজিল, অমনি তাহার কাছি ছাড়িয়া দিয়া লাফাইয়া বজরায় উঠিল। তীরের উপরে যে সিপাহীরা বজরা ঘেরাও করিয়াছিল, তাহারা উহাদিগকে মারিবার জন্য সঙ্গীন উঠাইল, কিন্তু তাহাদের হাতের বন্দুক হাতেই রহিল, পলক ফেলিতে না ফেলিতে একট প্রকাও কাগু হইয়া গেল। দেবীর কৌশলে এক- পলকমধ্যে সেই পাচ শত কোম্পানীর সিপাহী পরাস্ত হইল । পূৰ্ব্বে বলিয়াছি যে, প্রথমাবধিই বজরায় চারিখানা পাল খাটান ছিল । বলিয়াছি যে, মধ্যে নিশি ও দিব৷ আসিয়া নাবিকদিগকে কি উপদেশ দিয়া গিয়াছিল। সেই উপদেশ অনুসারেই খোটার কাছে লোক বসিয়াছিল। আর সেই উপদেশ অনুসারে পালের কাছির কাছে চারি জন নাবিক বসিয়াছিল। শাকের শব্দ শুনিবামাত্র, তাহারা পালের কাছি সকল টানিয়া ধরিল। মাঝি হাল আঁটিয়া ধরিল । আমনি কেই প্রচণ্ড বেগশালী ঝটিকা আসিয়া চারিখানি পালে লাগিল। বজরা ঘুরিল—যে দুই জন সিপাহী সঙ্গীন তুলিয়াছিল, তাহাদের সঙ্গীন উচু হইয়া রহিল—ৰজরার মুখ পঞ্চাশ হাত তফাতে গেল। বজরা ঘুরিল—তার পর ঝড়ের বেগে পালভরা বজরা কাত হইল, প্রায় ডুবে । লিখিতে এভক্ষণ লাগিল, কিন্তু এতখানা ঘটিল এক নিমেষমধ্যে। সাহেব ব্রজেশ্বরের চড়ের প্রত্যুত্তরে ঘুষি উঠাইয়াছেন মাত্র, ইহার মধ্যে এতখান। সব হইয়া গেল। র্তাহারও হাতের ঘুষি হাতে রহিল, যেমন বজরা কাত হইল, অমনি সাহেব টলিয়া মুষ্টিবদ্ধ হস্তে দিবাসুন্দরীর পাদমূলে পতিত হইলেন। ব্ৰজেশ্বর খোদ সাহেবের ঘাড়ের উপর পড়িয়া গেল—এবং রঙ্গরাজ তাহার উপর পড়িয়া গেল। হরবল্লভ প্রথমে নিশি ঠাকুরাণীর ঘাড়ের উপর পড়িয়াছিলেন, পরে সেখান হইতে পদচ্যুত হইয়া গড়াইতে গড়াইতে রঙ্গরাজের নাগর জুতায় আটকাইয়া গেলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন যে, নৌকাখানা ডুবিয়া গিয়াছে। আমরা সকলে মরিয়া গিয়াছি, আর এখন দুর্গা নাম জপিয়া কি হইবে ? কিন্তু নৌকাও ডুবিল না—কাত হইয়া আবার সোজা হইয়া বাতাসে পিছন করিয়া বিদ্যুদবেগে ছুটিল। যাহারা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার খাড় হইয়া দাড়াইল—সাহেব আবার ঘুষি তুলিলেন । কিন্তু সাহেবের ফোঁজ, যাহারা জলে দাড়াইয়াছিল, বজরা তাহাদের ঘাড়ের উপর দিয়া চলিয়া গেল। অনেকে জলে ডুবিয়া প্রাণরক্ষা করিল, কেহ দূর হইতে বজরা বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী ঘুরিতেছে দেখিতে পাইয়া, পলাইয়া বাচিল, কেহ বা আহত হইল ; কেহ মরিল না। ছিপগুলি বজরার নীচে পড়িয়া ডুবিয়া গেল—জল সেখানে এমন বেশী নহে—স্রোত বড় নাই—সুতরাং সকলেই বাচিল । কিন্তু বজরা আর কেহ দেখিতে পাইল না, নক্ষত্ৰবেগে উড়িয়া বজরা কোথায় ঝড়ের সঙ্গে মিশিয়া চলিল, কেহ আর দেখিতে পাইল না। সিপাহী সেনা ছিন্ন ভিন্ন হইল । দেবী তাহদের পরাস্ত করিয়া পাল উড়াইয়। চলিল, লেফটেনাণ্ট সাহেব ও হরবল্লভ দেবীর নিকট বন্দী হইল। নিমেষমধ্যে যুদ্ধজয় হইল। দেবী তাই আকাশ দেখিয়া বলিয়াছিল, “আমার রক্ষার উপায় ভগবান করিতেছেন " অষ্টম পরিচ্ছেদ বজরা জলের রাশি ভাঙ্গিয় দুলিতে দুলিতে নক্ষত্ৰবেগে ছুটিল। শব্দ ভয়ানক। বজরার মুখে কৃত তরঙ্গরাশির গর্জন ভয়ানক—ঝড়ের শব্দ ভয়ানক। কিন্তু নৌকার গঠন অনুপম, নাবিকদিগের দক্ষতা ও শিক্ষা প্রসিদ্ধ। নৌকা এই ঝড়ের মুখে চারিখানা পাল দিয়া নিৰ্ব্বিঘ্নে চলিল। আরোহিবর্গ যাহারা প্রথমে কুষ্মাণ্ডাকারে গড়াগড়ি দিয়াছিলেন, র্তাহারা সকলে স্বপদস্থ হইলেন। হরবল্লভ রায় মহাশয়, অঙ্গুষ্ঠে যজ্ঞোপবীত জড়িত করিয়া দুর্গানাম জপিতে আরম্ভ করিলেন, আবার না ডুবি । লেফটেনাণ্ট সাহেব সেই মুলতুবী ঘুষিটা আবার পুনর্জীবিত করিবার চেষ্টায় হস্তোত্তোলন করিলেন, অমনি ব্ৰজেশ্বর র্তার হাতখানা ধরিয়া ফেলিল । হরবল্লভ ছেলেকে ভৎসনা করিলেন। বলিলেন, “ও কি কর । ইংরেজের গায়ে হাত তোল ?” ব্ৰজেশ্বর বলিল, “আমি ইংরেজের গায়ে হাত তুলিতেছি, না ইংরেজ আমার গায়ে হাত তুলিতেছে ?” হরবল্লভ সাহেবকে বলিলেন, “হুজুর ! ও ছেলেমানুষ, আজও বুদ্ধিশুদ্ধি হয় নি, আপনি ওর অপরাধ লইবেন না। মাফ করুন ।” সাহেব বলিলেন, “ও বড় বদমাস ! তবে যদি , আমার কাছে ও ষোড়হাত করিয়া মাফ চায়, তবে আমি মাফ করিতে পারি।” হরবল্লভ । ব্রজ, তাই কর। ষোড় হাত করিয়া সাহেবকে বল, “আমায় মাফ করুন।” ব্ৰজেশ্বর। সাহেব, আমরা হিন্দু, পিতৃ আজ্ঞা আমরা কখনও লঙ্ঘন করি না। আমি আপুনার