আধুনিক সাহিত্য/বিহারীলাল

উইকিসংকলন থেকে

বিহারীলাল


বর্তমান নববর্ষের প্রারম্ভেই কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পরলোক প্রাপ্তি হইয়াছে।

 বঙ্গের সারস্বতকুঞ্জে মৃত্যু ব্যাধের ন্যায় প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নিষ্ঠুর শরসন্ধানে অল্পকালের মধ্যে অনেকগুলি কণ্ঠ নীরব হইয়া গেল।

 তন্মধ্যে বিহারীলালের কণ্ঠ সাধারণের নিকট তেমন সুপরিচিত ছিল না। তাঁহার শ্রোতৃমণ্ডলীর সংখ্যা অল্প ছিল এবং তাঁহার সুমধুর সংগীত নির্জনে নিভৃতে ধ্বনিত হইতে থাকিত, খ্যাতির প্রার্থনায় পাঠক এবং সমালোচক -সমাজের দ্বারবর্তী হইত না।

 কিন্তু যাহারা দৈবক্রমে এই বিজনবাসী ভাবনিমগ্ন কবির সংগীতকাকলিতে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার কাছে আসিয়াছিল তাহাদের নিকটে আদরের অভাব ছিল না। তাহারা তাঁহাকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলিয়া জানিত।

 বঙ্গদর্শন প্রকাশ হইবার বহুপূর্বে কিছুকাল ধরিয়া অবোধবন্ধু-নামক একটি মাসিক পত্র বাহির হইত। তখন বর্তমান লেখক বালক-বয়সপ্রযুক্ত নিতান্ত অবোধ ছিল। কিঞ্চিৎ বয়ঃপ্রাপ্তি-সহকারে যখন বোধোদয় হইল তখন উক্ত কাগজ বন্ধ হইয়া গেল।

 সৌভাগ্যক্রমে পত্রগুলি কতক বাঁধানো কতক বা খণ্ড আকারে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আলমারির মধ্যে রক্ষিত ছিল। অনেক মূল্যবান্ গ্রন্থাদি থাকতে সে আলমারিতে চপলপ্রকৃতি বালকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। এক্ষণে নির্ভয়ে স্বীকার করিতে পারি, অবোধবন্ধুর বন্ধুত্ব-প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়া সে নিষেধ লঙ্ঘন করিয়াছিলাম। এই গোপন দুষ্কর্মের জন্য কোনোরূপ শান্তি পাওয়া দূরে থাক্, বহুকাল ধরিয়া যে আনন্দলাভ করিয়াছিলাম তাহা এখনো বিস্তৃত হই নাই।

 এখনো মনে আছে, ইস্কুল ফাকি দিয়া একটি দক্ষিণদ্বারী ঘরে সুদীর্ঘ নির্জন মধ্যাহ্নে অবোধবন্ধু হইতে পৌল-বর্জিনীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করিতে করিতে প্রবল বেদনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। তখন কলিকাতার বহির্বর্তী প্রকৃতি আমার নিকট অপরিচিত ছিল—এবং পৌল-বর্জিনীতে সমুদ্রতটের অরণ্যদৃশ্য-বর্ণনা আমার নিকট অনির্বচনীয় সুখস্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাত হইত, এবং সেই তরঙ্গঘাতধ্বনিত বনচ্ছায়াস্নিগ্ধ সমুদ্রবেলায় পৌল-বর্জিনীর মিলন এবং বিচ্ছেদবেদনা হৃদয়ের মধ্যে যেন মুছনা-সহকারে অপূর্ব সংগীতের মতো বাজিয়া উঠিত।

 এই ক্ষুদ্র পত্রে যে-সকল গদ্যপ্রবন্ধ বাহির হইত, তাহার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব ছিল। তখনকার বাংলা গদ্যে সাধুভাষার অভাব ছিল না, কিন্তু ভাষার চেহারা ফোটে নাই। তখন যাহার মাসিকপত্রে লিখিতেন তাহারা গুরু সাজিয়া লিখিতেন—এইজন্য তাঁহারা পাঠকদের নিকট আত্মপ্রকাশ করেন নাই এবং এইজন্যই তাহাদের লেখার যেন একটা স্বরূপ ছিল না। যখন অবোধবন্ধু পাঠ করিতাম তখন তাহাকে ইস্কুলের পড়ার অনুবৃত্তি বলিয়া মনে হইত না। বাংলাভাষায় বোধ করি সেই প্রথম মাসিক পত্র বাহির হইয়াছিল যাহার রচনার মধ্যে একটা স্বাদবৈচিত্র্য পাওয়া যাইত। বর্তমান বঙ্গসাহিত্যের প্রাণসঞ্চারের ইতিহাস যাহারা পর্যালোচনা করিবেন তাহারা অবোধবন্ধুকে উপেক্ষা করিতে পারিবেন না। বঙ্গদর্শনকে যদি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের প্রভাতসূর্য বলা যায় তবে ক্ষুদ্রায়তন অবোধবন্ধুকে প্রত্যুষের শুকতারা বলা যাইতে পারে।

 সে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কূজিত হইয়া উঠে নাই। সেই উষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল। সে সুর তাহার নিজের। ঠিক ইতিহাসের কথা বলিতে পারি না, কিন্তু আমি সেই প্রথম বাংলা কবিতায় কবি নিজের সুর শুনিলাম। রাত্রির অন্ধকার যখন দূর হইতে থাকে তখন যেমন জগতের মূর্তি রেখায় রেখায় ফুটিয়া ওঠে, সেইরূপ অবােধবন্ধুর গদ্যে এবং পদ্যে যেন প্রতিভার প্রত্যুষকিরণে মূর্তির বিকাশ হইতে লাগিল। পাঠকের কল্পনার নিকটে একটি ভাবের দৃশ্য উদঘাটিত হইয়া গেল।—

‘সর্বদাই হু হু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন
 চারি দিকে ঝালাফালা
 উঃ কী জলন্ত জ্বালা,
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গপতন।’

 আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে এই প্রথম বােধ হয় কবির নিজের কথা। তৎসময়ে অথবা তৎপূর্বে মাইকেলের চতুর্দশপদীতে কবির আত্ম- নিবেদন কখনাে কখনাে প্রকাশ পাইয়া থাকিব—কিন্তু তাহা বিরল—এবং চতুর্দশপদীর সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যে আত্মকথা এমন কঠিন ও সংহত হইয়া আসে যে, তাহাতে বেদনার গীতােচ্ছাস তেমন স্ফুর্তি পায় না।

