সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/কৌতুকাবহ ভ্রম

উইকিসংকলন থেকে
R. D. SORNOKAR, ENGR

কৌতুকাবহ ভ্রম।

সেক্‌সপিয়র।


কৌতুকাবহ ভ্রম।


 এফিসস্‌ ও সিরাকুজ নামক দুই বিখ্যাত রাজ্যের অধিপতিদিগের কোন কারণে পরস্পর সাতিশয় অপ্রণয় হইলে, এফিসসাধিপ স্বীয় সাম্রাজ্য মধ্যে একটা নিদারুণ নিয়ম নিবদ্ধ করিলেন, যদি সিরাকুজীয় কোন ব্যক্তি এফিসসে আগমন করে এবং কাহার দৃষ্টিগোচর হয় তবে সহস্র সুবর্ণ তদভাবে বধ দণ্ডে দণ্ডিত হইবেক।

 কিয়ৎকালানন্তর সিরাকুজ নিবাসী ইজিয়ন্‌ নামা এক জন বৃদ্ধ বণিক্ দৈব দুর্ঘটনায় ব্যাকুলতাপ্রযুক্ত এফিসস্ রাজধানীর রাজর্ত্ম্য ভ্রমণ করিতে২ হঠাৎ তত্রত্য রাজপুরুষগণের নয়ন পথে পতিত হইলেন, সুতরাং ধৃত হইয়া নিরূপিত অর্থ দণ্ড, তদসামর্থ্যে বধ দণ্ড বিধান নিমিত্ত নৃপ নিকেতনে নীত হইলেন।

 ইজিয়নের নিকট রজত কাঞ্চনাদি ধন ছিল না, সুতরাং এফিসসারধিরাজ সমীপে সুবর্ণ দণ্ড প্রদানে অসমর্থ হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ তাহার প্রাণ দণ্ডের আদেশ হইল। কিন্তু নৃপতি যদিও নৃপ নীত্যানুসারে ব্যবস্থা পরবশ হইয়া বিদেশীয় বর্ষিষ্ঠ বণিকের প্রাণ বধের বিধি দিলেন, তথাপি স্বীয় সমীক্ষ্যকারিতা গুণে নুদিত হইয়া মনে২ বিবেচনা করিলেন সিরাকুজবাসী সর্ব্ব সাধারণের বিদিত আছে তদ্দেশীয় নির্ধন জন এখানে পদার্পণ করিলে তাহাকে সদ্যঃ শমন সদনাতিথ্য স্বীকার করিতে হয়, তথাচ কি সাহসে এই ব্যক্তি আগমন করিল, অতএব ইহার বৃত্তান্ত জানিতে হইল। রাজা এবম্প্রকার কুতূহলাক্রান্ত হইয়া সেই স্থবিরকে আত্ম বিবরণ আনুপুর্ব্বিক ব্যক্ত করিতে অনুরোধ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন ওহে বর্ষীয়ন্‌, তুমি সিরাকুজবাসী হইয়া অর্থ সম্বল বিনা কি সাহসে এফিসসে প্রবাসী হইতে উদ্যম করিয়াছিলে?

 ইজিয়ন্ এফিসস্‌রাজের এবম্বিধ বিনয়গর্ভ বচন শ্রবণে নত শিরা হইয়া সম্মান প্রদর্শন পুরঃসর নিবেদন করিলেন, মহারাজ, আমি শোকসন্তাপে নিতান্ত তাপিত চিত্ত, ক্ষণকালের নিমিত্তও জীবন ধারণে অভিলাষুক নহি, সুতরাং মরণে নির্ভয়। আমার প্রতি আত্ম বিবরণ ব্যক্ত করণের আদেশ হইল, কিন্তু তাহার বর্ণন করিতে বক্ষোবিদীর্ণ হইবে, তথাপি অনুমতি পালন নিমিত্ত সংক্ষেপে কহি শ্রবণে অবধান হউক।

 হে নরনাথ, আমার জন্মভূমি সিরাকুজ নগর, এবং জীবিকা বাণিজ্য বৃত্তি। আমি পরিণয়ের যোগ্য সময়ে দার পরিগ্রহ করিয়া প্রিয়তমা সহ পরমসুখে কালক্ষেপ করিতে লাগিলাম, এবং কালক্রমে জগদীশ্বরের কৃপায় আমার সহধর্ম্মিণী গর্ভিণী হইলেন। ইতিমধ্যে বিশেষ প্রয়োজন বশতঃ আমাকে এপিদামনিয়ম নগরে গমন করিতে হইল, এবং কার্য্যের গতিতে তথায় ছয় মাস অবস্থিতি করিলাম কিন্তু তন্মধ্যেও কর্ম্মের শেষ হইল না, অতএব প্রেয়সীকে স্বনিকটে আনয়ন নিমিত্ত কিঙ্কর প্রেরণ করিলাম। পত্নী আমার প্রবাসের আবাসে আসিয়া কিয়দ্দিন পরে দুইটি আশ্চর্য্য যমজ পুত্র প্রসব করিলেন। আমার তনয় দ্বয়ের আকৃতি এবং সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরস্পর ঈদৃশ সদৃশ হইল যে কোন ক্রমে প্রভেদ করা যাইত না। যে দিবস আমার পুত্র দ্বয় ভূমিষ্ঠ হইল, সেই দিন প্রতিবেশিনী এক সুদীনা রমণী তদ্রূপ দুইটী যমক বালক প্রসব করিল, তাহাদেরও আকার অবয়ব আমার সন্তানদিগের অনুরূপ পরস্পর একরূপ ছিল। সে যাহা হউক, ঐ প্রসূতি ও তৎপতি নিতান্ত নিরন্ন প্রযুক্ত আমি তাহাদের নিকট সেই দুইটী শিশু ক্রয় করিয়া লইয়া আত্ম আত্মজদ্বয়ের দাসত্বে নিযুক্ত করিবার অভিপ্রায়ে নিজ বালক সহ তাহাদের প্রতিপালন করিতে লাগিলাম।

 আমার বনিতা শশিকলার তুল্য বালকদ্বয়ের দিন২ রূপ লাবণ্য বৃদ্ধি দেখিয়া মনে২ মহা আস্পর্দ্ধা ও অভিমান করিতেন, এবং স্বদেশে গিয়া আত্মীয় স্বজনকে সন্তান দেখাইবার নিমিত্ত সাতিশয় সমুৎসুকা হইলেন, অতএব দেশে পুনর্যাত্রা নিমিত্ত অহর্নিশ অশেষ বিশেষে আমাকে মন্ত্রণা দিতে লাগিলেন। যদিও আমার কর্ম্মাবশেষ হয় নাই তথাপি গৃহিণীর আগ্রহে ত্বরায় সকল কার্য্য সমাধা করিয়া ভবনে প্রত্যাগমনের আয়োজন করিলাম, এবং অবিলম্বে পুত্র কলত্র বাল ভৃত্য সমভিব্যাহারে পোতারূঢ় হইলাম। কিন্তু তখন সেখান হইতে আসিতে আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না এবং অতি কুক্ষণে যাত্রা হইয়াছিল, অতএব সাগরের উপর তরণী মধ্যেই তাহার বৈগুণ্যের ফল ফলিল। আমরা তরিযোগে এপিদামনিয়ম নগর হইতে সার্দ্ধক্রোশ পথ না যাইতে যাইতে হঠাৎ একটা ঝটিকা উঠিয়া এমত বেগে বহমান হইল যে নাবিকেরা নৌকা রক্ষণে নিরুপায় হইয়া পড়িল এবং আমাদের কএকটীকে প্রচণ্ড পবন বেগে বিনাশোন্মখ পেতমধ্যে রাখিয়া অবিলম্বে স্ব২ প্রাণ পরিরক্ষণ কারণ একখান ক্ষদ্র তরিতে আরোহণ পূর্ব্বক পলায়ন করিল।

 আমার মহিলা জলধির উপর এই বিপদে পড়িয়া অনবরত রোদন ও বিলাপ করিতে লাগিলেন, সুকুমার কুমারেরা যদিও তাহার ক্রন্দনের কারণ বুঝিতে পারিল না তথাপি প্রসূতির রোদন দর্শনে অতিশয় ব্যাকুল হইয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। এই সকল দেখিয়া বিষাদে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল, আত্ম প্রাণ যাহাহউক কি রূপে অবলা ও অব্রুবাণ বালকগণের রক্ষা করি এই ভাবনায় ব্যস্ত হইলাম, কিন্তু অনেক চিন্তা করিয়া পরিত্রাণের কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না ইহাতে অন্তঃকরণ একেবারে ভগ্ন হইয়া পড়িল। আমি ভগ্নমনা হইয়া বসিয়া আছি ইত্যবসরে

