বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৫৭৪
উপেন্দ্রকিশাের রচনাসমগ্র

 তথাপি রাজার চিন্তা দূর হইল না। চাকর চাকরানীরা যদি কথা না শোনে আর যদি বৃষ্টি হয়? এই ভাবিয়া রাজা নিতান্ত ব্যস্ত ভাবে রানীর নিকট বসিয়া ক্রমাগত চাকরানীদিগের উপর পাহারা দিতে লাগিলেন, আর, মেঘ আসিলেই জানালা বন্ধ করিতে হইবে, তাই তিনি প্রত্যেক মিনিটে দুবার করিয়া ছাতে উঠিয়া আকাশ দেখিতে লাগিলেন।

 কাজেই রাজার আর রাজ্যের কাজ দেখিবার অবসর রহিল না। মন্ত্রীরা ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, প্রজারা চটিয়া গেল। রাজাকে খবর দিতে গেলেই তিনি বলেন, আমার অবসর কোথায়?

 মাসের পর মাস এইভাবে গেল, ইহার মধ্যে কেহই রাজার দর্শন পাইল না। বুড়া মন্ত্রী দাড়ি চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, তাই ত? ইহার একটা উপায় না করিলে নয়।

 অন্দরমহলে চাকরানীদিগকে মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাদের কি কি কাজ করিতে হয়?

 চাকরানীরা বলিল, যাহাতে বাড়ির ভিতর জল না আসে, সকল কাজের আগে আমাদিগকে তাহাই দেখিতে হয়।

 রানী যে জল দেখিতে নারাজ, মন্ত্রীমহাশয় তাহার কথা একটু একটু শুনিয়াছিলেন, তিনি চাকরানীদিগের কথা শুনিয়া ভাবিলেন, ‘হুঁ—উ’ তবে দেখিতেছি, রানীকে জল দেখাইবার ফন্দি করিতে হইল।

 এই ভাবিয়া মন্ত্রী মহাশয় একটি বাগান প্রস্তুত করাইলেন। বাগানের ভিতরে এমন একট বাড়ি হইল যে, বাহিরে বৃষ্টি হইলেও সে বাড়ীর ভিতর হইতে তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না। সেই বাগানে একটি অতি সুন্দর ছোট পুকুরও ছিল, কিন্তু তাহা দেওয়াল এবং গাছপালার ঘোরফেরের মধ্যে এমনি কৌশলপূর্বক লুকাইয়া রাখা হইয়াছিল যে, দিনকতক, বাগানেব ভিতরে না ঘুরিলে আর তাহার সন্ধান পাইবার জো ছিল না।

 ক্রমে রাজা সংবাদ পাইলেন যে, মন্ত্রী একটি আশ্চর্য বাগান করিয়াছেন, তাহার ভিতরে জল নাই, আর তাহার মধ্যে একটি সুন্দর বাড়ি আছে, সে বাড়ির ভিতরে থাকিলে বাহিরে বৃষ্টি হইলে তাহা দেখা যায় না। ক্রমাগত ছাতে উঠিয়া উঠিয়া রাজা মহাশয়ের বড়ই পা ধরিয়া গিয়াছিল। মন্ত্রীর বাগানবাড়ির কথা শুনিয়া তিনি লম্বা নিশ্বাস ফেলিলেন, আর বলিলেন, আমি উহা দেখিতে যাইব!

 বাগানবাড়ি দেখিয়া রাজার এতই ভালো লাগিল যে, তিনি রানীকে সেখানে লইয়া আসিতে আর একদিনও বিলম্ব করিলেন না, বুড়া মন্ত্রীর মনের ভিতরে আর হাসি ধরে না। তিনি পরম আদরে রাজা ও রানীকে বাগানে পৌঁছাইয়া দিয়া, বাহির হইতে তালা লাগাইয়া দিলেন।

 এতদিন ঘরের ভিতরে বন্ধ থাকার পর বাগানের খোলা হাওয়ায় রাজা রানীর প্রাণ জুড়াইয়া গেল। তাঁহারা দুইজনে ভোরে উঠিয়া বাগান দেখিতে আরম্ভ করিলেন, দুপুরবেলাও ঘরে ফিরিলেন না। রাজামহাশয় একে ত সেই রানীকে আনিয়া অবধি জল খান নাই, ইহার উপর আবার দুপুরবেলায় প্রখর রোদ লাগিয়া, তাঁহার এমনি ভয়ানক পিপাসা আর জ্বালা হইল যে কি বলিব। পিপাসার তাড়নায় তিনি রোদ ছাড়িয়া ক্রমাগত ঘন ছায়ার দিকে যাইতে লাগিলেন, সেই ঘন ছায়ার ভিতরে, ঘনগাছের আড়ালে, রাজামহাশয় আসিয়া দেখিলেন—