বিষয়বস্তুতে চলুন

ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 একজন প্রহরীর তত্ত্বাবধানে সময়মত আহারীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত হইল। তখন হোসেন কহিলেন, “এখন আহারীয় প্রস্তুত হইয়াছে, অনুমতি হইলে সকলেই ভোজন করিয়া লইতে পারেন।”

 প্রহরী। সকলের ভোজন একবারে হইতে পারে না। প্রথমে তোমরা ভোজন কর, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

 হোসেন। আমরা অগ্রে ভোজন করিব কেন? আপনাদিগের আহারাদি হইয়া গেলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

 প্রহরী। তাহা হইতে পারিবে না। তোমরা অগ্রে ভোজন করিলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

 হোসেন। যদি আপনারা নিতান্তই অগ্রে ভোজন না করেন, তাহা হইলে সকলেই এক সময় ভোজন করা যাউক। আপনারা থাকিতে আমরা কিরূপে অগ্রে খাইতে পারি?

 প্রহরী। তাহাও হইতে পারে না।

 হোসেন। কেন?

 প্রহরী। তোমরা ভোজন করিলে, তাহার পর তোমাদিগের কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা অগ্রে দেখিয়া, পরিশেষে আমরা ভোজন করিব।

 হোসেন। আপনার এ কথার অর্থ ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

 প্রহরী। বুঝিতে না পারিয়া থাকেন, আমি বুঝাইয়া দিতেছি। আমাদিগের তত্ত্বাবধানে আপনারা আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমাদিগের অলক্ষিতে আপনারা উহার সহিত অনায়াসেই বিষ মিশ্রিত করিয়া দিতে পারেন। প্রথমে আপনারা আহার করিলেই, আমরা জানিতে পারি যে, সেই সকল আহারীয় দ্রব্যের সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত আছে কি না। আহারান্তে যদি আপনাদিগের কোনরূপ বৈলক্ষণ্য না ঘটে, তাহা হইলে আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারিব যে, উহার সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত নাই। ইহার পর আর আপনাদিগকে আহারীয় দ্রব্যের নিকট গমন করিতে দিব না। আমরা নিজ হস্তে সেই সকল দ্রব্য পরিবেশন করিয়া আহার করিব।  হোসেন। আপনার এ কথায় আমাদিগের কোন উত্তর নাই। আমরা আহারীয় দ্রব্যের নিকট আর গমনই করিব না। আপনারা উহা হইতে কিছু কিছু আমাদিগকে প্রদান করুন, আমরা দূরে বসিয়া আহার করি। আমরা আপনাদিগের আদেশ প্রতিপালন করিব মাত্র; কিন্তু আপনাদিগকে এবং মনিবদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া, পরিতুষ্টির সহিত কখনই আহার করিয়া উঠিতে পারিব না।

 ইহার পর হোসেনের প্রস্তাব-মতই কার্য্য হইল। হোসেন ও তাহার পরিচারকদ্বয় দূরে আহার করিতে বসিলেন; একজন প্রহরী তাহাদিগকে পরিবেশন করিলেন। প্রহরীগণ যখন দেখিল, হোসেন বা তাহার পরিচারকদ্বয় সেই সকল দ্রব্য আহার করিয়া সুস্থ শরীরে রহিলেন, তখন তাহারা তাহাদিগের নিজের আহারের উদ্যোগ করিতে লাগিল। কিন্তু আসামীদ্বয় আহার করিবে কি না, সে সম্বন্ধে কোন কথাই কহিল না। তখন হোসেন কহিলেন, “আপনাদিগের আহারের উদ্যোগ হইতেছে; কিন্তু আসামীদ্বয় কখন আহার করিবেন?”

 প্রহরী। আসামীদ্বয়েরও কি আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছেন?

 হোসেন। উহারাই আহার করিবেন বলিয়া, সকলের নিমিত্ত আহারীয় আমরা প্রস্তুত করিয়াছি। নতুবা আমাদিগের আহারীয় প্রস্তুত করিবার কোনরূপ প্রয়োজনই ছিল না।

 প্রহরী। উহারা ফাঁসি যাইবার আসামী। উহাদিগকে আমরা কিরূপে আহার করিতে অনুমতি দিতে পারি?

