কজ্জলী/বিরিঞ্চিবাবা

উইকিসংকলন থেকে


চৌদ্দ নম্বর হাবশীবাগান লেনের মেসটি ছোট কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কারণ ম্যানেজার নিবারণ মাষ্টার খুব আমুদে লোক হইলেও সব দিকে তার কড়া নজর আছে। মেসের অধিবাসী পাঁচ-ছয়জন মাত্র এবং সকলেরই অবস্থা ভাল। বসিবার জন্য একটি আলাদা ঘর, তাতে ঢালা ফরাশ এবং অনেক রকম বাদ্যযন্ত্র, দাবা, তাস, পাশা ও অন্যান্য খেলার সরঞ্জাম, কতকগুলি মাসিক পত্রিকা প্রভৃতি চিত্তবিনোদনের উপকরণ সজ্জিত আছে। কাল হইতে পূজার বন্ধ, সেজন্য মেসের অনেকে দেশে চলিয়া গিয়াছে। বাকী আছে কেবল নিবারণ ও পরমার্থ। ইহারা কোথাও যাইবে না, কারণ দুইজনেরই শ্বশুরবাড়ির সকলে কলিকাতায় আসিতেছেন।

 নিবারণ কলেজে পড়ায়। পরমার্থ ইনশিওরান্সেব দালালি, হঠযোগ এবং থিয়সফিব চর্চা করে। আজ সন্ধ্যায় মেসের বৈঠকখানায় ইহারা দুইজন এবং পাশের বাড়ির নিতাইবাবু আড্ডা দিতেছেন। নিতাইবাবু নিত্যই এখানে আসেন। তাঁর একটু বয়স হইয়াছে, সেজন্য মেসের ছোকরার দল তাঁকে একটু সমীহ করে, অর্থাৎ পিছন ফিরিয়া সিগারেট খায়।

 নিতাইবাবু বলিতেছিলেন—‘চিত্তে সুখ নেই দাদা। ঝি-বেটী পালিয়েছে, খুকীটার জ্বর, গিন্নী খিটখিট করছেন, আপিসে গিয়েও যে দু-দণ্ড ঘুমুব তার জো নেই, নতুন ছোট-সায়েব ব্যাটা যেন চরকি ঘুরছে।’

 পরমার্থ বলিল ‘কেন আপনাদের আপিসে তো বেশ ভাল ব্যবস্থা আছে।’

 নিতাই। সেদিন আর নেই রে ভাই। ছিল বটে মেকেঞ্জি সায়েবের আমলে। বরদা-খুড়োকে


জান তো? শ্যামনগরের বরদা মুখুজ্যে। খুড়ো দুটে সময় আফিম খেতেন, আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত ঘুমুতেন। আমরা সবাই পালা ক’রে টিফিন- ঘরে গড়িয়ে নিতুম, কিন্তু খুড়ো চেয়ার ছাড়তেন না। একদিন হয়েছে কি —লেজার ঠিক দিতে দিতে যেমনি পাতার নীচে পৌঁছেছেন অমনি ঘুম এল। নড়ন-চড়ন নেই, নাক-ডাকা নেই, ঘাড় একটু ঝুঁকল না, লেজারে টোটালের জায়গায় হাতের কলমটি ঠিক ধরা আছে। অসাধারণ ক্ষমতা— দূর থেকে দেখলে কে বলবে খুড়ো ঘুমুচ্ছে। এমন সময় মেকেঞ্জি সায়েব ঘরে এল, সকলে শশব্যস্ত। সায়েব খুড়োর কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ ক’রে খুড়োর কাঁধে একটি চিমটি কাটলে। খুড়ো একটু মিটমিটিয়ে চেয়েই বিড়বিড় ক’রে আরম্ভ করলে—সাঁইত্রিশের সাত নাবে তিনে-কত্তি তিন। সায়েব হেসে বললে— হ্যাভ এ কাপ অফ টী বাবু। এখন সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সংসারে ঘেন্না ধরে গেছে। একটি ভাল সাধু-সন্ন্যাসী পাই তো সব ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

 পরমার্থ। জগন্নাথ-ঘাটে আজ একটি সাধুকে দেখে এলুম— আশ্চর্য ব্যাপার। লোকে তাঁকে বলে মিরচাই— বাবা। তিনি কেবল লঙ্কা খেয়ে থাকেন, ভাত নয়, রুটি নয়, ছাতু নয় শুধু লঙ্কা। লক্ষ লক্ষ লোক ওষুধ নিতে আসছে, একটি ক'রে লঙ্কা মন্ত্রপূত ক’রে দিচ্ছেন, তাই খেয়ে সব ভাল হয়ে যাচ্ছে। শুনেছি তাঁর আবার যিনি গুরু আছেন, তাঁর সাধনা আরও উঁচু দরের। তিনি খান স্রেফ করাতের গুঁড়ো।

 নিতাই। ওহে মাষ্টার, তুমি তো ফিলজফিতে এম. এ. পাস করেছ— লঙ্কা, করাতের গুঁড়ো, এ সবেব আধ্যাত্মিক তাৎপর্য কি বল তো? তোমার পাখোয়াজ বন্ধ কর বাপু, কান ঝালাপালা হ’ল।

 নিবারণ প্রথমে একটা মাসিক পত্রিকা লইয়া নাড়াচাড়া কবিতেছিল। তাতে যে পাঁচটি গল্প আছে তাব প্রত্যেকের নায়িকা এক-একটি সতী-সাধ্বী বারাঙ্গনা। অবশেষে নিবারণ পত্রিকাটি ফেলিয়া দিয়া একটা পাখোয়াজ কোলে লইয়া মাঝে মাঝে বেতালা চাঁটি মারিতেছিল। নিতাইবাবুব কথায় বাজনা থামাইয়া বলিল —‘ও সব হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন সাধনার মার্গ। যেমন জ্ঞানমার্গ, কর্মমার্গ, ভক্তিমার্গ, তেমনি মিরচাইমার্গ, করাতমার্গ, লবণমার্গ, একাদশীমার্গ, গোবমার্গ, টিকিমার্গ, দাড়িমার্গ, স্ফাটিকমার্গ, কাগমার্গ—’

 নিতাই। কাগমার্গ কি রকম?

 নিবারণ। জানেন না? . গেল বছর হরিহর ছত্রের মেলায় গিয়েছিলুম। এক জায়গায় দেখি একটা প্রকাণ্ড বাঁশের খাঁচায় শ-দুই কাগ ঝামেলা করছে। পাশে একটা লোক হাঁকছে— দো-দো আনে কৌয়ে, দো-দো আনে। ভাবলুম বুঝি পেশোয়ারী কি মূলতানী কাগ হবে, নিশ্চয় পড়তে জানে। একটা ধাড়ি-গোছ কাগের কাছে গিয়ে শিস দিয়ে বললুম— পড়ো ময়না, চিত্রকোট কি ঘাট পর— সীতাবাম—রাধাকিষণ বোলো—চুচ্চুঃ। ব্যাটা ঠোকরাতে এল। কাগ-ওলা বললে— বাবু, কৌয়া নহি পঢ়তা। তবে কি করে বাপু? কাগেব মাংস তো শুনতে পাই তেতো, লোকে বুঝি সুক্ত বানাবার জন্যে কেনে? বললে তাও নয়। এই কাগ খাঁচায় কয়েদ রয়েছে, দু-দু আনা খরচ ক’রে যতগুলি ইচ্ছে কিনে নিয়ে জীবকে বন্ধনদশা হ’তে মুক্তি দাও, তোমারও মুক্তি হবে। ভাবলুম মোক্ষের মার্গ কি বিচিত্র। অন্য লোকে মুক্তি পাবে তাই এই গরিব কাগ-ওলা বেচারা নিজের পরকাল নষ্ট করছে। একেই বলে conservation of virtue, একজন পাপ না করলে আর একজনের পুণ্য হবার জো নাই।

 এই সময় একটি হ্যাটকোটধারী বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে ঘরে আসিয়া পাখার রেগুলেটার শেষ পর্যন্ত ঠেলিয়া দিয়া হ্যাটটি আছড়াইয়া ফেলিয়া ফরাশের উপর থপ করিয়া বসিয়া পড়িল। এর নাম সত্যব্রত, সম্প্রতি লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়া কাজকর্মের চেষ্টা দেখিতেছে। সত্যব্রত হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিল— ‘ওঃ, কি মুশকিলেই পড়া গেছে!'

