সময় অসময় নিঃসময়/সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ভাবাদর্শ

উইকিসংকলন থেকে

সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ভাবাদর্শ

 ‘শিল্পীকে কী ভাব তোমরা? নিছক জরদগব—যদি চিত্রকর হয়, শুধু চোখ আছে? যদি গাইয়ে হয় শুধু কান কিংবা যদি কবি হয়, তাহলে মনের প্রতিটি স্তরে একটা বীণা? কিংবা ধরো, মুষ্টিযোদ্ধা হলে নেহাত কিছু পেশি? একেবারে উল্টো। একই সঙ্গে শিল্পী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব-হৃদয় বিদারক, উত্তেজক বা সুখপ্রদ ঘটনার প্রতি যে সবসময় সজাগ—সমস্ত রকম ভাবে সে এদের ডাকে সাড়া দেয়। এটা কী করে সম্ভব যে অন্য কোনো মানুষ সম্পর্কে সে কোনো আগ্রহ বোধ করবে না? জীবনকে যে এত আন্তরিকতা দিয়ে তোমাদের সামনে তুলে ধরছে—কী করেই বা সে জীবন থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখবে? না, ঘর সাজানোর জন্যে ছবি আঁকা হয় না। শত্রুকে আক্রমণ করার জন্যে বা শত্রুর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্যে ছবি আসলে যুদ্ধের হাতিয়ার।’

 এই অসামান্য কথাগুলি যাঁর, তিনি বিশ শতকের কিংবদন্তি শিল্পী পাবলো পিকাসো। ১৯৩৭-এর ২৬ এপ্রিল জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নির্দেশে জার্মান বিমান বাহিনী স্পেনের ছোট্ট শহর গুয়ের্নিকার উপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে তাকে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছিল। আর, এর ঠিক ছদিন পরে পিকাসোতার বিশ্ববিখ্যাত মুরালের কাজ আরম্ভ করেন। বোমাবিধ্বস্ত গুয়ের্নিকার নামে ছবিটির নাম রাখেন তিনি। এতে প্রমাণিত হয়েছিল, মানুষের সপক্ষে ও অন্ধকারের অপশক্তির বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করাই শিল্পীর প্রধানতম দায়িত্ব। একুশ শতকের প্রথম বছরে আফগানিস্থানের সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, শিশুদের পাঠশালা যখন শক্তি-দম্ভে উন্মাদ মার্কিন বোমায় ও ক্ষেপণাস্ত্রে ধ্বংস হয়ে গেল—পিকাসোর উত্তরাধিকারীরা কোথায় ছিলেন? তবে কি চৈতন্য পুরোপুরি অসাড় হয়ে গেছে আমাদের?

 এই আর্ত প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছে কয়েক বছর ধরে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও ভিন্ন মতবাদের অধিকারকে নির্মম তাচ্ছিল্যে অস্বীকার করে ইঙ্গ-মার্কিন সমরশক্তি যখন ইরাকের জনপদের পরে জনপদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেয়-বেয়নেটের বিরুদ্ধে ফুল ও পায়রা ছুঁড়ে দেওয়ার মতো কোনও সংস্কৃতি-কর্মী কি থাকে না কোথাও?

 এই জিজ্ঞাসা থেকে ফিরে যেতে হয় মৌলিক আদি-প্রশ্নে:সংস্কৃতিকি? সাংস্কৃতিক আন্দোলন কেন, কাদের জন্যে? এতে ভাবাদর্শের গুরুত্ব কোথায়? না, এ আদপেই কোনও তাত্ত্বিক প্রশ্ন নয়, অত্যন্ত জরুরি প্রায়োগিক বাস্তবের বিষয়। কিছুদিন থেকেই বেশ কিছু কথা মনে কাটার মতো বিধছে। আমাদের এই প্রান্তিক বরাক উপত্যকায় যেমন, তেমনই উদ্ভাসিত কোনও অঞ্চলেও যাঁরা গানে-নাচে-নাটকে অত্যন্ত জোরালো ভাবে প্রগতিশীল মর্মবস্তুর পোষকতা করেন, তাঁদেরই কেউ কেউ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেন, না বাপু, রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা এল বা কারা গেল, তাতে আমাদের কী, আমরা তো গাইব, লিখব, নাটক করব; সাংস্কৃতিক দায়িত্ব আন্তরিকভাবে যদি পালন করি, রাজনীতির মারপ্যাচ নিয়ে মাথা ঘামাব কেন? কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের দখলে গেছে, তাদের কাছাকাছি থাকলে আমাদের সাংস্কৃতিক কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে যদি সুবিধা হয়, তাহলে ক্ষতি কী? আমরা তো কৌশল হিসেবে সমঝোতাকে মান্যতা দিচ্ছি। সাময়িক ঝড় যদি উঠে থাকে সমাজে, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে না-হয় আত্মরক্ষাই করলাম। অন্তত ঝড়ের মুখে কুটোর মতো ভেসে তো যাইনি।

 এইসব গাইয়ে-নাচিয়ে-লিখিয়েদের সাংস্কৃতিক কাজ-কর্মে আন্তরিকতায় কিন্তু কোনও খাদ নেই। অথচ এঁরা মারাত্মক ভ্রান্তির শিকার। এঁরা আসলে ভাবাদর্শের অনস্বীকার্য অস্তিত্বের গুরুত্ব গভীরভাবে অনুধাবন করেননি। আবার এইসব আন্তরিক অথচ বিভ্রান্ত সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে সহাবস্থান করতে গিয়ে কোনও কোনও সংস্কৃতি-সেনানী নিজের অগোচরেই আত্মিক অবসাদের চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে আরম্ভ করেন। ভাবাদর্শের উত্তাপও তাদের আত্মহননের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। তখন মধ্যাহ্নে সূর্যাস্তের উপক্রম হয়। কেন এমন ঘটে? ঘটে এইজন্যে যে প্রাগুক্ত দু-ধরনের কূটাভাস শেষোক্তদের বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তিকেও একটু একটু করে শিথিল করে দেয়। যাদের সাহচর্যে সংস্কৃতির যুদ্ধ শানিততর হওয়ার কথা ছিল, তাদের পিছিয়ে পড়া কিংবা সাফল্যের হাতছানিতে মুগ্ধ হওয়া অনুভব করতে করতে এঁরা মানবিক উত্তরণ সম্পর্কে অবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। অথচ নিজেদের কাছে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার লক্ষ্যভ্রষ্টতা স্বীকারও করতে পারেন না। এই অন্ধবিন্দুমূলত সময়েরই সংকট, এটা অনুভবে জেনেও ভাবাদর্শের জোর ও প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন। আর, তেমন মুহূর্তে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন যাতে বহুদিনকার সাংস্কৃতিক উদ্যম এবং সেই উদ্যমে তাদেরই গৌরবজনক ভূমিকা নিরাকৃত হয়ে যায়। এ আসলে ব্যক্তিবাদী ঝোকের এমন একটি ধরন যা সাধারণত বিশ্লেষণের বিষয় হয় না।

