বলিলেন,— “বাবা! এ দুঃখের কান্না নয়! তোমা হেন চাঁদ ছেলে যে গর্ভে ধরিয়াছে, তার আবার দুঃখ কিসের? তোমার সুধামাখা কথা শুনিলে ভয় হয়,—এ হতভাগিনীর কপালে তুমি কি বাঁচিবে?”
সেইদিন আহারাদির পর, খেতুর ছেঁড়া-খোঁড়া কাপড়গুলি মা সেলাই করিতে বসিলেন।
খেতু বলিলেন,— “মা! আমি ছেঁড়ার দুই ধার এক করিয়া ধরি, তুমি ওদিক হইতে সেলাই কর, তাহা হইলে শীঘ্র শীঘ্র হইবে। আর মা! যখন সূচে সূতা না থাকিবে, তখন আমি পরাইয়া দিব, তুমি ছিদ্রটি দেখিতে পাও না, সূতা পরাইতে তোমার অনেক বিলম্ব হয়।”
এইরূপে মাতা-পুত্রে কথা কহিতে কহিতে কাপড় সেলাই হইতে লাগিল। তাহার পর মা সেইগুলিকে ক্ষারে কাচিয়া পরিষ্কার করিয়া লইলেন। খেতু কলিকাতায় যাইবেন, তাহার আয়োজন এইরূপে হইতে লাগিল।
বৈকালবেলা খেতু নিরঞ্জনের বাটী যাইলেন। নিরঞ্জন ও নিরঞ্জনের স্ত্রীকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইয়া, কলিকাতায় যাইবার কথা তাহাদিগকে বলিলেন। রামহরির নিকট নিরঞ্জন পূর্ব্বেই সমস্ত কথা শুনিয়াছিলেন।
এক্ষণে খেতুকে আশীর্ব্বাদ করিয়া, নানারূপ উপদেশ দিয়া নিরঞ্জন বলিলেন,— “খেতু! সর্ব্বদা সত্যকথা বলিবে, মিথ্যা কখনও বলিও না। নীচতা ও নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করবে। জীবে দয়া করিবে। যথাসাধ্য পরোপকার করবে। ইহাই সনাতন ধর্ম্ম। সুখ-দুঃখের সকল কথা তোমার রামহরি দাদাকে বলিবে, কোনও কথা তাহার নিকট গোপন করিবে না। অনেক বালকের সহিত তোমাকে পড়তে হইবে, তাহার মধ্যে কেহ দুষ্ট, কেহ শিষ্ট হইবে। অন্যায় করিয়া কাহাকেও মারিও না, দু্র্ব্বলকে মারিও না, পাঁচজনে পড়িয়া একজনকে মারিও না, দুর্ব্বলকে কেহ মারিতে আসিলে তাহার পক্ষ হইও। দুর্ব্বলের পক্ষ হইয়া যদি মার খাইতে হয় সেও ভাল। প্রতিদিন রাত্রিতে শুইবার সময় মনে করিয়া দেখিবে যে, সেদিন কি সুকার্য্য, কি কুকার্য্য করিয়াছ। যদি কোনও প্রকার কুকার্য্য করিয়া থাক, তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিবে যে, আর এমন কাজ কখনও করিব না।”
এইরূপ খেতু, নিরঞ্জন কাকার নিকট হইতে বিদায়গ্রহণ করিলেন। মঙ্গলবার রাত্রিতে মাতা-পুত্রের নিদ্রা হইল না। দুইজনে কেবল কথা কহিতে লাগিলেন, কথা আর ফুরায় না।
কতবার মা বলিলেন,— “খেতু! ঘুমাও, না ঘুমাইলে অসুখ করিবে।”
খেতু বলিলেন,— “না মা! আজ রাত্রিতে ঘুম হইবে না। আর মা কাল রাত্রিতে তো আর তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পাব না? কাল কতদূর চলিয়া যাব। সে কথা যখন মা! মনে করি, তখন আমার কান্না পায়।”
মা বলিলেন,— পূজার ছুটির আর অধিক দিন নাই, দেখিতে দেখিতে এ কয়মাস কাটিয়া যাইবে। তখন তুমি আবার বাড়ী আসিবে।
প্রাতঃকালে রামহরি আসিলেন। খেতুর মা, খেতুর কপালে দধির ফোটা করিয়া দিলেন, চাদরের খুঁটে বিল্বপত্র বঁধিয়া দিলেন। নীরবে নিঃশব্দে রামহরির হাতের উপর খেতুর হাতটি দিলেন। চক্ষু ফুটিয়া জল আসিতেছিল, অনেক কষ্টে তাহা নিবারণ করিলেন।
অবশেষে ধীরে ধীরে কেবল এই কথাটি বলিলেন,— “দুঃখিনীর ধন তোমাকে দিলাম।”
রামহরি বলিলেন,— “খেতু! মাকে প্রণাম কর।” খেতু প্রণাম করিলেন, রামহরি নিজেও প্রণাম করিয়া দুইজনে বিদায় হইলেন।