 সত্য প্রায়ই মুশকিলে পড়িয়া থাকে, সেজন্য তার কথায় কেহ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করিল না। অগত্যা সে আপন মনে বলিতে লাগিল— ‘সমস্ত দিন আপিসের হাড়ভাঙা খাটুনি, বিকেলে যে একটু ফুর্তি করব তারও জো নেই। ভাবলুম আজ ম্যাটিনিতে সীতা দেখে আসি। অমনি পিসিমা ব’লে বসলেন— সতে, তুই ব’কে যাচ্ছিস, আমার সঙ্গে চল্, সাণ্ডেলমশায়ের বক্তৃতা শুনবি। কি করি, যেতে হ’ল। কিন্তু সব মিথ্যে। সাণ্ডেলমশায় বলছেন ধর্মজীবনের মধুরতা, আব আমি ভাবছি আরসোলা।'

 নিতাই। আরসোলা?

 সত্য। তিন টন আরসোলা। ফরওআর্ড কনট্রাক্ট আছে, নভেম্বর-ডিসেম্বর শিপমেণ্ট, চল্লিশ পাউণ্ড পনর শিলিং টন, সি-আই-এফ হংকং। চায়নায় লড়াই বাধবে কিনা, তাই আগে থাকতে রসদ সংগ্রহ করছে। বড়-সায়েবের হুকুম— এক মাসের মধ্যে সমস্ত মাল পিপে-বন্দী হওয়া চাই। কোত্থেকে পাই বলুন তো? ওঃ, কি বিপদ!

 নিতাই। হ্যাঁরে সতে, তুই না বেস্মজ্ঞানী, তোদের না মিথ্যে কথা বলতে নেই?

 সত্য। কেন বলতে নেই। পিসিমার কাছে না বললেই হ’ল।

 নিবারণ। সতে, তোর সন্ধানে ভাল বাবাজী কি স্বামিজী আছে?

 সত্য। ক-টা চাই?

 নিতাই। যা যাঃ, ইয়াবকি করিস নি। মন্ত্রতন্ত্রই মানিস না তা আবার বাবাজী।

 সত্য। কেন মানব না। পিসিমার দাঁত কনকন করছিল, খেতে পারেন না, ঘুমুতে পারেন না, কথা কইতে পারেন না, কেবল পিসেমশায়কে ধমক দেন। বাড়িসুদ্ধ লোক ভয়ে অস্থির। পিপারমিণ্ট, আস্পিরিন, মাদুলি, জলপড়া, দাঁতের পোকা বার কো-ও-রি, কিছুতে কিছু হয় না। তখন পিসেমশায় এসা জোর প্রার্থনা আরম্ভ করলেন যে তিন দিনের দিন দাঁত পড়ে গেল।

 পরমার্থ চটিয়া উঠিয়া বলিল— ‘দেখ সত্য, তুমি যা বোঝ, না তা নিয়ে ফাজলামি ক’রো না। প্রার্থনাও যা মন্ত্রসাধনাও তা। মন্ত্রসাধনায় প্রচণ্ড এনার্জি উৎপন্ন হয় তা মান?’

 সত্য। আলবৎ মানি। তার সাক্ষী রাজশাহির তড়িতানন্দ ঠাকুর, কলেজের ছেলেরা যাকে বলে রেডিও বাবা। বাবার দুই টিকি, একটি পজিটিভ, একটি নেগেটিভ। আকাশ থেকে ইলেকট্রিসিটি শুষে নেন। স্পার্ক ঝাড়েন এক-একটি আঠারো ইঞ্চি লম্বা। কাছে এগোয় কার সাধ্য,— সিল্কের চাদর মুড়ি দিয়ে দেখা করতে হয়।

 নিবারণ। নাঃ, মিরচাই বেদান্ত ইলেকট্রিসিটি এর একটাও নিতাই-দার ধাতে সইবে না। যদি কোনও নিরীহ বাবাজী সন্ধানে থাকে তো বল। কিন্তু কেরামতি চাই, শুধু ভক্তিতত্ত্বে চলবে না। কি বলেন নিতাইদা?

 পরমার্থ। তবে দমদমায় গুরুপদবাবুর বাগানে চল বিরিঞ্চিবাবার কাছে।

 নিবারণ। আলিপুরের উকিল গুরুপদবাবু? আমাদের প্রফেসার ননির শ্বশুর? তিনি আবার বাবাজী জোটালেন কোথা থেকে? সত্য তুই জানিস কিছু?

 সত্য। ননিদার কাছে শুনেছিলুম বটে গুরুপদবাবু সম্প্রতি একটি গুরুর পাল্লায় পড়েছেন। স্ত্রী মারা গিয়ে অবধি ভদ্রলোক একবারে বদলে গেছেন। আগে তো কিছুই মানতেন না।

 নিবারণ। গুরুপদবাবুর আর একটি আইবড় মেয়ে আছে না?

 সত্য। বুঁচকী, ননিদার শালী।

 নিবারণ। তারপব পরমার্থ, বাবাজীটি কেমন?

 পরমার্থ। আশ্চর্য। কেউ বলে তাঁর বয়স পাঁচ-শ বৎসর, কেউ বলে পাঁচ হাজার, অথচ দেখতে এই নিতাই-দার বয়সী বোধ হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে একটু হেসে বলেন - বয়স ব’লে কোনও বস্তুই নেই। সমস্ত কাল - একই কাল; সমস্ত স্থান - একই স্থান। যিনি সিদ্ধ তিনি ত্রিকাল ত্রিলোক একসঙ্গেই ভোগ করেন। এই ধর এখন সেপ্টেম্বর ১৯২৫, তুমি হাবশীবাগানে আছ। বিরিঞ্চিবাবা ইচ্ছে করলে এখনই তোমাকে আকবরের টাইমে আগ্রাতে অথবা ফোর্থ সেঞ্চুরি বি. সি. তে পাটলিপুত্র নগরে এনে ফেলতে পারেন সমস্তই আপেক্ষিক কি না।

 নিবারণ। আইনস্টাইনের পসার একবারে মাটি?

 পরমার্থ। আরে আইনষ্টাইন শিখলে কোত্থেকে? শুনেছি বিরিঞ্চিবাবা যখন চেকোসেভিাকিয়ায় তপস্যা করতেন তখন আইনস্টাইন তাঁর কাছে গতায়াত করত। তবে তর বিদ্যে রিলেটিভিটির বেশী এগোয় নি।

 নিতাইবাবু উদ্গ্রীব হইয়া সমস্ত শুনিতেছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘আচ্ছা, আইনস্টাইনের থিওরিটা কি বল তো?

 পরমার্থ। কি জানেন, স্থান কাল আর পাত্র এরা পরস্পরের ওপর নির্ভর করে। যদি স্থান কিংবা কাল বদলায়, তবে পাত্রও বদলাবে।

 সত্য। ও হ’ল না, আমি সহজ ক'রে বলছি শুনুন। ধরুন আপনি একজন ভারি লোক, ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনে গেছেন, তখন আপনার ওজন ২ মন ৩০ সের। সেখান থেকে গেলেন গেঁড়াতলা কংগ্রেস কমিটিতে - সেখানে ওজন হ’ল মাত্র ৫ ছটাক, ফুঁয়ে উড়ে গেলেন।

 নিবারণ। ঠিক। জনাদন ঠাকুর পটলডাঙ্গায় কেনে আড়াই সের আলু, আর মেসে এলেই হয়ে যায় ন-পো।

 নিতাই। আচ্ছা পরমার্থ, বিরিঞ্চিবাবা নিজে তো ত্রিকালসিদ্ধ পুরুষ। ভক্তদের কোনও সুবিধে ক'রে দেন কি?

 পরমার্থ। তেমন তেমন ভক্ত হ'লে করেন বই কি। এই সেদিন মেকিরাম আগরওয়ালার বরাত ফিরিয়ে দিলেন। তিন দিনের জন্যে তাকে নাইণ্টিন ফোর্টিনে নিয়ে গেলেন, ঠিক লড়ায়ের আগে। মেকিরাম পাঁচ হাজার টন লোহার কড়ি কিনে ফেললে—ছ টাকা হন্দর। তার পরেই তাকে এক মাস নাইণ্টিন নাইণ্টিনে রাখলেন। মেকিরাম বেচে দিলে একুশ টাকা দরে। তখন আবার তাকে হাল আমলে ফিরিয়ে আনলেন। মেকিরাম এখন পনর লাখ টাকার মালিক। না বিশ্বাস হয়, অঙ্ক ক’ষে দেখ।

 নিতাইবাবু পরমার্থের দুই হাত ধরিয়া গদ্‌গদস্বরে বলিলেন - ‘পরমার্থ ভাই রে, আমায় এক্ষুনি নিয়ে চলু বিরিঞ্চিবাবার কাছে। বাবার পায়ে ধ'রে হত্যা দেব। খরচা যা লাগে সব দেব, ঘটি-বাটি বিক্রি ক’রব, গিন্নির হাতে পায়ে ধ'রে সেই দশ ভরির গোটছড়াটা বন্ধক দেব। বাবার দয়ায় যদি হপ্তাখানেক নাইণ্টিন ফোর্টিনে ঘুরে আসতে পারি, তবে তোমায় ভুলব না পরমার্থ। টেন পারসেণ্ট - বুঝলে? হা ভগবান, হায় রে লোহা!

