পাতা:রাধারাণী-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় খণ্ড : প্রথম পরিচ্ছেদ ఫిపి আমার পিসীর শ্বশুরালয় সেই কালিকাপুরে। সেইখানে লবঙ্গ নামে কোন ভদ্রলোকের কস্তার সঙ্গে পিলী আমার সম্বন্ধ উপস্থিত করিলেন। সম্বন্ধের পূৰ্ব্বে আমি লবঙ্গকে সৰ্ব্বদাই দেখিতে পাইতাম। আমার পিসীর বাড়ীতে আমি মধ্যে মধ্যে যাইতাম। লবঙ্গকে পিসীর বাড়ীতেও দেখিহাম—তাহার পিত্রালয়েও দেখিতাম। মধ্যে মধ্যে লবঙ্গকে শিশুবোধ হইতে “ক”য়ে করাত, “খ”য়ে খরা শিখাইতাম । যখন তাহার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হইল, তখন হইতে সে আমার কাছে আর আসিত না । কিন্তু সেই সময়েই আমিও তাহারে দেখিবার জন্য অধিকতর উৎসুক হইয়া উঠিলাম। তখন লবঙ্গের বিবাহের বয়ঃক্রম উত্তীর্ণ হইয়াছিল—লবঙ্গ কলিকা ফোট ফোট হইয়াছিল। চক্ষের চাহনী চঞ্চল অথচ ভীত হইয়া আসিয়াছিল—উচ্চ হান্ত মৃত্যু এবং ব্রীড়াযুক্ত হইয় উঠিয়াছিল—দ্রুত গতি মন্থর হইয়। আসিতেছিল। আমি মনে করিতাম, এমন সৌন্দৰ্য্য কখন দেখি নাই—এ সৌন্দর্য্য যুবতীর অদৃষ্টে কখন ঘটে না। বস্তুতঃ অতীতশৈশব অথচ অপ্রাপ্তযৌবনার সৌন্দৰ্য্য, এবং অফুটবাক শিশুর সৌন্দৰ্য্য, ইহাই মনোহর—যৌবনের সৌন্দৰ্য্য তাদৃশ নহে। যৌবনে বসনভূষণের ঘটা, হাসি চাহনীর ঘট,--বেণীর দোলনি, বাহুর বলনি, গ্রীবার হেলনি, কথার ছলনি—যুবতীর রূপের বিকাশ একপ্রকার দোকানদারি। আর আমরা যে চক্ষে সে সৌন্দৰ্য্য দেখি, তাহাও বিকৃত। যে সৌন্দর্য্যের উপভোগে ইন্দ্রিয়ের সহিত সম্বন্ধযুক্ত চিত্তভাবের সংস্পর্শ মাত্র নাই, সেই সৌন্দৰ্য্যই সৌন্দৰ্য্য। এই সময়ে আমাদের কুলকলঙ্ক কন্যাকৰ্ত্তার কর্ণে প্রবেশ করিল। সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল । আমার হৃদয়পতত্রী সবে এই লবঙ্গলতায় বসিতেছিল—এমত সময় ভবানীনগরের রামসদয় মিত্র আসিয়া লবঙ্গলতা ছিড়িয়া লইয়া গেল। তাহার সঙ্গে লবঙ্গলতার বিবাহ হইল। লবঙ্গলাভে নিরাশ হইয়া আমি বড় ক্ষুন্ন হইলাম। ইহার কয়বৎসর পরে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যে, তাহা আমি বলিতে পারিতেছি না। পশ্চাৎ বলিব কি না, তাহাও স্থির করিতে পারিতেছি না। সেই অবধি আমি গৃহত্যাগ করিলাম। সেই পৰ্য্যন্ত নানা দেশে ভ্রমণ করিয়াই বেড়াই। কোথাও স্থায়ী হইতে পারি নাই । কোথাও স্থায়ী হই নাই, কিন্তু মনে করিলেই স্থায়ী হইতে পারিতাম। মনে করিলে কুলীন ব্রাহ্মণের অপেক্ষ অধিক বিবাহ করিতে পারিতাম। আমার সব ছিল—ধন, সম্পদ, বয়স, বিদ্যা, বাহুবল—কিছুরই অভাব ছিল না ; অদৃষ্টদোষে, একদিনের দুৰ্ব্বদ্ধিদোষে, সকল ত্যাগ করিয়া, আমি এই মুখময় গৃহ—এই উদ্যানতুল্য পুষ্পময় সংসার ত্যাগ করিয়া,