বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১
নারীর মূল্য

স্তম্ভ উঠিয়াছে, গল্পের মধ্যে, দৃষ্টান্তের মধ্যে তখন সে স্ত্রীর দাম চড়িয়া গিয়াছে। পুরুষ যে কেবলমাত্র নিজের সুখ ও সুবিধা ব্যতীত,— সেটা সত্যই হৌক আর কাল্পনিক হৌক—আর কোনদিকে দৃষ্টিপাত করে নাই, সে-কথা চাপা দিয়া গর্ব করিয়া প্রচার করিয়াছে, “যে-দেশে নারী হাসিতে হাসিতে চিতায় গিয়া বসিত, স্বামীর পাদপদ্ম ক্রোড়ে লইয়া প্রফুল্ল-মুখে নিজেকে ভস্মসাৎ করিত, ইত্যাদি ইত্যাদি—”

 কিন্তু তাই যদি হয়, তবে স্বামীর মৃত্যুর পরই তাহার বিধবাকে একবাটি সিদ্ধি ও ধুতুরা পান করাইয়া মাতাল করিয়া দেওয়া হইত কেন? শ্মশানের পথে কখন বা সে হাসিত, কখন কাঁদিত, কখন বা পথের মধ্যেই ঢুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িতে চাহিত। এই তার হাসি, এই তার সহমৃতা হইতে যাওয়া! তার পর চিতায় বসাইয়া কাঁচা বাঁশের মাচা বুনিয়া চাপিয়া ধরা হইত, পাছে সতীদাহ-যন্ত্রণা আর সহ্য করিতে না পারে। এত ধূনা ও ঘি ছড়াইয়া অন্ধকার ধুঁয়া করা হইত যে, কেহ তাহার যন্ত্রণা দেখিয়া যেন ভয় না পায়। এবং এত রাজ্যের ঢাক, ঢোল, কাঁঁসি ও শাঁখ সজোরে বাজানো হইত যে, কেহ যেন তাহার চীৎকার, কান্না বা অনুনয়-বিনয় না শোনে। এই ত সহমরণ! আমি জানি, এখানে অনেক রকমের আপত্তি উঠিবে। প্রথমেই উঠিবে, দেশের লোকের সত্যই যদি এই বিশ্বাস থাকে যে, সহমৃতা সতী পরলোকে স্বামীর সহিত বাস করিতে পায় এবং সেইজন্যই এ অনুষ্ঠান,—তাহা হইলেও আমার এই উত্তর যে, দেশের অশিক্ষিত ইতর লোক কি বিশ্বাস করিত, না করিত, সে আলোচনায় লাভ নাই, কারণ তাহারা শুধু ভদ্র ও শিক্ষিতের অনুকরণ ও অনুগমন করিত মাত্র। কিন্তু যেদেশে তখনও টোল করিয়া মহামহোপাধ্যায়েরা সাংখ্য বেদান্ত পড়াইতেন, জন্মান্তর বিশ্বাস করিতেন, কর্ম-ফলে জীবের স্থাবর জঙ্গম পশু-জন্ম প্রচার করিতেন, দেবযান পিতৃযান প্রভৃতি পথের নির্দেশ করিতেন—তাঁহারা যে সত্যই বিশ্বাস করিতেন, পৃথিবীতে কর্মফল যাহার যাহা হৌক, দুইটা প্রাণীকে একসঙ্গে বাঁধিয়া পোড়াইলেই