পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আমন্দমঠ বাড়ীতে ভবানন্দ ঠাকুর প্রবেশ করিলেন । নিম্নতলে একটি ঘরে যেখানে অৰ্দ্ধবয়স্ক একটি স্ত্রীলোক পাক করিতেছিল, সেইখানে গিয়া ভবানন্দ মহাপ্রভু দর্শন দিলেন । স্ত্রীলোকটি অৰ্দ্ধবয়স্ক, মোটাসোটা, কালোকোলে, ঠোঁট পর কপালে উল্কি, সীমস্তপ্রদেশে কেশদাম চুড়াকারে শোভা করিতেছে, ঠন্‌ ঠন্‌ করিয়৷ ক্টাড়ির কানায় ভাতের কাঠি বাজিতেছে, ফৰ্ব ফর করিয়৷ অলকদামের কেশগুচ্ছ উড়িতেছে, গল্‌ গলু করিয়া মাগী আপন! আপনি বকিতেছে আর তার মুখভঙ্গীতে তাহার মাথার চুড়ায় নানাপ্রকার টলুনিটালুনির বিকাশ হইতেছে । এমন সময় ভবানন্দ মহাপ্রভু গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “ঠাকুরুণদিদি, প্রাতঃপ্রণাম ।” ঠাকুরুণদিদি ভবানন্দকে দেখিয়া, শশব্যস্তে বস্থাদি সামলাইতে লাগিলেন । মস্তকের মোহন চুড়া পুলিয়৷ কেলিবেন ইচ্ছ। ছিল, কিন্তু সুলিপ হুইল না, কেন না. সকৃড়ি হাত । নিসেকমন্সণ সেই চিকুর জাল—হায় ! তাহাতে পূজার সময় একটি বকফুল পড়িয়াছিল । বস্ত্রাঞ্চলে ঢাকিতে যত্ন করিলেন ; বস্ত্রাঞ্চল তাহ ঢাকিতে সক্ষম হইল না, কেন না, ঠাকুরুণটি একখানি পাচ হাত কাপড় পরিবৃছিলেন । -সেই পাচ হাত কাপড় প্রথমে গুরুভারপ্রণত উদরপ্রদেশ বেষ্টন করিয়। আসিতে প্রায় নিঃশেষ হঠয়া পড়িয়ছিল । তার পর দুঃসহ ভার গ্রস্থ হৃদয়মগুলেরও কিছু আবরুপদ। রক্ষা করিতে ইষ্টয়াছে । যে ঘাড়ে পাছিয়া বস্ত্রাঞ্চল জলাব দিল । কানের উপর উঠিয়। বলিল, তার বাইতে পারি না । অগতা পরম প্রাড়ব তা গৌরী ঠাকুরাণী কথিত বস্ত্রঋলকে কানের কাছে ধরিয়। রাখিলেন এবং ভবিষ্যতে আট হাত কাপড় কিনিবার জন্য মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়। বলিলেন “কে, গোসাইঠাকুর ? এস এস ! আমায় আবার প্রাতঃপ্রণাম কেন ভাই ?” ভব । তুমি ঠানদিদি যে । গৌরী। আদর করে বল বলিয়া । তোমর। ই'লে গোসাই মানুষ, দেবতা ! তা করেছ করেছ, বেঁচে থাক । তা করিলেও করিতে পার, হাজার হোক, আমি বয়সে বড় । এখন ভবানন্দের অপেক্ষ গৌরী দেবী মহাশয়৷ বছর পচিশের বড়, কিন্তু সুচতুর ভবানন্দ উত্তর করিলেন, “সে কি ঠানদিদি । রসের মানুষ দেখে ঠানদিদি বলি। নইলে যখন হিসাব হয়েছিল, তুমি আমার চেয়ে ছয় বৎসরের ছোট হইয়াছিলে, মনে নাই ? আমাদের বৈষ্ণবের সকল রকম আছে জান, আমার মনে মনে ইচ্ছা, মঠধারী ব্রহ্মচারীকে বলিয়া 8તું - 盛° তোমায় সাঙ্গা ক’রে ফেলি। সেই কথাটাই বলুঞ্জে এসেছি । 