 নিবারণ। গুরুপদবাবু কিছু গুছিয়ে নিতে পারলেন?

 পরমার্থ। তাঁর ইহকালের কোনও চিন্তাই নেই। শুনেছি বিষয় সম্পত্তি সমস্তই গুরুকে দেবেন।

 নিবারণ। এতদূর গড়িয়েছে? হ্যাঁরে সত্য, তোর ননিদা, তোর বউদি, এঁরা কিছু বলছেন না?

 সত্য। ননিদাকে তো জানই, ন্যালা-খ্যাপা লোক, নিজের এক্সপেরিমেণ্ট নিয়েই আছেন। আর বউদি নিতান্ত ভালমানুষ। ওঁদের দ্বারা কিছু হবে না। কিছু করতে হয় তো তুমি আর আমি। কিন্তু দেরি নয়। হবে।

 নিবারণ। তবে এক্ষুনি ননির কাছে চল্। ব্যাপারটা ভাল ক'রে জেনে নিয়ে তার পর দমদমায় যাওয়া যাবে।

 নিতাইবাবু কাগজ পেনসিল লইয়া লোহার হিসাব কষিতেছিলেন। দমদমা যাওয়ার কথা শুনিয়া বলিলেন‘তোমরাও বাবার কাছে যাবে নাকি? সেটা কি ভাল এত লোক গিয়ে আবদার করলে বাবা ভড়কে যেতে পারেন। সত্যটা একে বেম্ম তায় বিশ্ববকাট, ওর গিয়ে লাভ নেই। কেন বাপু, তোদের অমন খাসা ব্রাহ্মসমাজ রয়েছে, সেখানে গিয়ে হত্যে দে না, আমাদের ঠাকুরদেবতার ওপর নজর দিস কেন? আমি বলি কি, আগে আমি আর পরমার্থ যাই। তারপর আর একদিন না হয় নিবারণ যেয়ো।'

 নিবারণ। না না, আপনার কোনও ভয় নেই, আমরা মোটেই আবদার করব না, শুধু একটু শাস্ত্রালাপ করব। সুবিধে হয় তো কাল বিকেলেই সব একসঙ্গে যাওয়া যাবে।

প্রফেসার ননি কোনও কালে প্রফেসারি করে নাই, কিন্তু অনেকগুলি পাস করিয়াছে। সে বাড়িতে নানা প্রকার বৈজ্ঞানিক গবেষণা করিয়া থাকে, সেজন্য বন্ধুবর্গ তাকে প্রফেসার আখ্যা দিয়াছে। রোজগারের চিন্তা নাই, কারণ পৈতৃক সম্পত্তি কিছু আছে। ননি গুরুপদবাবুর জামাতা, সত্যব্রতের দূরসম্পর্কীয় ভ্রাতা এবং নিবারণের ক্লাসফ্রেণ্ড।

 নিবারণ ও সত্যব্রত যখন ননির বাড়িতে পৌছিল তখন রাত্রি আটটা। বাহিরের ঘরে কেহ নাই, চাকর বলিল বাবু এবং বহুমা ভিতরের উঠানে আছেন। নিবারণ ও সত্য অন্দরে গিয়া দেখিল উঠানের এক পাশে একটি উনানের উপর প্রকাণ্ড ডেকচিতে সবুজ রঙের কোনও পদার্থ সিদ্ধ হইতেছে, ননির স্ত্রী নিরুপমা তাহা কাঠি দিয়া ঘাঁটিতেছে। পাশের বারান্দায় একটা হারমোনিয়ম আছে, তাহা হইতে একটা রবারের নল আসিয়া ডেকচির ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে। প্রফেসার ননি মালকোঁচা মারিয়া কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

 নিবারণ বলিল— ‘একি বউদি, এত শাগের ঘণ্ট কার জন্যে রাঁধছেন?'


 নিরুপমা বলিল—‘শাক নয়, ঘাস সেদ্ধ হচ্ছে। ওঁর কত রকম খেয়াল হয় জানেন তো।’

 নিবারণ। সেদ্ধ হচ্ছে? কেন, ননির বুঝি কাঁচা ঘাস আর হজম হয় না?

 ননি বলিল—“নিবারণ, ইয়ারকি নয়। পৃথিবীতে আর অন্নাভাব থাকবে না।

 নিবারণ। কলেই তো প্রফেসার ননি বা রোমন্থক জীব নয় যে ঘাস খেয়ে বাঁচবে।

 ননি। আরে ও কি আর ঘাস থাকবে? প্রোটীন সিন্থেসিস হচ্ছে। ঘাস হাইড্রোলাইজ হয়ে কার্বোহাইড্রেট হবে। তাতে দুটো অ্যামিনো-গ্রুপ জুড়ে দিলেই বস। হেক্সা-হাইড্রক্সি-ডাই-অ্যামিনো—

 নিবারণ। থাক, থাক। হারমোনিয়মটা কি জন্যে?

 ননি। বুঝলে না? অক্সিডাইজ করবার জন্যে। নিরু, হারমোনিয়মটা বাজাও তো।

 নিরুপমা হারমোনিয়মের পেডাল চালাইল। শুর বাহির হইল না, রবারের নল দিয়া হাওয়া আসিয়া ডেকচির ভিতর বগবগ করিতে লাগিল।

 নিবারণ। শুধুই ভুড়ভুড়ি! আমি ভাবলুম বুঝি সংগীতরস রবারের নল ব'য়ে ঘাসের সঙ্গে মিশে সবুজ- অমৃতের চ্যাঙড় সৃষ্টি করিবে। যাক—বউদি, বাবার খবর কি বলুন তো।

 নিরুপমা ম্লানমুখে বলিল—‘শোনেন নি কিছু? মা যাওয়ার পরু থেকেই কেমন এক রকম হয়ে গেছেন গণেশমামা কোথা থেকে এক গুরু জুটিয়ে দিলেন, তাঁকে নিয়েই একেবারে তন্ময়। বাহ্যজ্ঞান নেই বললেই হয়, কেবল, গুরু গুরু গুরু। অনেক কান্নাকাটি করেছি কোনও ফল হয় নি। শুনছি টাকাকড়ি সবই গুরুকে দেবেন। বুচকীটার জন্যেই ভাবনা। তার কাছেই গিয়ে থাকতুম, কিন্তু শাশুড়ীর অসুখ, এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারছি না।’

 সত্য বলিল—‘আচ্ছ। ননি-দা, তুমি তো বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলতে পার?’

 ননি। তা কখনও পারি? শ্বশুরমশায় ভাববেন ব্যাটা সম্পত্তির লোভে আমার ধর্মকর্মের ব্যাঘাত করতে এসেছে।

 সত্য। তবে হুকুম দাও, প্রহারেণ ধনঞ্জয় ক'রে দিই।

 নিরুপমা। না না, জুলুম যদি কর তবে সেটা বাবার ওপরেই পড়বে। বাবাকে কষ্ট না দিয়ে যদি কিছু করতে পার তো দেখ।

 সত্য। বড় শক্ত কথা। আচ্ছা বউদি, বিরিঞ্চিবাবার ব্যাপারটা কি রকম বলুন তো।

 নিরুপমা। ব্যাপার প্রায় মাসখানেক থেকে চলছে। দমদমার বাগানে আছেন, সঙ্গে আছে তাঁর চেলা ছোট-মহারাজ কেবলানন্দ। গণেশমামা খিদমত করছেন। বাবা দিনরাত সেখানেই পড়ে আছেন। রোজ দু-তিন-শ ভক্ত গিয়ে ধরনা দিচ্ছে, বিরিঞ্চিবাবার অদ্ভুত কথাবার্তা শোনবার জন্যে হা ঁক'রে আছে। প্রতি রবিবার রাত্রে হোম হচ্ছে, তা থেকে একএক দিন এক-একটি দেবতাব আবির্ভাব হচ্ছে কোনও দিন বামচন্দ্র, কোনও দিন ব্রহ্মা, কোনও দিন যিশু, কোনও দিন শ্রীচৈতন্য। যাকে-তাকে হোমঘরে ঢুকতে দেওয়া হয় না, যারা খুব বেশী ভক্ত তারাই যেতে পায়। ব্রহ্মা বেরনোর দিন আমি ছিলুম।

 সত্য। কি রকম দেখলেন?