 বিহারীলাল তখনকার ইংরাজিভাষায় নব্যশিক্ষিত কবিদিগের ন্যায় যুদ্ধবর্ণনাসংকুল মহাকাব্য, উদ্দীপনাপূর্ণ দেশানুরাগমূলক কবিতা লিখিলেন না এবং পুরাতন কবিদিগের ন্যায় পৌরাণিক উপাখ্যানের দিকেও গেলেন না—তিনি নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা লখিিলেন। তাঁহার সেই স্বগত উক্তিতে বিশ্বহিত দেশহিত অথবা সভামনােরঞ্জনের কোনাে উদ্দেশ্য দেখা গেল না। এইজন্য তাহার সুর অন্তরঙ্গরূপে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া সহজেই পাঠকের বিশ্বাস আকর্ষণ করিয়া আনিল।

 পাঠকদিগকে, এইরূপে বিশ্রভাবে আপনার নিকট টানিয়া আনিবার ভাব প্রথম অবােধবন্ধুর গদ্যে এবং অবােধবন্ধুর কবি বিহারীলালের কাব্যে অনুভব করিয়াছিলাম। পৌল-বর্জিনীতে যেমন মানুষের এবং প্রকৃতির নিকট-পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম বিহারীলালের কাব্যেও সেইরূপ একটি ঘনিষ্ঠ সঙ্গ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। মনে আছে নিম্ন-উদ্ধৃত শ্লোকগুলির বর্ণনায় এবং সংগীতে মনশ্চক্ষের সমক্ষে সুন্দর চিত্রপট উদ্‌ঘাটিত হইয়া হৃদয়কে চঞ্চল করিয়া তুলিত।

কভু,ভাবি কোনাে ঝরনার
উপলে বন্ধুর যার ধার—
 প্রচণ্ড প্রপাতধ্বনি
 বায়ুবেগে প্রতিধ্বনি
চতুর্দিকে হতেছে বিস্তার—
গিয়ে তার তীরতরুতলে
পুরু পুরু নধর শাদ্বলে
 ডুবাইয়ে এ শরীর
 শবসম রবাে স্থির
কান দিয়ে জলকলকলে।
যে সময় কুরঙ্গিণীগণ
সবিস্ময়ে মেলিয়ে নয়ন,
 আমার সে দশা দেখে
 কাছে এসে চেয়ে থেকে
অশ্রুজল করিবে মােচন—
সে সময়ে আমি উঠে গিয়ে,
তাহাদের গলা জড়াইয়ে
 মৃত্যুকালে মিত্র এলে
 লােকে যেম্নি চক্ষু মেলে
 তেম্নিতর থাকিব চাহিয়ে।’

 কবি যে মন ‘হু হু’ করার কথা লিখিয়াছেন তাহা কী প্রকৃতির বলিতে পারি না। কিন্তু এই বর্ণনা পাঠ করিয়া বহির্জগতের জন্য একটি বালক-পাঠকের মন হু হু করিয়া উঠিত। ঝর্নার ধারে জলশীকর-সিক্ত স্নিগ্ধশ্যামল দীর্ঘকোমল ঘনঘাসের মধ্যে দেহ নিমগ্ন করিয়া নিস্তব্ধভাবে জলকলধ্বনি শুনিতে পাওয়া একটি পরম আকাক্ষার বিষয় বলিয়া মনে হইত; এবং যদিও জ্ঞানে জানি যে, কুরঙ্গিণীগণ কবির দুঃখে অশ্রুপাত করিতে আসে না এবং সাধ্যমতে কবির আলিঙ্গনে ধরা দিতে চাহে না, তথাপি এই নিঝরপার্শ্বে ঘনশম্পতটে মানবের বাহুপাশবদ্ধ মুগ্ধ কুরঙ্গিণীর দৃশ্য অপরূপ সৌন্দর্যে হৃদয়ে সম্ভববৎ চিত্রিত হইয়া উঠিত।

‘কভু ভাবি পল্লীগ্রামে যাই,
নামধাম সকল লুকাই;
চাষীদের মাঝে রয়ে,
চাষীদের মতো হয়ে,
চাষীদের সঙ্গেতে বেড়াই।
প্রাতঃকালে মাঠের উপর
শুদ্ধ বায়ু বহে ঝর ঝর।
চারিদিক মনোরম,
আমোদে করিব শ্রম;
সুস্থ স্ফুর্ত হবে কলেবর।
বাজাইয়ে বাঁশের বাঁশরি
সাদা সোজা গ্রাম্য গান ধরি,
সরল চাষার সনে,
প্রমোদপ্রফুল্লমনে
কাটাইব আনন্দে শর্বরী।

বরষার যে ঘোরা নিশায়
সৌদামিনী মাতিয়ে বেড়ায়—
ভীষণ বস্ত্রের নাদ,
ভেঙে যেন পড়ে ছাদ,
বাবু সব কাঁপেন কোঠায়—
সে নিশায় আমি ক্ষেত্রতীরে
নড়বোড়ে পাতার কুটিরে
স্বচ্ছন্দে রাজার মতো
ভূমে আছি নিদ্রাগত;
প্রাতে উঠে দেখিব মিহিরে।’

 কলিকাতার ছেলে পল্লীগ্রামের এই সুখময় চিত্রে যে ব্যাকুল হইয়া উঠিবে ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। ইহা হইতে বুঝা যায়—অসন্তোষ মানবপ্রকৃতির সহজাত। অট্টালিকা অপেক্ষা নড়বোড়ে পাতার কুটিরে যে সুখের অংশ অধিক আছে অট্টালিকাবাসী বালকের মনে এ মায়া কে জন্মাইয়া দিল? আদিম মানবপ্রকৃতি। কবি নহে। কবিকে যিনি ভুলাইয়াছেন সেই মহামায়া। কবিতায় অসন্তোষ-গানের বাহুল্য দেখা যায় বলিয়া অনেকে আক্ষেপ করিয়া থাকেন। কিন্তু দোষ কাহাকে দিব? অসন্তোষ মানুষকে কাজ করাইতেছে, আকাঙ্ক্ষা কবিকে গান গাওয়াইতেছে। সন্তোষ এবং পরিতৃপ্তি যতই প্রার্থনীয় হউক, তাহাতে কার্য এবং কাব্য উভয়েরই ব্যাঘাত করিয়া থাকে। অ যেমন বর্ণমালার আরম্ভ এবং সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণের সহিত যুক্ত, অসন্তোষ ও অতৃপ্তি সেইরূপ সৃজনের আরম্ভে বর্তমান এবং সমস্ত মানবপ্রকৃতির সহিত নিয়ত সংযুক্ত। এইজন্যই তাহা কবিতায় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে কবিদিগের মাসিক ক্ষিপ্ত রিপাকক্তির বিকারবশত নহে। কবি যখন কবিতা রচনা করে তখন সে মাঠের শোভা, কুটিরের সুখ বর্ণনা করে না; নগরের বিস্ময়জনক বৈচিত্র্য তাহার চিত্ত আকর্ষণ করে, তখন সে গাহিয়া ওঠে​—