 একুশ শতক যে নির্মানবায়ন, নিশ্চিহ্নায়ন ও ভাবাদর্শ-রিক্ততার অন্ধকূপ হয়ে উঠবে—তার যথেষ্ট ইঙ্গিত ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। অতএব সংস্কৃতি কী ও কেন—অনেক পুরনো এই প্রশ্নের সময়োপযোগী মীমাংসা চাই। এ চেষ্টা তাত্ত্বিকেরা করতেই পারেন; কিন্তু প্রয়োগের মধ্য দিয়ে যা অনুভব করছি, তা-ই মাননীয়। কেননা সংস্কৃতি মানে উপস্থাপনার কৃতি। অতএব সক্রিয় হতে গিয়ে যদি মঞ্চশোভন হওয়ার নেশায় মদির হই এবং প্রভাব ছড়িয়ে দেওয়ার তাড়নায় পণ্যায়নের যুক্তিশৃঙ্খলার সঙ্গে আপস করি—তাহলে সর্ষের ভেতরে ভূত ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কাই সত্য হয়ে উঠবে। এইজন্যে আদি-প্রশ্নটির উত্তর একই সঙ্গে সরল ও জটিল। যদি ভাবি, সংস্কৃতি মানে নাচ-গান-ছবি-কবিতা-নাটক কিংবা সমস্যাদীর্ণ পৃথিবী থেকে ছুটি নিয়ে বিনোদনের মুহূর্ত-যাপন: তাহলে একে বলব সরল উত্তর। একে মিথ্যা বলা যাবে না হয়তো কিন্তু তা পুরোপুরি সত্য নয়। সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক থাক আপাতত। তবে একটা কথা নিশ্চয় বলা যায়: সংস্কৃতি মূলত সময়ের দর্পণ, সময়ের সন্তান। যদি বলি, সময়ে তো বিদূষণও থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এও বলা প্রয়োজন যে দূষণ মুক্তির স্বতশ্চল আয়োজন সময়ের ভেতর থেকেই উঠে আসে। সংস্কৃতিতে মাঝে মাঝে বিপন্নতার কালো ছায়া ঘনিয়ে এলেও দ্বিবাচনিকতার অমোঘ নিয়মে সূর্যালোকের স্বচ্ছতাই তার স্থায়ী ভাব।

 প্রতিদিন নতুন সূর্য উঠে আসে। নতুন দিন মানে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন উপলব্ধি। অভিজ্ঞতা অনবরত পাল্টে যাচ্ছে, অতএব সংস্কৃতি-চেতনাও বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। এই পরিবর্তন বিষয়-বস্তুতে ধরা পড়ে সহজে, প্রকরণে বদল ঘটে দেরিতে। জীবন-পথে চলতে চলতে আমরা সঞ্চয় করি, প্রকাশের তাগিদ অনুভব করে সেই সঞ্চয়কেই আবার পরখ করে নিই। যা কিছু আমাদের জীবনের এগিয়ে যাওয়ার গতি ও আগ্রহের সঙ্গে মানানসই নয়, তাকে ত্যাগ করি; ততটুকুই ধরে রাখি যা চলমান সময়ের সঙ্গে; থাকে। সব কিছুরই কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ, অপরাজেয় মানুষ; বিচিত্র ঘটনার সঙ্গে সংঘর্ষে হয়তো ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়ায়, একাধিক বিকল্প সম্ভাবনার সামনে এসে দ্বিধা ও সংশয় বোধ করে, সাময়িক পরাজয় হলেও পর্যদস্ত হয় না কখনও। গভীর-গভীরতর অন্ধকারের পর্যায়ের পরেও কতবার মানুষ তাই নতুন আলোর ইঙ্গিত নিয়ে এসেছে। এই পথ চলা ও আলোয় ফেরার আনন্দ-ই হল সংস্কৃতি।

