বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

রহস্যপ্রিয় কৌতুকময়ী চঞ্চল নারীপ্রকৃতি চাপা দেওয়া আছে, তাহার অপর্যাপ্ত হাসির প্রস্রবণ যে ব্রতোপবাসের সহস্রবিধ কৃচ্ছ্রসাধনায় আজও শুকায় নাই―ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় সে তেমনি জীবন্ত―এই কথা স্মরণ করিয়া সর্বশরীরে তাহার কাঁটা দিল। পরিহাসে নিজেও যোগ দিয়া হাসিয়া কহিল, হয়ত বা মাঝে মাঝে মায়ের স্থানে বলি দিয়ে খেতো। অর্থাৎ আমার শ্বশুর কিংবা শাশুড়ীঠাকরুন ইতিমধ্যে আপনার কাছে এসেছিলেন, এবং অনেক অপ্রিয় অসত্য শুনিয়ে গেছেন।

 ষোড়শী কহিল, না, তাঁরা কেউ আসেন নি। আমি যে মন্ত্রেতন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেচি এটা অসত্য হতে পারে, কিন্তু অপ্রিয় হবে কেন নির্মলবাবু? তা ছাড়া আপনার আসার ধরন দেখে নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে হয়ত বা নিতান্ত মিথ্যা না হতেও পারে। তাহার মুখে হাসির আভাস লাগিয়াই রইল, কিন্তু গলার শব্দ বদলাইয়া গেল। ওষ্ঠপ্রান্তে ও কণ্ঠস্বরে সহসা যেন আর সঙ্গতি রহিল না।

 নির্মল আশ্চর্য, অবাক হইয়া রহিল। ইহার কতটুকু পরিহাস এবং কতখানি তিরস্কার, এবং কিসের জনা তাহা সে কিছুতে ভাবিয়া পাইল না।

 ষোড়শী নিজেও আর কিছু কহিল না, কিন্তু তাহার আনত মুখের পরে যে অপ্রত্যাশিত লজ্জার আরক্ত আভা পলকের নিমিত্ত ছায়া ফেলিয়া গেল, ইহা তাহার চোখে পড়িল। কিন্তু সে ঐ পলকের জন্যই। ষোড়শী আপনাকে সামলাইয়া লইয়া মুখ তুলিয়া হাসিমুখে কহিল, কুটুমের অভ্যর্থনা ত হলো। অবশ্য হাসি-খুশি দিয়ে যতটুকুই পারি ততটুকুই―তার বেশী ত সম্বল নেই ভাই―এখন আসুন, বরঞ্চ কাজের কথা কওয়া থাক।

 তাহার ঘনিষ্ঠ সম্ভাষণকে এবার সে সংশয়ের সহিত গ্রহণ করিতে চাইল, তবুও তাহার মন ভিতরে ভিতরে উল্লসিত হইয়া উঠিল। কহিল, বলুন।

 ষোড়শী কহিল, দুটি লোক দেবতাকে বঞ্চিত করতে চায়। একটি রায়মহাশয়, আর একটি জমিদার―

 নির্মল বলিল, আর একটি আপনার বাবা। এঁরাই ত আপনাকেও বঞ্চিত করতে চান।

 বাবা? হ্যাঁ, তিনিও বটে। এই বলিয়া ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।

 নির্মল বলিল, আমার শ্বশুরের কথা বুঝি, আপনার বাবার কথাও কতক বুঝতে পারি, কিন্তু পারিনে এই জমিদার প্রভুটিকে বুঝতে। তিনি কিসের জন্য আপনার এত শত্রুতা করেন?

 ষোড়শী বলিল, দেবীর অনেকখানি জমি তিনি নিজের বলে বিক্রি করে ফেলতে চান, কিন্তু আমি থাকতে সে কোনমতেই হবার জো নাই।

 নির্মল সহাস্যে কহিল, সে আমি সামলাতে পারব। বলিয়া সে কটাক্ষে ভৈরবীর মুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া দেখিল, ষোড়শী নীরব হইয়া আছে, কিন্তু তাহার মুখের কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। খানিক পরে মুখ তুলিয়া ধীরে ধীরে কহিল, কিন্তু আরও অনেক জিনিস আছে, যা আপনিও হয়ত সামলাতে পারবেন না।

 কি সে-সব? একটা ত আপনার মিথ্যে দুর্নাম?

১২১