‘কী কল বানিয়েছে সাহেব কোম্পানি!
কলেতে ধোঁওয়া ওঠে আপনি, সজনি।’

 কলের বাঁশি যাহারা শুনিতেছে মাঠের ‘বাঁশের বাঁশরি’ শুনিয়া তাহারা ব্যাকুল হয় এবং যাহারা বাঁশের বাঁশরি বাজাইয়া থাকে কলের বাঁশি শুনিলে তাহাদের হৃদয় বিচলিত হইয়া উঠে। এইজন্য শহরের কবিও সুখের কথা বলে না, মাঠের কবিও আকাঙ্ক্ষার চাঞ্চল্য গানে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করে।

 সুখ চিরকালই দূরবর্তী, এইজন্য কবি যখন গাহিলেন ‘সর্বদাই হু হু করে মন’ তখন বালকের অন্তরেও তাহার প্রতিধ্বনি জাগিয়া উঠিল। কবি যখন বলিলেন—

‘কভু ভাবি ত্যেজে এই দেশ,
যাই কোনাে এ হেন প্রদেশ,
যথায় নগর গ্রাম
নহে মানুষের ধাম,
পড়ে আছে ভগ্ন-অবশেষ।
গর্ব-ভরা অট্টালিকা যায়,
এবে সব গড়াগড়ি যায়—
বৃক্ষলতা অগণন
ঘের করে আছে বন,
উপরে বিষাদবায়ু বায়
প্রবেশিতে যাহার ভিতরে
ক্ষীণ প্রাণী নরে ত্রাসে মরে,
যথায় শ্বাপদদল

করে ঘাের কোলাহল,
ঝিল্লি সব ঝিঁ ঝিঁ রব করে।
তথা তার মাঝে বাস করি
ঘুমাইব দিবা বিভাবরী—
আর কারে করি ভয়,
ব্যাঘ্রে সৰ্পে তত নয়
মানুষ-জন্তুকে যত ডরি।’

তখন এই চিত্রে ভয়ের উদয় না হইয়া বাসনার উদ্রেক হইল। যে ছেলে ঘরের বাহিরে একটি দিন যাপন করিতে কাতর হয়, ঝিল্লি-রবাকুল বিষাদবায়ুবীজিত ঘন-অরণ্যবেষ্টিত ভীষণ ভগ্নাবশেষ কেন যে তাহার নিকটে বিশেষরূপে প্রার্থনীয় বোধ হইল বলা কঠিন। আমাদের প্রকৃতির মধ্যে একটি বন্ধন-অসহিষ্ণু স্বেচ্ছাবিহারপ্রিয় পুরুষ এবং একটি গৃহবাসিনী অবরুদ্ধ রমণী দৃঢ় অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া আছে। একজন জগতের সমস্ত নূতন নূতন দেশ, ঘটনা এবং অবস্থার মধ্যে নব নব রসাস্বাদ করিয়া আপন অমর শক্তিকে বিচিত্র বিপুলভাবে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিবার জন্য সর্বদা ব্যাকুল, আর-একজন শতসহস্র অভ্যাসে বন্ধনে প্রথায় প্রচ্ছন্ন এবং পরিবেষ্টিত। একজন বাহিরের দিকে লইয়া যায়, আর-একজন গৃহের দিকে টানে। একজন বনের পাখি, আর-একজন খাঁচার পাখি। এই বনের পাখিটাই বেশি গান গাহিয়া থাকে। কিন্তু ইহার গানের মধ্যে অসীম স্বাধীনতার জন্য একটি ব্যাকুলতা, একটি অভ্রভেদী ক্রন্দন বিবিধ ভাবে এবং বিচিত্র রাগিণীতে প্রকাশ পাইয়া থাকে।

 সিন্ধবাদ নাবিকের অপরূপ ভ্রমণ এবং রবিন্সন্‌ক্রুসোর নির্জন দ্বীপ-প্রবাস মনের মধ্যে যে এক তৃষাতুর ভাবের উদ্রেক করিয়া দিত, অবোধবন্ধুর প্রথম কবিতাটি সেই ভাবকেই সংক্ষেপে সংগীতে ব্যক্ত করিয়াছিল। যে ভাবের উদয়ে পরিচিত গৃহকে প্রবাস বোধ হয় এবং অপরিচিত বিশ্বের জন্য মন-কেমন করিতে থাকে বিহারীলালের ছন্দেই সেই ভাবের প্রথম প্রকাশ দেখিতে পাইয়াছিলাম।

‘কভু ভাবি সমুদ্রের ধারে
যথা যেন গর্জে একেবারে
প্রলয়ের মেঘসংঘ;
প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভঙ্গ
আক্রমিছে গর্জিয়া বেলারে—
সম্মুখেতে অসীম অপার,
জলরাশি রয়েছে বিস্তার।
উত্তাল তরঙ্গ সব
ফেনপুঞ্জে ধবধব,
গণ্ডগোলে ছোটে অনিবার—
মহাবেগে বহিছে পবন
যেন সিন্ধুসঙ্গে করে রণ;
উভে উভ-প্রতি ধায়,
শব্দে ব্যোম ফেটে যায়,
পরস্পরে তুমুল তাড়ন—
সেই মহা রণাঙ্গস্থলে
স্তব্ধ হয়ে বসিয়ে বিরলে,
(বাতাসের হু হু রবে
কান বেশ ঠাণ্ডা রবে;)
দেখিগে শুনিগে সে সকলে।
যে সময়ে পূর্ণ সুধাকর
ভূষিবেন নির্মল অম্বর,

চন্দ্রিকা উজলি বেলা
বেড়াবেন করে খেলা
তরঙ্গের দোলার উপর—
নিবেদিব তাঁহাদের কাছে
মনে মোর যত খেদ আছে।
শুনি না কি মিত্রবরে
দুখের যে অংশী করে
হাঁপ ছেড়ে প্রাণ তার বাঁচে।’

