বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ
১৪১

উঠিতেছে। একটা জাতির সাধারণ লোকেরা যে পরিমাণে মহৎ ও উন্নত হয়, জাতিও ঠিক সেই পরিমাণে মহৎ ও উন্নত হয়।”

 এই সব দৃষ্টান্ত হইতে এই মহান শিক্ষা লাভ করা যায় যে, কৃষক, খনির মজুর, নাপিত বা মেষপালকের বৃত্তিতে কোন সামাজিক অমর্যাদা নাই। ঐ সব দেশে পরিশ্রম করিয়া সাধভাবে জীবিকার্জন সম্মানজনক বিবেচিত হয়, কিন্তু আমাদের দেশে শ্রমের কোন মর্যাদা নাই। যাহারা ‘ভদ্রলোক’ বলিয়া পরিচিত, তাহারা অনাহারে মরিবে তব, কায়িক শ্রমের কাজ করিবে না,—বরং সামান্য বেতনের কেরাণীগিরিতে সন্তুষ্ট হইবে। অনেক সময় সে আত্মীয়ের গলগ্রহ হইয়া পরগাছার মত জীবন ধারণ করিতেও লজ্জিত হয় না।

 আমাদের চামার, জোলা, তাঁতি, নাপিতেরা আবহমান কাল হইতে সেই একঘেয়ে পৈতৃক ব্যবসা করিয়া আসিতেছে, তাহাদের জীবনে কোন পরিবর্তন নাই, আনন্দ নাই। আমাদের কতকগুলি শ্রমশিল্পী অস্পৃশ্য জাতীয় এবং তাহারা যে ভাবে দিনের পর দিন পৈতৃক ব্যবসা চালায়, তাহাতে তাহাদের অবস্থার উন্নতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কিন্তু হিন্দ, ভারতের বাহিরে, লোকে যে কোন ব্যবসা বা জীবিকা অবলম্বন করিতে পারে, তাহাতে তাহাদের সামাজিক মর্যাদার হানি হয় না। সমাজের যে কোন স্তরে তাহারা বিবাহ করিতে পারে, এবং এই কারণে তাহারা দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া বহ, বাধা বিপত্তির মধ্যেও জীবনে সাফল্য লাভ করিতে পারে।

 তিব্বত ও বর্মা ভারতের সংলগ্ন,—যথাক্রমে তাহার উত্তর ও পূর্বে অবস্থিত। বৌদ্ধ ধর্মের মধ্য দিয়া বাংলা দেশ হইতে তাহারা তাহাদের সভ্যতা লাভ করিয়াছিল। তাহারা জাতিভেদ জানে না এবং তাহাদের স্ত্রীলোকেরা যে স্বাধীনতা ভোগ করে তাহা আমেরিকার স্ত্রীলোকদের পক্ষেও ঈর্ষার বিষয়। চীন দেশও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্য দিয়া বাংলার নিকট তাহার সভ্যতা, সংস্কৃতি, দর্শন প্রভৃতির জন্য বহুল পরিমাণে ঋণী। ইয়োরোপীয় ও আমেরিকান লেখকেরা এক বাক্যে বলিয়াছেন যে, এই চীন দেশে তিন হাজার বৎসরের মধ্যে অস্পৃশ্যতা বলিয়া কিছু নাই এবং জগতের মধ্যে এই জাতির ভিতরেই জাতিভেদের প্রভাব সর্বাপেক্ষা কম। দরিদ্র পিতামাতার সন্তানেরা অতীতে অনেক সময়ই ‘মান্দারিন' হইয়াছে। আমাদের মধ্যে যে চামার সে চিরকাল চামারই থাকিবে এবং তাহার সন্তান সন্ততির সমাজে কোন কালে মর্যাদালাভের সম্ভাবনা নাই। তাহাদের স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা এই ভাবে নষ্ট হইয়া গিয়াছে।

 কৃষক, মেষপালক অথবা খনির মঞ্জুর অনেক সময় কবি বা ভূতত্ত্ববিদ হইয়া উঠে। যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে সে পালিত হয়, তাহার ফলে তাহার চরিত্রের গুণাবলীর সম্যক বিকাশের সংযোগ ঘটে। আর আমাদের দেশের কৃষক, মেষপালক বা চামার এমন অবস্থার মধ্যে বর্দ্ধিত হয় যে, তাহাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির কোন আশা নাই। ডাপ্টের 'ইনফার্নো’-র মত তাহাদের মাটির ঘরের দরজায়ও যেন এই কথাটি লিখিত আছে—“এখানে যে প্রবেশ করিবে, তাহাকে সমস্ত আশা ত্যাগ করিতে হইবে।” যে চোরা বালিতে সে পড়িয়াছে, তাহা হইতে তাহাকে উদ্ধার করিবার কেহ নাই। রবার্ট বার্নসের জীবনী হইতে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত গলি পড়িলে বুঝা যায়, ব্রিটিশ কৃষক ও তাহার পারিবারিক জীবন এবং ভারতীয় কৃষক ও তাহার পারিবারিক জীবনের মধ্যে কি প্রভেদ! স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ইহাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগের চিত্রই অঙ্কিত হইয়াছে, বর্তমান কালে ব্রিটিশ কৃষকের পারিবারিক জীবনের বহ, উন্নতি হইয়াছে।

 “বার্নসের শিক্ষা তখনও সমাপ্ত হয় নাই, সেই সময়ে তাঁহার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইল। স্কটল্যাণ্ডের কৃষকেরা তাহাদের কুটীরকেই স্কুলে পরিণত করে; যখন সন্ধ্যা কালে পিতা