 শুধুমাত্র এই সংস্কৃতির অমেয় শক্তিতেই মানুষ পশুর চেয়ে আলাদা। মানুষের মধ্যে কিন্তু জান্তব পিছুটান রয়ে যায় যা আজকের ভোগবাদী সমাজে অত্যন্ত স্থূলভাবে প্রকট। জান্তব প্রবৃত্তির লজ্জাহীন অভিব্যক্তি ইদানীং সভ্যতার সমার্থক হয়ে পড়ছে এবং সাধারণ মানুষের চেতনাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিচ্ছে। এটাই সবচেয়ে শঙ্কার কারণ। ব্যক্তি-সর্বস্বতার সাম্প্রতিক উৎকট পর্যায়ে অন্ধ প্রতিযোগিতা শুধু নিজেকে জাহির করার জন্যেই। এহেন পরিস্থিতিতে তাকেই বলব সাংস্কৃতিক রুচিসম্পন্ন মানুষ, যে সমষ্টি-চেতনায় দীক্ষিত হয়ে নিজেকে মুছে ফেলতে জানে। তার মানে অবশ্য ব্যক্তিত্বকে গ্রাস করা নয়, সমষ্টির সঙ্গে দ্বিরালাপে ব্যক্তির ক্রমিক ঊর্ধ্বায়ন। এইজন্যে সংস্কৃতি এক যুদ্ধের নাম, বলা ভালো, যুদ্ধ-প্রস্তুতির নাম। এই লড়াই প্রথমত নিজের সঙ্গে বলে সচেতন ভাবেই লড়াই জারি রাখতে হয়। যে-পরিমাণে মানুষ জান্তব প্রবৃত্তির হাতছানি এড়িয়ে নিজেকে উত্তরায়নের পথে সঞ্চালিত করে—ঠিক ততটাই গড়ে ওঠে তার রুচি, তার সৌন্দর্যবোধ, তার সংস্কৃতি। এইজন্যেই সংস্কৃত ভাষার এক কবির বয়ান অনুসরণ করে বলা যায়, মানুষের মনুষ্যত্বের একটি বড় প্রমাণ হল তার সংস্কৃতি-চেতনা। মানুষের মধ্যে যেহেতু অনবরত চলে পশু-সত্তার আনাগোনা, সংস্কৃতি দিয়েই মানুষের অবমূল্যায়ন রোধ করতে হয়। বিশেষত কোনও সামাজিক দুর্যোগের মুহূর্তে বহুযুগের জমে-ওঠা অন্ধকার যখন পশুর হিংস্রতা নিয়ে মানুষের পৃথিবীকে ছিড়ে-খুঁড়ে তছনছ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে—তখনই টের পাওয়া যায়, সংস্কৃতির কত প্রয়োজন। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের পরে ভারতবর্ষ যেমন টের পেয়েছিল। বুঝেছিল, সংস্কৃতি নিছক কবিতা-নাটক-গান-গল্প-ছবি কিংবা আত্ম-সন্তুষ্টির আয়োজন নয়, সমস্ত কুশ্রীতা ও আত্মিক দৈন্যের আস্ফালনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের তীক্ষ্ণ অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহার করতে গিয়েই বেঞ্জামিন মেলোয়েজ, সফদার হাসমি, ব্রজলাল অধিকারীর মতো সংস্কৃতি-যোদ্ধারা ইতিহাস হয়ে যান। এই অস্ত্র সম্বল করেই পল রোবসন, পিট সিগারেরা দেশ-জাতি-ভাষা-ধর্ম-বর্ণের সীমানা পেরিয়ে যান অনায়াসে।

 আধুনিকতা যখন অবক্ষয়বাদের চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছিল, ভাবাদর্শকে নস্যাৎ করার জন্যে কখনও ঠাট্টা-মস্করা আর কখনও ধূর্ত অপতত্ত্ব ব্যবহার করার প্রবণতা ছিল। সংস্কৃতিকর্মীদের দায় শুধু নাচ-গান-নাটক আয়োজনের উপযোগী সংগঠন করেই ফুরিয়ে যায়নি; প্রগাঢ় আবেগে বিশ্বাসের আলো জ্বালিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কর্তব্য শেষ হয়নি। তাদের সতর্ক থাকতে হয়েছিল অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের প্রকাশ্য ও গোপন সন্ত্রাস সম্পর্কেও। জীবন-যাপন ও সমাজ-সংস্থানের প্রতিটি স্তরে সর্বাত্মক 1 সংগ্রাম অব্যাহত না রাখলে যে-কোনও অসতর্ক মুহূর্তে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আত্মরতির মোহিনী মায়া ছড়িয়ে আধিপত্যবাদ কত প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন সংস্কৃতি-সেনানীকে পথভ্রষ্ট করেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। আবার গণনাট্য আন্দোলনের উপলবন্ধুর পথ চলার ইতিবৃত্ত যদি লক্ষ করি, দেখব, ভোগবাদ ও পণ্যায়নের অজস্র চোরা-ফাদ এড়িয়ে গিয়েই জনতার মুখরিত সখ্যকে তা ধ্রুববিন্দু করে নিতে পেরেছে। গত ছয় দশকে ভাবাদর্শকে নাকচ করার কম আয়োজন ছিল না। তবু পথে নেমে পথ চিনে নেওয়ার প্রক্রিয়া থেমে যায়নি। বিশেষত গত এক দশকে আধুনিকোত্তরবাদী পর্যায়ের বৌদ্ধিক সন্ত্রাস ও প্রতিভাবাদর্শের আক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে সংস্কৃতির যুদ্ধ পুরোপুরি নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে। নিঃসন্দেহে সময় এখন আরও জটিল আবর্তময়। তাই সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের নিবিড় গ্রন্থনার তাৎপর্য বোঝার জন্যে নতুন নতুন প্রায়োগিক কৃৎকৌশল আবিষ্কার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যুদ্ধটা যখন নতুন, যুদ্ধের পুরোনো আয়ুধও অচল। ইদানীং সংশয় ও আপস যেভাবে আত্মিক আঁধি তৈরি করছে, তাতে মনে হয়, পীড়া সংক্রমণের কারণগুলিকে এবার নতুন চোখে দেখা শুরু করতে হবে। আর, সেইসঙ্গে পীড়া উপশমের জন্যে এবং সংস্কৃতিচর্যার মধ্যে ভাবাদর্শের নির্যাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে পুরোপুরি নতুন ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।