এই বর্ণনাগুলি কতবার পাঠ করিয়াছি তাহার সংখ্যা নাই, এবং এই-সকল শ্লোকের মধ্য দিয়া সমুদ্র পর্বত অরণ্যের আহ্বান বালক-পাঠকের অন্তরে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছিল। সাময়িক অন্য কবির রচনাতেও প্রকৃতিবর্ণনা আছে, কিন্তু তাহা প্রথাসংগত বর্ণনামাত্র, তাহা কেবল কবির কর্তব্যপালন। তাহার মধ্যে সেই সোনার কাঠি নাই যাহার স্পর্শে নিখিল প্রকৃতির অন্তরাত্মা সজীব ও সজাগ হইয়া আমাদিগকে নিবিড় প্রেমপাশে আবদ্ধ করে।

 সাময়িক কবিদিগের সহিত বিহারীলালের আর-একটি প্রধান প্রভেদ তাহার ভাষা। ভাষার প্রতি আমাদের অনেক কবির কিয়ৎপরিমাণে অবহেলা আছে। বিশেষত মিত্রাক্ষর ছন্দের মিলটা তাহারা নিতান্ত কায়ক্লেশে রক্ষা করেন। অনেকে কেবলমাত্র শেষ অক্ষরের মিলকে যথেষ্ট জ্ঞান করেন এবং অনেকে ‘হয়েছে’ ‘করেছে’ ‘ভুলেছে’ প্রভৃতি ক্রিয়াপদের মিলকে মিল বলিয়া গণ্য করিয়া থাকেন। মিলের দুইটি প্রধান গুণ আছে, এক তাহা কর্ণতৃপ্তিকর আর-এক অভাবিত-পূর্ব। অসম্পূর্ণ মিলে কর্ণের তৃপ্তি হয় না, সেটুকু মিলে স্বরের অনৈক্যটা আরো যেন বেশি করিয়া ধরা পড়ে এবং তাহাতে কবির ক্ষমতা ও ভাষার দারিদ্র্য প্রকাশ পায়। ক্রিয়াপদের মিল যত ইচ্ছা করা যাইতে পারে—সেরূপ মিলে কর্ণে প্রত্যেকবার নূতন বিস্ময় উৎপাদন করে না, এইজন্য তাহা বিরক্তিজনক ও ‘একঘেয়ে' হইয়া ওঠে। বিহারীলালের ছন্দে মিলের এবং ভাষার দৈন্য নাই। তাহা প্রবহমান নিরূরের মতো সহজ সংগীতে অবিশ্রাম ধ্বনিত হইয়া চলিয়াছে। ভাষা স্থানে স্থানে সাধুতা পরিত্যাগ করিয়া অকস্মাৎ অশিষ্ট এবং কর্ণপীড়ক হইয়াছে, ছন্দ অকারণে আপন বাঁধ ভাঙিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে কবির স্বেচ্ছাকৃত; অক্ষমতাজনিত নহে। তাহার রচনা পড়িতে পড়িতে কোথাও এ কথা মনে হয় না যে, এইখানে কবিকে দায়ে পড়িয়া মিল নষ্ট বা ছন্দ ভঙ্গ করিতে হইয়াছে।

 কিন্তু উপরে যে ছন্দের শ্লোকগুলি উদ্ধৃত হইয়াছে ‘বঙ্গসুন্দরী'তে সেই ছন্দই প্রধান নহে। প্রথম উপহারটি ব্যতীত ‘বঙ্গসুন্দরী’র অন্য সকল কবিতার ছন্দই পর্যায়ক্রমে বারো এবং এগারো অক্ষরে ভাগ করা। যথা—

‘সুঠামশরীর পেলব লতিকা
আনত সুষমাকুসুমভরে,
চাঁচর চিকুর নীরদমালিকা
লুটায়ে পড়েছে ধরণী-'পরে।’

 এ ছন্দ নারী বর্ণনার উপযুক্ত বটে—ইহাতে তালে তালে নূপুর ঝংকৃত হইয়া উঠে। কিন্তু এ ছন্দের প্রধান অসুবিধা এই যে, ইহাতে যুক্ত অক্ষরের স্থান নাই। পয়ার ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দে লেখকের এবং পাঠকের অনেকটা স্বাধীনতা আছে। অক্ষরের মাত্রাগুলিকে কিয়ংপরিমাণে ইচ্ছামত বাড়াইবার কমাইবার অবকাশ আছে। প্রত্যেক অক্ষরকে একমাত্রার স্বরূপ গণ্য করিয়া একেবারে এক নিশ্বাসে পড়িয়া যাইবার আবশ্যক হয় না। দৃষ্টান্তের দ্বারা আমার কথা স্পষ্ট হইবে।

‘হে সারদে, দাও দেখা।
বাঁচিতে পারি নে একা;
কাতর হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয়।
কী বলেছি অভিমানে
শুনো না শুনো না কানে,
বেদনা দিয়ো না প্রাণে, ব্যথার সময়।’

ইহার মধ্যে প্রায় যুক্ত অক্ষর নাই। নিম্নলিখিত শ্লোকে অনেকগুলি যুক্তাক্ষর আছে, অথচ উভয় শ্লোকই সুখপাঠ্য এবং শ্রুতিমধুর।

‘পদে পৃথ্বী, শিরে ব্যোম,
তুচ্ছ তারা সূর্য সোম,
নক্ষত্র নখাগ্রে যেন গনিবারে পায়ে,
"সম্মুখে সাগরাম্বরা
"ছড়িয়ে রয়েছে ধরা,
কটাক্ষে কখন যেন দেখিছে তাহারে।’

এই দুটি শ্লোকই কবির রচিত ‘সারদামঙ্গল’ হইতে উদবৃত। ‘বঙ্গসুন্দরী’ হইতে দুইটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া তুলনা করা যাক।

‘একদিন দেব তরুণ তপন
হেরিলেন সুরনদীর জলে
অপরূপ এক কুমারীরতন
খেলা করে নীল নলিনীদলে।’

