বিষয়বস্তুতে চলুন

আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 জীবানন্দ কুটীর হইতে বাহির হইয়া গেলে পর, শান্তিদেবী আবার সারঙ্গ লইয়া মৃদু মৃদু রবে গীত করিতে লাগিলেন।

“প্রলয়পয়োধিজলে; ধৃতবানসি বেদং
বিহিত বহিত্র চরিত্র মখেদং
কেশব ধৃত মীন শরীর
জয় জগদীশ হরে।”

 গোস্বামিবিরচিত মধুর স্তোত্র যখন শান্তিদেবীকণ্ঠনিঃসৃত হইয়া রাগ তাল লয় সম্পূর্ণ হইয়া সেই অনন্ত কাননের অনন্ত নীরব বিদীর্ণ করিয়া, পূর্ণ জলোচ্ছ্বাসের সময়ে বসন্তানিলতাড়িত তরঙ্গভঙ্গের ন্যায় মধুর হইয়া আসিল, তখন তিনি গায়িলেন;―

নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতং
সদয় হৃদয় দর্শিত পশুঘাতং
কেশব ধৃত বুদ্ধ শরীর
জয় জগদীশ হরে।

 তখন বাহির হইতে কে অতি গম্ভীর রবে গায়িল, গম্ভীর মেঘগর্জ্জনবৎ তানে গায়িল;—

ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালং
ধূমকেতু মিব কিমপি করালং
কেশবধৃত কল্কিশরীর
জয় জগদীশ হরে।”

 শান্তি গলা চিনিল, বলিল “রহ্‌ পোড়াকপালীর ছেলে! বুড়ো বয়সে তুমি মেয়েমানুষের সঙ্গে গায়িতে এসো!” এই বলিয়া শান্তি সারঙ্গের তারগুলি আর একটু চড়াইয়া লইয়া, কণ্ঠ আর একটু উঁচুতে তুলিয়া দিয়া, গায়িল;―

বেদানুদ্ধরতে জগন্তি বহতে,
ভূগোলমুদ্বিভ্রতে,
দৈত্যং দাররতে, বলিং ছলয়তে
ক্ষত্রক্ষয়ং কুর্ব্বতে।
পৌলস্ত্যং জয়তে হলং কলয়তে
কারুণ্যমাতন্বতে,
ম্লেচ্ছার্চ্ছন্মুয়তে দশাকৃতিকৃতে
কৃষ্ণায় তুভাং নমঃ।

 বলিতে বলিতে সে দীর্ঘ তাল, সেই উচ্চৈরব, সে গগনবিদারক তান ছাড়িয়া দিয়া শান্তি গায়িল;―

“স্মিত কমলা কুচমণ্ডল
ধৃত কুণ্ডল কলিত ললিত বনমাল
জয় জয় দেব হরে।”

 বাহির হইতে যে সঙ্গে গায়িতেছিল সে আপনি গাইল,

 দিনমণিমণ্ডন, ভবখণ্ডন মুনিজন মানস হংস―

 শান্তি ভক্তিভাবে প্রণত হইয়া সত্যানন্দের পদধূলি গ্রহণ করিল, বলিল “প্রভো! আমি এমন কি ভাগ্য করিয়াছি যে, আপনার শ্রীপাদপদ্ম এখানে দর্শন পাই―আজ্ঞা করুন আমাকে কি করিতে হইবে” বলিয়া সারঙ্গে সুর দিয়া শান্তি আবার গায়িল;―

 “তব চরণপ্রণতা বয়মিতি ভাবয় কুরু কুশলং প্রণতেষু।”

 সত্যানন্দ বলিল “মা তোমার কুশলই হইবে।”

 শান্তি। কিসে ঠাকুর―তোমার তো আজ্ঞা আছে আমার বৈধব্য!

 সত্যা। তোমারে আমি চিনিতাম না। মা! দড়ির জোর না বুঝিয়া আমি জেয়াদা টানিয়াছি, তুমি আমার অপেক্ষা জ্ঞানী; ইহার উপায় তুমি কর, জীবানন্দকে বলিও না যে আমি সকল জানি। তোমার প্রলোভনে তিনি জীবন রক্ষা করিতে পারেন। এতদিন করিতেছেন। তাহা হইলে আমার কার্য্যোদ্ধার হইতে পারে।

 সেই বিশাল নীল উৎফুল্ল লোচন নিদাঘকাদম্বিনীবিরাজিত বিদ্যুত্তুল্য ঘোর রোষকটাক্ষ হইল। শান্তি বলিল, “কি ঠাকুর আমি আর আমার স্বামী এক আত্মা, যাহা যাহা তোমার সঙ্গে কথোপকথন হইল সবই বলিব। মরিতে হয় তিনি মরিবেন, আমার ক্ষতি কি? আমি তো সঙ্গে সঙ্গে মরিব। তাঁর স্বর্গ আছে, মনে কর কি আমার স্বর্গ নাই?”

 ব্রহ্মচারী বলিল যে “আমি কখন হারি নাই, আজ তোমার কাছে হারিলাম। মা আমি তোমার পুত্র, সন্তানকে স্নেহ কর, জীবানন্দের প্রাণরক্ষা কর, আপনার প্রাণরক্ষা কর, আমার কার্য্যোদ্ধার হইবে।”

 বিজলি হাসিল। শান্তি বলিল “আমার স্বামীর ধর্ম্ম আমার স্বামীর হাতে; আমি তাঁহাকে ধর্ম্ম হইতে বিরত করিবার কে? ইহলোকে স্ত্রীর পতি দেবতা, কিন্তু পরলোকে সবারই ধর্ম্ম দেবতা―আমার কাছে আমার পতি বড়, তার অপেক্ষা আমার ধর্ম্ম বড়, তার অপেক্ষা আমার কাছে আমার স্বামীর ধর্ম্ম বড়। আমার ধর্ম্মে আমার যে দিন ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে পারি। আমার স্বামীর ধর্ম্মে জলাঞ্জলি দিব? মহারাজ! তোমার কথায় আমার স্বামী মরিতে হয় মরিবেন, আমি বারণ করিব না।”

 ব্রহ্মচারী তখন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “মা এ ঘোর ব্রতে বলিদান আছে। আমাদের সকলকেই বলি পড়িতে হইবে। আমি মরিব, জীবানন্দ, ভবানন্দ সবাই মরিবে, বোধ হয় মা তুমিও মরিবে; কিন্তু দেখ কাজ করিয়া মরিতে হইবে, বিনা কার্য্যে কি মরা ভাল?―আমি কেবল দেশকে মা বলিয়াছি আর কাহাকেও মা বলি নাই, কেন না সেই সুজলা সুফলা ধরণী ভিন্ন আমরা অনন্যমাতৃক। আর তোমাকে মা বলিলাম, তুমি মা হইয়া সন্তানের কাজ কর, যাতে কর্য্যাদ্ধার হয় তাহা করিও, জীবানন্দের প্রাণরক্ষা করিও, তোমার প্রাণরক্ষা করিও।”

 এই বলিয়া সত্যানন্দ “হরে মুবারে মধুকৈটভারে” গায়িতে গায়িতে নিষ্ক্রান্ত হইল।