পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(to সত্য। তোমারে আমি চিনিতাম না। মা ! দড়ির জোর না বুঝিয়। আমি জেয়দা টানিয়াছি, তুমি "আমার অপেক্ষ জ্ঞানী, ইহার উপায় তুমি কর, জীবানন্দকে বলিও না যে, আমি সকল জানি । তোমার প্রলোভনে তিনি জীবন রক্ষা করিতে পারেন, এত দিন করিতেছেন, তাহা হইলে আমার কার্যোদ্ধার হইতে পারে। - সেই বিশাল নীল উৎফুল্ল লোচনে নিদাঘ-কাদম্বিনী বিরাজিত বিদ্যুৎতুল্য ঘোর রোষকটাক্ষ হইল। শাস্তি বলিল, “কি ঠাকুর । আমি আমার স্বামী এক আত্মা, যাহা যাহা তোমার সঙ্গে কথোপকথন হইল, সবই বলিব । মরিতে হয়, তিনি মরিবেন, তামার ক্ষতি কি ? আমি তে। সঙ্গে সঙ্গে মরিব । তার স্বৰ্গ আছে, মনে কর কি আমার স্বর্গ নাই ?" ব্রহ্মচারী বলিলেন যে, “আমি কখন হারি নাই, আজি তোমার কাছে হারলাম ! মা, আমি তোমার পুত্র ; সস্তানকে স্নেহ কর, জীবানন্দের প্রাণবক্ষ কর, আপনার প্রাণরক্ষা কর, আমার কার্যোদ্ধার হইবে ।" বিজুলী হাসিল । শাস্তি বলিল, “আমার স্বামীর ধৰ্ম্ম আমার স্বামীর হাতে ; আমি তাহাকে ধৰ্ম্ম হইতে বিরত করিবার কে ? ইহলোকে স্ত্রীর পতি দেবতা, কিন্তু পরকালে সবারই ধৰ্ম্ম দেবতা—আমার কাছে আমার পতি বড়, তার অপেক্ষ আমার ধৰ্ম্ম বড়, তার অপেক্ষা আমার কাছে আমার স্বামীর ধৰ্ম্ম বড় । আমার ধৰ্ম্মে অামার মে দিন ইচ্ছা, জলাঞ্জলি দিতে পারি ; আমার স্বামীর ধৰ্ম্মে জলাঞ্জলি দিব ? মহারাজ ! তোমার কথায় আমার স্বামী মরিতে হয় মরিবেন, আমি বারণ করিব না ।” ব্রহ্মচারী তখন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, *স, এ ঘোর ত্রতে বলিদান আছে । আমাদের প্রকলকেই বলি পড়িতে হুইবে । আমি মরিব, জীবানন, ভবানন্দ সলাই মরিবে, বোধ হয় মা, তুমিও মরিবে ; কিন্তু দেখ, কাজ করিয়৷ মরিতে হইবে, বিন কার্য্যে কি মরা ভাল ? —আমি কেবল দেশকে ম৷ বলিয়াছি, আর কাহাকেও মা বলি সাই ; কেন না, সেই স্থজল সুফল ধরণী ভিন্ন আমরা অনন্তমাতৃক । আর তোমাকে ম৷ বলিলাম । ভূমি মা হইয়া সস্তানের কাজ কর, যাহাতে কার্য্যোদ্ধার হয়, তাহা করিও, জীবানন্দের প্রাণরক্ষা করিও, তোমার প্রাণরক্ষা করিও ।” এই বলিয়া সত্যানন্দ “কুরে মুরারে মধুকৈটভারে” গায়িতে গায়িতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী অষ্টম পরিচ্ছেদ ক্রমে সন্তান-সম্প্রদায়মধ্যে সংবাদ প্রচারিত হইল যে, সতানন্দ আসিয়াছেন, সস্তানদিগের সঙ্গে কি কথা কহিবেন, এই বলিয়া তিনি সকলকে আহবান করিয়াছেন । তখন দলে দলে সস্তান-সম্প্রদায় আসিয়া সমবেত হইতে লাগিল । জ্যোৎস্না-রাত্রিতে নদীসৈকত পাশ্বে বৃহৎ কাননমধ্যে আম, পনস, তাল, তিন্তিড়ী, অশ্বথ, বেল, বট, শালুলী প্রভৃতি বৃক্ষাদিরঞ্জিত মহাগহনে দশ সহস্ৰ সন্তান সমবেত হইল । তখন সকলেই পরস্পরের মুখে সত্যানন্দের আগমনবার্তা শ্রবণ করিয়া মহা কোলাহলধ্বনি করিতে লাগিল । সতানন্দ কি জন্য কোথায় গিয়াছিলেন, তাহ সাধারণে জানিত না । প্রেবাদ এই যে, তিনি সস্তানদিগের মঙ্গলকামনায় তপস্তার্থ হিমালয়ে প্রস্থান করিয়াছিলেন । আজ সকলে কানাকানি করিতে লাগিল, “মহারাজের তপঃসিদ্ধি হইয়াছে—আমাদের রাজ্য হইবে ।" তখন বড় কোলাঙ্গল ইষ্টতে লাগিল, কেহ টীংকার করতে লাগিল- “মার মার, নেড়ে মার ।" কেহ বলিল, “জয় জয় । মঙ্গরাজকি জয় !" কেত গায়িল, “পরে মুরারে মধুকৈটভারে !" কেহ গায়িল, “বন্দে মাতরম্ ! কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালী হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীর পাত করিব ?" কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয় রাধামাধবের মন্দির গড়িব ?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, আপনার ধন আপনি খাইব ?" দশ-সহস্র নরকণ্ঠের কলকল রব, মধুর বায়ুসস্তাড়িত বুঙ্গপত্ররাশির মৰ্ম্মর, সৈকতবাহিনী ভরঙ্গিণীর মুড়-মুক্ত তর-তর রব, নীল আকাশের চন্দ্র, তারা, শ্বেত মেঘরাশি শু্যামল ধরণীতলে প্তরিত কানন, স্বচ্ছ নদী শ্বেভসৈকত, ফুল. কুসুমদাম । অীর মধ্যে মধ্যে সেই সৰ্ব্বজনমনোরম “বন্দে মাতরম্ " সত্যনিন্দ আসিরা সেই সমবেত সস্তান-মণ্ডলীর মধ্যে দাড়াইলেন । তখন সেই দশ সহস্ৰ সন্তানমস্তক বৃক্ষবিচ্ছেদপতিত চন্দ্রকিরণে প্রভাসিত হইয়। গ্র্যামল তৃণভূমে প্রণত হইল । অতি উচ্চস্বরে অশ্রপুর্ণলোচনে উভয় বাহু উৰ্দ্ধে উত্তোলন করিয়া সত্যানন্দ বলিলেন, “শঙ্খচক্ৰগদ|পদ্মধারী, বনমালী, বৈকুণ্ঠনাথ, যিনি কেশিমথন, মধুমুর নরকমর্দন, লোকপালন, তিনি তোমাদের মঙ্গল করুন, তিনি তোমাদের বাহুতে বল দিন, মনে ভক্তি দিন, ধৰ্ম্মে মতি দিন, তোমরা একবার তাহার