তরণির অভ্যন্তরে নেত্রপাত হওয়াতে দেখিতে পাইলাম কতক গুলা অতিরিক্ত মাস্তুর এক কোণে রাশীকৃত রহিয়াছে। মাস্তুর দর্শনে আমার যৎকিঞ্চিৎ আশ্বাস জন্মিল, তৎক্ষণাৎ একটা উঠাইয়া লইয়া তাহার একাগ্রে কনিষ্ঠ বালককে ও অপরাগ্রে তদীয় শিশু দাসকে রজ্জু দ্বারা দৃঢ়রূপে বন্ধন করিলাম, এবং জ্যেষ্ঠ তনয় ও তাহার ভৃত্যকে তদ্রূপ অন্য একটা মাস্তুরের দুই প্রান্তে বন্ধন করিতে বনিতাকে কহিলাম। নাবিকেরা প্রচণ্ড পবন বেগে পোত নিপতিত হইলে যখন অন্য উপায় বিহীন হয় তখন কোন ক্রমে আপনাদের প্রাণ রক্ষা নিমিত্ত অতিরিক্ত মাস্তুর সংগ্রহ করিয়া রাখে, অতএব আমি সেই মাস্তুর যোগে পরিবার রক্ষা স্থির করিয়া কনিষ্ঠ বালকদ্বয়ের রক্ষার ভার স্বয়ং গ্রহণ এবং জ্যেষ্ঠ বালক দুটীর ভার পত্নীর প্রতি অপর্ণ পূর্ব্বক স্ত্রী পুরুষ দুই জনে আপনাদিগকে সেই দুই মাস্তুরের মধ্য স্থানে পৃথক্ পৃথক্ বন্ধন করিলাম। ভাগ্য বলে এই সুযুক্তি উপস্থিত না হইলে সকলেই সমুদ্রের সলিলে নিমগ্ন হইয়া জলসাৎ হইতাম, কেননা তাহার অব্যবহিত পর ক্ষণে আমাদের তরণি মহা সমীরণে ঘূর্ণায়মান হইয়া একটা শৈলোপরি বেগে পতিত হইল, এবং তৎক্ষণাৎ ছিন্ন ভিন্ন হইয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল। আমরা দম্পতী দুই মাস্তুরোপলক্ষে নীরের উপরে ভাসিতে লাগিলাম, কিন্তু আমি কনিষ্ঠ বালকদ্বয়ের রক্ষার নিমিত্ত ব্যস্ত সমস্ত হওয়াতে ভার্য্যার কোন সাহায্য করিতে পারিলাম না। তিনি আপন মাস্তুরে জ্যেষ্ঠ বালক দুটীর সহিত ভাসিতে ভাসিতে এক দিকে চলিয়া গেলেন। আমি কিয়ৎ ক্ষণ পরে দূর দৃষ্টি করিয়া দেখিলাম একখান ধীবরের নৌকা দৈবাৎ আসিয়া উপস্থিত হওয়াতে তত্রস্থ নাবিকেরা ঐ দুর্ঘটনা দর্শনে দয়াবান্ হইয়া আমার কলত্র, জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সেই শিশু ভৃত্যটীকে আপনাদের তরিতে তুলিয়া লইয়ছে। অনুমান করি সেই জালজীবিরা করিন্থ নগর নিবাসী হইবেক। তোয়নিধির তুঙ্গ তরঙ্গোপরি ভাসমান বনিতা ও দুইটী শিশুর ঐ রূপে রক্ষা দেখিয়া আমার মনে অনেক সান্তনা হইল, এবং আপনি পূর্ব্বাপেক্ষা বহু গুণ বল প্রকাশ পুরঃসর সাগরের উর্ম্মির উপর যুজিতে লাগিলাম, ইত্যবসরে আমাদের নিকটেও একখান তরণী আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং তাহার কর্ণধার কৃপাকরিয়া আমাদিগকে তুলিয়া লইল। আমরা যে নৌকায় আশ্রয় পাইলাম তত্রস্থ নাবিকদের সহিত আমার পরিচয় হওয়াতে তাহারা যথেষ্ট সমাদর করিল, এবং আমার দুর্ঘটনায় খিদ্যমান হইয়া সেই তরিযোগেই আমাদিগকে সিরাকুজ নগরে রাখিয়া গেল। কিন্তু প্রিয়তমা ও জ্যেষ্ঠ তনয় এবং তদীয় শিশু দাস ধীবরদের তরণীতে আশ্রয় পাইয়া পরে কি দশা গ্রস্ত হইল তাহার আর কোন বার্ত্তা প্রাপ্ত হইলাম না, এবং তদবধি আমার মনঃ শল্যবিদ্ধ প্রায় হইয়া রহিল।

 আমি কনিষ্ঠ তনয় ও তদীয় বালক ভৃত্যটীকে প্রতিপালন করত কালযাপন করিতে লাগিলাম। তাহারা দুইটী ক্রমে২ শৈশব অতিক্রমণ করিয়া যুবা হইল। কনীয়ান্‌ সন্তান নিরন্তর আমাকে খিদ্যমান দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিত কি নিমিত্ত সন্তাপ করি, এবং তাহার প্রসূতিকে মনে পড়িত, অতএব সে আমার প্রমুখাৎ অগ্রজ সোদর ও জননীর অনুদ্দেশ বিবরণ শ্রবণ করিয়া তাহাদের উদ্দেশ নিমিত্ত সাতিশয় উৎসুক হইল, এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া অবধি বারম্বার অভ্যর্থনা পূর্ব্বক তদর্থ দেশ বিদেশ পর্যটনের অনুমতি প্রার্থনা করিতে লাগিল। আমি প্রথম২ তাহার বাক্যে মনোযোগ করিলাম না, এবং তাহাকে বিদেশ যাত্রা করিতে দিতে ইচ্ছাও ছিল না। যদিও জ্যেষ্ঠ পুত্র ও পত্নীর উদ্দেশ নিমিত্ত অতিশয় সমুৎসুক ছিলাম তথাচ অনুপস্থিত আশায় কি জানি যদি উপস্থিত ধনে বঞ্চিত হই এই ভয়ে যবিষ্ঠ আত্মজের যাচ্ঞায় কোন ক্রমেই সম্মত হইলাম না। কিন্তু কনীয়ান্‌ সন্তানের অন্তঃকরণে মাতৃ ভ্রাতৃ স্নেহ কেমন প্রবল ভাবে উদ্রিক্ত হইয়াছিল সে আমার নিবারণ বচনে ক্ষান্ত না হইয়া জননী ও অগ্রজের অনুসন্ধান নিমিত্ত মহা ব্যাকুল হইল, এবং পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক ব্যগ্রতা সহকারে সতত আমার আদেশ চাহিতে লাগিল, আমি তাহাকে শান্ত্বনা করিতে না পারিয়া অগত্যা পরিশেষে সম্মত হইলাম। কনিষ্ঠ তনয় আমার অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া স্বীয় দাস সমভিব্যাহারে সোদর ও গর্ভধারিণীর উদ্দেশ করিতে যাত্রা করিল। তাহার ভৃত্যও তদ্রূপ ব্যগ্র ছিল কেননা সেও আপন ভ্রাতার অনুসন্ধান নিমিত্ত মনে সাতিশয় উৎসুক হইয়াছিল। হে মহারাজ, অদ্য সপ্তম বৎসর পূর্ণ হইল আমি সেই শিশু সন্তানটীতেও বিরহিত হইয়া আছি, এতাবৎ কাল মধ্যে তাহার বার্ত্তাও প্রাপ্ত হই নাই। তাহার অন্বেষণ নিমিত্ত স্বদেশ ত্যাগ করিয়া পাঁচ বৎসর অহোরাত্র গ্রীশ, আসিয়া প্রভৃতি নানা দেশ ভ্রমণ করিয়া আসিলাম কুত্রাপি অনুসন্ধান পাইলাম না, এক্ষণে ক্ষুণ্ণমনে সদনে প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, কিন্তু কোন জনপদে আপনার পদ সঞ্চার পূর্ব্বক পুত্রের তত্ত্বকরণে ত্রুটি না হয় একারণ যাইতে২ প্রত্যাবৃত্ত হইয়া অদ্য আপনকার এই এফিসস্ নগরী মধ্যে আসিয়াছিলাম, বোধ হয় কৃতান্ত এত দিনের পর এদীনের মর্মান্তিক দুঃখের অন্ত করিবেন, অতএব রাজ পুরুষগণ কর্ত্তৃক ধৃত হইয়া আনীত হইয়াছি, এবং এই দণ্ডাজ্ঞা হইল। পরন্তু হে নরনাথ, যদিস্যাৎ আমি কলত্র পুত্রের জীবন সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিতে পরিতাম তবে আমার সুখের মরণ হইত, কিন্তু কি করি নিদারুণ বিধি বোধ হয় সে সুখও আমার কপালে লেখে নাই।

 ইজিয়ন্ এইরূপে আত্ম দুঃখের বৃত্তান্ত বর্ণন করিলে এফিসসাধিপতি করুণার্দ্র চিত্ত হইয়া মনোমধ্যে বিবেচনা করিলেন এই দুর্ভাগ্য জন পরিজনের প্রতি স্বাভাবিক স্নেহ বশতঃ এই ঘোর বিপাকে পতিত হইয়াছে, অতএব ইহাকে সদ্যঃ সংহার করা কর্ত্তব্য নহে, পরে বধ্য বণিক্‌কে কহিলেন ওহে স্থবির আমি শপথ পূর্ব্বক রাজ্যের নিয়ম পালন করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহার অন্যথা করিতে পারিব না, নচেৎ তোমার দুঃখে সদয় হইয়া ক্ষমা করিতাম, তথাপি তোমার প্রতি এই অনুকম্পা করিলাম রাজ্যের নিয়মানুসারে এইক্ষণেই তোমাকে বধ্যভূমিতে প্রেরণ না করিয়া অদ্যকার সমুদায় দিবস কারাগৃহে থাকিতে অবকাশ দিলাম, তুমি ইতিমধ্যে ঋণ অথবা যাচিতকাদি দ্বারা দণ্ডের অর্থ সংগ্রহ করিতে যত্ন কর।

 এফিসসাধিরাজ যদিও ইজিয়নের বিষাদাবহ বৃত্তান্ত আকর্ণনে দয়াবান্‌ হইয়া তাহার সদ্যঃ সংহার স্থগিত করিলেন তথাপি বর্ষীয়ান্‌ বণিকের জীবন রক্ষার সম্ভাবনা মাত্র রহিল না যেহেতু সেই বিদেশে তিনি নব প্রবাসী ও নিতান্ত অপরিচিত, কে তাহাকে সহস্র সুবর্ণ ঋণ অথবা যাচিতক দিবে। অতএব বৃদ্ধ বণিক্‌ ভূপতির কৃপার ফল অসম্ভব বোধে নিরাশ হইলেন, পরে প্রহরি পরিবৃত হইয়া কারাগারে প্রবেশ করিলেন।

 ইজিয়ন্ মনে করিয়াছিলেন ঐ নগরে তাঁহার বন্ধুবান্ধব কেহ নাই, কিন্তু তিনি যে আত্মজের জন্য স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া ভূরি২ ক্লেশ ভোগর পর এই বিপদে পতিত হইয়াছিলেন সেই সন্তান ও তাহার অগ্রজ উভয়েই পরস্পর অপরিচয়ে সেখানে অবস্থিতি করিতে ছিল।

 বণিক্‌ নন্দনদের উভয়ের আকৃতি ও মুখভঙ্গি পরস্পর সদৃশ ছিল, দুই জনের মধ্যে প্রভেদ প্রায় করা যাইতে পারিত না, এই নিমিত্ত উভয়েই আন্তিফোলসাভিধেয় হয়। অপর তাহাদের দুইটী যমজ দাসও পরস্পর অবয়বে বৈলক্ষণ্য শূন্য হওয়াতে দুই জনেই দ্রুমিও অভিধান প্রাপ্ত হয়। কনিষ্ঠ আন্তিকোলসের অনুসন্ধান নিমিত্ত ইজিয়ন্ যে দিন এফিসসে আগমন করিলেন, সেই দিন ঐ কুমার আপন কিঙ্কর কনীয়ান্‌ দ্রুমিও সমভিব্যাহারে তন্নগরে পদাপর্ণ করে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে জনেক মিত্র সহ সাক্ষাৎকার হওয়াতে তাহাকে জনকের ন্যায় দুর্গতি ভোগ করিতে হইল না। তাহার সেই বন্ধু তাহাকে দেখিবা মাত্র কহিল হে বন্ধো, তুমি সিরাকুজ দেশীয়, একারণ এই এফিসস্‌ নগরে তোমার পদার্পণে অপ্রতিসমাধেয় বিপদ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা, তাহার প্রমাণ এই, অদ্য তোমার স্বদেশস্থ এক জন বৃদ্ধ বণিক্ এখানে আসিয়া রাজ পুরুষগণ কর্তৃক রাজ সাক্ষাৎকারে নীত হইয়াছিল, অবগতি হইল তাহার প্রাণ সংহারাদেশ হইয়াছে, অতএব সখে তুমি সিরাকুজবাসি বলিয়া আত্ম পরিচয় দিও না, অত্রত্য সকলের সমীপে কহিও এপিদামনিয়ম নগর হইতে আসিয়াছি। আন্তিফোল্‌স অকৃত্রিম মিত্রের এই কথা আকর্ণন করিয়া সাতিশয় ভয়াকুল হইল এবং সখার পরামর্শানুবর্ত্তী হইতে স্বীকার করিল, কিন্তু স্বদেশীয় এক ব্যক্তি প্রাণ সঙ্কটে পতিত হইয়াছে শুনিয়া মনঃপীড়ায় অতি মাত্র কাতর হইতে লাগিল। পরন্তু সেই জন যে তাহারই জনক ইহা স্বপ্নেও অনুভব করে নাই।

 জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্‌ দৈবযোগে এফিসস্‌ নগরবাসী হইয়া বিংশতি বৎসর যাবৎ তথায় অবস্থিতি করাতে বিবিধ প্রকারে বিপুলবিত্ত উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, ইহাতে তিনি যদিস্যাৎ জানিতে পারিতেন ইজিয়ন্‌ তাঁহার জন্মদ পিতা, বিপদে পতিত হইয়াছেন তাহা হইলে তিনিই পিতার পরিত্রাণ নিমিত্ত দণ্ডের অর্থ প্রদান করিতেন, কিন্তু তিনি জনকের বিষয় কিঞ্চিন্মাত্র অবগত ছিলেন না। যৎকালে ধীবরেরা মাতৃ সহ তাঁহাকে জলনিধি হইতে উদ্ধার করে তখন তিনি নিতান্ত শিশু ছিলেন, সুতরাং জনক জননীর বিবরণ বিস্মরণ হইয়াছিলেন, কেবল জালজীবিদের দ্বারা প্রাণ দানের ব্যাপার অত্যল্প মনে পড়িত। ধীবরেরা দুইটী বালক সহ আন্তিফোলসের মাতাকে সাগর হইতে উদ্ধার করিয়াছিল বটে, কিন্তু অভাগিনী জননীকে শোক সলিলে নিমগ্ন করত সাগর তীরে রাখিয়া বিক্রয় দ্বারা ধন লাভ করিবার নিমিত্ত শিশু দুটীকে আপনাদের সমভিব্যাহারে লইয়া গিয়াছিল।

 তদনন্তর আন্তিফোলস্ ও তদীয় ভৃত্য মহাবীর মেনাফন্‌ রাজার নিকট বিক্রীত হইল। মেনাফন্‌ রাজা এফিসস্‌ দেশীয় নরপতির মাতুল, সময়ক্রমে কোন প্রয়োজনবশতঃ যখন ভাগিনেয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে এফিসসে আসিয়া কিয়ৎকাল অবস্থিতি করেন তখন ঐ দুইটী বালক তাঁহার সঙ্গে ছিল।

 জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ প্রভু সমভিব্যাহারে এফিসস্‌ নগরে বাস করিতে করিতে দেশীয় রাজার নিকট পরিচিত হইলেন। তাহার বয়োবৃদ্ধি ক্রমে সদ্ব্যবহার ও শৌর্য্যাদি গুণ নিকর প্রকাশমান হওয়াতে এফিসসাধিপতি তৎপ্রতি উত্তরোত্তর প্রীত হইতে লাগিলেন, এবং কিয়ৎকাল গতে আপনার অনীকিনী মধ্যে নিযুক্ত করিয়া সেনানী পদে স্থাপিত করিলেন। অগ্রজ আন্তিফোলস্ সৈন্যাধ্যক্ষ হইলে এফিসস্‌ রাজ্যের বিরুদ্ধে একটা ঘোরতর সমর উপস্থিত হইল, তাহাতে যদিও রাজা স্বয়ং রণ সজ্জা করিয়া বহির্গত হইয়াছিলেন তথাপি বিপক্ষ পক্ষের ষড়যন্ত্রে যুদ্ধ জয় সুকঠিন, বিশেষতঃ রাজার সমরশায়ী হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা হয় কিন্তু তিনি স্বীয় শৌর্য্য বীর্য্য প্রকটন পুরঃসর অরাতিদিগকে নিরাকৃত করিয়া নরনাথের প্রাণ রক্ষা করেন। এফিসসাধিপতি নবীন সেনানীর এই কার্য্যে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া পুরস্কার স্বরূপে স্বীয় রাজধানীস্থ এদ্রিয়ানা নাম্নী অতি ধনাঢ্যা পরম রূপবতী এক কন্যার সহিত তাঁহার পরিণয় করিয়া দিলেন, তাহাতে জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ স্বীয় দাস দ্রুমিও সহ ঐ রমণীর ভবনে তদবধি বাস করিতেছিলেন। তাঁহার তাদৃশাবস্থায় তাঁহার পিতা ইজিয়ন্‌ শোকার্ত্ত হইয়া তাহাদের অন্বেষণ করিতে২ এফিসসে আসিয়া ঐ বিপদে পড়েন।

 কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্‌ এফিসসে গিয়া অকৃত্রিম মিত্রের পরামর্শে বাসস্থল গোপন করত অন্য দেশে নিবাসের পরিচয় দিয়া নগরীর মধ্যে এক স্থানে আপনার আবাস নির্দ্ধারিত করিলেন, এবং সহচর যবিষ্ঠ দ্রুমিওকে আহারীয়ায়োজনে নিয়োজন পুরঃসর অর্থ সম্পত্তি তন্নিকটে রাখিয়া আপনি এফিসস্ রাজধানী বিশেষ রূপে নিরীক্ষণ ও তত্রত্য জনগণের রীতি নীতি পর্য্যালোচন নিমিত্ত পদব্রজে চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতে গেলেন।

 যবীয়ান্ দ্রুমিও অতি সুরসিক ছিল, সে আপন প্রভু আন্তিফোলস্ যখন২ জননী ও সহোদরের অনুদ্দেশ নিমিত্ত বিমর্ষ বা শোকান্বিত হইতেন তখন কৌতুক ও পরিহাস রসে তাঁহার চিত্ত বিনোদন করিত, এ কারণ প্রভুর নিকট কথোপকথনে এতদ্রূপ প্রশ্রয় ও সমাদর প্রাপ্ত হইয়াছিল যে অন্য দাসে তদ্রূপ পায় না।

 কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্‌ স্বীয় সহচর দাসকে বাসায় রাখিয়া যখন এফিসস্‌ নগর নিরীক্ষণ মানসে ভ্রমণ করিতেছিলেন তৎকালে অনুদ্দিষ্ট সহোদর ও গর্ভধারিণীর নিমিত্ত তাঁহার অন্তঃকরণ অতিশয় কাতর হইল। তিনি ক্ষণকাল রাজপথে দণ্ডায়মান হইয়া সবিষাদ বচনে কহিতে লাগিলেন মাতা ও ভ্রাতার অন্বেষণে দেশ বিদেশ পর্যটন করিলাম, কুত্রাপি উদ্দেশ পাইলাম না, হায় সাগরের জলবিন্দু অন্য জলকণার সন্ধান করিতে২ যদ্রূপ জলধির উত্তাল তরঙ্গে আচ্ছন্ন হয় তদ্রূপ আমিও বিনষ্ট আত্মীয় জনান্বেষণ করিতে২ স্বয়ং নষ্ট হইতেছি।

 তিনি এইরূপ মনস্তাপ করিতেছেন, ইত্যবসরে হঠাৎ উপস্থিত এক জন নয়নগোচর হওয়াতে বোধ করিলেন আপনার সহচর দ্রুমিও নিকটে আগমন করিতেছে কিন্তু সে ব্যক্তি তাঁহার সমভিব্যাহারী দ্রুমিও দাস নহে, তদীয় সহোদর জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলসের দাস, তাহারও নাম দ্রুমিও ছিল। আন্তিফোলসেরা দুই সহোদর ও তাহাদের দাস দ্রুমিও দ্বয়, মাতৃগর্ভ হইতে যমকভাবে ভূমিষ্ঠ হইবার সময় যদ্রূপ পরস্পর তুল্যাকার ছিল কালক্রমে বয়োবৃদ্ধি হইলেও তাহাদের অন্যোন্যের অবয়ব সৌসাদৃশ্যে বৈলক্ষণ্য হয় নাই, অতএব এক দ্রুমিওতে অন্য দ্রুমিও ভ্রম অসম্ভব নয়। সে যাহা হউক। কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ স্বদাস দ্রুমিওকে বাসা ও অর্থাদি পরিত্যাগ পূর্ব্বক আগত বোধ করিয়া সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিলেন ওহে তুমি কেন এখানে আসিলা। জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলসের ভৃত্য দ্রুমিও অবয়ব সাদৃশ্যে তাহাকেই নিজ প্রভু জ্ঞান করিয়াছিল, সে উত্তর করিল মহাশয় মাধ্যাহ্নিকার্থ কর্ত্রী আহ্বান করিতে পাঠাইলেন, অন্ন ব্যঞ্জনাদি সমগ্র প্রস্তুত, ত্বরায় আগমন করুন, বিলম্ব করিলে খাদ্য সকল শীতল হইয়া যাইবেক। আন্তিফোলস্‌ কহিলেন ওহে দ্রুমিও এ পরিহাসের সময় নয়।

তুমি মুদ্রাদি কোথায় রাখিয়া আসিলে বল। দাস এ প্রশ্নে মনোযোগ না করিয়া আপনার কথাই পুনর্ব্বার কহিল। পরে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন ওহে কর্ত্রী কে? ইহাতে সে উত্তর করিল কেন আপনকার ভার্য্যা। সে সময় কনিষ্ঠ আন্তিফোলসের পরিণয় হয় নাই সুতরাং তাহার বনিতা কোথায়, অতএব কৌতুকি দাসের অসময়ে পরিহাসামোদ বিবেচনা করিয়া কোপাবেশে বলিলেন দ্রুমিও তোমার সঙ্গে কখন২ রহস্যালাপ করিয়া থাকি বুঝি সেই আস্পর্দ্ধায় তুমি ধৃষ্ট হইয়া অসময়েও আমার সহিত কৌতুক করিতেছ, দেখ এখন আমি পরিহাসে রসিক নহি, আমার দ্রব্যসামগ্রী ও অর্থ কোথায় রাখিয়া আইলে শীঘ্র বল। এ আমাদের দেশ ভূমি নহে, তুমি ও আমি দুই জনেই বিদেশী, এখানে কোন ব্যক্তির করে টাকাকড়ী নিক্ষেপ করিতে তোমার সাহস হইল? আগত দাস তাহাকে আপনার প্রভুই জ্ঞান করিয়াছিল, সে, তুমি ও আমি দুই জনেই বিদেশী, এই কথা শুনিয়া মনে করিল প্রভু আমার সহিত পরিহাস করিতেছেন, অতএব সহাস্য বদনে নিবেদন করিল মহাশয় অনুগ্রহ করিয়া গৃহে আগমন করুন, ভোজন করিতে এরূপ রহস্য করিলে ভাল হয়, কর্ত্রী ভোজনের সমগ্র আয়োজন করিয়া স্বীয় সহোদরার সহিত আপনকার অপেক্ষা করিতেছেন, আপনাকে ডাকিয়া দিতে আমাকে পাঠাইলেন, টাকা কড়ীর কথা আমি কি জানি। আন্তিফোলস্ ভৃত্যের এরূপ বাক্য বারম্বার শ্রবণে যথার্থ পরিহাস জ্ঞানে তাহার ধৃষ্টতা বিবেচনা করত সাতিশয় ক্রোধান্বিত হইলেন, এবং কোপাবেগ সম্বরণে অসামর্থ্য হেতুক করস্থিত যষ্টিদ্বারা তাহাকে প্রহার করিলেন। ভৃত্য প্রহার প্রাপ্ত হইবা মাত্র বেগে গৃহে গমন করিয়া বিষণ্ণবদনে কর্ত্রী সমক্ষে আবেদন করিল স্বামী আহারার্থ আপনকার নিকট আগমন করিতে অস্বীকার করিলেন, অধিকন্তু কহিলেন তাঁহার কলত্র কেহ নাই।

 জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলসের বনিতা আমার কলত্র কেহই নাই এই নিদারুণ বচন আপনার পতির মুখ হইতে বিনির্গত হই-

য়াছে শুনিয়া ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। ঐ যোষা স্বামির অন্য রমণী সমাগম সন্দেহ করিত, অতএব ভৃত্য প্রমুখাৎ এতাদৃশ উপেক্ষা বাক্য শ্রবণে কহিল ভর্ত্তা আমা অপেক্ষা অন্য ভামিনীর প্রতি অধিক অনুরাগী বুঝি ইহা ব্যক্ত করণার্থ এই বচনোপন্যাস করিয়াছেন। পরে অভিমানে পরিপূর্ণ হইয়া পতিকে বিস্তর ভর্ৎসন করিল এবং অবশেষে অধীর হইয়া আপনার মস্তক ও বক্ষঃস্থলে করাঘাত করত আর্ত্তস্বরে বিলাপ করিতে লাগিল। তাহার সহোদরা লুসিয়ানা তাহাকে এইরূপ অধৈর্য্যা দেখিয়া বিবিধ প্রবোধ বচন প্রয়োেগ পুরঃসর শান্ত্বনা করিতে যথেষ্ট চেষ্টা পাইল এবং মনের অমূলক সন্দেহ ও ঈর্ষা নিবারণ নিমিত্ত বিস্তর যত্ন করিল, কিন্তু কোনক্রমে কৃতকার্য্যা হইতে পারিল না।

 এ দিকে কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ কোপাবেগ সম্বরণে অসামর্থ্য প্রযুক্ত আশৈশব সহচর পরম প্রিয়পাত্র ভৃত্যকে প্রহার করিয়া মনে২ অনুতাপ করিতেই কিয়ৎক্ষণ পরে বাসায় গিয়া দেখিলেন দাস সমগ্র দ্রব্যসামগ্রী ও অর্থ সহ নির্বিকার আকারে আবাস মধ্যে বসিয়া রহিয়াছে। তিনি তাহাকে অসময়ে পরিহাসজন্য পুনর্ব্বার তিরস্কার করিবার উপক্রম করিতেছেন ইত্যবসরে জ্যেষ্ঠ অন্তিফোলসের কান্তা কোপ কম্পিত কলেবরে স্বীয় কান্তের তত্ত্ব করিতে২ ঐ স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং তাঁহাকেই বল্লভ বোধ করিয়া মানভরে ভূরি২ ভর্ৎসন বচন প্রয়োগ করিতে লাগিল। তিনি দেখিয়া শুনিয়া অবাক্ হইলেন, এবং এক দৃষ্টে অদৃষ্ট পূর্ব্বা রমণীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, কেননা ইতি পূর্ব্বে কস্মিন্ কালেও যে নয়নগোচর হয় নাই সে অকস্মাৎ পতি সম্বোধনে অনুযোগ করে এ অতি চমৎকার। সেই সীমন্তিনী কিয়ৎ ক্ষণ অভিমান বচনে অনুযোগ করিয়া পরে কহিল হে নাথ তুমি কি কেবল কপট প্রণয় প্রদর্শন করিতে? তোমার সেই স্নেহ ও প্রেম রস কি একেবারে অন্তর্হিত হইল? হে প্রাণপতে কি অপরাধে এ অধিনীর প্রতি এত বিরক্তি হইল যে এক্ষণে বনিতা বলিয়াও স্বীকার কর না? যাহা হউক, এক্ষণে স্পষ্ট বুঝিলাম অন্য ললনার নবীন প্রণয়ে আসক্ত হইয়াছ। যুবা অন্তিফোলস্ অপরিচিতা যুবতীর এবম্প্রকার প্রণয়ের্শ্যাম্বিত বচন শ্রবণে সাতিশয় চমৎকৃত হইয়া মৃদুস্বরে কহিলেন হে সুন্দরি তুমি কি আমার সহিত সম্ভাষণ করিতেছ? হে আত্মবিস্মৃতে আমি তোমার পতি নহি, আমি এস্থানে দুই ঘটিকা মাত্র পদাপর্ণ করিয়াছি। কিন্তু তাঁহার এ সমস্ত কথায় কোন ফল দর্শিল না, সেই ভ্রান্তা অবলার ভ্রম কোন ক্রমে অপগত হইল না। তাঁহাকে স্বামিজ্ঞানে ধারণ করিয়া স্ব সমভিব্যাহারে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি যত্ন করিল। আন্তিফোলস্ স্ত্রীলোকের অনুরোধ ত্যাগ করিতে না পারিয়া অগত্যা সেই সীমন্তিনীর সঙ্গে চলিলেন, এবং তাহার সদনে গমন করিয়া ভোজনে বসিলেন, কিন্তু সে অবলা বারম্বার পতি সম্বোধনে ও তাহার ভগিনী ভগিনীপতি সম্ভাষে কথা বার্ত্তা কহাতে হতজ্ঞান হইয়া মনে২ বিতর্ক করিতে লাগিলেন আমি কি নিদ্রাবস্থায় ইহার পাণি গ্রহণ করিয়াছি, অথবা এখনও কি স্বাপাবেশে আছি। এবম্প্রকার তর্ক বিতর্ক করত রাষাদ্বয় সহ ভোজন করিতে থাকিলেন। তাঁহার দাস প্রভুকে হঠাৎ একটা যুবতী আসিয়া ধরিয়া লইয়া গেল দেখিয়া পশ্চাৎ২ গমন করিয়াছিল, তাহাকে ঐ রমণীর পাচিকা জ্যেষ্ঠ দ্রুমিওর পত্নী অবয়ব সাম্যে আপন পতি ভ্রমে রন্ধনশালায় আহ্বান করত স্বামি সম্বোধনে তাহার সহিত কথোপকথন করিতে লাগিল। অতএব ভৃত্যও বিস্ময়পুরিতান্তঃকরণে স্তব্ধ হইয়া রহিল। দ্রুমিওরা যমজ সহোদর এবং একাকার ছিল সুতরাং পাচিকা আপনা পতি দ্রুমিও তদানীং গৃহে না থাকাতে তাহাকে অসিতে দেখিয়া স্বামীই প্রত্যাগত হইল এমত বোধ করিয়াছিল।

 কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ অপরিচিতা দুই কুল যোষার সঙ্গে ভেজিন করিতেছেন ইত্যবসরে গৃহপতি এবং সেই ভামিনীর প্রকৃত পতি জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ স্বীয় দাস দ্রুমিও সমভিব্যাহারে বহির্দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং দ্বার বন্ধ দেখিয়া মুক্তকরণার্থ দ্বারপালদিগকে আহ্বান করিলেন। কিন্তু দ্বারিরা তাঁহার কথায় কপাট উদ্ঘাটন করিল না কেননা গৃহিণী পুরীমধ্যে অন্য কাহাকেও প্রবেশ করিতে দিতে বিশেষ রূপে নিষেধ করিয়াছিল। পরে তিনি অতি উচ্চস্বরে আপনার ও দ্রুমিও দাসের পরিচয় কহিয়া বারম্বার কবাটে আঘাত করিতে লাগিলেন, অন্তঃপুরচারিণী কিঙ্করীরা তদ্বাক্য আকর্ণন করিয়া উপহাস পুরঃসর চীৎকার করিয়া কহিতে লাগিল ওহে তোমরা কে? এ কি কৌতুক কথা কহিতেছ, আমাদের কর্ত্তা আন্তিফোলস্‌ বাটীর মধ্যে কর্ত্রীর সহিত ভোজন করিতেছেন, এবং দ্রুমিও নিজ বনিতার সঙ্গে পাকালয়ে আছে, তোমরা কেন বিরক্ত করিতেছ, স্বস্থানে প্রস্থান কর। দ্বার বহিস্থ আন্তিকোলস্ গৃহাভ্যন্তর বর্ত্তিনী দাসীদের এবম্প্রকার পরিহাস বচন শ্রবণ করিয়া সাতিশয় ক্রোধান্বিত হইলেন এবং পুনঃ২ পদাঘাতে কপাট ভগ্নপ্রায় করিলেন তথাপি পুরমধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলেন না। অতএব অপমানিতম্মন্য হইয়া কিয়ৎক্ষণ পরে কোপাবেশে দাস সঙ্গে চলিয়া গেলেন, কিন্তু সহধর্ম্মচারিণীর সহিত একজন পুরুষ স্বামিভাবে আহার করিতেছে একথা শ্রবণাবধি তাঁহার অন্তঃকরণে অসীম বিস্ময় জন্মিয়াছিল, ইহাতে সাশ্চর্য্য চিত্ত হইয়া তদ্বিষয়ের চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন।

 কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ অপরিচিতা অঙ্গনার সমভিব্যাহারে আহার করিতেছিলেন বটে কিন্তু সেই মহিলা মুহুর্মুহু স্বামি বলিয়া সম্ভাষণ করাতে চিত্তমধ্যে অত্যন্ত উত্ত্যক্ত হইতে লাগিলেন, এবং তাঁহার দাসও পাকশালায় পাচিকার পুনঃ২ পতি সম্বোধন পুরঃসর কথোপকথনে বিরক্ত হইল, অতএব আর অধিক কাল থাকিলে যদি অন্য কোন ঘটনা উপস্থিত হয় এই বিবেচনায় ভোজনাবসান হইবামাত্র উভয়েই ছলক্রমে বাটীর বহির্গত হইলেন। যদিও ঐ গৃহিণীর সহোদরা লুসি-