 বয়ানে কি ঔচিত্যের প্রসঙ্গ বেশি চলে এল! আসলে ঔচিত্যবোধ মানেই প্রত্যাশার নতুন দিগন্ত আর উদ্ভাসনের নতুন পরম্পরা। সংস্কৃতি-কর্মীরও তো স্পষ্ট একটা লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষ্য সম্পর্কিত ধারণাকে মাঝে-মাঝে পুনর্নবায়িত করে নিতে হয়। নইলে নিজেদের অগোচরে আত্মিক অবসাদ তৈরি হবে; ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সত্তার মধ্যে আকস্মিকভাবে দেখা দেবে অনন্বয়ের কুয়াশা। অতএব পুরনো বোতলে নতুন পানীয় নয়, নতুন আধারে নতুন আধেয় পরিবেশন করার জন্যে সংস্কৃতিকর্মীদের সব সময় জেগে থাকতে হবে। এখানেই ভাবাদর্শ খুব প্রাসঙ্গিক, কারণ ভাবাদর্শ মানে যা আমাদের জাগিয়ে রাখে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত একটি গান ব্যবহার করে বলা যায়, হিমের রাতে গগনের দীপগুলিকে হেমন্তিকা যখন আড়াল করে—তখন তা ঘরে-ঘরে বার্তা পাঠায়: জ্বালাও আলো আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীকে! আধুনিকোত্তর পণ্য-সর্বস্ব জগতে সংস্কৃতিকর্মীকে লক্ষ করতে হয়, কীভাবে তার জগৎকে প্রতিজগৎ ও বাস্তবকে প্রতিবাস্তব করে ভোলা হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। বস্তুত একই সঙ্গে ইদানীং তাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভাবাদর্শহীনতা ও প্রতিভাবাদর্শের সঙ্গে। চূড়ান্ত ভোগবাদী অন্ধ সমাজ যখন প্রতিদিনই চোরাবালির পরিধি বাড়িয়ে চলেছে, উপগ্রহ-প্রযুক্তির বিশ্বায়ন হওয়ার ফলে দূরদর্শন ও কম্পিউটার ঘরে-ঘরে নিয়ে আসছে জ্ঞানশূন্য তথ্যের বুদ্বুদ ও রঙিন মিথ্যায় ভরা বিনোদন-সংস্কৃতি-কর্মীর যুদ্ধ এখন মঞ্চ থেকে সরে এসেছে প্রতিটি গৃহকোনে।

 এ সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়ানোর নয়। এ সময় নতুন করে যুদ্ধাস্ত্রে শান দেওয়ার। একথা মনে রেখে, যুদ্ধ কেবল বাইরে নয়, যুদ্ধ ভেতরেও। যুদ্ধ প্রকাশ্য নয় শুধু, যুদ্ধ গভীর গোপনেও। একবার যে সংস্কৃতির গাণ্ডীব তুলে নিয়েছে হাতে, অক্ষয় তৃণীরের সমর্থন সম্পর্কে এক মুহূর্তের জন্যেও ভরসা হারালে চলবে না তার। নিজেকে অনেক সময় আমরা নিজেরাই প্রতারিত করি, কুযুক্তিকে ভাবি যুক্তি, পিছিয়ে-পড়াকে ভাবি রণকৌশল। ভুলে যাই, একটি পথই খোলা সংস্কৃতি-কর্মীর: সে-পথ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। থমকে দাঁড়ানো মানে পেছন-পায়ে হাঁটা, সে-পথ অন্ধকার কৃষ্ণবিবরে নিয়ে যায় শুধু। সমস্ত উদ্যম, সমস্ত অর্জন, সমস্ত উত্তাপ শুষে নিয়ে তা সংস্কৃতিকর্মীকে শেষ পর্যন্ত প্রতিভাবাদর্শের অন্ধকূপে বন্দী করে ফেলে। আধুনিকতাবাদী বিমানবায়নের বিরুদ্ধে যাঁর ঘোষিত যুদ্ধ ছিল, আধুনিকোত্তর নির্মানবায়ন পর্যায়ে তিনি কি যুদ্ধকে অস্বীকার করবেন? কল্পিত কিংবা বাস্তব কোনও অজুহাতে আত্মপ্রতারক যুক্তিশৃঙ্খলা সাজিয়ে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াবেন? তাহলে সেই পুরোনো প্রশ্নেই তো ফিরে যেতে হয় আবার: সংস্কৃতি তবে কী? সাধারণভাবে সংস্কৃতির এবং বিশেষভাবে গণনাট্যের ইতিহাস প্রমাণ করে: মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক কিংবা ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিকতার সেতু যখন কালো মেঘের ছায়ায় আবিল হয়ে ওঠে, সে-সময় সংস্কৃতিই নিয়ে আসতে পারে সূর্যোদয়ের অরুণাভাস। তাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দিনে কত গান কত নাটক সৃষ্টি হয়েছিল আজও যা আমাদের প্রেরণা দেয়। সংগ্রাম ও সৃষ্টির যুগলবন্দিতে প্রমাণিত ভাবাদর্শের অপরিহার্যতা। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও আগ্রাসী নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ আজ যদি তুঙ্গে ওঠে, সংস্কৃতি কখনও পিছিয়ে থাকতে পারে না কিংবা দ্বিধাগ্রস্তও হতে পারে না।

পুনরুজ্জীবিত সংস্কৃতিই ফিরিয়ে আনতে পারে মানব-সম্পর্কের স্বাভাবিকতা ও মানবিক বিকাশের ধারাবাহিকতা। রুটির লড়াই থেকে রুচির লড়াই যে আলাদা নয়, এই উপলব্ধি জাগাতে পারে সুস্থ সংস্কৃতি-চেতনা। সুস্থ’ শব্দটি ব্যবহার করছি কারণ সংস্কৃতির নামে পঙ্গু, অবান্তর ও বকচ্ছপ ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে অসুস্থতার বিকার মানবিক বিকাশের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের আচার আচরণে, সংস্কার ও বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়ায় ওই বিকার খুব দ্রুত শেকড় ছড়ায় আজও, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বোধ নিতান্ত বাইরের প্রচ্ছদ হয়ে থাকে। বিপদের এই একটা দিক। আবার, বিপদের অন্য আরেকটা দিক হল, সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে চিন্তার স্বচ্ছতা কখনও কখনও হারিয়ে যায়, কূপমণ্ডুক অভ্যাসের সঙ্গে আপস করতে করতে লড়াইয়ের ইচ্ছাও বজায় থাকে না। শুরুতে লিখেছিলাম, সংস্কৃতি সময়ের সন্তান এবং সময়-প্রহরী। এখানে আরেকটি কথা বলা যাক, সময়েরও রয়েছে দুটো অবয়ব ও স্বভাব। আপাতকাল ও প্রকৃতকাল বলে এদের চিহ্নিত করতে পারি। সংস্কৃতি যেহেতু নীতি ও কৌশলের ওপর নির্ভরশীল, আপাতকাল থেকে অর্জিত প্রতীয়মান অভিজ্ঞতা ও প্রকৃতকাল সম্পৃক্ত উপলব্ধির দ্বিরালাপ সম্পর্কে সংস্কৃতিকর্মীর সচেতন থাকতেই হয়। প্রতীয়মানের প্রতি মনোযোগী হওয়াটা কৌশলের অঙ্গ, কিন্তু এইজন্যে বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় উদ্যম সঞ্চালিত করার নীতি সম্পর্কে শিথিলতা দেখানো চলে না। কিন্তু আমাদের চারপাশে মাঝে মাঝে দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, যা অতিসরলীকরণের সংক্ষেপিত পথে চটজলদি জনতা-সফল হতে চায়।