 হোসেন। যাহাদিগকে ফাঁসি দিবার হুকুম হয়, ফাঁসির পূর্বে যে কয় দিবস তাহারা বাঁচিয়া থাকে, সে কয় দিবস কি তাহা-

দিগকে আহার করিতে দেওয়া হয় না। যদি সরকারের এরূপ কোন নিয়ম থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। বরং লোক-পরম্পরায় শুনিতে পাওয়া যায়, ফাঁসি যাইবার পূর্বে ফাঁসির আসামী যাহা খাইতে চাহে, সরকার হইতে তাহাই তাহাকে খাইতে দেওয়া হয়। সে যাহা হউক, এত পরিশ্রম করিয়া যখন আমরা আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছি, তখন উহাদিগকে কিছু আহার করিতে দিয়া আমাকে সবিশেষরূপ অনুগৃহীত করুন।

 প্রহরী। উঁহারা আহার করুন, বা না করুন, তাহাতে আপনার ক্ষতি-বৃদ্ধি কি?

 হোসেন। ক্ষতি নাই? খুব ক্ষতি আছে। যিনি আমার অন্নদাতা, তিনি আহার করিতে পাইবেন না, আর আমরা আহার করিয়া বসিয়া আছি! ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? আমি আপনাদিগকে সবিশেষরূপ অনুরোধ করিতেছি, উঁহাদিগের আহার করিতে দিবার পক্ষে কোনরূপ প্রতিবন্ধক হইবেন না। উঁহারা যেরূপ মনঃকষ্টে আছেন, তাহাতে যে আহার করিতে পারিবেন, সে ভরসা আমার নাই; তবে আহার করিতে বসিয়াছেন, ইহা দেখিলেই আমার মনটা একটু সন্তুষ্ট হইবে, এই মাত্র। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত যদি আপনাদিগের আরও কিছু লইবার প্রত্যাশা থাকে, তাহাও আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন।

 প্রহরী। যখন আপনি এরূপ ভাবে অনুরোধ করিতেছেন, তখন আপনার অনুরোধই বা রক্ষা না করি কি প্রকারে? তবে জানেন কি, আমরা পেটের দায়ে চাকুরী করিতে আসিয়াছি, তাই আপনাকে বলিতেছি।  হোসেন। ইহার জন্য এত গোলযোগ করিবার প্রয়োজন কি? আপনারা যখন যাহা চাহিতেছেন, আমি তখনই তাহা আপনাদিগকে প্রদান করিতেছি। প্রথমেই এ কথা আমাকে বলিতে পারিতেন। আপনাদিগের প্রস্তাবে যদি আমি সম্মত হইতে পারিতাম, তাহা হইলে উহাদিগের নিমিত্ত আহারীয় প্রস্তুত করিতাম, আর যদি সেই প্রস্তাব আমার সাধ্যাতীত হইত, তাহা হইলে আপনাদিগকে সেলাম করিয়া আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করিতাম। আচ্ছা, এখন বলুন দেখি, উহাদিগকে আহার করিবার অনুমতি দিবার নিমিত্ত আপনারা কি প্রার্থনা করেন?

 প্রহরী। পঁচিশ টাকা।

 হোসেন। আপনারা পাঁচজন আছেন, আপনাদিগের প্রত্যেক কেই পঁচিশ টাকা করিয়া আমাকে প্রদান করিতে হইবে?

 প্রহরী। না, মোট পঁচিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে।

 হোসেন। পঁচিশ টাকা আমি প্রদান করিতে পারিব না। আপনারা পাঁচজন আছেন, প্রত্যেককে দুই টাকা হিসাবে মোট আপনাদিগকে আমি দশ টাকা প্রদান করিতেছি। ইহাতে আপনার সম্মত হইয়া আসামীদ্বয়কে আহার করিবার নিমিত্ত অনুমতি প্রদান করেন ভালই, নতুবা আমি এ স্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি, আপনাদিগের মনে যাহা উদয় হয়, তাহা করিবেন।

 প্রহরী। আপনাকে আর প্রস্থান করিতে হইবে না। দশ টাকা নিতান্ত অল্প হইতেছে, আর পাঁচটী টাকা বাড়াইয়া দিন।

 হোসেন। পাঁচ টাকা ত দূরের কথা, দশ টাকার উপর আমি আর পাঁচটা পয়সাও বাড়াইয়া দিতে পারিব না। ইহাতে আপনাদিগের যাহা অভিরুচি হয়, তাহা করিতে পারেন।  প্রহরী। যে কার্য্যে আপনারা অসন্তুষ্ট হন, সে কার্য্য আমাদিগের কোনরূপেই কর্ত্তব্য নহে। আচ্ছা, আপনার প্রস্তাবেই আমরা সম্মত হইলাম। টাকা দশটা কখন প্রদান করিবেন?