ইহার সহিত নিম্ন-উধৃত শ্লোকটি একসঙ্গে পাঠ করিলে প্রভেদ প্রতীয়মান হইবে।

‘অপ্সরী কিন্নরী দাড়াইয়ে তীরে
ধরিয়ে ললিত করুণাতান

বাজায়ে বাজায়ে বীণা ধীরে ধীরে
গাহিছে আদরে স্নেহের গান।

‘অপ্সরী কিন্নরী’ যুক্ত অক্ষর লইয়া এখানে ছন্দোভঙ্গ করিয়াছে। কবিও এই কারণে ‘বঙ্গসুন্দরী’তে যথাসাধ্য যুক্ত অক্ষর বর্জন করিয়া চলিয়াছেন। কিন্তু বাংলা যে ছন্দে যুক্ত অক্ষরের স্থান হয় না সে ছন্দ আদরণীয় নহে। কারণ, ছন্দের ঝংকার এবং ধ্বনিবৈচিত্র্য যুক্ত অক্ষরের উপরেই অধিক নির্ভর করে। একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা নাই, তার উপরে যদি যুক্ত অক্ষর বাদ পড়ে তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। তাহা শীঘ্রই শান্তিজনক তন্দ্রাকর্ষক হইয়া উঠে, এবং হৃদয়কে আঘাতপূর্বক ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না। সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা এবং যুক্ত অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগুঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন, সেইজন্যে তাহার অমিত্রাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়।

 আর্যদর্শনে বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’ সংগীত যখন প্রথম বাহির হইল তখন ছন্দের প্রভেদ মুহূর্তেই প্রতীয়মান হইল। সারদামঙ্গলের ছন্দ নূতন নহে, তাহা প্রচলিত ত্রিপদী, কিন্তু কবি তাহা সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত কুরিয়া তুলিয়াছেন। ‘বঙ্গসুন্দরী’র ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, এবং সেই মিষ্টতা একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন, কিন্তু সারদামঙ্গলের গীতসৌন্দর্য অনুকরণসাধ্য নহে।

 সারদামঙ্গল এক অপরূপ কাব্য। প্রথম যখন তাহার পরিচয় পাইলাম তখন তাহার ভাষায় ভাবে এবং সংগীতে নিরতিশয় মুগ্ধ হইতাম, অথচ তাহার আদ্যোপান্ত একটা সুসংলগ্ন অর্থ করিতে পারিতাম না। যেই একটু মনে হয় এইবার বুঝি কাব্যের মর্ম পাইলাম অমনি তাহা আকার পরিবর্তন করে। সূর্যাস্তকালের সুবর্ণমতি মেঘমালার মতে-সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধ রূপের আভাস দেয়, কিন্তু কোনো রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না, অথচ সুদূর সৌন্দর্যস্বর্গ হইতে একটি অপূর্ব পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।

 এইজন্য সারদামঙ্গলের শ্রেষ্ঠতা। অরসিক লোকের নিকট ভালোরূপে প্রমাণ করা বড়োই কঠিন হইত। যে বলিত ‘আমি বুঝিলাম না, আমাকে বুঝাইয়া দাও’ তাহার নিকট হার মানিতে হইত।

 কবি যাহা দিতেছেন তাহাই গ্রহণ করিবার জন্য পাঠকের প্রস্তুত হওয়া উচিত; পাঠক যাহা চান তাহাই কাব্য হইতে আদায় করিবার চেষ্টা করিতে গেলে অধিকাংশ সময়ে নিরাশ হইতে হয়। তাহার ফল হয়, যাহা চাই তাহা পাই না এবং কবি যাহা দিতেছেন তাহা হইতেও বঞ্চিত হইতে হয়। সারদামঙ্গলে কবি যাহা গাহিতেছেন তাহা কান পাতিয়া শুনিলে একটি স্বর্গীয় সংগীতসুধায় হৃদয় অভিষিক্ত হইয়া উঠে, কিন্তু সমালোচনা-শাস্ত্রের আইনের মধ্য হইতে তাহাকে ছাকিয়া লইবার চেষ্টা করিলে তাহার অনেক বস বৃথা নষ্ট হইয়া যায়।

 প্রকৃতপক্ষে সারদামঙ্গল একটি সমগ্রকাব্য নহে, তাহাকে কতকগুলি খণ্ড কবিতার সমষ্টিরূপে দেখিলে তাহার অর্থবোধ হইতে কষ্ট হয় না। দ্বিতীয়ত, সরস্বতী সম্বন্ধে সাধারণত পাঠকের মনে যেরূপ ধারণা আছে কবির সরস্বতী তাহা হইতে স্বতন্ত্র। কবি যে সরস্বতীর বন্দনা করিতেছেন তিনি নানা আকারে নানা ভাবে নানা লোকের নিকট উদিত হন। তিনি কখনো জননী, কখনো প্রেয়সী, কখনো কন্যা। তিনি সৌন্দর্যরূপে জগতের অভ্যন্তরে বিরাজ করিতেছেন, এবং দয়া স্নেহ প্রেমে মানবের চিত্তকে অহরহ বিচলিত করিতেছেন। ইংরাজ কবি শেলি যে বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্যলক্ষ্মীকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন—

'Spirit of Beauty, that dost consecrate
With thine own hues all thou dost shine upon
Of human thought or form.'

যাহাকে বলিয়াছেন—

'Thou messenger of sympathies,
That wax and wane in lovers' eyes.'

সেই দেবীই বিহারীলালের সরস্বতী।

 সারদামঙ্গলের আরম্ভের চারি শ্লোকে কবি সেই সারদাদেবীকে মূর্তিমতী করিয়া বন্দনা করিয়াছেন। তৎপরে বাল্মীকির তপোবনে সেই করুণারূপিণী দেবীর কিরূপে আবির্ভাব হইল, কবি তাহা বর্ণনা করিতেছেন। পাঠকের নেত্রসম্মুখে দৃশ্যপট যখন উঠিল তখন তপোবনে অন্ধকার রাত্রি।

‘নাহি চন্দ্র সূর্য তারা
অনল-হিল্লোল-ধারা

বিচিত্র-বিদ্যুতদাম-দ্যুতি ঝলমল।

তিমিরে নিমগ্ন ভব,
নীরব নিস্তব্ধ সব,

কেবল মরুতরাশি করে কোলাহল।’

এমন সময়ে উষার উদয় হইল।—

‘হিমাদ্রিশিখর-'পরে
আচম্বিতে আলাে করে
অপরূপ জ্যোতি ওই পুণ্য-তপােবন।
বিকচ নয়নে চেয়ে
হাসিছে দুধের মেয়ে—

তামসী-তরুণ-উষা কুমারীরতন।
কিরণে ভুবন ভরা,
হাসিয়ে জাগিল ধরা,
হাসিয়ে জাগিল শূন্যে দিগঙ্গনাগণ।
হাসিল অম্বরতলে
পারিজাত দলে দলে,
হাসিল মানসসরে কমলকানন।