 সমসাময়িক সমস্যার মনোরঞ্জক সমাধানের আত্মপ্রতারণায় এবং গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা ও উপলব্ধির অভাবে মোটা দাগের পথ ধরে চলতে চান কেউ কেউ। এদের সংস্কৃতি-চিন্তায় তাৎক্ষণিকের দাবি মেটানোর তাগিদ অত্যন্ত প্রবল বলে স্ফুলিঙ্গ-ধর্মী আয়োজন উড়ে গিয়েই ফুরিয়ে যায়। পথ তাই হারিয়ে যায় নিচ্ছিদ্রভাবে অন্ধকারে। গভীরে হাত রাখতে এরা অপারগ, মঞ্চসাজ তাই ভেঙে যায় বারবার। সংস্কৃতিকর্মীদের এখনও সমাজ আলাদা চোখে দেখতে চায়। মঞ্চের বাইরে ও ভেতরে মানুষটি একই রকম কিনা—তা বুঝতে চায়। গানে-নাচে-নাটকে যে-বিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছে, সেই ভাবাদর্শের উপযোগী আচরণ সংস্কৃতিকর্মীদের জীবন-যাপনে পাওয়া যাচ্ছে কিনা, তা সমাজের সদা সতর্ক চোখ লক্ষ করে যাচ্ছে। তাই সাংস্কৃতিক চর্যা ও জীবনচর্যায় একই ভাবাদর্শের বিচ্ছুরণ না ঘটলে সংস্কৃতি হয়ে থাকবে নিছক প্রেক্ষাগৃহে পিঞ্জরায়িত। অতএব সব সংস্কৃতিকর্মী সময়-সেনানী নন; তাদের মধ্যেও রয়েছে আপাত ও প্রকৃতের বিভাজন। প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মী তারাই, যাঁরা অজ্ঞাতসারেও রক্ষণশীল অচলায়তনের গ্রাসে পড়েন না এবং যে-কোনও মূল্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন। তারা প্রতিবাদী ও প্রতিরোধমনস্ক। তারা জানেন, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হলেও তাতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য, নানা কৌনিকতা, নানা চড়াই-উৎরাই। তারা এও জানেন, ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেই সংকট; নিজেকে ‘বিরূপবিশ্বে নিয়ত একাকী’ ভেবে নিজের মুদ্রাদোযে নিজেরই শুধু আলাদা হয়ে যাওয়া।

 অথচ মানুষ নিজের শ্রমে সভ্যতার যে-ইমারত গড়ে তুলেছে, তা যৌথ জীবন-যাত্রা ও যৌথ উদ্যোগের ফসল। মানুষ যখন একাকী, মূলত তখনই সে বিভ্রান্ত। তাই শুভ কর্মপথে চলতে চলতে তাকে অবসর যাপন বা বিনোদন করতে হয়েছে যৌথভাবে, সঙ্গে সঙ্গে গড়ে তুলেছে যৌথ উৎসব ও যৌথ সংস্কৃতির রীতিনীতি। সময়ের সঙ্গে পাকে-পাকে বাঁধনে জড়িয়েছে নিজেকে, আবার বাঁধন খুলতে খুলতে এগিয়েছে। মাটিতে পা রেখে তার আকাশপানে চাওয়া, আবার আকাশ বিহারে ক্লান্ত হয়ে মাটির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে আসা। ব্যক্তি যুক্ত হতে চায় সমষ্টির সঙ্গে, কিন্তু বিযুক্তির যন্ত্রণাও সইতে হয় তাকে। জীবন চায় বিস্তার অথচ পদে পদে কেবলই সংকোচন, বিচ্ছেদ ও মৃত্যুর ভ্রুকুটি। সময়ের যে-যাত্রার কথা একটু আগে লিখেছি, তার মধ্যে কোনটা চিরকালীন আর কতটাই বা চিরকালীনতা, মানুষই তার রুচি ও প্রয়োজন মাফিক ঠিক করে নেয়। তার সংস্কৃতি-চিন্তায় তাই কিছু কিছু ধ্রুববিন্দু অর্থাৎ ভাবাদর্শের গ্রন্থনা থাকবেই পুড়েও যা পোড়ে না, বিক্ষত হয়েও যা বিদীর্ণ হয় না। আবার সমসাময়িক অভিজ্ঞতাও উপেক্ষা করা চলে না। মান্যতা দেওয়ার জন্যে নয়, অবহিত হওয়ার জন্যেও। কিন্তু যৌথ উপলব্ধি ও যৌথ উদ্যোগে যেসব সংস্কৃতি-যোদ্ধারা বিশ্বাসী, তারা ক্ষণিকের মুঠি দাও ভরিয়া’ বলে থেমে যান না; প্রকৃত কালের চিহ্নায়কগুলিকে শনাক্ত করতে চান। নইলে মন্থর হবে যে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার গতি, ক্ষণকালের প্রতি অতি প্রশ্রয়ে সহস্র শৈবালদাম এসে বাঁধবে স্বপ্নময় আকাঙ্ক্ষাকে—এসম্পর্কে তারা সচেতন। তাই তাদের সংগ্রাম নিরন্তর ভেতরে ও বাইরে চলতে থাকে ভাবাদর্শহীনতার নৈরাজ্য ও প্রতিভাবাদর্শের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। চলতে থাকে আত্মদীপ হয়ে ওঠার জন্যে, বহুবাচনিক জগতের দীপাধার হওয়ার জন্যে। তাদের দায়বদ্ধতা সেই সৃষ্টির কাছে যা দ্বন্দ্বময় সংগ্রামের ভাষা, আবার সেই সংগ্রামের কাছেও যা সৃষ্টির প্রেরণায় ছন্দোময়।

