ভাতের জোগাড় করে তাহা এই নোরিয়াদিগকে দেখিলে বেশ বুঝিতে পারা যায়। অবশ্য আমাদের দেশের জেলেরাও কম কষ্ট পায় না। শীত, গ্রীষ্ম, রোদ, বৃষ্টি, কুমিরের ভয় ইহাদের বেলাও খুব আছে। কিন্তু সমুদ্রে মাছ ধরার যে ক্লেশ দেখিয়াছি তাহার কাছে ঐ সকল কিছুই নহে।
সচরাচর তিনরকম উপায়ে ইহারা মাছ ধরিয়া থাকে। এক উপায় ছেট ছেট জাল লইয়া সমুদ্রের কুলে কুলে ছোট-ছোট মাছ ধরা। হাত পনেরো লম্বা আর হাত দেড়েক চওড়া একখানি জাল, তাহার মাঝে মাঝে এড়োভাগে সরু সরু কাঠি পরানো। দুজন লোক জালের দুই মাথায় ধরিয়া জলের ধারে ধারে চলিতে থাকে। যেই একটা ঢেউ আসিয়া ডাঙ্গার উপরে খানিক দূর অবধি উঠিয়া যায়, অমনি তাহার ফিরিবার পথে জালখানিকে দুজনে বেড়ার মতন খাড়া করিয়া ধরিয়া তাহার পথ আগলায়। কাঠির সাহায্যে জালখানি বেশ দাঁড়াইয়া থাকে, সুতরাং জল সরিবার সময় তাহাকে জালের ভিতর দিয়া সরিতে হয়, আর মাছ আটকা পড়ে। বড় ঢেউ থাকিলে ঐ উপায়ে মাছ ধরা চলে না, আর ইহাতে ছোট-ছোট মাছই পড়ে, তাহাও বেশি নহে।
দ্বিতীয় উপায়, কাটামারণে করিয়া সমুদ্রের ভিতরে গিয়া জাল দিয়া মাছ ধরা। ঐ জাল কিরকম তাহা দেখি নাই। কারণ যাইবার সময় উহা গুটানো থাকে, আর মাছ ধরিবার কাজটা সমুদ্রের ভিতরে এত দুরে হয় যে, ভালো করিয়া দেখাই যায় না। জেলেরা সকাল সকাল উঠিয়া মাছ ধরিতে বাহির হয়, আর দুপুরবেলায় ফিরিয়া আসে। যাইবার সময় ঢেউয়ের হাতে ইহাদিগকে বিস্তার লাঞ্ছনা পাইতে হয়। কতবার কাটামারণসুদ্ধ উলটাইয়া জলে পড়ে। আবার সেই ঢেউয়ের অত্যাচারের ভিতরেই কাটামারণ সোজা করিয়া পুনরায় উঠিয়া বসিতে হয়। কাটামারণের কাঠগুলি কর্কের মতন জলে ভাসে, আর খুব হালকা। কাটামারণ উলটিয়া গেলে তাহাকে সহজেই সোজা করা যায়। তবে টুপি পরিয়া মাথাটাকে বাঁচাইবার কতক চেষ্টা হইয়া থাকে বটে। ঐ ঢেউয়ের মুখে সোজা করাই অসম্ভব হইত, তাহার উপর আবার উহার আবার উহার জল সেঁচার দরকার। এই জন্যই ঐ স্থলে নৌকা ব্যবহার হইতে পারে না। আর নৌকায় করিয়া ঐ প্রণালীতে মাছ ধরাও সহজ হইত না।
ছোট-ছোট এক একটি কাটামারণে দুজন লোক ধরে। দুজনে মিলিয়া মাছও ধরে, কাটামারণও সামলায়, আর তাহা করিতেই তাহাদের সময় চলিয়া যায়। শরীরের যত্ন করিবার অবসরও হয় না, সুতরাং তাহার কোনো চেষ্টাও হয় না। তবে টুপি পরিয়া মাথাটাকে বাঁচাইবার কতক চেষ্টা হইয়া থাকে বটে। ঐ সকল টুপি উহারা বাঁশের চটা দিয়া নিজেই বুনিয়া থাকে। দেখিতে ঠিক সেঁউতীর মতন।
এসকল উপায়ে মাছ ধরিতে ছোট-ছোট জালই ব্যবহার হয়। নভেম্বর মাস হইতে উহারা বড় বড় জাল দিয়া মাছ ধরিতে আরম্ভ করে। আর সেই সময় হইতেই মাছ ধরা দেখিবার আমোদ আরম্ভ হয়। তখন আর কাটামারণে কাজ চলে না, নৌকার দরকার হয়। নৌকায় করিয়া অনেক দূর অবধি জাল ফেলিয়া আসে; তারপর ডাঙ্গায় আসিয়া তাহাকে টানিয়া তোলে। এক একটা জালের পিছনে কুড়ি-পঁচিশ জন করিয়া লোক খাটিতে হয়। স্ত্রী-পুরুষ, ছেলেবুড়ো সকলে মিলিয়া ইহাতে যোগ দেয়।
আসল যে জাল, সেটা একটা প্রকাণ্ড থলে;তাহার ভিতরে কুড়ি-বাইশজন মানুষ পুরিয়া