 তপােবনে এক দিকে যেমন তিমির রাত্রি ভেদ করিয়া তরুণ উষার অভ্যুদয় হইল তেমনি অপর দিকে নিষ্ঠুর হিংসাকে বিদীর্ণ করিয়া কিরূপে করুণাময় কাব্যজ্যোতি প্রকাশ পাইল কবি তাহার বর্ণনা করিতেছেন।—

‘অম্বরে অরুণােদয়,
তলে দুলে দুলে বয়
তমসা তটিনীরানী কুলুকুলুম্বনে
নিরখি লােচনলােভা
পুলিনবিপিনশােভা
ভ্রমেন বাল্মীকি মুনি ভাবভােলা মনে।
শাখিশাখে রসসুখে।
ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চী মুখে মুখে
কতই শােহাগ করে বসি দুজনায়।
হানিল শবরে বাণ,
নাশিল ক্রোঞ্চের প্রাণ—
রুধিরে আপ্লুত পাখা ধরণী লুটায়।
ক্রৌঞ্চী প্রিয়সহচরে
ঘেরে ঘেরে শােক করে—

অরণ্য পুরিল তার কাতর ক্রন্দনে।
চক্ষে করি দরশন
জড়িমা-জড়িত মন,
করুণহৃদয় মুনি বিহ্ব‌লের প্রায়।
সহসা ললাটভাগে
জ্যোতির্ময়ী কন্যা জাগে,
জাগিল বিজলী যেন নীল নবঘনে।
কিরণে কিরণময়
বিচিত্র আলােকোদয়,
ম্রিয়মাণ রবিচ্ছবি, ভুবন উজলে।
চন্দ্র নয়, সূর্য নয়,
সমুজ্জ্বল শান্তিময়
ঋষির ললাটে আজি না জানি কী জলে!
কিরণমণ্ডলে বসি
জ্যোতির্ময়ী সুরূপসী
যােগীর ধ্যানের ধন ললাটিকা মেয়ে
নামিলেন ধীর ধীর,
দাড়ালেন হয়ে স্থির
মুগ্ধনেত্রে বাল্মীকির মুখপানে চেয়ে।
করে ইন্দ্রধনু-বালা,
গলায় তারার মালা,
সীমন্তে নক্ষত্র জ্বলে, ঝলমলে কানন—
কর্ণে কিরণের ফুল,
দোদুল চাচর চুল
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকিয়ে আনন।•••

করুণ ক্রন্দনরােল

উত-উত-উতরােল,
চমকি বিহ্বলা বালা চাহিলেন ফিরে—
হেরিলেন রক্তমাখা
মৃত ক্রৌঞ্চ ভগ্নপাখা,
 কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ক্রৌঞ্চী ওড়ে ঘিরে ঘিরে।
একবার সে ক্রৌঞ্চীরে
আরবার বাল্মীকিরে
নেহারেন ফিরে ফিরে, যেন উন্মাদিনী—
কাতরা করুণাভরে
গান সকরুণ সুরে,
ধীরে ধীরে বাজে করে বীণা বিষাদিনী।
সে শােকসংগীতকথা
শুনে কাঁদে তরুলতা,
তমসা আকুল হয়ে কাঁদে উভয়
নিরখি নন্দিনীচ্ছবি
গদগদ আদিকবি
অন্তরে করুণাসিন্ধু উথলিয়া ধায়।’

 সারদাদেবীর এই এক করুণামূর্তি। তাহার পর ২১ শ্লোক হইতে আবার একটি কবিতার আরম্ভ হইয়াছে। সে কবিতায় সারদাদেবী ব্রহ্মার মানস-সরােবরে সুবর্ণপদ্মের উপর দাঁড়াইয়াছেন এবং তাঁহার অসংখ্য ছায়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। ইহা সারদাদেবীর বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্যমূর্তি।—

‘ব্রহ্মার মানসসরে
ফুটে ঢল ঢল করে

নীল জলে মনােহর সুবর্ণনলিনী,
পাদপদ্ম রাখি তায়
হাসি হাসি ভাসি যায়
যােড়শী রূপসী বামা পূর্ণিমাযামিনী।
কোটি শশী উপহাসি
উথলে লাবণ্যরাশি,
তরল দর্পণে যেন দিগন্ত আবরে—
আচম্বিতে অপরূপ
রূপসীর প্রতিরূপ
হাসি হাসি ভাসি ভাসি উদয় অম্বরে।’

এই সারদাদেবীর, এই Spirit of Beauty-র নব-অভ্যুদিত করুণা-বালিকামূর্তি এবং সর্বত্রব্যাপ্ত সুন্দরী ষোড়শীমূর্তির বর্ণনা সমাপ্ত করিয়া কবি গাহিয়া উঠিয়াছেন—

‘তােমারে হৃদয়ে রাখি
সদানন্দ মনে থাকি,
শ্মশান অমরাবতী দুই ভালাে লাগে
গিরিমালা, কুঞ্জবন,
গৃহ, নাটনিকেতন,
যখন যেখানে যাই, যাও আগে আগে।•••
যত মনে অভিলাষ’
তত তুমি ভালােবাসাে,
তত মনপ্রাণ ভরে আমি ভালােবাসি।
ভক্তিভাবে একতানে
মজেছি তােমার ধ্যানে,
কমলার ধনমানে নহি অভিলাষী।’

 এই মানসীরূপিণী সাধনার ধনকে পরিপূর্ণরূপে লাভ করিবার জন্য কাতরতা প্রকাশ করিয়া কবি প্রথম সর্গ সমাপ্ত করিয়াছেন।

 তাহার পর-সর্গ হইতে প্রেমিকের ব্যাকুলতা। কখনো অভিমান কখনো বিরহ, কখনো আনন্দ কখনো বেদনা, কখনো ভৎসনা কখনো স্তব। দেবী কবির প্রণয়িনী-রূপে উদিত হইয়া বিচিত্র সুখদুঃখে শতধারে সংগীত উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিতেছেন। কবি কখনো তাহাকে পাইতেছেন কখনো তাহাকে হারাইতেছেন, কখনো তাহার অভয়রূপ কখনো তাহার সংহারমূর্তি দেখিতেছেন। কখনো তিনি অভিমানিনী, কখনো বিষাদিনী, কখনো আনন্দময়ী। কবি বিষাদিনীকে বলিতেছেন—