 সংস্কৃতি কেন: এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর চাইতে গেলে আগে ঠিক করে নিতে হবে আমাদের বিশ্ববীক্ষা কী? অর্থাৎ কোন দৃষ্টিতে জীবনকে দেখছি আমরা? বাস্তব অভিজ্ঞতার বাস্তব বিশ্লেষণ করছি নাকি মনগড়া ভাবনায় বুদ হয়ে কল্পলোকের কথকতা করছি! এবং, করছি কাদের স্বার্থে? সংস্কৃতি-চর্চায় আমরা যদিও স্বাধীনতার দোহাই দিই, আসলে আমরা কতটা স্বাধীন! অর্থাৎ কোনও অদৃশ্য বাজিকরের পুতুলনাচনের খেলায় মোহগ্রস্ত হয়ে আমরা নাচন-কোঁদন করা পুতুলদের মধ্যে ঢুকে পড়িনি তো! একদিকে সাগর-পারের মুরুব্বিদের চোয়া চেঁকুর এবং অন্যদিকে স্বদেশি মৌলবাদী পাঁচন—এতদিন এদের সঙ্গে সহাবস্থান করে এবার কীভাবে সম্মিলিত ফ্যাসিবাদী ফাস এড়িয়ে যাব? নতুন সময় মানে নতুন ফাঁদ এবং নিশ্চয় ফাঁসুড়েদের আক্রমণ প্রতিহত করার নতুন কৌশলও। নতুন সময়ে নতুন ভাবে নির্ণীত মূল্যবোধের জন্যে আমাদের সাংস্কৃতিক বিশ্ববীক্ষাকেও নতুনভাবে বিন্যস্ত করে নিতে হবে। কতদিন আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াইনি। নিত্য নতুন মুখোশ পরার প্রবণতায় আমরা নিজেরাই প্রকৃত মুখকে ভুলে থেকেছি কতদিন! ফাঁপা বৌদ্ধিকতার গর্বে চলিষ্ণু জনতার জীবন-প্রবাহ থেকে সরে দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক চেতনাকেও লাঞ্ছিত করেছি। সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষয়কে আমরা যদি যথাপ্রাপ্ত বাস্তব বলে মান্যতা দিই, তাহলে তা তো বৈধতা পাবেই। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ক্ষয়িষ্ণুতার টীকা-টিপ্পনি- ভায্যের-কূটকচালিতে ব্যস্ত রয়েছেন। অথচ ব্যাপক জীবন-বিরোধী ষড়যন্ত্রের স্বরূপ অস্পষ্ট ছিল না কখনও। মুনাফা-লোভী সামাজিক বর্গের প্রয়োজনে সমস্তই পণ্য। দ্রুত পণ্যায়নের জন্যে সস্তা ও প্রগলভ চালাকি নিরঙ্কুশ এখন। মুখ সত্যিই ঢেকে গেছে বিজ্ঞাপনে।

 সংস্কৃতির সুপেয় ধারাকে মরুপথে চালিয়ে দিয়ে বিষাক্ত অপেয় করে তোলা হচ্ছে। মুষ্টিমেয় পরশ্রমজীবীর বিনোদন-সামগ্রী হিসেবে সংস্কৃতির আদলমাত্র অটুট রেখে নির্যাস নিঙড়ে নিয়ে তার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। উৎকট পণ্য হয়ে ওঠার জন্যে প্রকরণের উদ্ভট সপ্রতিভতাই যথেষ্ট। শাসক-প্রভুর উচ্ছিষ্টজীবী কৃষ্টি-ব্যবসায়ীদের মর্জিমাফিক উৎপাদিত হচ্ছে না-সংস্কৃতি। গণমাধ্যমগুলির উপরে একচেটিয়া দখলদারির সুবাদে সাধারণ মানুষের রুচিবোধ ও জীবনভাবনা এখন এদের লাগাতার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। এখন তৃষ্ণার আরেক নাম পেপসি, উচ্ছলতার আরেক নাম কোকাকোলা। এরকম অজস্র পণ্যনাম দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে দৈনন্দিনের নামাবলী। প্রতিটি ক্ষেত্রে সুচতুর ভাবে কৃষ্টির একটা আদল মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যে।

 এমন একটা সময় ছিল যখন বিনোদন মানে নিছক সুখের আবেশ ছিল না, তা ছিল গণমনের প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু এখন বিনোদন মানে শুধু পণ্য। যৌথচেতনায় আলোড়ন তোলে না আর পণ্যায়িত না-সংস্কৃতি। সর্বজনীন গ্রহীতার বদলে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ একক গ্রহীতার আত্মরতির সহায়ক হওয়াই তার অন্বিষ্ট। এতে অবশ্যম্ভাবী সংযোগের সামাজিক ও নান্দনিক তাৎপর্য হারিয়ে যাওয়া, ভাবাদর্শের অবান্তর হয়ে যাওয়াও। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেহেতু পৌছে গেছে ছদ্ম-সংস্কৃতির মাদক, চিরাগত পরম্পরা ধ্বস্ত হয়ে গিয়ে চিন্তা-চেতনার অনন্যতা দ্রুত মুছে যাচ্ছে। সংস্কৃতির সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত হয়ে যাচ্ছে সত্য-মিথ্যা-ভালো-মন্দ-ন্যায়-অন্যায়ের প্রসঙ্গ। জানি, ‘মেঘ ক্ষণিকের চিরদিবসের সূর্য, কিন্তু এই উচ্চারণ করে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকলে তো চলবে না। সূর্যোদয়কে ত্বরান্বিত করা আমাদেরই দায়। অন্ধকারকে অন্ধকার বলে চিহ্নিত যেমন করব, তেমনি তার বিরুদ্ধে প্রত্যয় ও উদ্যম গড়ে তোলার জরুরি দায়িত্বটি এড়িয়ে যাব না। ভুলব না যে সংস্কৃতির প্রশ্নটি আসলে মানুষের সপক্ষে দাঁড়ানোর প্রশ্ন, জীবন ও জগতের নিরন্তর পুনর্নির্মাণের প্রশ্ন, ভাবাদর্শের তাৎপর্য বুঝে নিয়ে তার প্রতি অবিচল থাকার প্রশ্নও।