 হোসেন। যখন আপনাদিগের আবশ্যক হইবে, তখনই আপনারা লইতে পারেন। এখনই চাহেন, তাহাও আমাকে বলুন, এখনই আমি উহা আপনাদিগের হস্তে প্রদান করিতেছি। |

 প্রহরী। সেই ভাল। আমি একাকী নহি, পাঁচজনের কার্য্য, অগ্রে দেওয়াই ভাল।

 প্রহরীর কথা শুনিয়া হোসেন আর কোন কথা কহিলেন, দশটী টাকা বাহির করিয়া তৎক্ষণাৎ সেই প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন।

 হোসেন টাকা প্রদান করিলেন সত্য; কিন্তু মনে মনে বড়ই অসন্তুষ্ট হইলেন। মনে করিলেন, এরূপ অত্যাচার করিয়া টাকা লওয়া নিতান্ত অন্যায়। আসামীর সহিত কথা কহিবার প্রয়োজন হইলে টাকা ভিন্ন হইতে পারিবে না। স্নানের নিমিত্ত টাকা, জলপানের নিমিত্ত টাকা, আহারের নিমিত্ত টাকা, এবং বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত একখানি চারিপায়া প্রদান করিতে হইলেও টাকা! কি ভয়ানক অত্যাচার। এই সকল অত্যাচারের নিমিত্তই পুলিসের এত দুর্নাম।

 হোসেন মনে মনে এইরূপ ভাবিতে লাগিলেন সত্য; কিন্তু প্রকাশ্যে কোন কথা কহিতে পারিলেন না। গোফুর খাঁ ও ওসমান, প্রথমতঃ কিছুতেই আহার করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু কোন প্রকারেই হোসেনের অনুরোধ লঙ্ঘন করতে না পারিয়া, আহার করিবার নিমিত্ত একবার বসি-

লেন মাত্র; ফলতঃ আহার করিতে পারিলেন না, চক্ষু-জলে আহারীয় ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

 আহারান্তে প্রহরীগণ আপনাপন চারিপায়ার উপর শয়ন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল। কেবল একজন মাত্র প্রহরী আসামীদ্বয়কে পাহারা দিতে লাগিল। আসামীদ্বয় সেই গৃহের ভিতর কয়েদী অবস্থায় বিষন্ন মনে বসিয়া রহিলেন।

 এইরূপে প্রায় সমস্ত দিবস সেই স্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। সন্ধ্যা হইতে অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, সেই সময় একজন প্রহরী এক্কা-চালকগণকে ডাকিল ও কহিল, “বেলা প্রায় অবসন্ন হইয়া আসিয়াছে। এখনও অনেকদূর আমাদিগকে গমন করিতে হইবে, আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। এক্কা সকল শীঘ্র প্রস্তুত করিয়া আন, আমরা এখনই এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।”

 প্রহরীর কথা শুনিয়া এক্কা-চালকগণ তখনই এক্কা প্রস্তুত করিয়া আনিল। প্রহরীগণ আসামীদ্বয়ের সহিত উহাতে আবোহণ করিল, হোসেনও আপনার দুইজন পরিচারকের সহিত আপন এক্কায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের একার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। এক্কা-চালকগণ অখে কষাঘাত করিতে করিতে বেগে একা চালাইতে আরম্ভ করিল।