就、 গৌরী । সে কি কথা ?—ছি, আমন কথা কি বলুতে আছে। আমরা হলেম বিধবা । ভব । তবে সাঙ্গ হবে না ? গৌরী । তা ভাই, যা জান, তা কর । তোমরা হ’লে পণ্ডিত, আমরা মেয়েমানুষ, কি বুঝি ? তা কবে হবে ? ভবানন্দ অতিকষ্টে হাস্তসংবরণ করিয়৷ বলিলেন, “সেই ব্রহ্মচারীটার সঙ্গে একবার দেখ হইলেই হয়। আর সে কেমন আছে ?” ." গৌরী বিষণ্ণ হইল। মনে মনে সন্দেহ করিল, সাঙ্গার কথাট। তবে বুঝি তামাসা । বলিল, “আছে অীর কেমন, যেমন থাকে ৷” ভব । তুমি গিয়া একবার দেখিয়া আইস, কেমন আছে, বলিয়। আক্টস, আমি আসিয়াছি, একবার সাক্ষাং করিব । গৌরী দেবী তখন ভাতের কাঠি ফেলিয়। হাত ধূইয়া, বড় বড় ধাপের সিড়ি ভাঙ্গিয়া দোতালার উপর উঠিতে লাগিল । একটি ঘরে ছেড়া মাছরের উপর বসিয়া এক অপূৰ্ব্বসুন্দরী । কিন্তু সৌন্দর্য্যের উপর একটা ঘোরতর ছায়া আছে । মধ্যাহ্নে কুলপরিপ্লাবিনী প্রসন্নসলিল বিপুল জল কল্লোলিনী স্রোতস্বতীর বক্ষের উপর অতি নিবিড় মেঘের ছায়ার - দ্যায় কিসের ছায়া আছে ; নদীহৃদয়ে তরঙ্গবিক্ষিপ্ত হুইতেছে, তীরে কুস্থমিত তরুকুল বায়ুভরে হেলিতেছে, ঘন পুষ্পভরে নামিতেছে, অট্টালিকাশ্রেণীও শোভিতেছে । তরণী-শ্রেণী-তাড়নে জল আন্দোলিত হইতেছে। কাল মধ্যাহ্ন, তবু সেই কদম্বিনীনিবিড় কালে ছায়ার সকল শোভাই কালিমাময় । এও তাই । সেই পূৰ্ব্বের মত চারু চিঙ্কণ চঞ্চল নিবিড় অলকদাম, পূৰ্ব্বের মত সেই প্রশান্ত পরিপূর্ণ ললাটভূমে পূৰ্ব্বমত অতুল তুলিকালিখিত ভ্ৰধনু, পূৰ্ব্বের মত বিস্ফারিত সজল উজ্জল কৃষ্ণতার বৃহচ্চক্ষু, তত কটাক্ষময় নয়, তত লোলত নাই, কিছু নম্র । অধরে তেমনি রাগরঙ্গ, হৃদয় তেমনি শ্বাসামুগামী পূর্ণতায় ঢলঢল, বাহু তেমনি বনলতা-দুষ্প্রাপ্য কোমলতাযুক্ত । কিন্তু আজ সে দীপ্তি নাই, সে উজ্জ্বলতা নাই, সে প্রখরতা নাই, সে চঞ্চলতা নাই, সে রস নাই । বলিতে কি, বুঝি সে যৌবন নাই। আছে কেবল সৌন্দৰ্য্য আর সে মাধুৰ্য্য । নুতন হইয়াছে ধৈর্য্যগাম্ভীৰ্য্য । ইহাকে পূৰ্ব্বে দেখিলে মনে হইত, মনুষ্যলোকে অতু লনীয়া সুন্দরী, এখন দেখিলে বোধ হয়, ইনি o; ‘Ā’