পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ক্রিভীন্ন খণ্ড প্রথম পরিচ্ছেদ শাস্তির অল্পবয়সে, অতি শৈশবে, মাতৃবিয়োগ হইয়াছিল । যে সকল উপাদানে শাস্তির চরিত্র গঠিত, ইহা তাহার মধ্যে একটি প্রধান । তাহার পিতা অধ্যাপক ব্রাহ্মণ ছিলেন । তাহার গৃহে অন্য স্ত্রীলোক কেহ ছিল না । কাজেই শাস্তির পিত। যখন টোলে ছাত্রদিগকে পড়াইতেন, শাস্তি গিয়া ঠ৷হার কাছে বসিয়া থাকিত । টোলে কতকগুলি ছাত্র বাস করি ত ; শান্তি অন্ত সময়ে তাহাদিগের কাছে বসিয়া খেল করিত, তাহাদিগের কোলে পিঠে চড়িত, তাহারাও শাস্তিকে আদর করিত । * এইরূপে শৈশবে নিয়ত পুরুষসহচর্যের প্রথম ফল এই হইল যে, শাস্তি মেয়ের মত কাপড় পরিতে শিথিল না, অথব৷ শিখিয়া পরিত্যাগ করিল । ছেলের মত কেঁাচা করিয়া কাপড় পরিতে আরম্ভ করিল। কেহ তখন মেয়ে কাপড় পরাষ্টয় দিলে, তাহ। খুলিয়া ফেলিত, আবার কোচ করিয়া পরিত। টোলের ছাত্রেরা গোপ। বাপে না, অতএব শান্তিও "কখন খোপা বাধিষ্ঠ ন –কে বা তার পোপ। বাধিয়া দেয় ? টোলের ছাত্রের কাঠের চিরুণী দিল। তাহার চুল আঁচড়াইয় দিত, চুলগুলি কুণ্ডলা করিয়া শাস্তির পিঠে, কাধে, বহুতে ও গালের উপর গুলিত । ছাত্রের ক্টোটা করিত, চন্দন মাখিত, শাস্তিও ফেঁট৷ করিত, চন্দন মাখিত, যজ্ঞোপবীত গলায় দিতে পাইত না বলিয়। শান্তি বড় কাদিত । কিন্তু সন্ধ্যাহিকের সময়ে ছাত্রদিগের কাছে বসিয়, তাহাদের অনুকরণ করিতে ছাড়িত না । ছাত্রের অধ্যাপকের অবর্তমানে অশ্লীল সংস্কৃতের গুই চারিটি বৃকৃনি দিয়া দুই একটা আদিরসাশিত গল্প করিতেন, টিয়া পার্থীর -মত শাস্তি সেগুলিও শিথিল-—টিয় পাখীর মত তাহার অর্থ কি, তাহা কিছুই জানিত ন । দ্বিতীয় ফল এই হইল যে, শান্তি একটু বড় হইলেই ছাত্রেরা যাহা পড়িত, শান্তিও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে শিখিতে আরম্ভ করিল। ব্যাকরণের এক বর্ণ জানে না, কিন্তু ভটি, রঘু কুমার নৈষধাদির শ্লোক ব্যাখ্য'সহিত মুখস্থ করিতে লাগিল । দেখিয়া শুনিয়া ন্তির পিত। যদ্যবিষ্যতি তদ্ভবিষ্যতি বলিয়া শাস্তিকে মুগ্ধবোধ আরম্ভ করাইলেন । শান্তি বড় শীঘ্র শীঘ্র শিখিতে লাগিল । অধ্যাপক বিস্ময়াপন্ন হইলেন । ব্যাকরণের সঙ্গে সঙ্গে দুষ্ট একখান| সাহিত্য পড়াইলেন । তার পর সব গোলমাল হইয় গেল। পিতার পরলোকপ্রাপ্তি হইল । তখন শাস্তি নিরাশ্রয় । টোল উঠিয়া গেল । ছত্রের চলিয়। গেল । কিন্তু শাস্তিকে তাহার ভালবাসিত—শাস্তিকে পরিত্যাগ করিম সাইতে পারিল না, এক জন তাহাকে দয়। করিয়া আপনার গৃহে লইয়। গেল । ইনিই পশ্চাৎ সন্তান-সম্প্রদায়ুমধ্যে প্রবেশ করিয়৷ জীবানন্দ নাম গ্ৰহণ করিয়াছিলেন । আমর। তাহাকে জীবানন্দই বলিত থাকিব । তখন জীবানন্দের পিতা-মাতা বর্তমান । তাহদিগের নিকট জীবানন্দ কণ্ঠাটির সবিশেষ পরিচয় দিলেন । পিত! মাত। জিজ্ঞস করিলেন, “এখন এ পরের ময়ের দায়-ভার নেক্স কে ?” জীবানন্দ বলিল, “আমি আনিয়াছি, আমিই দ। সু-ভার গ্রহণ করিব।” পিতা-মাতা বলিলেন, “ভালই ” জীবানন্দ অনূঢ়— শাস্তির বিবাহ-বয়স উপস্থিত । অতএব জীবানন্দ তাহাকে বিবাহ করিলেন । বিবাহের পর সকলেই অনুতাপ করিতে লাগিলেন । সকলেই বুঝিলেন, “কাজটা ভাল হয় নাই ।” শাস্তি কিছুতেই মেয়ের মত কাপড় পরিল না । কিছুতেই চুল ধাপিল না । সে বাটীর ভিতর থাকিত না ; পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলিয়। খেলা করিত । জীবানন্দের বাড়ার নিকটেই জঙ্গল, শান্তি জঙ্গলের ভিতরে এক প্রবেশ করিয়া কোথায় ময়ূর, কোথায় হরিণ, কোথায় দুল্লভ ফুল ফল, এই সকল খুজিয়া বেড়াইত । শ্বশুর-শাশুড়ী প্রথমে নিষেধ, পরে ভৎসনা, পরে প্রহার করিয়া শেযে ঘরে শিকল দিয়! শাস্তিকে কয়েদ রাখিতে আরম্ভ করিল। পীড়াপীড়িতে শাস্তি বড় জালাতন হইল। এক দিন দ্বার খোলা পাইয়া শাস্তি কাহাকেও ন বলিয়া গৃহত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল । - জম্বলের ভিতর বাছিয়া বাছিয়া ফুল তুলিয়৷ কাপড় ছোবাইয়া শাস্তি বাচ্ছা সন্ন্যাসী সাজিল । তখন বাজাল জুড়িয়া দলে দলে সন্ন্যাসী ফিরিত । শাস্তি