 আর, ঠিক এখানেই সঠিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রাণবান করার জন্যে জোট বাঁধার প্রশ্নটি এসে পড়ে। কী ও কেন আসলে একসূত্রে গাঁথা। বৃহত্তর জনজীবনের প্রাঙ্গণে পৌছাতে চাই আমরা, সুস্থ ও উদ্দীপ্ত জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সংস্কৃতি আমাদের পাথেয়। মূলপথের পাশ কাটিয়ে শাখা-পথ ধরে যাঁরা তথাকথিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান, তাঁরা ভ্রান্ত। স্রোত যদি ভুল উচ্ছ্বাস তৈরি করে, প্রাণপণ শক্তিতে যেতে হবে স্রোতের উজানে। দেশ-কাল সাময়িক উত্তেজনায় ভুল আবেগ তৈরি করতেও পারে, জনমানসে দেখা দিতে পারে ঘুম-পাড়ানো নিদালির ঘোর; ক্রান্তিকালে এরকম হতেই পারে যে আঁধিতে আলোকরেখা আচ্ছন্ন হচ্ছে এবং সাময়িক সুবিধার হাতছানিতে, এমন কি, পিছিয়ে-পড়াকেও মনে হতে পারে এগিয়ে যাওয়ার শর্ত! প্রগতির নামে প্রতিগতির কাছে নিজেদের বিশ্বাসকে হার-মানানোর এই ভয়ংকর পরীক্ষার মুহূর্তে সঠিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমাদের দৃঢ় ও অবিচল রাখতে পারে। যদি কখনও এমন হয় যে সর্বতোভাবেই অন্দরের সঙ্গে বাহিরের বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—তখনও সঠিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমাদের পথ দেখাতে পারে।

 কাকে বলছি সঠিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন? যাতে সূচনায় ভাবাদর্শ, বিকাশেও ভাবাদর্শ; অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার টালমাটাল পর্যায়েও ভাবাদর্শ। এই আন্দোলন রুটি ও রুচির লড়াইকে অভিন্ন পথের দুই অভিব্যক্তি বলে জানে এবং জানে বলেই শেকড়ের সঙ্গে সংযোগ ভুলে যায় না কখনও। কোনো জোড়াতালির বাঁধ দিয়ে দুঃসময়ের আত্মবিস্মৃতিকে ঠেকাতে চায় না, শাসক প্রভুদের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্যেও আপস করে না কখনও। আধুনিকতা বা আধুনিকোত্তরবাদের নামে চটকদার মোড়কে না-ভুলে অবক্ষয় ও নির্মানবায়নের চোরাবালিকে চিনিয়ে দেয় এবং উত্তরণের পথ আবিষ্কার করার জন্যে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের উপকরণ খোঁজে বহমান জীবনের ধারায়। স্বভাবত ওই সাংস্কৃতিক আন্দোলন শ্রেণী-চেতনার বিকাশ ছাড়া হতে পারে। আর, শ্রেণী-চেতনার উদ্ভব হতে পারে না ভাবাদর্শের পুষ্টি ছাড়া। ভাবাদর্শ মানেই প্রতিটি কাজে ও চিন্তায় ভরকেন্দ্র খুঁজে পাওয়া। তাই যে-পরিমাণে শ্রেণী-চেতনায় ঘাটতি দেখা দেয়, ঠিক সেই অনুপাতে দ্বিধা ও দোলাচলের শিকার হয় সংস্কৃতি-চর্চা। উদভ্রান্ত সাময়িকতার চাপে হারিয়ে যায় পথরেখা। প্রতিগতি ও প্রতিক্রিয়ার গোপন ও প্রকাশ্য আগ্রাসন এখন আরও নির্বাধ। তাই পথ হারানোর শঙ্কাও বেড়ে গেছে অনেক। এখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য স্মরণ করা যায়:‘সময় যদি দিন মাস বছর না হয়ে একটি সামাজিক পর্যায়রূপে স্বীকৃত হয়, তাহলে তেমন একটি পর্যায়ে কোনো-না-কোনো সংস্কৃতির প্রগতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এজন্যই প্রতিক্রিয়াকে না-চিনে প্রগতিশীল সংস্কৃতির চর্চা সাফল্য নিশ্চিত করে না!’ গুরুত্বপূর্ণ এই মন্তব্যের সূত্রে বলা যাক, সঠিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাকেই বলব, চিন্তা-চেতনায় আঁধি ও নৈরাজ্যের আভাস দেখা দিলেও যা সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানগুলিকে নির্দ্বিধায় ও গভীর প্রত্যয়ে চিনিয়ে দেয়। আর, আত্মিক অবসাদের হিম-ঋতু দেখা দিলে যা ভাবাদর্শের আগুনে নতুন সমিধ যোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করে, প্রগতির পথে আপসহীন পরিক্রমায় সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত সংস্কৃতি-সেনানীদের অনুপ্রাণিত করে।