 নিরুপমা। আমি কি ছাই ভাল ক’বে দেখেছি? অন্ধকার ঘরে হোমকুণ্ডুর পিছনে আবছায়ার মত প্রকাণ্ড মূর্তি, চারটে মুণ্ডু, লম্বা লম্বা দাড়ি। আমার তো দেখেই দাঁতে দাঁত লেগে ফিট হ'ল। গণেশমামা ঘর থেকে টেনে ধার ক'রে দিলেন। বুচকীর বরং সাহস আছে, প্রায়ই দেখছে কি না। কাল নাকি মহাদেব বার হবেন।

 নিবারণ। কাল একবার আমরা বিরিঞ্চিবাবার চরণ দর্শন ক'রে আসি, যদি তাঁর দয়া হয় তবে কপালে হয়তো মহাদেবদর্শনও হবে।

 নিরুপমা। গণেশমামাকে বশ করুন, তিনি হুকুম না দিলে হোমঘরে ঢুকতে পাবেন না।

 নিবারণ। সে আমি ক'রে নেব। কিন্তু সতে, তোকে নিয়ে যেতে সাহস হয় না, তোর মুখ বড় আলগা, তুই হেসে ফেলবি।

 সত্য তার সমস্ত দেহ নাড়িয়া বলিল—‘কখখনো নয়, তুমি দেখে নিও, হাসে কোন্ শা— ইল্!’

 নিবারণ। ও কি, জিব বার করলি যে?

 সত্য। বেগ ইওর পার্ডন বউদি, খুব সামলে, নিয়েছি। পিসীমার কাছে ব'লে ফেললে রক্ষে থাকত না।

 নিবারণ। আজ আমরা চলি। হ্যাঁ, ভাল কথা। ননি, এমন কিছু বলতে পার যাতে খুব ধোঁয়া হয়?

 ননি। কি রকম ধোঁয়া? যদি লাল ধোঁয়া চাও তবে নাইট্রিক অ্যাসিড অ্যাণ্ড তামা, যদি বেগনী চাও তবে আয়োডিন ভেপার, যদি সবুজ চাও—

 নিবারণ। আরে না না। প্লেন ধোঁয়া চাই।

 ননি। তা হ'লে ট্রাই-নাইট্রো-ডাই-মিথাইল—

 নিবারণ কান চাপিয়া বলিল—‘আবার আরম্ভ করলে রে! বউদি, এটাকে নিয়ে আপনার চলে কি ক’রে?’

 নিরুপমা হাসিয়া বলিল—'মামার বাড়িতে দেখেছি গোয়ালঘরে ভিজে খড় জ্বালে, খুব ধোঁয়া হয়।’

 নিবারণ। ইউরেকা! বউদি, আপনিই নোবেল প্রাইজ পাবেন, ননেটার কিছু হবে না।

 নিরুপমা। ধোঁয়া দিয়ে করবেন কি?

 নিবারণ। ছুঁচোর উপদ্রব হয়েছে, দেখি তাড়াতে পারি কি না।


গুরুপদবাবুর দমদমার বাগানবাড়ি পূর্বে বেশ সুসজ্জিত ছিল, কিন্তু তাঁর পত্নী গত হওয়া অবধি হতশ্রী হইয়াছে। সম্প্রতি বিরিঞ্চিবাবার অধিষ্ঠানহেতু বাড়িটি মেরামত করানো হইয়াছে এবং জঙ্গলও কিছু কিছু সাফ হইয়াছে, কিন্তু পূর্বের গৌরব, ফিরিয়া আসে নাই। গুরুপদবাবু সংসারের কোনও খবর রাখেন না, তাঁর শ্যালক গণেশই এখন সপরিবারে আধিপত্য করিতেছেন।

 বৈকালে পাঁচটার সময় নিবারণ, সত্যব্রত, পরমার্থ এবং নিতাইবাবু আসিয়া পৌঁছিলেন। বাড়ির নীচে একটি বড় ঘরে শতরঞ্জ বিছাইয়া ভক্তবৃন্দের বসিবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। তার একপাশে একটি তক্তাপোশে গদি এবং বাঘের ছাপ-মারা রগের উপর বিরিঞ্চিবাবার আসন। পাশের ঘরে ভক্ত মহিলাগণের স্থান। বাবাজী এখনও তাঁর সাধনকক্ষ হইতে নামেন নাই। দল উদ্‌গ্রীব হইয়া বসিয়া আছে এবং মৃদুস্বরে বাবার মহিমা গুঞ্জন করিতেছে। একটি সাহেবী পোশাক পরা প্রৌঢ় ব্যক্তি অশেষ কষ্ট স্বীকার করিয়া পা মুড়িয়া বসিয়া আছেন এবং অধীর হইয়া মাঝে মাঝে তাঁর কামানো গোঁফে পাক দিতেছেন। ইনি মিস্টার ও. কে. সেন, বার-অ্যাট-ল। সম্প্রতি কয়লার খনিতে অনেক টাকা লোকসান দিয়া ধর্মকর্মে মন দিয়াছেন।

 পরমার্থ ও নিতাইবাবুকে ঘরে বসাইয়া নিবারণ ও সত্যব্রত বাহিরে আসিল এবং বাগানের চারিদিক প্রদক্ষিণ করিয়া ফটকের কাছে উপস্থিত হইল। ফটকের পাশেই এক সারি টালি-ছাওয়া ঘর, তাতে আস্তাবল এবং কোচমান, দরোয়ান, মালী ইত্যাদি থাকিবার স্থান।

 আস্তাবলের সম্মুখে মৌলবী বছিরুদ্দি একটি ভাঙা বেঞ্চে বসিয়া কোচমান ঝোঁটি মিয়া এবং দরোয়ান ফেকু পাঁড়ের সঙ্গে গল্প করিতেছেন। মৌলবী সাহেবের নিবাস ফরিদপুর, ইনি গুরুপদবাবুর অন্যতম মুহুরী। গুরুপদবাবু ওকালতি ত্যাগ করায় বছিরুদ্দির উপার্জন কমিয়া গিয়াছে, কিন্তু এখনও তিনি নিয়মিত মাসহারা পাইয়া থাকেন, সেজন্য প্রায়ই মনিবকে সেলাম করিতে আসেন।

 মৌলবী সাহেব ফবিদপুরী উর্দুতে দুনিয়ার বর্তমান দুরবস্থা বিবৃত করিতেছিলেন, কোচমান ও দরোয়ান মাথা নাড়িয়া সায় দিতেছিল। অদূরে সহিস ঘোড়ার অঙ্গ ডলিতেছে এবং মাঝে মাঝে চঞ্চল ঘোড়ার পেটে সশব্দে থাবড়া মারিয়া বলিতেছে—‘আবে ঠহব যা উল্লু। সামনের মাঠে একটি স্থূলকায় বিড়াল মুখভঙ্গী করিয়া ঘাস খাইতেছে~-প্রত্যহ বিরিঞ্চিবাবার ভুক্তাবশিষ্ট মাছের মুড়া খাইয়া তার গরহজম হইয়াছে।

 সত্যব্রত বলিল——'আদাব মৌলবী সাহেব, মেজাজ তো দিব্যি শরিফ? পরনাম পাঁড়েজী। কোচমানজী আচ্ছা হ্যায় তো? এঁকে চেন না বুঝি? ইনি নিবারণ, বাবু, জামাইবাবুর দোস্ত। পূজোর জন্যে কিছু ভেট এনেছেন কিছু মনে করবেন না মৌধুরী সাহেব— আপনার দশ টাকা, পাঁড়েজী আর কোচমানজীর পাঁচ-পাঁচ, সহিস মালী এদের আরও পাঁচ।

 সৌজন্যে অভিভূত হইয়া বছিরুদ্দি, ফেকু এবং ঝোটি দত্তবিকাশ করিয়। বার বার সেলাম করিল এবং খোদা ও কালীমায়ীর নিকট বাবুজীদের তরক্কি প্রার্থনা করিল।

 মৌলবী বলিলেন—‘আর বাবু-মশয়, সে সব দিন-খ্যান কমনে চলে গেছে। মা-ঠাকরোন বেহস্ত পাওয়া ইস্তক মোদের বাবুসায়েবের জানডা কলেজায় নেই। অত ক’রে বললাম, হুজুর অমন পসারডা নষ্ট করবেন না। তা কে শোনে?—খোদার মর্জি।’

 নিবারণ বলিল—‘ও বাবাজীটাই যত নষ্টের গোড়া।’

 ফেকু পাঁড়ে ভরসা পাইয়া মত প্রকাশ করিল- বিরিঞ্চিবাবা বাবাজী থোড়াই আছেন। তাঁর জনৌ ভি নাই, জটা ভি নাই। তিনি মছরি খান, বকড়ির গোস্ত ভি খান। দোনো সাঁঝ চা-বিস্কুট না হইলে তাঁর চলে না। এ সব বংগালী বাবাজী বিলকুল জুয়াচোর। আর ছোটা মহারাজ যিনি আছেন তিনি তো একটি বিচ্ছু, ফেকু পাঁড়েকে পর্যন্ত দংশন করিতে তাঁর সাহস হয়। তিনি জানেন না যে উক্ত ফেকু পাঁড়ে মিউটিনিমে তলোয়ার খেলায়া থা (যদিও ফেকু তখনও জন্মেন নাই)। একবার যদি মনিব হুকুম দেন, তবে লাঠির চোটে বাবাজীদের হড্ডি চুর করিয়া দেওয়া যাইতে পারে।