‘অয়ি, এ কী, কেন কেন,
বিষন্ন হইলে হেন?
আনত আননশশী, আনত নয়ন,
অধরে মন্থরে আসি
কপােলে মিলায় হাসি,
থরথর ওষ্ঠাধর, স্ফোরে না বচন!
তেমন অরুণরেখা
কেন কুহেলিকা-ঢাকা,
প্রভাতপ্রতিমা আজি কেন গাে মলিন!
বলো বলো চন্দ্রাননে,
কে ব্যথা দিয়েছে মনে,
কে এমন—কে এমন হৃদয়বিহীন!
বুঝিলাম অনুমানে,
করুণাকটাক্ষদানে
চাবে না আমার পানে, ক’বেও না কথা।

কেন যে কবে না হয়
হৃদয় জানিতে চায়,
শরমে কি বাধে বাণী, মরমে বা বাজে ব্যথা।
যদি মর্মব্যথা নয়
কেন অশ্রুধারা বয়,
দেববালা ছলাকলা জানে না কখন—
সরল মধুর প্রাণ
সতত মুখেতে গান,
আপন বীণার তানে আপনি মগন।
অয়ি, হা, সরলা সতী,
সত্যরূপা সরস্বতী,
চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
পদপদ্মাসন-কাছে।
নীরবে দাড়ায়ে আছে,
কী করিবে, কোথা যাবে, দাও অনুমতি।
স্বরগকুসুমমালা
নকলন-জ্বালা
ধরিয়ে প্রফুল্লমুখে মস্তকে সকলি—
তব আজ্ঞা সুমঙ্গল,
যাই যাব রসাতল,
চাই নে এ বরমালা এ অমরাবতী।’

কবি অভিমানিনী সরস্বতীকে সম্বােধন করিয়া বলিতেছেন—

‘আজি এ বিষন্ন বেশে
কেন দেখা দিলে এসে,
কাঁদিলে কাঁদালে, দেবি, জন্মের মতন!

পূর্ণিমাপ্রমোদ-আলল,
নয়নে লেগেছে ভালাে,
মাঝেতে উথলে নদী, দু পারে দুজন—
চক্রবাক চক্রবাকী দু পারে দুজন।
নয়নে নয়নে মেলা,
মানসে মানসে খেলা,
অধরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন।
হৃদয়বীণার মাঝে
ললিত রাগিণী বাজে,
মনের মধুর গান মনেই বিলীন।
সেই আমি, সেই তুমি,
সেই এ সরগভূমি,
সেই-সব কল্পতরু, সেই কুঞ্জবন;
সেই প্রেম সেই স্নেহ,
সেই প্রাণ সেই দেহ—
কেন মন্দাকিনীতীরে দু পারে দুজন!’

কখনাে মুহূর্তের জন্য সংশয় আসিয়া বলে—

‘তবে কি সকলি ভুল?
নাই কি প্রেমের মূল—
বিচিত্র গগনফুল কল্পনালতার?
মন কেন রসে ভাসে,
প্রাণ কেন ভালােবাসে
আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?
শত শত নরনারী
দাঁড়ায়েছে সারি সারি—

নয়ন খুঁজিছে কেন সেই মুখখানি!
হেরে হারানিধি পায়,
না হেরিলে প্রাণ যায়—
এমন সরল সত্য কী আছে না জানি!’

কখনাে বা প্রেমােপভােগের আদর্শচিত্র মানসপটে উদিত হয়—

‘নন্দননিকুঞ্জবনে
বসি শ্বেতশিলাসনে
খােলা প্রাণে রতি-কাম বিহরে কেমন!
আননে উদার হাসি,
নয়নে অমৃত রাশি,
অপরূপ আলাে এক উজলে ভুবন।•••
কী এক ভাবেতে ভাের,
কী যেন নেশার ঘাের,
টলিয়ে ঢলিয়ে পড়ে নয়নে নয়ন—
গলে গলে বাহুলতা,
জড়িমা-জড়িত কথা,
সােহাগে সােহাগে রাগে গল গল মন।
করে কর থরথর,
টলমল কলেবর,
গুরুগুরু দুরুদুরু বুকের ভিতর—
তরুণ অরুণ ঘটা
আননে আরক্ত ছটা,
অধরকমলদল কাপে থরথর।
প্রণয়পবিত্র কাম
সুখস্বর্গ মােক্ষধাম—

আজি কেন হেরি হেন মাতােয়ারা বেশ!
ফুলধনু ফুলছড়ি
দূরে যায় গড়াগড়ি,
রতির খুলিয়ে খোঁপা আলুথালু কেশ!
বিহ্বল পাগল প্রাণে
চেয়ে সতী পতিপানে,
গলিয়ে গড়িয়ে কোথা চলে গেছে মন!
মুগ্ধ মত্ত নেত্র দুটি,
আধ ইন্দীবর ফুটি,
দুলুদুলু ঢুলুঢুলু করিছে কেমন।
আলসে উঠিছে হাই,
ঘুম আছে, ঘুম নাই,
কী যেন স্বপনমত চলিয়াছে মনে!
সুখের সাগরে ভাসি
কিবে প্রাণ-খােলা হাসি
কী এক লহরী খেলে নয়নে নয়নে!
উথুলে উথুলে প্রাণ
উঠিছে ললিত তান,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে গান গায় দুইজন।
সুরে সুরে সম রাখি
ডেকে ডেকে ওঠে পাখি,
তালে তালে ঢ'লে ঢ'লে চলে সমীরণ।
কুঞ্জের আড়ালে থেকে
চন্দ্রমা লুকায়ে দেখে,
প্রণয়ীর সুখে সদা সুখী সুধাকর।

সাজিয়ে মুকুলে ফুলে
আহ্লাদেতে হেলে-দুলে
চৌদিকে নিকুঞ্জলতা নাচে মনােহর।
সে আনন্দে আনন্দিনী
উথলিয়ে মন্দাকিনী
করি করি কলধ্বনি বহে কুতুহলে।’

 এইরূপ বিষাদ বিরহ সংশয়ের পর কবি হিমালয়শিখরে প্রণয়িনী দেবীর সহিত আনন্দমিলনের চিত্র আঁকিয়া গ্রন্থ শেষ করিয়াছেন। আরম্ভ-অংশ ব্যতীত হিমালয়ের বর্ণনা প্রশংসার যােগ্য নহে, সেই বর্ণনা বাদ দিয়া অবশিষ্ট অংশ উদ্ধৃত করি—

‘উদার উদারতর
দাঁড়ায়ে শিখর-পর
এই-যে হৃদয়রাণী ত্রিদিবসুষমা।
এ নিসর্গ-বঙ্গভূমি,
মনােরমা নটী তুমি,
শােভার সাগরে এক শােভা নিরুপমা;
আননে বচন নাই,
নয়নে পলক নাই,
কান নাই মন নাই আমার কথায়—
মুখখানি হাস-হাস,
আলুথালু বেশবাস,
আলুথালু কেশপাশ বাতাসে লুটায়।
না জানি কি অভিনব
খুলিয়ে গিয়েছে ভব
আজি ও বিহ্বল মত্ত প্রফুল্ল নয়নে!

