বিষয়বস্তুতে চলুন

আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/কৃতঘ্নতা

উইকিসংকলন থেকে

কৃতঘ্নতা

এক সৈনিক পুরুষ রণক্ষেত্রে অসাধারণ সাহসপ্রদর্শন করাতে, মাসিডনের অধীশ্বর ফিলিপের সাতিশয় অনুগ্রহভাজন হইযাছিল। সে জলপথে কোন স্থানে যাইতেছিল; পথিমধ্যে, অতি প্রবল বাত্যা, উপস্থিত হওয়াতে, নৌকা জলমগ্ন হইল। সে, প্রবল তরঙ্গবেগে তীরে নিক্ষিপ্ত হইয়া, উলঙ্গ ও মৃতপ্রায় পতিত রহিল। ঘটনাক্রমে,' ঐপ্রদেশের এক ব্যক্তি, সেই সময়ে, সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, তাহার তাদৃশী দশা দর্শনে দয়ার্দ্রচিত্ত হইয়া, তাহাকে আপন অলিয়ে লইযা গেলেন; এবং সবিশেষ যত্ন সহকারে, অশেষ প্রকারে, তাহার শুশ্রুষা কবিতে লাগিলেন। চল্লিশ দিন তাঁহার আশ্রয়ে থাকিয়া, সে ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল হইয়া উঠিল। তিনি দয়া করিয়া, স্বীয় আলয়ে না লইয়া গেলে, এবং সবিশেষ যত্ন, পরিশ্রম ও অর্থব্যয়স্বাকার পূর্ব্বক, তাহার শুশ্রুষা না করিলে, সে নি সন্দেহ, কালগ্রাসে পতিত হইত। তিনি, যথোপযুক্ত পরিচ্ছদ ও আবশ্যক পাথেয় দিযা তাহাকে স্বদেশগমনার্থ বিদায় করিলেন।

 প্রস্থানকালে, সৈনিক পুরুষ স্বীয় আশ্রয়দাতাকে বলিল, মহাশয, আমার সৌভাগ্যক্রমে, আপনি, সেদিন, সেস্থানে উপস্থিত হইয়াছিলেন, নতুবা অমার অবধাবিত প্রাণবিয়োগ ঘটিত। অপিনি, আমার জন্য, যেরূপ যত্ন, যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ অর্থব্যয় করিছেন, পিতা, পুত্রের জন্য, সেরূপ করিতে পাবেন কি না, সন্দেহস্থল। আপনি আমার যে উপকার করিয়াছেন, আমি কস্মিন্ কালেও তাহা ভুলিতে পারিব না। অধিক আর কি বলিব, আপনি আমার জন্মদাতা পিতা অপেক্ষাও অধিক। এইরূপ বলিয়া, অসমযে আশ্রয়দাতার নিকট বিদয় লইয়া, সৈনিকপুরুষ স্বদেশ অভিমুখে প্রস্থান করিল।  সৈনিক পুরুষের আশ্রয়দাতা যে ভূমিতে বাস ও কৃষিকর্ম্ম দ্বারা জীবিকানির্ব্বহ করিতেন, ফিলিপ, দানপত্র দ্বারা, সেই ভূমি, ঐ সৈনিক পুরুষকে পুরস্কারস্বরূপ দিলেন। এইরূপে সে, প্রাণদাতার অধিকৃত ভূমির অধিকারী হইযা, তাঁহার গৃহ ভগ্ন করিয়া, তাহাকে বলপূর্বক উঠাইয়া দিল। তিনি, তদীয় ঈদৃশ অকৃতজ্ঞতা দর্শনে, সতিশয় বিস্মিত ও নিরিতিশয় দুঃখিত হইলেন, এর আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত আবেদনপত্র দ্বারা, ফিলিপের গোচর কবিলেন। মানুষ এতদূর অকৃতজ্ঞ হইতে পারে, তাহার সেরূপ বোধ ছিল না। পত্রপাঠ মাত্র, তাঁহার কোপানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি, তৎক্ষণাৎ পূর্ব্ব-স্বামীকে সেই ভূমিতে অধিকারপ্রদানের আদেশপ্রদান কবিলেন, এবং সেই পাপিষ্ঠ সৈনিকপুরুষকে স্বীয় সমক্ষে আনাইয়া, তাহার ললাটে, কৃতঘ্ন নরাধম, এই দুটি শব্দ লেখাইয়া, আপন অধিকার হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।

 কৃতঘ্ন ব্যক্তি, সর্ব্বকালে, সর্ব্ব-দেশে, সর্ব্ব সমাজে, নিরতিশয় নিন্দনীয় হইয়া থাকে। মনুষ্যের যত দোষ সম্ভবিতে পারে, গ্রীদেশীয় লোকে কৃতঘ্নতাকে, সেই সমস্ত দোষ অপেক্ষা, গুরুতর বিবেচনা করিতেন। তাঁহারা কৃত ব্যক্তির সহিত বাক্যালাপ ও তাহার মুখাবলোকন, করিতেন না।