 মৌলবী জানাইলেন যে তাঁকেও কম অপমান সহ্য করিতে হয় নাই। মামাবাবু (গণেশ) যে তাঁর উপর লম্বাই চওড়াই করিবে তা তিনি বরদাস্ত করিবেন না। তিনি খানদানী মনিষ্যি, তাঁর ধমনীতে মোগলাই রক্ত প্রবাহিত হইতেছে। যদিও লোকে তাকে বছিরুদ্দি বলে, কিন্তু তাঁর আদত নাম ম্রেদম খাঁ। তাঁর পিতার নাম জাঁহাবাজ খাঁ, পিতামহের নাম আবদুল জব্বর, তাঁদের আদি নিবাস ফরিদপুর নয়— আরব দেশে, যাকে বলে, তুর্খ। সেখানে সকলেই লুঙ্গি পরে এবং উর্দু— বলে, কেবল পেটের দায়ে তাঁকে বাংলা শিখিতে হইয়াছে। সেই আরব দেশের মধ্যিখেনে ইস্তাম্বুল, তার বাঁয়ে শহর বোগদাদ। এই কলকাতা শহরডা তার কাছে একেবারেই তুশ্চু। বোগদাদের দখিন-বাগে মক্কা-শরিফ, সেখানকার পবিত্র কুয়ার জল আব-এ-জমজম তাঁর কাছে এক শিশি আছে। মনিব যদি হুকুম দেন তবে সেই জল ছিটাইয়া হালার-পো-হালা ইবলিসের বাচ্চা দুই বাবাজী মায় মামাবাবুকে তিনি হা—ই সাত দরিয়ার পারে জাহান্নমের চৌমাথায় পৌঁছাইয়া দিতে পারেন।

 নিবারণ বলিল—‘দেখুন মৌলবী সাহেব, আমরা বাবাজী দুটোকে তাড়াবই তাড়াব। যদি সুবিধে হয় তো আজই। কিন্তু একলা পেরে উঠব না। আপনি আর দারোয়ানজী সঙ্গে থাকা চাই।’

 ফেকু। মার-পিট হোবে?

 নিবারণ। আরে না না। তোমাদের কোনও ভয় নেই। কেবল একটু চিল্লাচিল্লি করতে হবে। পারবে তো?

 জরুব'। আলবৎ। জান কবুল। কিন্তু মনিব যদি গোসা হন? নিবারণ বুঝাইল, মনিবের চটিবার কোনও কাবণ থাকিবে না। একটু পরে সে আসিয়া যথাকর্তব্য বাতলাইয়া দিবে।

 নিবারণ ও সত্যব্রত বিরিঞ্চিবাবার দরবাব অভিমুখে চলিল। পথে গণেশমামার সঙ্গে দেখা, তিনি ব্যস্ত হইয়া হোমেব আয়োজন কবিতে যাইতেছেন। নিবারণ ও সত্যব্রতকে দেখিয়া বলিলেন— ‘এই যে তোমরাও এসেছ দেখছি, বেশ বেশ। হেঁ-হেঁ, তার পর— বাড়ির সব হেঁ-হেঁ? নিবারণ তোমার বাবা বেশ হেঁ-হেঁ? তোমার মা এখন একটু হেঁ-হেঁ? তোমার ছোট বোনটি হেঁ-হেঁ? সত্য তোমার পিসেমশায় পিসীমা সক্‌কলে—’

 নিবারণের স্বজনবর্গ সকলেই হেঁ-হেঁ। সত্যব্রতেরও তদ্রূপ। সমস্তই গণেশমামার আশীর্বাদের ফল। মামাবাবুর ভাবনায় ঘুম হইতেছিল না, এখন কথঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত হইলেন।

 সত্য বলিল— 'মামা, আপনার ছোট জামাইটির চাকরি হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তবে ছুটির পরেই আমাদের আপিসে একবাব পাঠাবেন, একটা ভেকান্সি আছে।'

 গণেশ। বেঁচে থাক বাবা বেঁচে থাক। তোমরা হ’লে আপনাব লোক, তোমরা চেষ্টা না করলে কি কিছু হয়? আপিস খুললেই সে তোমার সঙ্গে দেখা করবে।

 নিবারণ। মামাবাবু, একটি নিবেদন আছে। দেবদর্শন করিয়ে দিতে হবে।

 গণেশ। তা যাও না বাবার কাছে। সকলেই তো গেছে।

 নিবারণ। ও দেবতা তো দেখবই। আসল দেবতা দেখতে চাই, - হোমঘরে।

 গণেশমাম সভয়ে জিব কাটিয়া বলিলেন—‘বাপ রে, সে কি হয়! কত সাধ্যসাধনা ক’রে তবে অধিকার জন্মায়। আর আমাদের সত্য তো— এই—এই—যাকে বলে-’  নিবারণ। বেস্মজ্ঞানী। কিন্তু ওর ব্রহ্মজ্ঞান এখনও হয় নি। সত্য হচ্ছে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ, হিঁদুয়ানিটা ঠিক বজায় রেখেছে। ও গীতা আওড়ায়, থিয়েটার দেখে, সত্যনারায়ণের শিন্নি, মদনমোহনের খিচুড়িভোগ, কালীঘাটের কালিয়া সমস্ত খায়। আর বলতে নেই, আপনি হলেন নেহাত গুরুজন, নইলে ওর দু-চারটে বোলচাল শুনলে বুঝতেন যে ও বড় বড় হিঁদুর কান কাটতে পারে।

 গণেশ। যাই করুক, জাত গেলে আর ফিরে আসে না। তুমিও তো শুনতে পাই অখাদ্য খাও।

 নিবারণ। সে তো সব্বাই খায়। গুরুপদবাবুও ঢের খেয়েছেন। তা হ’লে দেবদর্শন হবে না? নিতান্তই নিরাশ করবেন? আচ্ছা, তবে চললুম।

 সত্য। প্রণাম মামাবাবু। হ্যাঁ, একটা কথা— আমি বলি কি, আপনার জামাইটি এখন মাস চার-পাঁচ টাইপরাইটিং শিখুক। একবারে আনাড়ী, তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে আমিই সায়েবের কাছে অপদস্থ হব। নেক্স্‌ট ভেকান্সিতে বরং চেষ্টা করা যাবে।

 গণেশ। আরে না না না। চাকরি একবার ফসকে গেলে কি আর সহজে মেলে? না সত্য, লক্ষ্মী বাবা আমার, চাকরিটি ক'রে দিতেই হবে।— হ্যাঁ— কি বলছিলে? তুমি এখন গীতা-টিতা প’ড়ে থাক? খুব ভাল। তা—হোমঘরে গেলে তেমন দোষ হবে না। একটু গঙ্গাজল মাথায় দিয়ে যেয়ো—দুজনেই। আচ্ছা— তা হ’লে জামাইটির কথা ভুলো না।

 গণেশ-মামা তফাতে গেলে নিবারণ বলিল—‘এখন পর্যন্ত তো বেশ আশাজনক বোধ হচ্ছে, শেষ রক্ষা হলেই হয়। অমূল্য, হাবলা এরা সব এসেছে?’

 সত্য। হ্যাঁ, তারা দরবারে রয়েছে। ঠিক সময় হাজির হবে। আচ্ছা নিবারণদা, মামাবাবুর কিছু বখরা আছে নাকি?