 সন্ধ্যার অল্প পরেই সকলে একটী থানায় গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে সকলে এক্কা হইতে অবতরণ করিয়া থানার ভিতর প্রবেশ করিলেন। থানায় সেই সময় দারোগা উপস্থিত ছিলেন না, কোন কার্য্য উপলক্ষে তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। অনুসন্ধানে হোসেন জানিতে পারিলেন যে, সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী অর্থাৎ দারোগাও একজন মুসলমান বংশ-সদ্ভূত।  যে সকল এক্কায় আরোহণ করিয়া আসামীদ্বয়, প্রহরীগণ ও হোসেন প্রভৃতি গমন করিয়াছিলেন, এখন সেই সকল একা বিদায় করিয়া দিবার প্রয়োজন হইল। কারণ, তাহারা অনেকদূর আগমন করায়, তাহাদিগের অশ্বগণ সবিশেষরূপ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তদ্ব্যতীত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় সেই স্থানে যতগুলি এক্কার প্রয়োজন হইবে, ততগুলিই অনায়াসে পাওয়া যাইবে।

 এইরূপ বন্দোবস্ত দেখিয়া, যে এক্কায় হোসেন তাঁহার ভৃত্যদুয়ের সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তাহাকে ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন। সেই একা-চালককে যে পরিমিত ভাড়া দিবার নিমিত্ত প্রহরীগণ বলিয়া দিল, হোসেন তাহাতে দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাই দিয়াছিলেন। এক্কা-চালক আপনার ভাড়া পাইয়া থানার বাহিরেগিন উপবেশন করিল।

 কেবলমাত্র একখানি এক্কার ভাড়া দিতে দেখিয়া একজন প্রহরী কহিল, “আপনি কেবলমাত্র একখানি এক্কার ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন দেখিতেছি। আর অপর এক্কা তিনখানি, যাহাতে আপনার মনিবদ্বয় এবং আমরা আসিয়াছি, তাহার ভাড়াও ওই সঙ্গে দিলেন না কেন?”

 হোসেন। আপনাদিগের এক্কা-ভাড়া প্রভৃতি যাহা কিছু ব্যয় হইবে, তাহার নিমিত্ত আমি এককালীন আপনাদিগকে পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিয়াছি। তাহা হইতে, এক্কা-ভাড়া প্রদান করিতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?

 প্রহরী। আপত্তি আর কিছুই নাই, তবে এখন আপনি দিয়া দিলেও কোন ক্ষতি নাই।  হোসেন। আমি একবার প্রদান করিয়াছি। বলেন না হয়, আর একবার প্রদান করি। যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে আপনাদিগের হাতে পড়িয়াছি, তখন যাহা বলিবেন, তাহাই করিতে হইবে।

 প্রহরী। আপনি অসন্তুষ্ট হইবেন না। এক্কা-ভাড়া এখন আপনি প্রদান করুন, বা আমরা প্রদান করি, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি নাই। কারণ, আমাদিগের নিকট আপনার যে পঞ্চাশ টাকা আছে, খরচ-পত্র বাদে তাহা হইতে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা আপনারই। আর যদি উহাতে সমস্ত খরচের সঙ্কুলান না হয়, তাহা হইলে আর যাহা লাগিবে, তাহা আপনাকে দিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় সামান্য এক্কা-ভাড়ার নিমিত্ত এত গোলযোগ করিতেছেন কেন?

 হোসেন। আমি কোনরূপ গোলযোগই করিতেছি না। যে টাকা আপনাদিগের নিকট আছে, তাহা হইতে এক্কা-ভাড়া প্রদান করিতে যদি আপনাদিগের কোনরূপ অসুবিধা হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রদান করিতেছি।

 প্রহরী। অসুবিধা আর কিছুই নয়। তবে টাকাগুলি যেরূপ ভাবে বাঁধিয়া রাখা আছে, তাহা হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া লইতে হইলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই যাহাতে এক্কাওয়ালাগণের আর বিলম্ব না হয়, সেই নিমিত্ত ভাড়াটা এখন আপনাকে দিতে বলিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই।

 হোসেন। সামান্য টাকার নিমিত্ত আর অধিক কথার প্রয়োজন নাই। আমি এখন উহা প্রদান করিতেছি, যেরূপ ভাল বিবেচনা হয়, পরিশেষে আপনারা তাহা করিবেন।  এই বলিয়া হোসেন আর তিনখানি এক্কার ভাড়াও আপনার নিকট হইতে উহাদিগকে দিয়া দিলেন।