আদরিণী, পাগলিনী,
এ নহে শশিষামিনী—
ঘুমাইয়ে একাকিনী কী দেখ স্বপনে।
আহা কী ফুটিল হাসি!
বড়াে আমি ভালােবাসি
ওই হাসিমুখখানি প্রেয়সী তােমার—
বিষাদের আবরণে
বিমুক্ত ও চন্দ্রাননে
দেখিবার আশা আর ছিল না আমার।
দরিদ্র ইন্দ্রত্বলাভে
কতটুকু সুখ পাবে,
আমার সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার।•••
এসো বােন, এসাে ভাই,
হেসে খেলে চ’লে যাই।
আনন্দে আনন্দ করি আনন্দকাননে।
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।
হে প্রশান্ত গিরিভূমি,
জীবন জুড়ালে তুমি,
জীবন্ত করিয়ে মম জীবনের ধনে।
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।
প্রিয়ে সঞ্জীবনীলতা,
কত যে পেয়েছি ব্যথা
হেরে সে বিষাদময়ী মুরতি তােমার।
হেরে কত দুঃস্বপন
পাগল হয়েছে মন—

কতই কেঁদেছি আমি ক’রে হাহাকার।
আজি সে সকলি মম
মায়ার লহরী-সম
আনন্দসাগরমাঝে খেলিয়া বেড়ায়।
দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী,
ত্রিভুবন আলাে করি,
দু নয়ন ভরি ভরি দেখিব তােমায়।
দেখিয়ে মেটে না সাধ,
কী জানি কী আছে স্বাদ,
কী জানি কী মাখা আছে ও শুভ-আননে!
কী এক বিমল ভাতি
প্রভাত করেছে রাতি,
হাসিছে অমরাবতী নয়নকিরণে।
এমন সাধের ধনে
প্রতিবাদী জনে জনে—
দয়া মায়া নাই মনে, কেমন কঠোর।
আদরে গেঁথেছে বালা
হৃদয়কুসুমমালা,
কৃপাণে কাটিবে কে রে সেই ফুলডোর!
পুন কেন অশ্রুজল
বহ তুমি অবিরল,
চরণকমল আহা ধুয়াও দেবীর!
মানসসরসী-কোলে
সােনার নলিনী দোলে,
আনিয়ে পরাও গলে সমীর সুধীর।

বিহঙ্গম, খুলে প্রাণ
ধরাে রে পঞ্চম তান, .
সারদামঙ্গলগান গাও কুতূহলে।’

 কবি যে-সুত্রে সারদামঙ্গলের এই কবিতাগুলি গাঁথিয়াছেন তাহা ঠিক ধরিতে পারিয়াছি কি না জানি না―মধ্যে মধ্যে সূত্র হারাইয়া যায়, মধ্যে মধ্যে উচ্ছ্বাস উন্মত্ততায় পরিণত হয় কিন্তু এ কথা বলিতে পারি, আধুনিক বঙ্গ সাহিত্যে প্রেমের সংগীত এরূপ সহস্রধার উৎসের মতো কোথাও উৎসারিত হয় নাই। এমন নির্মল সুন্দর ভাষা, এমন ভাবের আবেগ, কথার সহিত এমন সুরের মিশ্রণ আর কোথাও পাওয়া যায়। বর্তমান সমালোচক এক কালে বঙ্গসুন্দরী ও সারদামঙ্গলের কবির নিকট হইতে কাব্যশিক্ষার চেষ্টা করিয়াছিল, কতদুর কৃতকার্য হইয়াছে বলা যায় না; কিন্তু এই শিক্ষাটি স্থায়ীভাবে হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়াছে যে, সুন্দর ভাষা কাব্যসৌন্দর্যের একটি প্রধান অঙ্গ, ছন্দে এবং ভাষায় সর্বপ্রকার শৈথিল্য কবিতার পক্ষে সাংঘাতিক। এই প্রসঙ্গে আমার সেই কাব্যগুরুর নিকট আর-একটি ঋণ স্বীকার করিয়া লই। বাল্যকালে বাল্মীকিপ্রতিভা-নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করিয়া ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’-নামক সম্মিলন উপলক্ষে অভিনয় করিয়াছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক রসজ্ঞ লোকের নিকট সেই ক্ষুদ্র নাটকটি প্রীতিপদ হইয়াছিল। সেই নাটকের মূল ভাবটি, এমন-কি, স্থানে স্থানে তাহার ভাষা পর্যন্ত বিহারীলালের সারদামঙ্গলের আরম্ভভাগ হইতে গৃহীত।

 আজ কুড়ি বৎসর হইল সারদামঙ্গল আর্যদর্শন-পত্রে এবং যোলো বৎসর হইল পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে; ভারতী-পত্রিকায় কেবল একটিমাত্র সমালোচক ইহাকে সাদর সম্ভাষণ করেন। তাহার পর হইতে সারদামঙ্গল এই ঘোড়শ বৎসর অনাদৃতভাবে প্রথম সংস্করণের মধ্যেই অজ্ঞাতবাস যাপন করিতেছে। কবিও সেই অবধি আর বাহিরে দর্শন দেন নাই। যিনি জীবনরঙ্গভূমির নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া দর্শকমণ্ডলীর স্তুতিধ্বনির অতীত ছিলেন তিনি আজ মৃত্যুর যবনিকান্তরালে অপসৃত হইয়া সাধারণের বিদায়সম্ভাষণ প্রাপ্ত হইলেন না; কিন্তু এ কথা সাহসপূর্বক বলিতে পারি, সাধারণের পরিচিত কণ্ঠস্থ শতসহস্র রচনা যখন বিনষ্ট এবং বিস্মৃত হইয়া যাইবে সারদামঙ্গল তখন লোক-স্মৃতিতে প্রত্যহ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিবে এবং কবি বিহারীলাল যশঃস্বর্গে অম্লান বরমাল্য ধারণ করিয়া বাহিত্যের অমরগণের সহিত একাসনে বাস করিতে থাকিবেন।

 আষাঢ় ১৩০১