 নিবারণ। ভগবান জানেন। তবে গুরুপদবাবু যত দিন সংসারে নির্লিপ্ত থাকেন, মামাবাবুর তত দিনই সুবিধে।


বিরিঞ্চিবাবা সভা অলংকৃত করিয়া বসিয়াছেন। তাঁর চেহারাটি বেশ লম্বা-চওড়া, গৌরবর্ণ মুণ্ডিত মুখ, সুপুষ্ট গালের আড়াল হইতে দুইটি উজ্জ্বল চোখ উঁকি মারিতেছে। দু-পয়সা দামের শিঙাড়ার মত সুবৃহৎ নাক, মৃদু হাস্যমণ্ডিত প্রশস্ত ঠোঁট, তার নীচে খাঁজে খাঁজে চিবুকের স্তর নামিয়াছে। স্বামীগিরির উপযুক্ত মূর্তি। অঙ্গে গৈরিকরঞ্জিত আলখাল্লা, মস্তকে ঐরূপ কান-ঢাকা টুপি। বয়স ঠিক পাঁচ হাজার বলিয়া বোধ হয় না, যেন পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন। বাবার বেদীর নীচে ডান-দিকে ছোট-মহারাজ কেবলানন্দ বিবাজ করিতেছেন। ইঁহার বয়স কয় শতাব্দী তাহা ভক্তগণ এখনও নির্ণয় করেন নাই, তবে দেখিতে বেশ জোয়ান বলিয়াই মনে হয়। ইনিও গুরুর অনুরূপ বেশধারী, তবে কাপড়টা সস্তাদরের। বেদীর নীচে বাঁ-দিকে শীর্ণকায় গুরুপদবাবু বেদীতে মাথা ঠেকাইয়। অর্ধশয়িত অবস্থায় আছেন, জাগ্রত কি নিদ্রিত বুঝিতে পারা যায় না। পাশের ঘরে মহিলাগণের প্রথম শ্রেণীতে একটি সতব-আঠার বছরের মেয়ে লাল শাড়ির উপর এলোচুল মেলিয়া বসিয়া আছে এবং মাঝে মাঝে গুরুপদবাবুর দিকে করুণ নয়নে চাহিতেছে। সে বুঁচকী, গুরুপদবাবুর কনিষ্ঠা কন্যা। ভক্তবৃন্দের অনেকে সটান লম্ব। অবস্থায় উপুড় হইয়া যুক্তকর সম্মুখে প্রসারিত করিয়া পড়িয়া আছেন। অবশিষ্ট সকলে হাতজোড় করিয়া পা ঢাকিয়া বাবার বচনামৃত পানের জন্য উদ্গ্রীব হইয়া বসিয়া আছেন।

 সত্য ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া ভক্তমণ্ডলীর ভিতরে বসিয়া পড়িল। নিবারণ ছোট-মহারাজের বাধা অগ্রাহ্য করিয়া একেবারে বিরিঞ্চিবাবার পা জড়াইয়া ধরিল। বাবা প্রসন্ন হাস্যে বলিলেন———চেনা চেনা বোধ হচ্ছে!'

 নিবারণ। অধমের নাম নিবারণচন্দ্র।

 বিরিঞ্চি। নিবারণ? ও, এখন বুঝি তোমার ওই নাম? কোথা যেন দেখছি তোমায়, নেপালে? উঁহু, মুবশিদাবাদে। তোমার মনে থাকবার কথা নয়। জগৎ-শেঠের কুঠিতে, তার মায়েব শ্রাদ্ধের দিন। অনেক লোক ছিল— রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রায়-রায়ান জানকীপ্রসাদ, নবাবের সিপাহ্-সলার খান-খানান মহৎ জং, সুতোনুটির আমিরচন্দ্-~-হিস্ট্রিতে যাকে বলে উমিচাঁদ। তুমি শেঠজীর খাজাঞ্চী ছিলে, তোমার নাম ছিল—রোস-মোতিরাম। উঃ, শেঠজী খুব খাইয়েছিল, কেবল সুতোনুটির বাবুদের পাতে মণ্ডা কম পড়ে, তারা গালাগাল দিয়ে চলে যায়। তা মোতিরাম, উঁহু—নিবারণচন্দ্র, তুমি ধূর্জটিমন্ত্র জপ করতে শেখ, তাতে তোমার সুবিধে হবে। রোজ ভোরে উঠেই একশ-আট-বার বলবে—ধূর্জটি ধুর্জটি—ধুর্জটি, খুব তাড়াতাড়ি। আচ্ছা, এখন ব’স গিয়ে।

 নিবারণ পুনরায় পায়ের ধুলা লইল এবং তাহা চাটি-বার ভান করিয়া ভক্তদের মধ্যে গিয়া বসিল।

 নিতাইবাবু চুপি চুপি পরমার্থকে বলিলেন—‘ব্যাপার দেখলে? নিবারণটা আসবামাত্র বাবার নজরে প'ড়ে গেল, আর আমি-ব্যাটা দেড় ঘণ্টা হা ঁক'রে ব'সে আছি। একেই বলে বরাত। এইবার একবার উঠে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরব, যা থাকে কপালে।’

 যাঁরা ভূমিসাৎ হইয়া পড়িয়া ছিলেন তাঁদের মধ্যে একটি স্থুলকায় বৃদ্ধ ছিলেন। তাঁর পরিধানে মিহি জরি-পাড় ধুতি, গিলে-করা আদ্ধির পাঞ্জাবি, তার ভিতর দিয়া সরু সোনার হার দেখা যাইতেছে। ইনি বিখ্যাত মুৎসদ্দী গোবর্ধন মল্লিক, সম্প্রতি তৃতীয়পক্ষ ঘরে আনিয়াছেন। গোবর্ধনবাবু আস্তে আস্তে উঠিয়া করজোড়ে নিবেদন করিলেন—'বাবা, প্রবৃত্তিমার্গ আর নিবৃত্তিমার্গ এর কোন্‌টা ভাল?'

 বাবা ঈষৎ হাস্যসহকারে বলিলেন—“ঠিক ঐ কথা তুলসীদাস আমায় জিজ্ঞেস করেছিল। আমরা আহার গ্রহণ করি। কেন করি? ক্ষুধা পায় ব’লে। কি আহার করি? অন্নব্যঞ্জন ফলমূল মৎস্য মাংসাদি। আহার করলে কি হয়? ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়। ক্ষুধা একটা প্রবৃত্তি, আহারে তার নিবৃত্তি। অতএব ভোগের মূলে হচ্ছে প্রবৃত্তি, ভোগের ফল হচ্ছে নিবৃত্তি। তুলসী ছিল সন্ন্যাসী। আমি বললুম-বাপু, ভোগ না হ'লে তো তোমার নিবৃত্তি হবে না। তার রামায়ণ লেখা শেষ হ’লে তাকে রাজা মানসিংহ ক'রে দিলুম। অনেক বিষয়-সম্পত্তি করেছিল, কিন্তু কিছুই রইল না। তার ব্যাটা জগৎসিংহ বাঙালীর মেয়ে বে ক'রে সমস্ত উড়িয়ে দিলে। বঙ্কিম তার বইয়ে সে-কথা আর লেখে নি।'

 ব্যারিস্টার ও. কে. সেন বলিলেন- 'ওআণ্ডারফুল!'

 নিতাইবাবু আর থাকিতে পারিলেন না। ছুটিয়া গিয়া বাবার সম্মুখে গলবস্ত্র হইয়া বলিলেন—“দয়া কর প্রভু!’

 বাবা ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন— “কি চাই তোমাব?'

 নিতাইবাবু থতমত খাইয়া বলিলেন— 'নাইণ্টিন ফোর্টিন।'

 সত্যব্রতের একটা মহৎ রোগ- সে হাসি সমলাইতে পারে না। সে নিজে বেশ গম্ভীর হইয়া পরিহাস করিতে পারে, কিন্তু অপরের মুখে অদ্ভুত কথা শুনিলে তার গাম্ভীর্যরক্ষা কঠিন হয়। হাস্য দমনের জন্য সত্য একটি মুষ্টিযোগ ব্যবহার করিয়া থাকে। গুরুজনের সমক্ষে হাসির কারণ উপস্থিত হইলে সে কোনও ভয়াবহ অবস্থার কল্পনা করে। তবে সব সময় তাতে উপকার হয় না।

 বিরিঞ্চিবাব বলিলেন—'নাইণ্টিন ফোর্টিন? সে কি?’

 নিবারণ চুপি চুপি বলিল— 'ওআন-নাইন-ওআন- ফোর, ক্যালকাটা। নো রিপ্লাই? ট্রাই এগেন মিস।'

 সত্যব্রত ধ্যান করিতে লাগিল-ছুতার মিস্ত্রী তার পিঠের উপর রাঁদা চালাইতেছে। চোকলা চোকলা চামড়া উঠিয়া যাইতেছে। ওঃ সে কি অসহ্য যন্ত্রণা!

 নিতাইবাবু বলিলেন— 'সাতটি দিনের জন্যে আমায় লড়ায়ের আগে নিয়ে যান বাবা, সস্তায় লোহা কিনব—দোহাই বাবা!’

 বিরিঞ্চি। তোমার কি করা হয়?