য়ানার সুশীলতায় আন্তিফোলস্ সাতিশয় পরিতোষ পাইয়াছিলেন তথাপি কর্ত্রীর ঈর্ষ্যান্বিত বচনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েন, এবং দ্রুমিও রন্ধনশালাস্থ অঙ্গনার আলাপে আহ্লাদিত হয় নাই, সুতরাং দুই জনে বাটীর বাহিরে অসিয়া নিরাপদ্‌ জ্ঞানে মহা হর্ষান্বিত হইলেন।

 আন্তিফোলস্ ঐ কুলবালার আলয় হইতে বহির্ভূত হইলে এক জন স্বর্ণকার তাঁহার সাক্ষাৎ পাইল। সে জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলসের বনিতার এক ছড়া স্বর্ণহার প্রস্তুত করণের অনুমতি পাইয়াছিল, অতএব তাঁহাকে ঐ ব্যক্তি বোধ করিয়া তাহার হস্তে হার প্রদান করিল। আন্তিফোলস্ বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন এ কাহার হার? সুবর্ণজীবী বলিল মহাশয় এ কেমন কথা? আপনকার আদেশে হার নির্মাণ করিলাম, এখন আপনি গ্রহণ না করিলে আমি ইহা কি করিব, এতাবৎ বলিয়া তাহার করে হার সমর্পণ পূর্ব্বক চলিয়া গেল। আন্তিফোলস্ এবারে এক বিস্ময়জনক ঘটনার পর অন্য বিস্ময়াবহ ব্যাপার দর্শনে নিতান্ত সংশয়িত চিত্ত হইয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন এতদ্রাজ্যে প্রবেশাবধি বিবিধ অদ্ভুত ঘটনা দেখিলাম বোধ হয় আমাকে কেহ কোন প্রকার মোহনী বিদ্যা দ্বারা মুগ্ধ করিয়া থাকিবে নচেৎ ঈদৃশ অসম্ভব সংঘটন কেন হয়, যাহা হউক, এস্থানে আর অবস্থান কোন ক্রমে শ্রেয়স্কর নহে, এই পরামর্শ করিয়া সহচর দ্রুমিওকে দ্রব্যসামগ্রী অর্ণবপোতে উত্থাপনার্থ অনুমতি করিলেন।

 এ দিকে স্বর্ণকার হার দিয়া নিজালয়ে প্রত্যাগমন করিতেছে ইত্যবসরে বর্ত্মমধ্যে রাজকীয় পুরুষ ঋণশোধের নিমিত্ত তাহাকে ধরিল। দৈবাৎ সেই সময়েই জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ সেই স্থানে অসিয়া উপস্থিত হইলে সুবর্ণজীবী তাঁহার হস্তে হার দিয়া আসিল এই ভ্রমে তাঁহাকে অবলোকন করিয়া হৃষ্ট হইল, এবং আত্ম বিবরণ নিবেদন পুরসর উপস্থিত বিপদ্‌ বিমোচন নিমিত্ত তাঁহার নিকটে হারের মল্য যাচ্ঞা করিল, যেহেতুক তাহা ঋণ সংখ্যার তুল্য ছিল। তিনি সুবর্ণকারের এতদ্বচন শ্রবণে সাতিশয় বিস্ময় প্রকাশ করত কহিলেন সে কি? আমি তোমার নিকট কখন হার লইলাম? কিন্তু স্বর্ণকার তাঁহার এই কথায় তদপেক্ষা সাশ্চর্য্য ও সবিস্ময় হইয়া দৃঢ় রূপে কহিল কিয়ৎ ক্ষণ হইল তোমার করে আমি স্বয়ং সমপর্ণ করিয়া আসিতেছি। এই রূপে উভয়েই স্ব২ বাক্যের সত্যতায় দৃঢ় প্রত্যয় প্রযুক্ত অসংশয়চিত্তে অনেক ক্ষণ পর্যন্ত বাদানুবাদ করিতে লাগিলেন, বস্তুতঃ স্বর্ণকার কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্‌কে হার দিয়া অবয়ব সাদৃশ্যে জ্যেষ্ঠ আস্তিফোলস্‌কেই হার দিয়াছে নিশ্চয় করিয়াছিল, সুতরাং সে আপনার কথায় অনৃতের লেশমাত্র মনে করে নাই। সে যাহা হউক, রাজকীয় পুরুষ এ প্রকার বাক্‌কলহে সহজে মুদ্রা লাভের অসম্ভাবনা দেখিয়া সুবর্ণকারকে ঋণের নিমিত্ত কারালয়ে লইয়া যাইবার উদ্যম করিলে স্বর্ণকার আপনার হারের মূল্য নিমিত্ত আন্তিফোলসের নামে সেই পদাতিক সন্নিধানেই অভিযোগ করিল। তাহাতে রাজপুরুষ তাঁহাকেও ধারণ করিয়া দুই জনকেই অবরোধ করিয়া রাখিবার নিমিত্ত বন্ধন শালায় লইয়া চলিল।

 জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ যৎ কালে ধৃত হইয়া বন্ধনালয়ে গমন করিতেছিলেন দৈবাৎ সে সময় কনিষ্ঠ আন্তিকোলসের দাস দ্রুমিওকে পথি মধ্যে দেখিতে পাইলেন, অতএব তাহাকে নিজ ভৃত্য জ্ঞানে আজ্ঞা করিলেন ত্বরায় গৃহে গমন করিয়া গৃহিণী এদ্রিয়ানার নিকট হারের মূল্য আনয়ন কর, তাহার নিমিত্ত সঙ্কট ঘটিয়াছে। দ্রুমিও তাঁহাকে স্বীয় প্রভু বোধ করিয়াছিল, কিন্তু সে প্রভুর অকস্মাৎ এই দুরবস্থা দর্শনে এবং বাক্য শ্রবণে সাতিশয় চমৎকৃত ও বিস্ময়াকুল হইল, যেহেতু এদ্রিয়ানার নিকেতনে তাহার প্রভু ভোজন করিবার সময় সেই রমণীর বারম্বার পতি সম্বোধনে মহা বিরক্ত হইয়াছিলেন, এবং তন্নিমিত্ত কৌশল করিয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করত নিরাপদ বোধ করেন, এক্ষণে তাহার নিকটে আবার কি বুঝিয়া যাইতে কহিলেন তন্মর্ম্ম গ্রহণ করিতে পারিল না। অপর অব্যবহিত পূর্ব্বে প্রভুর নির্দেশানুসারে অর্ণব যানে দ্রব্য সামগ্রী আরোপণ করিয়া আসিল এক্ষণে আপনাদের আরোহণের সংবাদ দিতে আসিতেছিল এ সময় এই অসম্ভব আদেশ শ্রবণে হতজ্ঞান হইয়া কোন উত্তর করিতেও সমর্থ হইল না। অধিকন্তু যদিও সে স্বীয় প্রভুর সহিত হাস্য পরিহাস করিতে প্রশয় পাইয়াছিল এবম্প্রকার নিয়োগে শ্লেষ বচন প্রয়োগ করিতে পারিত তথাচ প্রভুর উদ্বেগ অবেক্ষণে তাকালে বাক্ চাতুরী অনুচিত জ্ঞান করিল, সুতরাং অন্তঃকরণ মধ্যে মহা ব্যাকুল হইয়া অগত্যা সেই গৃহে এদ্রিয়ানার নিকট চলিল এবং যাইতে২ কহিতে লাগিল কেবল প্রভুর নিদেশ লঙ্ঘন করিতে হইল, কিন্তু তথায় পাচিকাটা আবার স্বামী সম্বোধনে যদি উৎপাত না করে তাহা হইলেই পরিত্রাণ।

 দ্রুমিও জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলসের মহিলার আলয়ে গমন করিয়া তাহাকে প্রভুর ধৃত হওন বার্ত্তা কহিবামাত্র সে অবলা অতিশয় চঞ্চলা হইয়া এক থলিয়া টাকা তাহার হস্তে প্রদান পূর্ব্বক ত্বরায় তাহাকে বিদায় করিল। দ্রুমিও মুদ্রা লইয়া প্রত্যাগমন করিতে২ পথিমধ্যে আপনার প্রকৃত প্রভুর দর্শন পাইল। কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ এফিসসে প্রবেশাবিধি বিবিধ বিচিত্র ঘটনা দর্শনে সর্ব্বোতভাবে বিস্ময়ান্বিত হইয়াছিলেন, তাঁহার তুল্যাকার অজ্ঞাত সহোদর ঐ দেশে বাস করিয়া সুবিখ্যাত হওয়াতে তত্রত্য যে কোন ব্যক্তির সহিত যেখানে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল ভ্রম বশতঃ সকলেই বহুকালের পরিচিতির ন্যায় নমস্কারাদি করিয়া যথেষ্ট শিষ্টালাপ করিল, কেহ ঋণাপনোদান নিমিত্ত স্বয়ং উপযাজক হইয়া মুদ্রা প্রদানে উদ্যত হইল, কেহ নিজ নিকেতনে লইয়া সম্বর্দ্ধনা করণার্থ অশেষ যত্ন পাইল, কেহ তাঁহার কৃত উপকার স্বীকার করত গুণানুবাদ করিয়। ধন্য বাদ প্রদান করিল। বস্তুতঃ জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্‌ স্বীয় সদ্‌গুণ নিকরে এবম্প্রকার সমাদর ভাজন হইয়াছিলেন সুতরাং অবয়বের সৌসাদৃশ্যে তদ্ভ্রমে সকলে উচিত অভ্যর্থনা করিয়াছিল। অপর এক ব্যক্তি সূচিকর্ম্মকারী কতক গুলি কৌষেয় বসন ক্রয় করিয়াছিল, সে এক স্থানে তাঁহার দর্শন পাইয়া বসন প্রদর্শন পূর্ব্বক ব্যস্ত সমস্ত হইয়া কহিল মহাশয় আদেশ করুন অঙ্গের পরিমাণ গ্রহণ পুরঃসর এই বস্ত্রের এক প্রস্থ পরিচ্ছদ প্রস্তুত করি।

 কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ এই রূপে অনীক্ষিত ও অনালাপিত ব্যক্তিদের চির পরিচিতের ন্যায় আলাপ কৌশলাদি বিলোকন করিয়া নিতান্ত সংশয়িত চিত্তে চিন্তা করিতেছিলেন বোধ হয় কোন মায়াবী মায়িক বাগুরা বিস্তার পূর্ব্বক আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে নচেৎ ঈদৃশ অপরিচিত লোকের অভ্যর্থনা শ্রবণ ও অচিন্তিত বিষয়াবলোকন কেন ঘটিতেছে। ইতিমধ্যে তাঁহার দাস দ্রুমিও এদ্রিয়ানার নিকট হইতে ঋণ পরিশোধের টাকা আনিয়া হস্তে সমর্পণ পুরঃসর জিজ্ঞাসা করিল মহাশয় কি প্রকারে রাজপুরুষ দিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইলেন? আন্তিফোলস্ ভৃত্যের প্রমুখাৎ এই কথা শুনিয়া যৎপরোনাস্তি উদ্বিগ্ন হইলেন, বিশেষতঃ কারাগারে অবরুদ্ধ হইবার ও এদ্রিয়ানার সন্নিধান হইতে মুদ্রানয়ন নিমিত্ত তাহাকে প্রেরণ করিবার কথায় হত বুদ্ধি হইয়া অসংশয় নিশ্চয় করিলেন দ্রুমিও উন্মাদ গ্রস্ত হইয়াছে এবং আমিও যায়ায় মোহিত হইয়া ভ্রমণ করিতেছি। তদনন্তর দুর্ভাবনায় ভীত হইয়া সাতিশয় কাতর স্বরে চীৎকার করত কহিতে লাগিলেন হে করুণানিধান কৃপা কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া এই কুহকস্থান হইতে ত্বরায় আমাদিগকে উদ্ধার কর।

 তদনন্তর এক অপরিচিতা বারবনিতা আগমন পুরঃসর সম্মুখীন হইল এবং নাম গ্রহণ পূর্ব্বক সম্বোধন করিয়া তাহাকে কহিল তখন আমার সহিত ভোজন করিতে২ যে কনকহার প্রদানাঙ্গীকার করিলে তাহা দাও দেখি। আস্তিফোলস্ অভাবিতোপস্থিতা বারযোষাকে অবলোকন করিয়া এবং তাহার বদন হইতে বিনির্গত এই বচন শুনিয়া বিস্ময়ে অধীর হইয়া সুস্পষ্ট কুহকিনী কহিয়া তাহার অপবাদ দিলেন এবং সমুচিত বিরাগ প্রকাশ করত কহিতে লাগিলেন তুমি কে? তোমার সহিত কখন একত্র আহার করিলাম? ইতিপূর্ব্বে কস্মিন্ কালেও তুমি আমার নয়ন গোচর হও নাই, আমি কেন তোমাকে স্বর্ণালঙ্কার প্রদানের অঙ্গীকার করিব? বারবিলাসিনী তাঁহার এই বাক্য শুনিয়াও পুনর্ব্বার সুদৃঢ় বচনে বলিল কেন সেই যে আমার ভবনে একত্র ভোজন করিতে২ সুবর্ণ হার প্রদানে প্রতিশ্রুত হইলে। ইহাতেও তিনি বিস্ময় প্রকাশ পুরঃসর অস্বীকার করিলে বেশ্যা সবিষাদ বচনে বলিল তবে আমার সেই স্বর্ণাঙ্গুরীটী প্রত্যর্পণ কর। তিনি একথায় মহা বিরক্ত হইয়া পুনশ্চ তাহাকে কুহকিনী কহিয়া সক্রোধ বচনে ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন এবং শশব্যস্তে স্থানান্তরে প্রস্থান দ্বারা মায়াবিনীর সংসর্গ পরিত্যাগ করিতে সযত্ন হইলেন। অতএব বারবধূ সবিস্ময় মনে বিষাদ করিতে২ প্রত্যাবর্ত্তন করিল। বস্তুতঃ জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ সেই মহিলার সদনে কিয়ৎ প্রহর পূর্ব্বে গমন করিয়া এক সঙ্গে আহার করিতে২ কথোপকথনে তুষ্ট হইয়া তাহাকে এক ছড়া সুবর্ণ হার দিতে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, তাহাতে সে প্রফুল্লচিত্ত হইয়া স্মরণার্থ স্বীয় করের অঙ্গুরী তাঁহাকে সমর্পণ করিয়াছিল, সুতরাং পথি মধ্যে কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্‌কে দেখিয়া আকৃতি সাদৃশ্যে ভ্রমবশতঃ তাঁহার নিকট হার যাচ্ঞা করে।

 জ্যেষ্ঠ অন্তিফোলস্‌ আপন বনিতা এদ্রিয়ান কর্ত্তৃক গৃহ প্রবেশে নিবারিত হইয়া সাতিশয় কুপিত হইয়াছিলেন, বিশেষতঃ সহধর্ম্মচারিণী যে অত্যন্ত ব্যাপিকা ও ঈর্ষান্বিতা তাহা বিলক্ষণ বিদিত ছিলেন, অধিকন্তু তাঁহার পত্নী তাঁহাকে সর্ব্বদা পরভার্য্যা রত বলিয়া অপবাদ দিত, অতএব পুরমধ্যে প্রবেশে নিরুদ্ধ হইয়া রোষ বশতঃ বারযোষার সদনে ভোজন মানসে গমন করিয়াছিলেন, তাহাতে সেই বারনারী যথেষ্ট সমাদর পুরঃসর আহার করায়। অতএব তিনি পত্নীর নিমিত্ত যে হার নির্মাণ করিতে স্বর্ণকারকে কহিয়াছিলেন বারবিলাসিনীর বিনয়ে পরিতুষ্ট হইয়া তাহা তাহাকে প্রদান করিতে স্বীকৃত হয়েন, কিন্তু স্বর্ণকার ভ্রমবশতঃ সেই হার কনিষ্ঠ আন্তিফোলসের হস্তে সমপর্ণ করিয়াছিল, বারনারী হারের কথায় হর্ষে গদ্‌গদ হইয়া স্বহস্তের অঙ্গুরী তাঁহাকে সমপর্ণ করে। কিন্তু যখন সেই কুলটা আকার সাদৃশ্যে কনিষ্ঠ আন্তিফোলসের নিকট গমন পুরঃসর হার প্রার্থনা করিয়া প্রত্যাখ্যাত হইল তখন পূর্ব্ব ধন অঙ্গুরীয়ক বিনাশে মহা বিষণ্ণা হইয়া বিবিধ কটূক্তি করিতে২ দেশমান্য আন্তিফোলসের বুদ্ধি ভ্রংশ ও উন্মাদ গ্রস্ততার অপবাদ দিয়া ঐ সমস্ত বিষয় তদীয় অন্তঃপুর চারিণী এদ্রিয়ানাকে কহিতে গেল। এ দিকে দ্রুমিও দাস এদ্রিয়ানার নিকট হইতে আনীত মুদ্রা স্বীয় প্রকৃত প্রভু কনিষ্ঠ আন্তিফোলসের হস্তে সমপর্ণ করাতে জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ কারাগারে অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করিয়া কারাধ্যক্ষকে কহিলেন যদি আমাকে একবার বাটী যাইতে দাও এখনি ঋণের টাকা পরিশোধ করিতে পারি। পরে কারারক্ষক সম্মত হইলে তাহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া আলয়ে গমন করিলেন, কিন্তু তিনি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন তাঁহার আলপিতা কুলটা এদ্রিয়ানার নিকট কহিতেছে তোমার স্বামী উন্মত্ত হইয়াছেন, তিনি আমার আবাসে আহার করিয়া আমার সহিত কত কৌতুক করিয়াছিলেন, সংপ্রতি বর্ত্ম মধ্যে সাক্ষাৎ হওয়াতে নিতান্ত অপরিচিতের ন্যায় বিবিধ প্রলাপ বাক্য কহিলেন, এই বলিয়া কনিষ্ঠ আন্তিফোলসের সহিত পথি মধ্যে যে কথাবার্ত্তা হয় সমুদায় বিবরণ করিয়া বলিতেছিল।

 জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ আপনার প্রগল্‌ভা ভার্য্যা এদ্রিয়ানা দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখাতে জাতক্রোধ ছিলেন, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া প্রথমতঃ মহিলাকে অপমান জনক বচনে ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। এদ্রিয়ানা বারবধূর মুখে স্বামির যে উন্মাদপবাদ শুনিল অকস্মাৎ এই কর্কশ বচন প্রয়োগে তাহাতে বিশ্বাস করিল, বিশেষতঃ তাহার স্বামির সমানাকার কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ তাহার সহিত ভোজন করিতে২ বারবার কহিয়াছিলেন আমি তোমার পতি নহি এফিসস্‌ নগরে অদ্য পদাপর্ণ করিয়াছি, সেই সকল কথা স্মরণ পথে প্রকাশমান হওয়াতে অসংশয় হইয়া স্থির করিল স্বামী যথার্থ উমাদ গ্রস্ত হইয়াছেন বটে। অতএব কারারক্ষককে আরোপিত ঋণের মুদ্রা প্রদান পুরঃসর বিদায় করিয়া ভৃত্যদিগকে আজ্ঞা করিল রঞ্জু দ্বারা করদ্বয় বন্ধন পূর্বক কর্ত্তাকে এক তিমিরাবৃত আগারে বদ্ধ করিয়া রাখ, এবং তাহার চিকিৎসার নিমিত্ত ভিষক্‌দিগকে আহ্বান করিয়া পাঠাইল। তাহার স্বামী এই অলীকাপবাদে যত আক্রোশ প্রকাশ করিতে থাকিলেন বাটীস্থ লোকেরা ততই উন্মাদ কল্পনা করিয়া পরস্পর কহিতে লাগিল বায়ুর কি বিচিত্রা গতি, তাদৃশ প্রভু ক্ষণ মধ্যে এপ্রকার বিকৃত ভাবাপন্ন হইলেন। দ্রুমিও দাস এই সময়ে সদনে আসিয়া উপস্থিত হওত প্রভুর দুরবস্থাবলোকনে সকলকে তিরস্কার ও তাহার কথার পোষকতা করাতে ভৃত্যবর্গ তাহাকেও উন্মাদ গ্রস্ত স্থির করিয়া বন্ধন করিল।

 এদ্রিয়ানা কান্তকে কারাবদ্ধ করিয়া গৃহ কর্ম্মে গমন করিলে কিয়দ্ঘটিকানন্তর এক জন কিঙ্কর স্থানান্তর হইতে আগমন পূর্ব্বক নিবেদন করিল প্রভু বন্ধনালয় হইতে পলায়ন করিয়া দ্রুমিও সহ রাজ পথে ভ্রমণ করিতেছেন, আর তাহাদের হস্তে বন্ধন নাই। এদ্রিয়ানা এই কথা শ্রবণে সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইল এবং ব্যস্ত সমস্ত হইয়া স্বীয় সহোদরা ও কতিপয় ভৃত্য সমভিব্যাহারে তাহাকে ধৃত করিতে দ্রুত গমন করিল। তাহারা এক ধর্ম্মশালার দ্বারে উত্তীর্ণ হইয়া অনতি দূরে দেখিতে পাইল আন্তিফোলস্, দ্রুমিও দাস সহিত দণ্ডায়মান রহিয়াছেন, বস্তুতঃ তিনি জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ নহেন, যমজ সহোদরদ্বয়ের অভিন্নাকার প্রযুক্ত সকলের এরূপ ভ্রম জন্মিল।

 কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ অগ্রজের অনুরূপ আকৃতি নিমিত্ত নানা অদ্ভুত ঘটনা দর্শন করিতেছিলেন, এতদ্ভিন্ন তাহার প্রতি উৎপাত ঘটিবার অপর এক কারণ ছিল। স্বর্ণকার জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ ভ্রমে তাঁহাকে যে হার প্রদান করে তাহ| গলদেশে ধারণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। অতএব দৈবাৎ পুনর্ব্বার সুবর্ণকার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে সে তাহাকে লজ্জা দিয়া কহিল ক্ষণকাল পূর্ব্বে কহিয়াছিলে হার প্রাপ্ত হও নাই এক্ষণে গ্রীবা ভূষণ কি প্রকারে হইল? তিনি স্বর্ণকারের এই কথায় বিস্মিত হইয়া উত্তর করিলেন তোমার সহিত মধ্যে আবার কোথায় সাক্ষাৎ হইল? আমি হার গ্রহণ করিতে স্বীকার করি নাই, তুমি আমার বচন আপন অন্তঃকরণে ধারণ না করিয়া স্বেচ্ছাক্রমে সমর্পণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছিলা, তদবধি গ্রীবাভরণ করিয়া রাখিয়াছি।

 সে যাহা হউক এক্ষণে এদ্রিয়ানা তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া আপনার উন্মত্ত পতি জ্ঞানে আলয়ে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যত্ন করিতে লাগিল, এবং কহিল বন্ধন বিমোন করত প্রহরিদের কর হইতে কি প্রকারে পলায়ন করিয়া আসিলে | অপর তাহার সমভিব্যাহারি লোকেরা ধারণার্থ গাত্রে হস্তার্পণের উপক্রম করিল। ইহাতে আন্তিফোলস্ সহচর দ্রুমিওর সহিত ত্রস্ত হইয়া মহা বিপদ উপস্থিত বোধে বেগে ধর্ম্মশালার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন এবং সাতিশয় কাতরতা প্রকাশ করত মঠাধিকারিণীর শরণ প্রার্থনা করিতে লাগিলেন।

 মঠাধিকারিণী তাহাদের ব্যাকুলতা অবলোকনে অভ্যন্তর হইতে বহির্গত হইয়া উদ্বেগের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। ঐ বর্ষীয়সী অতি গম্ভীর স্বভাব এবং সুবিবেচনা ও বিচক্ষণতা নিমিত্ত সুখ্যাত ছিলেন। আন্তিফোলসের প্রমুখাৎ আক্রমণের বিবরণ শ্রবণানন্তর তাহাকে অভয় দিয়া এদ্রিয়ানার নিকট তদীয় পতির বৃত্তান্ত আকর্ণন করিবার মানসে মৃদু মধুর বচনে প্রশ্ন করিলেন বৎসে তোমার স্বামির অকস্মাৎ ঈদৃশ রেগাক্রান্ত হইবার কারণ কি? সাগরে তরি নিমগ্ন দ্বারা হঠাৎ কি তাঁহার মহা ক্ষতি হইয়াছে? অথবা পরম প্রণয় ভাজন কোন মিত্রের বিয়োগ জন্য শোকাকুল ছিলেন? এদ্রিয়ানা সবিনয়ে আবেদন করিল না মা এতাদৃশ কোন ঘটনা হয় নাই। তদনন্তর বৃদ্ধা কহিলেন তবে বুঝি তোমার স্বামী তোমাব্যতীত অপর কোন রামার প্রতি আসক্ত আছেন তাহাতেই ঈদৃশী দুর্দশা আপন্ন হইয়াছেন। এদ্রিয়ানা নিবেদন করিল আমি এ প্রকার সন্দেহ করিতাম বটে, আমার স্বামী সর্ব্বদা আবাসে বাস করিতেন না সুতরাং অন্য অঙ্গনার সহিত প্রণয় সম্ভবতে পারে। ফলতঃ তৎপতি জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ তদীয় ঈর্ষান্বিত প্রকৃতিতে সাতিশয় বিরক্ত ছিলেন, এবং তন্নিমিত্ত কখন নিজালয় ত্যাগ করত অন্যত্র গিয়া থাকিতেন। বুদ্ধিমতী মঠাধিকারিণীরও মনে তাদৃশ সন্দেহ হইল, অতএব তিনি কহিলেন যদি তোমার কান্ত অনাসক্ত, তবে তাঁহাকে মধ্যে২ ভর্ৎসনা করা উচিত ছিল। এদ্রিয়ানা বলিল অনেক বার করিয়াছি। বর্ষীয়সী বলিলেন বোধ হয় প্রকৃত রূপে তিরস্কার কর নাই। এদ্রিয়ানা স্বীয় প্রিয়তমকে নিরন্তর তিরস্কৃতি করিয়া যে শাসন করিত তাহাতে সেই বর্ষীয়সীর বিশ্বাসাধান নিমিত্ত কহিল এতজ্জন্য আমাদের স্ত্রীপুরুষে দিবানিশ কলহ হইত, নিশীথে স্বামী শয়নগত হইয়া স্বাপাবেশে থাকিলে আমি তাঁহাকে ঐ কথা কহিবার নিমিত্ত নেত্র নিমীলন করিতে দিতাম না, ভোজন সময়ে তদুত্থাপন করিয়া বচসা করিতাম, আর নির্জনে একত্র হইলে ঐ বিষয়ের প্রসঙ্গ ভিন্ন অন্যালাপ ছিলনা, অপিচ সভা মধ্যেও ব্যঙ্গোক্তি করিয়া অনেকবার বিরক্ত করিয়াছি, তথাপি ঘৃণা জন্মে নাই, পরকীয়া রসাস্বাদনাসক্তি ত্যাগ করেন নাই।

 মঠাধিকারিণী ক্রমে এদ্রিয়ানার চরিত্রের বৃত্তান্ত তাহার প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়া পরে সুমিষ্ট বাক্যে স্নেহ প্রদর্শন পুরঃসর কহিলেন তবে তুমিই অনুক্ষণ উত্ত্যক্ত করিয়া পতিকে ক্ষিপ্ত করিয়াছ, কেননা প্রেয়সী দ্রোহকারিণী হইলে তদীয় দন্ত ক্ষিপ্ত কুক্‌কুরের দশনাপেক্ষা বিষাল হয়। আমার অনুমান হইতেছে নিরন্তর ত্বৎকৃত নিদ্রা ব্যাঘাতে তোমার পতির মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়াছে, তুমি ভোজন সময়ে তাহাকে উদ্বিগ্ন করিতে, উদ্বেগাবস্থায় আহার করিলে পরিপাক হয় না, সর্ব্বদা তদ্রূপে ভোজন করিলে পীড়া জন্মিবার অসম্ভাবনা কি? অপর আত্মমুখে এই ব্যক্ত করিলে তাহাকে পরিষদ মধ্যেও ইঙ্গিত বাক্যে নিরানন্দ করিতে, আমোদ প্রমোদের সময় চিত্তে ঔদাস্য জন্মিলে অতিশয় বিকার হয়, অতএব স্পষ্ট প্রতীতি হইল তুমিই সর্ব্বদা উত্ত্যক্ত করিয়া স্বামিকে ক্ষিপ্ত করিয়াছ।

 এদ্রিয়ানার ভগিনী লুসিয়ানা সহোদরার অপরাধ মার্জ্জনার্থ মঠাধিকারিণীর সন্নিধানে অনেক প্রকার হেতুবাদ কহিল এবং মিষ্ট বচলে নিবেদন করিল স্বামী স্ত্রী জনের পরম গুরু, আমার অগ্রজা পতি প্রতি কদাপি পরুষ ভাষা প্রয়োগ করেন নাই, তদনন্তর তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল ভগিনি এতাদৃশ অপবাদে নীরব থাক কেন? উত্তর কর না। কিন্তু বর্ষীয়সী এদ্রিয়ানার দোষ এবম্প্রকারে সপ্রমাণ করিয়া দিলেন যে সে কেবল এতাবন্মাত্র প্রতিবচন প্রদান করিতে সমর্থ হইল আমি আত্মবচনেই অনুযোজ্যা হইলাম।

 এদ্রিয়ানা যদিও স্বীয় অসদাচরণে সলজ্জা হইল, তথাপি পতির উদ্ধার নিমিত্ত সাতিশয় ব্যর্থতা সহকারে যত্ন করিতে লাগিল, কিন্তু মঠাধিকারিণী কাহাকেও মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে দিলেন না এবং শরণাপন্ন আন্তিফোলস্‌কেও বহির্গত করিলেন না বরং তাহার আরোগ্যার্থ চিকিৎসা করাইতে মানস করিলেন, একারণ তাহাদিগকে অন্তর করিয়া দিয়া স্বয়ং মঠ মধ্যে প্রবেশ পুরঃসর দ্বারাবরোধ করণের আদেশ দিলেন।

 আন্তিফোলস্‌দ্বয়ের অবয়ব সৌসাদৃশ্য প্রযুক্ত যে দিবস ভ্রান্তি মূলক উক্ত সমস্ত ঘটনা হয়, দৈবযোগে এফিসসাধিপতি সেই দিন দীন ইজিয়নের দণ্ডার্থ অর্থ উপনীত না হইলে প্রাণ দণ্ড নিরূপণ করিয়াছিলেন, অর্থাৎ ইজিয়ন্‌ সেই দিন সূর্য্যাস্তের প্রাক্ কাল পর্যন্ত সংকলন পুরঃসর যদি দণ্ডের মুদ্রা উপস্থিত না করেন তবে তাঁহার প্রাণ দণ্ড করিতে ঘাতুকদিগকে আজ্ঞা দিয়াছিলেন। দিনকর হীনকর প্রায় হইয়া অস্ত প্রাপ্ত হন্‌ তথাপি প্রাচীন ইজিয়ন্ অর্থের কোন সুযোগ করিতে পারিলেন না।

 উপরি উল্লেখিত ধর্ম্মশালার সম্মুখে তাঁহার বধ্য ভূমি নির্ণীত হওয়াতে মঠাধিকারিণী সেই বর্ষীয়সী মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলে কিয়ৎক্ষণ পরেই ঘাতুকগণ বেষ্টিত হইয়া তিনি তথায় আনীত হইলেন। এফিসসাধিপতি ইজিয়নের বৃত্তান্তাবগত হইয়া তদবধি তাঁহার প্রতি সদয় ছিলেন অতএব বধ্যভূমিতে নীত হইলে যদি কেহ সেখানেও তাঁহার দণ্ডার্থ প্রদান করে তাহা হইলেও পরিত্রাণ দিবেন এই আশয়ে স্বয়ং তথায় গমন করিলেন।