 হ্যাঁ, সংস্কৃতি-সেনানী আসলে ভাবাদর্শের যোদ্ধা। সাংস্কৃতিক সংগ্রাম সৃষ্টির সংগ্রাম, পুনর্নির্মাণের সংগ্রাম। শ্রেণীশক্তিগুলির পুনর্বিন্যাসের দিনগুলিতে সংস্কৃতি-সেনানী আলোকস্তম্ভ হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক লড়াইয়ের পরিপূরক মাত্র নন তিনি। এই নিরিখে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মতো কবির কৃতিকে পুনঃপাঠ করতে পারি আজ। সময়ের কয়েকটি জটিল সন্ধিক্ষণে তারা মূল্যবোধের পুনর্নির্মাণের প্রস্তাবনাই করেছিলেন। তাদের অবদানকে আলোচকেরা যেভাবেই বিশ্লেষণ করুন না কেন, সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শের নিরন্তর পুনর্বিন্যাসই ছিল তাদের লক্ষ্য। পথ ও পাথেয়র স্বাতন্ত্র্য তাদের নিজ-নিজ ক্ষেত্রে অনন্য করে তুলেছে। প্রথাগত দৃষ্টিকোন থেকে তাদের যদি না-দেখি, আজকের সংশয়-ধূসর প্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার ভিন্নতর দ্যোতনা আবিষ্কার করতে পারব। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন লেখককে ‘নিছক কলম-পেষা মজুর’ বলেছেন, তেমনই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের সংস্কৃতি-শ্রমিক বলতে পারি। এই শ্রমিক যেহেতু সংগ্রামী, তিনি যোদ্ধা-শ্রমিক। আর, যুদ্ধ মানে যুদ্ধের আয়ুধ-যুদ্ধক্ষেত্র-যুদ্ধের লক্ষ্য-যুদ্ধকৌশল-প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সতর্ক ও অবহিত হওয়া। অর্থাৎ ভাবাদর্শের দৃঢ় ভিত্তিতে অবিচল থাকা।

 নিজস্ব ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা প্রশ্নাতীত। মতান্ধতা কখনও কখনও আন্দোলনের স্বভাবকে আচ্ছন্ন ও গতিকে ব্যাহত করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত নিজের পথ ধরেই তাকে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতের উচ্চাবচতা অনুযায়ী সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার কৌশল মাঝে মাঝে বদলে নিতে হয় যদিও, ব্যবহারিক রাজনীতির লেজুড় তা নয় কখনও। অমোঘ শ্রেণী-বাস্তবতা অবশ্যই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও প্রকরণের নিয়ামক, কিন্তু তার পুষ্টি ও প্রকাশের পথ আলাদা। না-লিখলেও চলে যে ভাবাদর্শের প্রতি আনুগত্য মতান্ধতা এক কথা নয়। যদিও আধিপত্যবাদীরা এই দুটোকে এক করে দেখাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। সংস্কৃতি-কর্মী চক্ষুষ্মন, তিনি অন্ধ নন। তার সার্থকতা নির্ভর করে কল্পনাশক্তি ও অন্তদৃষ্টির ওপর। সাংস্কৃতিক সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য কী, তা যদি একটু ভাবি, দেখব, গণতান্ত্রিক চেতনা উজ্জীবনের লক্ষ্যে এবং ইতিবাচক চিন্তার পরিসরকে যতদূর সম্ভব ব্যাপক করার স্বার্থে সমাজের সমস্ত উদ্যোগী, সৃষ্টিশীল ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে পৌছানোই তার অন্বিষ্ট। এটা ঠিক, বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষও সংশয় ও দ্বিধাজনিত দোলাচল কাটিয়ে উঠতে পারেন না। তাদের পিছুটান গুলিকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে একমাত্র যথার্থ ভাবাদর্শ-সচেতন সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং এভাবেই প্রগতি-শিবিরের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে।

 শ্রেণী-চেতনায় অবিচল থেকেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি-সেনানীরা যদি সৃষ্টিশীল, কল্পনা-সমৃদ্ধ ও স্বতন্ত্র না হতে পারেন—তাহলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারে না। এইজন্যে অন্য গণ-সংগঠন পরিচালনার কৌশল দিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনকে  এগিয়ে নেওয়া যায় না। এর পথ ও পাথেয় পুরোপুরি আলাদা। বিশেষত ইদানীং যখন নয়া-উপনিবেশবাদের দোসর সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ সর্বশেষ তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে ঘরে-ঘরে পৌছে গেছে এবং বরাক উপত্যকার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলও না-সংস্কৃতির মহাপ্লাবনে ভেসে যেতে বসেছে—মানবিক উত্তরাধিকার রক্ষায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির ভূমিকা ও কৃকৌশল পুনর্বিবেচনা না করে উপায় নেই। ব্যবহারিক রাজনীতির পুরোনো কৌশল যে অনেকটাই ভোঁতা হয়ে পড়েছে, ইদানীংকার অসাড় পরিস্থিতিই তার প্রমাণ।

 নতুন ধরনের বহু জটিল প্রশ্ন ও সেইসব প্রশ্নের অভিঘাতকে কীভাবে কার্যকরী মোকাবিলা করা সম্ভব। -সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠকদের একথা ভেবে দেখতেই হবে। কঠিন এ সময়ে একমাত্র ভাবাদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েই সাংস্কৃতিক আন্দোলন গভীরতর ও ব্যাপকতর উত্তরণের পথ। দেখাতে পারে। চরম আত্মিক বিপর্যয়ের মুহুর্তেও নিরাপদ অভ্যাসের কূপমণ্ডুকতা ছেড়ে বেরোতে পারেন শুধু সংস্কৃতি-সেনানী। যে-পথে আলো জেলে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে, সে-পথে আত্মপ্রতারণা অচল। ভণ্ডামির প্রগলভতাকে জয় করেই মানুষের মানবিক নির্যাসে প্রতিষ্ঠিত পরিচয়ে উত্তীর্ণ। হওয়া সম্ভব। অন্ধকার ও সংশয়ের বলয় পেরিয়ে আলোতে পৌছানোর লক্ষ্যে সংস্কৃতিযোদ্ধা অবিচল থাকুন, এই আমাদের প্রত্যাশা। পীড়ার সংক্রমণ অনেকদূর ছড়িয়েছে, আরোগ্য-সংকেত থাকলেও দুরূহ লড়াই সামনে। বিনিদ্র রাত কাটবে অনেক, দ্বিধার প্রহর পেরোবে। নিতে হবে তবু জাগ্রত প্রহরীর ভূমিকা।