 নিতাই। আজ্ঞে ভলচার ব্রাদার্সের আপিসে লেজার-কিপার, কুল্লে দেড়-শ টাকা মাইনে, সংসার চলে না।

 বিরিঞ্চি। ষড়ৈশ্বর্য সস্তায় হয় না বাপু, কঠোর সাধনা চাই। মূলাধারচক্রে ঠেলা দিয়ে কুলকুণ্ডলিনীকে আজ্ঞাচক্রে আনতে হবে, তার পর তাকে সহস্রার পদ্মে তুলতে হবে। সহস্রারই হচ্ছেন সূর্য। এই সূর্যকে পিছু হাঁটাতে হবে। সূর্যবিজ্ঞান আয়ত্ত না হ'লে কালস্তম্ভ করা যায় না। তাতে বিস্তর খরচতোমার কম্ম নয়। তুমি আপাতত কিছুদিন মার্তণ্ড মন্ত্র জপ কর। ঠিক দুপপুর বেলা সূর্যের দিকে চেয়ে একশ-আটবার বলবে—মার্তণ্ড-মার্তণ্ড-মার্তণ্ড-খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু খবরদার, চোখের পাতা না পড়ে, জিব জড়িয়ে না যায়, —তা হ’লেই মরবে।

 নিতাইবাবু বিবস বদনে ফিরিয়া আসিলেন।

 বিবিঞ্চিবাবা বলিলেন— 'ধন-দৌলত সকলেই চায়, কিন্তু উপযুক্ত পাত্রে পড়া চাই। এই নিয়েই তো যিশুর সঙ্গে আমার ঝগড়া। যিশু বলত, ধনীর কখনও স্বর্গরাজ্য লাভ হবে না। আমি বলতুম—তা অর্থের সদব্যবহার করলেই হবে। আহা বেচারা বেঘোরে প্রাণটা খোয়ালে।'

 মিষ্টার সেন সবিস্ময়ে বলিলেন—'এক্সকিউজ মি প্রভু, আপনি কি জিসস ক্রাইস্টকে জানতেন??

 বিরিঞ্চি। হাঃ হাঃ, যিশু তো সেদিনকার ছেলে।

 মিষ্টার সেন। মাই ঘড!

 সত্যের কানের ভিতর গঙ্গাফড়িং, নাকের ভিতর গুবরে পোকা—কুরিয়া কুরিয়া খাইতেছে।


 মিষ্টার সেন নিবারণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“ইনি তা হ’লে গৌটামা বুড্‌ঢাকেও জানতেন?’

 নিবারণ। নিশ্চয়। গৌতম বুদ্ধ কোন্ ছার, প্রভু মনু-পবাশরের সঙ্গে এক ছিলিমে গাঁজা খেতেন। সবার সঙ্গে ওঁর আলাপ ছিল। ভগীরথ, টুটেন খামেন, নেবু-চাড-নাজাব, হাম্মুরাব্বি, নিওলিথিক ম্যান, পিথেকানথ্রোপস ইরেক্টস, মায় মিসিং লিংক।

 মিষ্টার সেন চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন- “মাঃই।”

 সাতটা বাঘ সত্যর পিছনে তাড়া করিয়াছে। সামনে তিনটা ভালুক ধাবা তুলিয়। দাঁড়াইয়া আছে।

 বিরিঞ্চিবাবা কহিলেন——'একবার মহাপ্রলয়ের পর বৈবস্বত আমায় বললে——নীললোহিত কল্পে কি? না, শ্বেতবরাহ কল্প তখন সবে শুরু হয়েছে। বৈবস্বত বললে- মানুষ তো সৃষ্টি করলুম, কিন্তু ব্যাটারা দাঁড়াবে কোথা, খাবে কি?—চারিদিকে জল থই থই করছে। আমি বললুম—ভয় কি বিবু, আমি আছি, সূর্যবিজ্ঞান আমার মুঠোর মধ্যে। সূর্যের তেজ বাড়িয়ে দিলুম, চো ক’রে জল শুকিয়ে গেল, বসুন্ধরা ধনধান্যে ভরে উঠল। চন্দ্র-সূর্য চালাবার ভার আমারই ওপর কিনা।'

 মিষ্টার সেন কেবল মুখব্যাদান করিলেন।

 সত্য মরিয়া গিয়াছে। পঞ্জাব মেলের সঙ্গে দার্জিলিং মেলের কলিশন —রক্তারক্তি —পিসীমা—

 কিছুতেই কিছু হইল না। পুঞ্জীভূত হাসি সত্যব্রতের চোখ নাক মুখ ফাটিয়া বাহির হইবার উপক্রম করিল। সে তখন নিরুপায় হইয়া বিপুল চেষ্টায় হাসিকে কান্নায় পরিবর্তিত করিল এবং দু-হাতে মুখ ঢাকিয়া ভেউ ভেউ করিয়া উঠিল।

 বিরিঞ্চিবাবা বলিলেন— 'কি হয়েছে, কি হয়েছে-আহা, ওকে আসতে দাও আমার কাছে।'

 সত্য নিকটে গিয়া বলিল— ‘উদ্ধার কর বাবা, মানব-জন্মে ঘেন্না ধ'রে গেছে। আমায় হরিণ ক'রে সেই ত্রেতা যুগে কণ্ব মুনির আশ্রমে ছেড়ে দাও বাবা! অর্থ চাই না, মান চাই না, স্বর্গও চাই না। শুধু চাট্‌টি কচি ঘাস, শকুন্তলার নিজের হাতে ছেঁড়া। আব এক জোড়া বড় শিং দিও প্রভু, দুষ্মন্তটাকে যাতে গুঁতিয়ে দিতে পারি।”

 নিবারণ বেগতিক দেখিয়া বলিল—'ছেলেটার মাথা খাবাপ হয়ে গেছে বাবা।বিস্তর শোক পেয়েছে কিনা।'

 ঘড়িতে সাতটা বাজিল। দৈনিক পদ্ধতি অনুসাবে এই সময় বিরিঞ্চিবাবা হঠাৎ তুরীয় অবস্থাপ্রাপ্ত হইলেন। তিনি চক্ষু বুঁজিয়া কাঠ হইয়া বসিয়া রহিলেন, কেবল তাঁর ঠোঁট দুটি ঈষৎ নড়িতে লাগিল। মামাবাবু, চেলা-মহারাজ এবং দুইজন ভক্ত বাবার শ্রীবপু চ্যাংদোলা করিয়া সাধনকক্ষে লইয়া। গেলেন। সভা আজকার মত ভঙ্গ হইল। ভক্তগণ ক্রমশ বিদায় হইতে লাগিলেন।

 নিতাইবাবু বলিলেন—'বিষের সঙ্গে খোঁজ নেই কুলোপান। চক্কর! এ রকম বাবাজী আমার পোষাবে না। ক্ষ্যামতা যদি থাকে তবে দু-চারটে নমুনা দেখা না বাপু। তা নয়, সত্যযুগে কি করেছিলেন তারই ব্যাখ্যান। চল পরমার্থ, সাতটা কুড়ির ট্রেন এখনও পাওয়া যাবে। নিবারণ আর সতেটার খোঁজে দরকার নেই। তারা নিজের নিজের পথ দেখবে। দেখ পরমার্থ, কাল নাহয় মিরচাই-বাবার কাছেই নিয়ে চল।'


ত্যব্রত বুঁচকীকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া বলিল- 'দেখুন, একটু চা খাওয়াতে পারেন? নিবারণ-দাও আসবে এখনই। ওঃ, গলাটা বড্ড চিরে গেছে।'

 বুঁচকী বলিল- ‘চিরবে না?—যা চেঁচাচ্ছিলেন! জল চড়িয়ে দিচ্ছি, বসুন একটু। আচ্ছা, আমার বাবার সামনে কি কাণ্ডটা করলেন বলুন তো? কি ভাববেন তিনি?'

 সত্য মনে মনে বলিল, তোমার বাবা তো বেহুঁশ ছিলেন। প্রকাশ্যে বলিল—‘একটু বাড়াবাড়ি ক’রে ফেলেছি নয়? ভারি অন্যায় হয়ে গেছে, আর কখখনো অমন হবে না! আপনার বাবার কাছে মাপ চেয়ে তাঁকে খুশী ক’রে তবে বাড়ি ফিরব।'

 বুঁচকী। বাবার আবার খুশি-অখুশি। বেঁচে আছেন এই পর্যন্ত, কে কি করছে বলছে তা জানতেও পারছেন না।

 সত্য। থাকবে না, এমন দিন থাকবে না। আপনি দেখে নেবেন।—ওই যে, নিবারণ-দা আসছেন।


রাত ন-টা। হোম আরম্ভ হইয়াছে। ভক্তের দল পূর্বেই বিদায় হইয়াছে। হোমঘরে আছেন কেবল বিরিঞ্চিবাবা, গুরুপদবাবু, ঝুঁচকী, মামাবাবু, নিবারণ, সত্যব্রত এবং গোবর্ধনবাবু। ইনি একজন বিশিষ্ট ভক্ত, বাবার জন্য তেতলা আশ্রম নির্মাণ করিয়া দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। হোমঘরটি ছোট, দরজা-জানালা প্রায় সমস্তই বন্ধ, প্রবেশের পথ মামাবাবু আগলাইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। ছোট মহারাজ, অর্থাৎ কেবলানন্দ, বাবার নৈশ আহার চরু প্রস্তুত করিবার জন্য অন্যত্র ব্যস্ত আছেন। ঘরে একটি মাত্র ঘৃতপ্রদীপ মিটমিট করিতেছে। বিরিঞ্চিবাবা যোগাসনে ধ্যানমগ্ন, সম্মুখে হোমকুণ্ড। পিছনে গুরুপদবাবু ও তাঁর কন্যা উপবিষ্ট। তাঁহাদের এক পাশে নিবাবণ ও সত্যব্রত, অপর পাশে গোবর্ধনবাবু বসিয়া আছেন।

 অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ থাকিয়া বিরিঞ্চিবাবা কোষা হইতে জল লইয়া চতুর্দিকে ছড়াইয়া দিলেন। ঘৃত- প্রদীপ নিবিয়া গেল। হোমাগ্নির শিখা নাই, কেবল কয়েক খণ্ড অঙ্গার আরক্ত হইযা আছে। বিরিঞ্চিবাবা তখন মুখের উপব হাত কাঁপাইয়া ভীষণ গালবাদ্য আবম্ভ করিলেন। সেই গম্ভীব বু-বু-বু-বু নিনাদে ক্ষুদ্র গৃহ কম্পিত হইতে লাগিল।

 সত্যব্রত বুঁচকীব কানে কানে বলিল —‘বুঁচু, ভয় করছে?’ বুঁচকী বলিল ‘না।’

 সহসা হোমকুণ্ড হইতে নীলাভ অগ্নিশিখা নির্গত হইল। সেই ক্ষীণ অস্পষ্ট আলোকে সকলে দেখিলেন মহাদেবই তো বটে!—হোমকুণ্ডের পশ্চাতে ব্যাঘ্রচর্মধারী হাড়মালাবিভূষিত পিনাকডমরুপাণি ধবলকান্তি দম্ভব- মত মহাদেব।

 গুরুপদবাবু নির্বাক নিশ্চল। গোবর্ধন মল্লিক তাঁর কারবার এবং তৃতীয়পক্ষ সংক্রান্ত অভাব-অভিযোগ করুণ স্বরে দেবাদিদেবকে নিবেদন করিতে লাগিলেন।

গণেশমামা শিবস্তোত্র আবৃত্তি করিতে লাগিলেন—যেটি তাঁর ছোট মেয়ে মহাকালী-পাঠশালায় শিখিয়াছে।

 নিবারণ সত্যব্রতকে চুপিচুপি বলিল—‘এইবার।’ সত্যব্রত উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল- ‘বম্ বাবা মহাদেব!'

 একটু পরে হঠাৎ বাহিরে একটা কলরব উঠিল। তারপর চিৎকার করিয়া কে বলিল- 'আগ লাগা হ্যায়।'

 বিরিঞ্চিবাবার গালবাদ্য থামিল। তিনি চঞ্চল হইয়া ইতস্তত চাহিতে লাগিলেন। মামাবাবু ব্যস্ত হইয়া বাহিরে গেলেন।

 ‘আগুন আগুন—বেরিয়ে আসুন শিগগির—।’ ঘন ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া ঘরে ঢুকিতে লাগিল। বিরিঞ্চি-বাবা এক লাফে গৃহত্যাগ করিলেন। গোবর্ধনবাবু চিৎকার করিতে করিতে বাবার পদানুসরণ করিলেন। ঝুঁচকী পিতার হাত ধরিয়া বলিল —‘বাব।, বাবা, ওঠ!’ নিবারণ কহিল— ‘এখন যাবেন না, একটু বসুন, কোনও ভয় নেই।'

 মহাদেবের টনক নড়িল। তিনি উসখুস করিতে লাগিলেন। নিবারণ একটা বাতি জ্বালিল। মহাদেব পিছনের দরজা দিয়া পলায়নের উপক্রম করিলেন—অমনি সত্যব্রত জাপটাইয়া ধরিল।

 মহাদেব বলিলেন—‘আঃ, ছাড়—ছাড়—লাগে, মাইবি এখন ইয়ারকি ভাল লাগে না—চাদ্দিকে আগুন- ছেড়ে দাও বলছি।'

 সত্যব্রত বলিল—‘আরে অত ব্যস্ত কেন। একটু আলাপ পরিচয় হক। তারপর ক্যাবলবাম, কদ্দিন থেকে দেবতাগিরি করা হচ্ছে??

 বাহিব হইতে দু-চারজন লোক হোমঘবে প্রবেশ করিল। ফেকু পাঁড়ের জিম্মায় কেবলানন্দকে দিয়া নিবাবণ ও সত্যব্রত বিস্ময়বিমূঢ় গুরুপদবাবু ও তাঁর কন্যাকে বাহিবে আনিল।

 বাড়িতে আগুন লাগে নাই। পাশের ঘরে খানিকটা ভিজা খড় কে জ্বালাইয়া দিয়াছিল। দারোয়ান, মৌলবী সাহেব, কোচমান এবং অমূল্য হাবলা প্রভৃতি সত্যব্রতের অনুচববৃন্দ মিথ্যা হল্লা করিয়াছে।


বিরিঞ্চিবাবা ভাঙেন কিন্তু মচকান না। বলিলেন- ‘কেমন গুরুপদ, এখন আশা মিটল তো? যে নাস্তিক, তার দিব্যদৃষ্টি হবে কেন? তাই তোমার কপালে

দেবতা দেখা দিয়েও দিলেন না। শেষটায় মানুষের মূর্তি ধ'রে বিদ্রূপ করলেন।'

 সত্যব্রত বলিল—— ‘বিদ্রূপ ব’লে বিদ্রূপ! মহাদেব প’চে গিয়ে বেরুল ক্যাবলা। বিরিঞ্চিবাবা হয়ে গেলেন জোচ্চোব!’

 গোবর্ধনবাবু বলিলেন—'ব্যাটা আমার সঙ্গে চালাকি? গোবর্ধন মল্লিক পাঁচটা হৌসের মুছুদ্দী, বড় বড় ইংরেজ চরিয়ে খায়,— তাকে তুমি ঠকাবে? মাবো শালেকে। দুই থাবড়া।'

 গুরুপদবাবু এতক্ষণে প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। বলিলেন -'না না, যেতে দাও, যেতে দাও। সত্য, গাড়িটা জুতিয়ে এঁদের স্টেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা কব। কেউ যেন কিছু না বলে।'

 তল্পিতল্পা গুছানো হইলে সত্য সশিষ্য বিবিঞ্চি-বাবাকে গাড়িতে তুলিয়া দিল। বিদায়কালে বলিল——‘প্রভু, তা হ’লে নিতান্তই চললেন? চন্দ্র-সূর্য আপনার জিম্মায় রহিল, দেখবেন যেন ঠিক চলে। দম দিতে ভুলবেন না, আর মধ্যে মধ্যে অয়েল করবেন।'

 ভিড় কমিলে গুরুপদবাবু বলিলেন—'বাবা নিবারণ, বাবা সত্য, তোমরা আমায় রক্ষা করেছ, এ উপকার, “যাঃ” বিরিঞ্চিধারা আমি ভুলব না। আজ তোমরা এখানেই খাওয়া-দাওয়া ক'রে থাক, অনেক রাত হয়েছে। একি সত্য, তোমার হাতে রক্ত কেন?'

 সত্য। ও কিছু নয়, ধস্তাধস্তিব সময় মহাদেব একটু কামড়ে দিয়েছিলেন। আপনি ব্যস্ত হবেন না, বিশ্রাম করুন গিয়ে।

 গুরুপদ। তবে তুমি আমার সঙ্গে এসে, বুঁচকী টিংচার আয়োডিন দিয়ে বেঁধে দেবে এখন।   * * *

 আহাবান্তে সত্য বলিল— “ওঃ, কি মুশকিলেই পড়া গেছে।'

 নিবারণ বলিল- 'আবার কি হ’ল রে?'

 সত্য। নিবারণ-দা।

 নিবারণ। বল্ না কি।

 সত্য। নিবারণ-দা!

 নিবারণ। ব’লেই ফ্যাল্ না কি।

 সত্য। আমি বুঁচকীকে বে করব।

 নিবারণ। তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু তোর সঙ্গে বিয়ে যদি না দেয়?

 সত্য। আলবৎ দেবে, বুঁচকীর বাপ দেবে।

 নিবারণ। বাপ না হয় রাজী হ’ল, কিন্তু মেয়ে কি বলে?

 সত্য। বড় গোলমেলে জবাব দিচ্ছে।

 নিবারণ। কি বললে বুঁচকী?

 সত্য। বললে—যাঃ।

 নিবারণ। দূর গাধা, যাঃ মানেই হ্যাঁঃ।