 এদ্রিয়ানা তখন পর্যন্ত মঠের নিকট দণ্ডায়মানা ছিল, অনতিদূরে দেশাধিপতিকে সমুপস্থিত দেখিয়া সমক্ষে গমন পূর্ব্বক আত্ম বিবরণ ব্যক্ত করত মঠাধিকারিণীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়া কহিল ধর্ম্মাবতার এই ধর্ম্মশালার অধ্যক্ষ আমার পতিকে সমর্পণ করেন না, বিচারাজ্ঞা হয়। দৈবাৎ এই সময়েই তাহার প্রকৃত পাণিগ্রাহ গৃহাভ্যন্তর হইতে বহির্গত হইয়া বন্ধন মোচন করত দ্রুমিও দাস সমভিব্যাহারে রাজ সন্নিধানে গিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং দুঃশীলা মহিলা তাঁহাকে ক্ষিপ্তাপবাদ দিয়া বন্ধনালয়ে বন্ধন পূর্ব্বক অকারণ ঘোর যাতনা প্রদান করিয়াছে এতন্নিমিত্ত বনিতার নামে অভিযোগ করিতে লাগিলেন। এদ্রিয়ানা নিশ্চয় করিয়াছিল তাহার পতি দাস সমভিব্যাহারে মঠের মধ্যে আছেন এক্ষণে তাহাকে আপনার ভবনের দিক্ হইতে দাস সহ সমাগত হইয়া এবম্প্রকার অভিযোগ করিতে দেখিয়া সাতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইল।

 এদিকে ইজিয়ন্ বধ্যভূমিতে আনীত হইয়া জনতা মধ্যে আপন পুত্রকে অবলোকন করাতে হর্ষে পুলকিত হইলেন এবং মনে করিলেন আমার কনীয়ান্‌ তনয় প্রসূতি ও সহোদরের উদ্দেশে দেশ বিদেশ ভ্রমণানন্তর অবশেষে বুঝি এই দেশে আগমন পুরঃসর বসতি করিয়াছে, যাহা হউক, এস্থানে ইহাকে অনেকের গণ্য দেখিতেছি, দণ্ডার্থ দিয়া অবশ্য আমাকে মুক্ত করিতে পারিবে, বধ্য ভূমিতে পরম লাভহইল, চিরানুদ্দিষ্ট আত্মজকে পুনঃ প্রাপ্ত হইলাম। মনে এইরূপ উল্লাসিত হইয়া স্নেহবাক্যে তাঁহাকে কহিলেন বৎস অগ্রে আমাকে উদ্ধার কর। জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্‌ শৈশবাবস্থায় সাগরোপরি জনক হইতে বিযুত হওয়া অবধি স্মরণাতীত কাল যাবৎ তাঁহাকে দর্শন করেন নাই, সুতরাং পিতা বলিয়া চিনিতে না পারাতে উত্তর করিলেন তোমার সহিত কি সম্বন্ধ যে এতাবৎ সংখ্যক ধন সমর্পণ করিব। বৃদ্ধ ইজিয়ন্‌ পুত্রের এতদ্বচনাকর্ণনে মনোমধ্যে দুঃখিত না হইয়া বিবেচনা করিলেন বালক দুর্ভাবনা ও ব্যাকুলতা বশতঃ বিকৃত চিত্ত হইয়া থাকিবেক, তন্নিমিত্ত চিনিতে পারিল না, অথবা এদেশে আসিয়া ধনসম্পত্তি করত সম্ভ্রান্ত হইয়াছে, আমি ঈদৃশ দুর্দশাগ্রস্ত, জনতা মধ্যে আমাকে পিতা বলিয়া স্বীকার করিতে লজ্জিত হইতেছে। পরন্তু অর্থ বিরহে তদ্দণ্ডে তদীয় প্রাণ দণ্ড হয় একারণ পুনর্ব্বার তাঁহার নিকট পরিচিত হইতে যত্ন করিলেন কিন্তু জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ কোন ক্রমেই চিনিতে পারিলেন না। এতদবসরে মঠাধিকারিণী গৃহাভ্যন্তরস্থ কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ ও তদীয় দাস সমভিব্যাহারে বহির্গত হইয়া রাজ সাক্ষাৎকারে আগমন করিলেন, তাহাতে এদ্রিয়ানা এক স্থানে দুই জন স্বামী ও দুই দাস অবলোকন করত বিস্ময়ে অবাক হইয়া রহিল।

 অনন্তর যে প্রগাঢ় ভ্রান্তি বশতঃ সকলের উৎপাত ঘটিতেছিল তাহার সমূলোন্মূলন হইল। পরস্পর অভিন্নাকার দুই জন আন্তিফোলস্ ও দুই দ্রুমিও দাস অবলোকন করিবা মাত্র ইজিয়ন্ বণিকের কথা এফিসসাধিপতির স্মরণে আসিল। তিনি প্রাতঃকালে ইজিয়নের বর্ণিত তদীয় বৃত্তান্ত স্মরণ করত কহিলেন এই যুবক দ্বয় নিঃসন্দেহ ইজিয়নের যমজ তনয়, আর এই দুই জন ইহাদের ভৃত্য।

 ইজিয়ন্‌ প্রাণ দানার্থ বধ্য ভূমিতে আসিয়া পুত্র কলত্র সকলের সহিত পুনর্ব্বার মিলিত হওয়াতে আপনার নৈরাশ্য অনির্ব্বচনীয় লাভ ও আনন্দে অপনোদন করিলেন। প্রাতঃ কালে রাজসমক্ষে নীত হইয়া অবধারিত করিয়াছিলেন দিনকরের অস্ত প্রয়াণ সঙ্গে মদীয় সমস্ত সাংসারিক লীলা বিলীন হইবেক, কেননা এফিসসাধিপতি তাঁহার বিবরণ শ্রবণে সদয় হইয়া সদ্যো সংহার বারণ করিলেও উদ্বন্ধনের সময় নিরূপিত করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু সেই সময়ে তাঁহার চির অনুদ্দিষ্ট তনয় দ্বয় সহ সমাগম ও প্রিয়তমার সহিত পরিচয় হইল। দুই আন্তিফোলস্ ও দুই দ্রুমিও দর্শনে নরপতি তাহাদিগকে পরস্পর যমজ সহোদর ও ইজিয়নাত্মজ কহিলে মঠাধিকারিণী বর্ষীয়সী প্রাচীন ইজিয়ন্‌কে স্বীয় পতি বলিয়া চিনিতে পারিলেন, এবং ঐ যুবক দ্বয় তাঁহার গর্ভজ বলিয়া মনে পড়িল।

 নির্দয় ধীবরের জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ ও তৎ সহচর দ্রুমিও এই দুইটী বালক লইয়া গেলে ইজিয়নের বনিতা স্বদেশ ভ্রষ্টা ও পতি পুত্র বিহীনা হইয়া শোকে ব্যাকুলা হওত কতক দিন পথে২ ভ্রমণ করেন পরে এফিসসে আসিয়া তত্রস্থ ধর্ম্মশালার পূর্ব্বাধিকারিণীর নিকট শরণাপন্ন হয়েন এবং স্বীয় সচ্চরিত্র ও ধর্ম্মিষ্ঠতা নিমিত্ত মঠাধিকারিণীর অবসানে তৎপদে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। যে আন্তিফোলস্ ক্ষণকাল পূর্ব্বে তাঁহার আলয়ে আশ্রয় লয় সে যে তাঁহার তনয় কিছুই জানিতে পারেন নাই, কেবল আতিথ্য ধর্ম্মের রক্ষা নিমিত্ত স্থান দান করিয়াছিলেন।

 যাহা হউক এক্ষণে পিতা পুত্র ও সহোদর দ্বয়ে চির বিপ্রয়োগের পর অভাবনীয় সংযোগ হইলে সেই বহুজনাকীর্ণ বধ্য ভূমি মধ্যেই তাঁহাদের পরস্পর প্রেম ও স্নেহে আশ্লেষ হইতে লাগিল। এফিসসাধিপতি এই অনন্দোৎসবে মগ্ন হওয়াতে ক্ষণ কালের নিমিত্ত ইজিয়নের দণ্ড বিধান বিস্মরণ হইলেন, এবং উপস্থিত জনসমূহ ঐ বিবরণ পরিজ্ঞানে বিস্ময়োৎফুল্ল হইল। তদনন্তর ধনাঢ্য জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ জনকের প্রাণ পরিত্রাণ নিমিত্ত দণ্ডের ধন স্বকোষ হইতে আনয়ন পুরঃসর রাজসমক্ষে সমর্পণ করিলেন কিন্তু নৃপতি ইজিয়নের এই দৈবঘটনার বৈচিত্র্যে সাশ্চর্য্য চিত্ত হওয়াতে বিনা দণ্ডে তাঁহাকে মুক্তি দিলেন। তদনন্তর মঠাধিকারিণী ইজিয়ন্‌ ভামিনী স্বামি ও পুত্র দ্বয় সহিত ধর্ম্মশালায় প্রবেশ করিলেন এবং বহু কালের পর সংমিলন হওয়াতে আহ্লাদ সাগরে মগ্ন হইয়া পরস্পর কথোপকথন করিতে লাগিলেন। রাজা তচ্ছ্রবণার্থ তাঁহারদের সমভিব্যাহারে গমন করিয়াছিলেন। দ্রুমিও দ্বয়ও পরস্পরের অচিন্তিত মিলনে হর্ষ প্রফুল্ল হইল এবং মুকুরে যদ্রূপ আপন প্রতিমূর্ত্তি দেখিলে আহ্লাদ জন্মে তাহারা পরস্পরে আত্ম সাদৃশ্য অবলোকন করিয়া তদ্রূপ আনন্দিত হইতে লাগিল।

 এদ্রিয়ানা পূর্ব্বে স্বামির প্রতি ঈর্ষান্বিতা ছিল তাহাতে জ্যেষ্ঠ আন্তিফোলস্ সর্ব্বদা অসুখী হইতেন, এক্ষণে পিতৃ মাতৃ ভ্রাতৃ সমাগমে সৌভাগ্যোদয় হওয়াতে শ্বশ্রুর উপদেশে সুশীলা হইল।

 পরে কনিষ্ঠ আন্তিফোলস্ ভ্রাতৃজায়ার ভগিনী লুসিয়ানার রূপলাবণ্য ও সদ্গুণ নিচয়ে সন্তুষ্ট হইয়া কিয়দ্দিনানন্তর তাহার পাণি গ্রহণ করিলেন। অতএব বৃদ্ধ ইজিয়ন্‌ সন্তুষ্ট সন্তান স্নুষা কলত্র ভৃত্য সমভিব্যাহারে পরম সুখে এফিসস্ দেশে শেষ কাল যাপন করিতে লাগিলেন। তাঁহার তনয় দ্বয় এবং দুই দ্রুমিও পরস্পর অনুরূপ আকৃতি জন্য ভ্রমবশতঃ অকারণ ক্লেশ সহ্য করিয়াছিল কিন্তু তদনন্তর তদ্রূপ ভ্রমোত্থাপন হইলে মহা কৌতুক জন্মিত ইতি।