 আপনাপন ন্যায্য মজুরি বুঝিয়া লইয়া এক্কাওয়ালাগণ সেই স্থান হইতে তখনই প্রস্থান করিল। প্রহরীগণের ব্যবহার দেখিয়া হোসেন মনে মনে ভাবিলেন, উহাদিগের খরচের নিমিত্ত যে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হইয়াছে, তাহা পাইবার আর কোনরূপ উপায় নাই। অথচ আরও যাহা কিছু খরচ হইবে, তাহার সমস্তই তাহাকে বহন করিতে হইবে।

 এই সময় গোফুর খাঁ হোসেনকে তাহার নিকট ডাকিলেন। হোসেন তাহার নিকট গমন করিলে তিনি কহিলেন, “হোসেন। আমি দেখিতেছি, তুমি নিরর্থক অনেক অর্থ নষ্ট করিতেছ।”

 হোসেন। আপনাদিগের জীবন অপেক্ষা কি অর্থের মূল্য অধিক? যে আপনাদিগের নিমিত্ত আমি সেই অর্থ ব্যয় করিব না?

 গোফুর। আমাদিগের জীবন রক্ষার নিমিত্ত অর্থ ব্যয় করিতে আমাদিগের কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু এইরূপ নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিয়া কি আমাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারিবে?

 হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারিব না সত্য; কিন্তু আপাততঃ আপনাদিগের কষ্টের অনেক লাঘব করিতে সমর্থ হইব।

 গোফুর। যাহাদিগের জীবনের আর কিছুমাত্র আশা নাই, দুই চারিদিবসের নিমিত্ত তাহাদিগের শারীরিক কষ্ট নিবারণ করিয়া ফল কি? মানসিক কষ্টের নিকট শারীরিক কষ্ট কিছুই নহে। যে ব্যক্তি সর্বদা মানসিক কষ্ট ভোগ করিতেছে, তাহার যতই কেন শারীরিক কষ্ট হউক না, তাহার দিকে তাহার লক্ষ্যই হয় না।  হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আমাদিগের সম্মুখে আপনি শারীরিক কষ্ট ভোগ করিবেন, অর্থ থাকিতে আমরা কিরূপে উহা দেখিতে সমর্থ হইব? আর আপনাদিগের জীবনের আশা নাই, এ কথাই বা আপনার কিরূপে অনুমান করিলেন?

 গোফুর। যাহার ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার আর জীবনের আশা কি?

 হোসেন। এখনও অনেক আশা আছে। যে বিচারালয় হইতে আপনাদিগের ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার উপর বিচারালয় আছে। সেখানে আপীল করিব, যেরূপ ভাবে ও যত অর্থ ব্যয় করিয়া চেষ্টা করিতে হয়, তাহা করিব। ইহাতে কি কোনরূপ ফল প্রাপ্ত হইব না? ঈশ্বর না করুন, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিব; আবশ্যক হইলে বড় লাটের নিকট পর্য্যন্ত গমন করিব। পরিশেষে বিলাত পর্যন্ত চেষ্টা করিব। ইহাতেও কি সুবিচার হইবার সম্ভাবনা নাই? যদি ইহাতেও না পারি, তাহা হইলে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত অসৎ উপায় অবলম্বন করিতে ক্রটি করিব না। আপনি আপনার মনকে স্থির করিয়া রাখুন। দেখিবেন, যেরূপ উপায়েই হউক, কখনই আপনাদিগকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে দিব না।

 গোফুর। তুমি যাহা মনে করিতেছ, তাহা সম্পূর্ণরূপ অসম্ভব। ইহা কখনই হইতে পারে না।

 হোসেন। জগতে অসম্ভব কিছুই নাই; অর্থে না হইতে পারে, এরূপ কোন কার্য্যই নাই। দেখিবেন, যাহা মুখে বলিতেছি, কার্যে তাহা পরিণত করিতে পারি কি না!  গোফুর। আমার বিবেচনায় তুমি আর নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিও না। আমাদিগের নিমিত্ত এইরূপ ভাবে যে অর্থ ব্যয় করিবে, তাহা আমাদিগের নামে দরিদ্র ব্যক্তিকে দান করিও। তাহা হইলে আমাদিগের পরকালের অনেক উপকার করা হইবে। ইহকালে যাহা হইবার, তাহা হইল।

 হোসেন। গরিব-দুঃখীকে আপনারা যেরূপ ভাবে অর্থ দান করিতে কহিবেন, তাহা আমরা করিব। তদ্ব্যতীত আপনাদিগের জীবন-রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে চেষ্টা করিতে ক্রটি করিব। বিশেষ-

 গোফুর। বিশেষ কি?

 হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ আমি যে নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতেছি, তাহা নহে। আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ সকলেই আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত তাঁহাদিগের সঞ্চিত সমস্ত অর্থ ও তাঁহাদিগের সমস্ত অলঙ্কার-পত্র পর্য্যন্ত আমার হস্তে প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এবং বলিতেছেন, যদি কোনরূপে আমি আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে তাহার সকলেই বিষপান করিয়া আপনাপন জীবন নষ্ট করিবেন। আমি যদিচ এখন তাহাদিগের নিকট হইতে কোন অর্থ গ্রহণ করি নাই, তথাপি যদি আমি এইরূপ ব্যয় করিয়া আপনাদিগের জীবন রক্ষার কোনরূপ উপায় না করি, তাহা হইলে কি সর্বনাশ ঘটিবে, একবার মনে করিয়া দেখুন দেখি?

 গোফুর। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ যখন আমাদিগের জীবনের নিমিত্ত এত উৎসুক, তাঁহাদিগের নিমিত্ত কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন?  হোসেন। সে সম্বন্ধে আমি এ পর্য্যন্ত কিছুই মনে ভাবি নাই। কারণ, আমার বিশ্বাস, এ সম্বন্ধে আমার কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না!

 গোফুর। কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না কেন?

 হোসেন। যখন আমার বিশ্বাস যে, যেরূপে পারি, আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিব, তখন আমার সেই সকল দিকে এখন দৃষ্টি করিবার কোনরূপ প্রয়োজন নাই। যেরূপ ভাবে এ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে, এখন সেইরূপ ভাবেই চলুক। পরিশেষে আপনারা নিষ্কৃতি লাভ করিয়া যখন বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন, সেই সময় আপনার যেরূপ অভিরুচি হয়, সেইরূপ করিবেন।

 গোফুর। সে বহুদূরের কথা।

 হোসেন। আমি দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইতেছি, উহা দূরের কথা নহে।

 গোফুর। সে পরের কথা। আমাদিগকে বাঁচাইতে পারিবে, এরূপ লুব্ধ আশ্বাসের উপর একবারে নির্ভর করিয়া থাকিও না। আমাদিগকে খালাস করিবার যতদূর চেষ্টা করিতে হয়, কর; অথচ অপরাপর বন্দোবস্তের দিকেও সবিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিও। কারণ, যদি আমাদিগের জীবন রক্ষাই না হয়, তাহা হইলে আমি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতে আমার ইচ্ছামত বিষয়-আদির বন্দোবস্ত করার আবশ্যক। জমিদারী সম্বন্ধে কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিতেছ?

 হোসেন। এখনও কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার চেষ্টা করি নাই। যেরূপ আদেশ করিবেন, সেইরূপ ভাবেই বন্দোবস্ত করিব।  গোফুর। মোকদ্দমার খরচের নিমিত্ত যে টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছ, সেই টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ নষ্ট করিতে হইয়াছে কি?

 হোসেন। টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ আমি নষ্ট করি নাই, বা উহা বন্ধক দিতেও হয় নাই। সরকারী তহবিলের যে যে স্থানে যে যে টাকা মজুত ছিল, তাহাই সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি মাত্র। যদি কিছু দেনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার নিমিত্ত বিষয়-আদি কিছুই বন্ধক দিতে হইবে না। সমস্ত জমিদারী এ পর্য্যন্ত যেরূপ ভাবে ছিল, এখনও সেইরূপ ভাবেই আছে।

 হোসেন ও গোফুর খাঁর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে একজন প্রহরী আসিয়া আসামীদ্বয়কে হাজতের ভিতর বন্ধ করিয়া দিল। সুতরাং উভয়ের কথাবার্তা সেই সময়ের নিমিত্ত শেষ হইয়া গেল। আসামীদ্বয় সবিশেষ দুঃখিত অন্তঃকরণে হাজতের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

সম্পূর্ণ।


  • শ্রাবণ মাসের সংখ্যা,

“ঘর-পোড়া লোক।”


(শেষ অংশ)
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
যন্ত্রস্থ।